
নাসিমুল বাতেন
নাসিমুল বাতেন গৃহঋণের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং (ডিবিএইচ) ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। গৃহঋণ, হাউজিং খাত এবং ডিবিএইচের কার্যক্রম ও পরিকল্পনা সম্পর্কে কথা বলেছেন সমকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাকির হোসেন
সমকাল : গৃহঋণের সাম্প্রতিক প্রবণতা কেমন? কোন কোন বিষয় সার্বিকভাবে বর্তমান প্রবণতাকে প্রভাবিত করছে?
নাসিমুল বাতেন : বাংলাদেশের মর্টগেজ-জিডিপির অনুপাত মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ, যা পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গৃহঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশের বেসরকারি খাতের ঋণের সাড়ে ৮ শতাংশ ছিল গৃহঋণ, যা আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি। এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত, নগরায়ণের ফলে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে রিয়েল এস্টেট খাতের পরিধি অনেক বেড়েছে। এমনকি উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়েও গৃহ নির্মাণ বেড়েছে এবং গৃহঋণের চাহিদা বেড়েছে। এ ছাড়া ঋণের সুদের ওপর ৯ শতাংশ সীমা আরোপিত হওয়ায় অনেক ব্যাংক এসএমই ও অন্যান্য ঋণ প্রদান থেকে নিরুৎসাহিত হয়ে গৃহঋণে ফোকাস বাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেহেতু সুদের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে ছিল, যা গৃহঋণের প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করেছে।
সমকাল : সুদের হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরোপিত সীমা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আপনাদের ওপর কোনো চাপ তৈরি করেছে? এ বিষয়ে কোনো সুপারিশ রয়েছে?
নাসিমুল বাতেন : সুদের হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরোপিত সীমা অবশ্যই বর্তমান পরিস্থিতিতে চাপ তৈরি করেছে। প্রথমত, ব্যাংকের জন্য ঋণের সুদের ওপর ৯ শতাংশের সীমা থাকায় আমাদের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এর ভেতরে বা কাছাকাছি গৃহঋণ দিতে হচ্ছে, যেহেতু গ্রাহকের জন্য সুদের হার একটি মুখ্য বিষয়। ব্যাংকের জন্য আমানতের সুদহারে সীমা না থাকলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ৭ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের মতো গুটি কয়েক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এই হারে আমানত পেলেও বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য তা পাওয়া বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দুরূহ, যেহেতু মুদ্রাস্ম্ফীতি অনেক বেড়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের মতামত হচ্ছে, যে কোনো 'মার্কেট ইন্টারভেনশন' দীর্ঘমেয়াদে উপযুক্ত নয়। ঋণের সুদহারে সীমা রাখতে হলে তা মুদ্রাস্ম্ফীতির সঙ্গে 'লিংক' করে রাখা যেতে পারে, কিন্তু ডিপোজিট রেটের ওপর ঊর্ধ্বসীমা খুব একটা যুক্তিসংগত নয়। যেমন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য যেহেতু ঋণের সুদহারে ঊর্ধ্বসীমা ১১% আছে, তাদের স্বাধীনতা থাকা উচিত নিজস্ব সক্ষমতা বিবেচনা করে আমানতের হার অফার করে ফান্ড সংগ্রহ করে ব্যবসা পরিচালনা করার।
সমকাল : সার্বিকভাবে হাউজিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনাদের পর্যালোচনা জানতে চাই।
নাসিমুল বাতেন : আমরা যদি খুব সাম্প্রতিক সময়ের কথা বলি, তাহলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো রিয়েল এস্টেটও খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ম্ফীতি, নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ফ্ল্যাট বিক্রি বা নিজস্ব গৃহনির্মাণ কমেছে। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে ঢাকার ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) কারণে নতুনভাবে 'ফ্লোর এরিয়া রেশিও' নিয়ে জটিলতা। নতুন 'ফ্লোর এরিয়া রেশিও' অনুযায়ী ঢাকা শহরের বেশিরভাগ এলাকায় বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণে সমস্যা তৈরি হবে। কিন্তু আমাদের মতো ছোট কিন্তু জনবহুল দেশে 'ভার্টিক্যাল এক্সটেনশন' ছাড়া উপায় নেই। এ রকম নানাবিধ সমস্যায় রিয়েল এস্টেট খাত এখন সমস্যাসংকুল সময় অতিক্রম করছে, যার প্রভাব গৃহঋণের ওপর পড়েছে।
সমকাল : নিম্ন ব্যয়ের বা সাশ্রয়ী হাউজিংয়ের ক্ষেত্রে বেসরকারি আবাসন খাত কতটুকু এগোতে পেরেছে? মূল প্রতিবন্ধকতা কোন জায়গায়?
