আবাসন খাতে সামগ্রিকভাবে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। তবে মোট ঋণে কমেছে এ খাতের অংশ। গত জুন শেষে ব্যাংকগুলোর মোট আবাসন ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। গত বছরের একই মাস শেষে যা ছিল ৭৭ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। এক বছরে বেড়েছে ৭ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ। অথচ জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ছিল আবাসন ঋণ। আগের বছরের একই সময়ে যা ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ ছিল।

বিদ্যমান নিয়মে আবাসন খাতের জন্য ব্যাংক থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা ঋণ নেওয়া যায়। ব্যাংকে এ ক্ষেত্রে ঋণ ও নিজস্ব পুঁজির অনুপাত ৭০:৩০। এর মানে, এক কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট কেনায় ৩০ লাখ টাকা নিজস্ব পুঁজির বিপরীতে ৭০ লাখ টাকা ঋণ দেবে ব্যাংক। অন্যদিকে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ ও পুঁজির কোনো অনুপাত নির্ধারণ করে দেয় না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব প্রতিষ্ঠান নিজেরাই এ অনুপাত ঠিক করে।

ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে একটি ফ্ল্যাট কিনতে যে দাম পড়ে তাতে সঞ্চয় করে কেনা অনেকের পক্ষে কঠিন। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের লোকজনের জন্য অনেকটা অসম্ভব। সুদহারসহ সার্বিক বিবেচনায় অনেক ক্ষেত্রে পরিশোধে হিমশিম খান তাঁরা। পরিবারের খরচ চালিয়ে প্রতি মাসে কিস্তি পরিশোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। যদিও শতভাগ আবাসন ঋণ আদায়ের হার খুব ভালো। এরকম বাস্তবতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে। শুধু আবাসন ঋণের জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং (ডিবিএইচ) ফাইন্যান্স এবং ন্যাশনাল হাউজিংয়ের মতো প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া বেশিরভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আবাসন খাতে বিভিন্ন ঋণপণ্য রয়েছে।

আবাসন খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, সুদের হার কম থাকা, অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়াসহ সরকারের কিছু উদ্যোগের ফল হিসেবে আবাসন খাতে গতি বাড়ছিল। কিন্তু করোনার সময় তা থমকে যায়। করোনা-পরবর্তী সময়ে নির্মাণসামগ্রীর দরবৃদ্ধি এ খাতে বড় সংকটের কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়।

কোন খাতে কত ঋণ: চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা। এক বছর আগে যা ছিল ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভোক্তা ঋণ বেড়েছে বেশি হারে। বেশিরভাগ জিনিসের দর বাড়ার এ সময়ে এ দুটি খাতে ঋণ বেড়েছে। বেড়েছে কৃষিতেও। শিল্পসহ অন্যান্য খাতে অংশ কমেছে।

চলতি বছরের জুন শেষে মোট ঋণের ৩৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ দাঁড়িয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। আগের বছর যা ছিল ৩৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ভোক্তা ঋণ আগের বছরের জুনের ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮ দশমিক শূন্য ১৯ শতাংশে উঠেছে। মোট ঋণে দারিদ্র্য বিমোচন, বেসরকারি কল্যাণমূলক সংস্থাসহ অন্যান্য খাতের অংশ ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। এবার তা শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ হয়েছে। এ ছাড়া কৃষি খাতের অংশ মোট ঋণের ৪ দশমিক ৭২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ হয়েছে।

শিল্প খাতে আগের বছরের জুনের ৪১ দশমিক ৬৮ শতাংশ থেকে কমে চলতি বছরের জুনে ৪১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে নেমেছে। নির্মাণ খাতে ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ থেকে কমে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ হয়েছে। করপোরেশন, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ২ দশমিক ২৬ শতাংশে নেমেছে। আগের বছর যা ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ ছিল। পরিবহনে আগের বছরের জুনের ১ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমেছে।

সাশ্রয়ী আবাসন কতদূর: নিজের একটি বাড়ি বা ফ্ল্যাট বেশিরভাগ মানুষের স্বপ্ন। কিন্তু জমি ও নির্মাণসামগ্রীর দরবৃদ্ধি, যথাযথ পরিকল্পনার অভাব, বড় শহরকেন্দ্রিক আবাসন প্রকল্পসহ নানা কারণে সাশ্রয়ী আবাসনের প্রত্যাশা পূরণে দেশ পিছিয়ে আছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্নপূরণ খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ভারতে সাশ্রয়ী আবাসনের জন্য সরকারের বিশেষ কর্মসূচি রয়েছে। সে দেশে দরপত্র আহ্বান করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ডেভেলপারদের জন্য জমি দেয় সরকার। আয়ের ভিত্তিতে গ্রাহকদের শ্রেণীকরণ করে আবাসন ঋণের সুদে ভর্তুকি দেওয়া হয়ে থাকে। ভর্তুকির অর্থ একবারে পরিশোধ করে তারপর গ্রাহকের জন্য কিস্তি হিসাব করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কর্মসূচি রয়েছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের জন্য সহজ শর্তে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিবেশবান্ধব খাতের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক গঠিত পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচির আওতায় এ ঋণ দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ ৭৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনায় ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। পুনঃঅর্থায়নের আওতায় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক রেটের তুলনায় ১ শতাংশ কম সুদে ঋণ পাবে। বর্তমানে ব্যাংক রেট আছে ৪ শতাংশ। এর মানে চুক্তিবদ্ধ একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৩ শতাংশ সুদে অর্থায়ন পাবে। গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার নির্ধারিত হবে ঋণের মেয়াদের ভিত্তিতে। এ ক্ষেত্রে ঋণের মেয়াদ পাঁচ বছরের কম হলে সর্বোচ্চ সুদহার হবে পাঁচ শতাংশ। পাঁচ থেকে আট বছরের কম মেয়াদি ঋণের সুদহার সাড়ে ৫ শতাংশ। এ ছাড়া আট থেকে ১০ বছর মেয়াদি ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৬ শতাংশ।
আবাসন খাতের কোম্পানিগুলো ঢাকার বাইরেও কিছু প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। পদ্মা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো এর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ করা গেলে ঢাকার বাইরে এবং বিশেষ করে এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় পরিকল্পিত সাশ্রয়ী আবাসনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।