একেকটি ট্রলারে ১২ থেকে ১৬ জন জেলে ও মাঝিমাল্লা থাকেন। প্রতিটি ট্রলারের জেলেরা ৭ থেকে ১০ দিনের জ্বালানি, খাদ্য, পানি, নগদ অর্থসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে পরিবারের মায়া-মমতা ও ভালোবাসা ত্যাগ করে ছোটেন গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারের জন্য। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকায় জেলেরা ছিলেন নিরাপদে। পটুয়াখালীর জেলেরা শুনিয়েছেন তাঁদের সংগ্রামী জীবনের আখ্যান। এ নিয়ে লিখেছেন মুফতী সালাহউদ্দিন

'পরিবার লইয়া ভালা থাহনের লাইগ্যা জীবন বাজি রাইখ্যা গভীর সাগরে ছুটে যাই। বাঁইচ্যা আইতে পারমু, নাহি সাগরেই ডুইব্যা মরমু হেডা ভাবনারও সময় নাই। সাত দিন, দশ দিন পর কহোনও ট্রলার ভর্তি মাছ লইয়া ফির‌্যা আই। আবার কহোনও খালি হাতেও ফির‌্যা আই। এইয়ার মধ্যেই হয়তো দ্যাহা যায় ঝড়ের কবলে পইর‌্যা ট্রলারডুবিতে লগের সঙ্গীডা হারায়ে ফেলি। কষ্ট হইলেও একটু পরই স্বাভাবিক হইয়া আবার মাছ ধরা, জাল পাতা শুরু করি। জীবিকার তাগিদে মোগো মৃত্যুঝুঁকি নিয়া জীবন চলা'- কথাগুলো বলছিলেন পটুয়াখালীর কুয়াকাটা আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের জেলে মো. আবুল হাসেম (৫৫)।

আরেক জেলে মো. এনায়েতুর রহমান বলেন, 'ঝড়ের কবলে পড়ে পাশের বোটটি (ফিশিং ট্রলার) যখন ডুবে যায় তখন মনে হয় আর বাঁচমু না, ফিরর‌্যা যাইতে পারমু না পরিবারের কাছে। দুই-তিন দিন কাটে অনাহারে-অর্ধাহারে। তারপর পাই না ইলিশ, এতে খুব কষ্টে মোগো দিন কাটে। মৃত্যুর ভয় তুচ্ছ করে ইলিশ ধরতে গভীর সাগরে ছুটে চলাই মোগো জীবন।'

জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পটুয়াখালী জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৭৮ হাজার ৬৮০ জন। এর মধ্যে গভীর বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারের জেলে ৪৮ হাজার ৩৯৮ জন এবং এ এলাকায় গভীর সমুদ্রগামী ফিশিং ট্রলার রয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন এজেন্সির (সিডা) আর্থিক সহায়তায় ডেনিশ ইনস্টিটিউশন ফর হিউম্যান রাইটসের (ডিআইএইচআর) তত্ত্বাবধানে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তার সহযোগী সংগঠন বিলস ও কোস্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত উপকূলীয় জেলেদের ওপর একটি গবেষণা প্রকল্প চালায়। চলতি বছরে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, জেলেদের ৭৯ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবার একজন উপার্জনকারীর ওপর নির্ভরশীল। মৎস্য শ্রমিক এ জেলে পরিবারগুলোর প্রায় সবার প্রধান পেশা মৎস্য আহরণ।

কুয়াকাটার হুইচানপাড়ার জেলে আব্দুর রশিদ (৬২) বলেন, '৩৫ বছর ধইর‌্যা এই জেলে পেশায় আছি। যহোন গভীর সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ি তহোন মনে হয় আর বুঝি বউ ও পোলামাইয়াগো ধারে ফির‌্যা যাইতে পারমু না। এই গভীর সাগরেই ডুইব্যা মরমু। হের পরও যাই বউ ও পোলামাইয়াগোরে একটু ভালো খাওয়ানো, ভালো থাহোনের জন্য। মোর ৬ পোলা ও ২ মাইয়া আছে। মোর এক পোলা এইবার রাজশাহী ইনভার্সিটিতে (ইউনিভার্সিটি) ইংরাজি বিভাগে ভর্তি করাইছি। কাউরে এই পেশায় আনি নাই। অগোরে কইছি তোগো এই পেশায় আহোন লাগবো না। মুই যা কামাই করি হেইয়া দিয়াই সবাই মিল্লা খাইতে পারমু। যতদিন বাঁইচ্যা থাকমু এবং সক্ষম থাকমু ততদিন সাগরে মাছ ধরতে যামুই। তাতে বাঁচি আর মরি।'

