- ফিচার
- লন্ডনের বিষাক্ত বাগান
লন্ডনের বিষাক্ত বাগান
-samakal-6365ec7b986fd.jpg)
বাগান শব্দটা শুনে আমাদের মনে সাধারণত ফুলে-ফলে সুরভিত, গাছগাছালিতে পূর্ণ দৃষ্টিনন্দন এক টুকরো দৃশ্য ভেসে ওঠে। কিন্তু কেমন লাগবে যদি একটি বাগানের সামনে গিয়ে দাঁড়ান আর পরক্ষণেই প্রধান ফটকে দেখতে পান বিপদ সংকেত! ক্রস আকৃতির এক জোড়া হাড়ের ওপর মানুষের খুলির চিহ্ন। এই চিহ্ন ঘিরে ইংরেজি হরফে লেখা সতর্কবাণী, 'দিজ প্লান্টস ক্যান কিল' (বাগানের গাছগুলো আপনাকে মেরে ফেলতে পারে)। সতর্কবাণীটি পড়ে মুহূর্তেই আপনি আতঙ্কিত হতে পারেন। আবার হয়তো ভয়কে ছাপিয়ে মনের কোণে জাগতে পারে কৌতূহল- কী এমন আছে এই কুচকুচে কালো লোহার ফটকের ভেতরের জগৎটায়?
ব্যতিক্রমধর্মী এই বাগানটির নাম 'দ্য পয়জন গার্ডেন'। এর অবস্থান উত্তর ইংল্যান্ডের নর্দাম্বারল্যান্ড কাউন্টিতে। ডিউক অব নর্দাম্বারল্যান্ডের অ্যানউইক ক্যাসল-সংলগ্ন ১৪ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে অ্যানউইক গার্ডেন। ডাচেস অব নর্দাম্বারল্যান্ড জেইন পার্সির পরিকল্পনায় অ্যানউইক গার্ডেনের একাংশ নিয়ে এই পয়জন গার্ডেন গড়ে তোলা হয়েছে।
অ্যানউইক গার্ডেন সবার জন্য উন্মুক্ত হলেও পয়জন গার্ডেনে ঢুকতে হয় গাইডদের সঙ্গে, ঢোকার আগে দর্শনার্থীকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যেন তাঁরা কোনো গাছে স্পর্শ না করেন অথবা ফুলের গন্ধ শোঁকা বা কোনো অংশের স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা না করেন। কারণ বাগানটিতে রয়েছে শতাধিক প্রজাতির বিষাক্ত, নেশা উদ্রেককারী ও চেতনানাশক উদ্ভিদ। এই গাছগুলোর সংস্পর্শে এলে কোনো না কোনোভাবে ক্ষতি অনিবার্য।
কিছু উদ্ভিদের ক্ষেত্রে তো পাশে দাঁড়ালেই আছে মৃত্যুঝুঁকি। এই বাগানে সংরক্ষিত শতাধিক প্রজাতির মধ্যে অন্যতম বিপজ্জনক গাছ হলো মঙ্কসহুড বা উলফস বেইন। এই উদ্ভিদে রয়েছে অ্যাকোনিটিন, মানুষের স্নায়বিক ও হূৎক্রিয়ার জন্য ক্ষতিকর।
২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি, ওয়েস্ট লন্ডনের বাসিন্দা লখভিন্দর কউর সিং নামের এক মহিলা তাঁর সাবেক প্রেমিককে হত্যার জন্য ব্যবহার করেছিলেন এই গাছের বীজ। লন্ডনজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল এই অদ্ভুত হত্যাকাণ্ড। লখভিন্দর তাঁর রান্নার সঙ্গে মঙ্কসহুডের বীজ মিশিয়ে তাঁর সাবেককে খাইয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরেই লখভিন্দর পরিচিতি পান কুখ্যাত 'কারি কিলার' হিসেবে।
পয়জন গার্ডেনের সবচেয়ে বিষাক্ত উদ্ভিদের খ্যাতি সম্ভবত রাইসিনাস কমিউনিসের। ক্যাস্টর বিন বা ক্যাস্টর তেলের জন্য অধিক পরিচিত এই উদ্ভিদ রাইসিন নামক বিষ তৈরি করে। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী রাইসিনাস উদ্ভিদ পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত উদ্ভিদ, যা সাধারণত সব অঞ্চলেই পাওয়া যায়। রাইসিনাস কমিউনিস এতটাই বিষাক্ত যে, এর চারটি বীজ একটি শিশুকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মৃত্যু ঘটাতে আট থেকে দশটি বীজই যথেষ্ট।
কিছু গাছ আছে- মানুষের মৃত্যু ঘটাতে যাদের খেতে, স্পর্শ বা গন্ধ নিতে হয় না। বাগানের 'লরেল' গাছটি সে রকমই। এ গাছে দুটি রাসায়নিক উপাদান আছে, যেগুলো এমনিতে আলাদাভাবে ক্ষতিকর নয়। কিন্তু যখন কোনো প্রাণী এর পাতা চিবানোর চেষ্টা করে, তখন রাসায়নিক উপাদান দুটি একসঙ্গে মিলে তৈরি করে বিষাক্ত সায়ানাইড গ্যাস। খোলা পরিবেশে এই গ্যাস খুব একটা ক্ষতি না করলেও, বদ্ধ পরিবেশে বেশ ভালো রকম ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ইংল্যান্ডের এই নর্দাম্বারল্যান্ড অঞ্চলে মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তির হার তুলনামূলক বেশি। সঙ্গত কারণেই পয়জন গার্ডেনকে কেবল বিষাক্ত গাছের প্রদর্শনী হিসেবে সীমাবদ্ধ না রেখে, একে মাদকবিষয়ক সচেতনতা কর্মসূচিরও অংশ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে শতাধিক বিষাক্ত উদ্ভিদের পাশাপাশি এই বাগানে রাখা হয়েছে কয়েক প্রজাতির নেশা উদ্রেককারী উদ্ভিদ। যেমন পপি, ক্যানাবিস, খট ইত্যাদি। এসব উদ্ভিদ থেকে তৈরি হয় নানা রকম মাদকদ্রব্য- হেরোইন, আফিম, গাঁজা ইত্যাদি।
পয়জন গার্ডেনে দর্শনার্থী হিসেবে আসা শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা যখন স্বচক্ষে এই নেশাজাতীয় উদ্ভিদগুলো দেখছে, তাঁদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ক্ষতিকর মাদকদ্রব্য থেকে নিজেদের দূরে রাখার মানসিকতা।
মন্তব্য করুন