নাসিমুল বাতেন : অ্যাফোর্ডেবল বা সাশ্রয়ী হাউজিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আবাসন খাতের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। যদিও রিয়েল এস্টেট ডেভেলপাররা মধ্যবিত্ত গ্রাহকদের জন্য ১০০০ থেকে ১২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট তৈরি করছেন, তবুও ঢাকা শহরের বেশিরভাগ জায়গায় অন্তত ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকার নিচে এ ধরনের ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা যদি নিম্ন ব্যয়ের বা সাশ্রয়ী হাউজিংয়ের কথা বলি, তাহলে এ ফ্ল্যাটের দাম ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকায় নামিয়ে আনতে হবে। এটি করতে হলে ফ্ল্যাটের আকার কমিয়ে আনতে হবে, শহরকে সম্প্রসারিত করতে হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে এবং সর্বোপরি বেসরকারি খাতকে প্রণোদনার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে- এ ধরনের প্রজেক্ট নির্মাণের জন্য এবং এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা যদি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের অ্যাফোর্ডেবল বা সাশ্রয়ী হাউজিংয়ে বিশাল প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যার পেছনে আছে সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত। যেমন ডেভেলপারদের সরকার জমি দিয়েছে ছোট আকারের কম দামের ফ্ল্যাট তৈরির জন্য। আবার গ্রাহকের আয় অনুযায়ী 'ক্রেডিট লিংকড সাবসিডি স্কিম' এর মাধ্যমে ৩ থেকে ৬ শতাংশ সুদ ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। তদুপরি যেসব ডেভেলপার সাশ্রয়ী হাউজিং প্রজেক্টের গাইডলাইন অনুযায়ী প্রজেক্ট নির্মাণ করেছে, এই প্রজেক্টের আয়ের ওপর কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাই ২০১১ সালে যেখানে ভারতে মর্টগেজ-জিডিপির অনুপাত ছিল ৪.৫%, তা এখন প্রায় ১০%। আমাদের দেশে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ফ্ল্যাট তৈরির, কিন্তু আমাদের মতো জনবহুল দেশে সরকারের পক্ষে সম্ভব নয় নিম্ন আয়ের সব মানুষের জন্য আবাসন তৈরি করা। সেজন্য এটিই উত্তম হবে যদি তারা সঠিক নীতিমালা গ্রহণ করে, যা দ্বারা বেসরকারি খাত উদ্বুদ্ধ হয়ে নিম্ন ব্যয়ের সাশ্রয়ী আবাসন তৈরিতে এগিয়ে আসবে।
সমকাল : গৃহঋণের ক্ষেত্রে ডিবিএইচ এ বছর কোন ধরনের পরিস্থিতিতে আছে? গত কয়েক বছরের তুলনামূলক চিত্র জানতে চাই।
নাসিমুল বাতেন : করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ২০২২ সালের শুরু ছিল আশাব্যঞ্জক। কিন্তু প্রথম প্রান্তিকের পর মূলত বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রভাবে পৃথিবীর সব দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গৃহঋণের ক্ষেত্রে ঋণ বিতরণ ও ঋণের স্থিতি অনুযায়ী ডিবিএইচের স্থান প্রথম। আমাদের গৃহঋণ বিতরণ হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। ঋণের বর্তমান স্থিতি ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত আমরা ৭৬৫ কোটি টাকা গৃহঋণ দিয়েছি, যা গত বছরের এ সময়ের চেয়ে সামান্য বেশি। ২০১৯ সালে আমাদের গৃহঋণ বিতরণ ছিল ৯৫৮ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে করোনা মহামারিতে নেমে আসে ৬৫৩ কোটিতে। ২০২১ সালে আমরা ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করি। আশা করছি, এই বছর আমরা গত বছরের চেয়ে কিছুটা বেশি গৃহঋণ দিতে পারব। যদিও সার্বিক পরিস্থিতি ভালো থাকলে, তা আরও বেশি হতে পারত।
সমকাল : ডিবিএইচের প্রডাক্ট ও সেবার বিশেষত্ব এবং আপনাদের এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা জানতে চাই।
নাসিমুল বাতেন : এ বছর ডিবিএইচ তার ২৫ বছর পূর্ণ করল। ডিবিএইচ দেশের বেসরকারি খাতের একমাত্র আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা শুধু গৃহঋণ দিয়ে থাকে। আমরা যেহেতু একটি প্রডাক্ট নিয়ে ফোকাসড, তাই আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে অত্যন্ত দ্রুত এবং সহজে গ্রাহকদের ঋণ দিতে পারি। আমরা গত ১৭ বছর ধারাবাহিকভাবে সর্বোচ্চ ক্রেডিট রেটিং 'ট্রিপল এ' অর্জন করেছি, যা আমাদের আমানতকারীসহ গ্রাহকদের আস্থা জুগিয়েছে। আমরা মূলত আমানতের মাধ্যমে ফান্ড সংগ্রহ করে ঋণ দিয়ে থাকি। ব্যাংকের ওপর আমাদের নির্ভরতা নেই বললেই চলে। আমরা গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য বিবেচনা করে ঋণ দিয়ে থাকি। যার ফলে আমাদের খেলাপি ঋণ কখনও ১ শতাংশ অতিক্রম করেনি। গত ২৫ বছরে আমরা যে ১৪ হাজার কোটি টাকার গৃহঋণ দিয়েছি, তার মধ্যে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ মাত্র ৯৭ লাখ টাকা।
আমরা আগে মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসা পরিচালনা করলেও এখন আমরা খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, কুমিল্লা, সিলেটসহ ১৪টি শাখার মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছি। নিকট ভবিষ্যতে আমাদের আরও কিছু শাখা খোলার পরিকল্পনা আছে। আমরা সম্প্রতি সরকারি কর্মচারীদের জন্য সরকারি গৃহঋণ স্কিমের বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছি। আমরা আমাদের গ্রাহকদের বাড়ির পাশাপাশি 'কার লোন' ও 'পার্সোনাল লোন' শুরু করেছি। গ্রাহকদের চাহিদার কথা চিন্তা করে আমরা খুব তাড়াতাড়ি ইসলামিক ফাইন্যান্স উইন্ডো চালু করছি। আমরা সম্প্রতি সাশ্রয়ী গ্রিন হাউজিংয়ে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আইএফসির সঙ্গে সার্ভিস চুক্তি করেছি, যা এ সেক্টরে আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়াবে। এভাবেই আমাদের ২৫ বছরের পথচলার সাফল্যকে ধরে রেখে সামনের দিকে আরও বড় পরিসরে গৃহঋণ ব্যবসা পরিচালনার পরিকল্পনা করছি।
মন্তব্য করুন