মা ইলিশ রক্ষায় চলতি মাসের ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিনের জন্য সাগর ও নদনদীতে সব ধরনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। নিষেধাজ্ঞার ১৮তম দিন সোমবার (২৪ অক্টোবর) দেশের উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। কিন্তু সমুদ্রগামী জেলেরা নিষেধাজ্ঞা থাকায় বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে না গিয়ে আগে থেকেই তীরে নিরাপদে অবস্থান করছিলেন। এতে এবার ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন জেলেরা।

এর আগে চলতি বছরের ১৮ ও ১৯ আগস্ট কয়েক দফা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে পটুয়াখালীর ২৭টি ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। এতে ৮টি ট্রলারসহ ১২২ জেলে নিখোঁজ হন। পরবর্তী সময়ে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও মৎস্য আড়ত মালিক সমিতির নেতারা চেষ্টা চালিয়ে ২৭টি ট্রলারের শতাধিক জেলেকে জীবিত উদ্ধার করেন। ডুবে যাওয়া ওই ২৭টি ট্রলারের ৯ জেলে এখনও নিখোঁজ। এর মধ্যে আলীপুর মৎস্য বন্দরের সাতজন এবং মহিপুর মৎস্য বন্দরের দু'জন জেলে নিখোঁজ। তাঁদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী জুটেছে, তা এখনও জানা যায়নি।

স্থানীয় ফিশিং ট্রলার মাঝি সমিতির সাবেক সভাপতি মো. নূরুল ইসলাম নূরু মাঝি বলেন, 'গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করতে গেলে জীবনের ঝুঁকি তো একটু থাকবেই। এসব জেলে ও মাঝিমাল্লাকে নিয়ে প্রশিক্ষণ, সেমিনার, আলোচনা করা হয়। কখনও সমিতির পক্ষ থেকে আবার কখনও এনজিও, সরকার, কোস্টগার্ড এসব করে জেলেদের সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে। '

কুয়াকাটার মহিপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ রাজ বলেন, 'গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা জেলেদের যথাসময়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে সতর্ক করা হয় এবং তাঁরা তা পেয়েও যান। এ জেলেরা অসচেতন নন। আবহাওয়া বার্তা পেয়ে তাঁরা গভীর সমুদ্র থেকে রওনা দেন ঠিক সময়ই। কিন্তু গভীর সমুদ্র থেকে তীরে আসতে অন্তত ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা লাগে। তীরে আসার আগেই ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ফলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সরকারিভাবে উদ্ধারের জন্য কোনো নৌযান না থাকায় আমাদের যা যা আছে তা নিয়ে নিখোঁজ জেলেদের উদ্ধারে নেমে পড়ি। নিখোঁজ ও মৃত্যুবরণকারী জেলে পরিবারদের কিছু সহায়তা দেওয়া হয় মৎস্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে।'

ইলিশ সংরক্ষণের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকার সময়টায় যে সরকারি সহায়তা দেওয়ার কথা, তাও জেলেরা ঠিকমতো পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপভুক্ত মাত্র ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ জেলের কার্ড রয়েছে। অনেকের নাম জেলে হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও জেলে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়নি। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের ৪ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত ২২ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধের সময় মাত্র ৪০ শতাংশ জেলে সরকারি বরাদ্দ পেয়েছেন। গত বছর মে মাসের ২০ তারিখ থেকে জুলাই মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময় ১৯ শতাংশ জেলে কোনো চাল বরাদ্দ পাননি।
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটিতে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে 'জেলে' নির্ধারণের জন্য সংজ্ঞায়িত করা, নির্ভুল জেলে তালিকা প্রণয়ন ও পরিচয়পত্র প্রদান, সরকারি খাদ্য সহায়তা যেন জেলে সঠিকভাবে পান তা নিশ্চিত করা, মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকার সময়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং সহজ শর্তে ও অল্প সুদে জেলেদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা।