গত সংখ্যার পর
রাষ্ট্র ও তার অধীন আর্থসামাজিক ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের চর্চাকেও নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। ধরা যাক, আধুনিক বলে কথিত বাংলা কবিতার কথা। এর উদ্ভব ও বিকাশ ইংরেজ শাসনের সূত্রপাতের পর থেকেই। দু'হাতে কবিতা লিখেছেন ঈশ্বর গুপ্ত। তাঁর ভাষাটা আধুনিক। সামাজিক অসংগতি নিয়ে তিনি চমৎকার হাসিঠাট্টা করেছেন। ইংরেজানুকরণ তাঁর ব্যঙ্গবিদ্রুপের বাইরে থাকেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে তিনি যেন ইয়ার্কি-ফাজলামো করছেন। যে অভিযোগ তাঁর অনুরাগী বঙ্কিমচন্দ্রের ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ঈশ্বর গুপ্তের আধুনিকতার অন্তরে ছিল অসংশোধনীয় এক রক্ষণশীলতা। সিপাহি অভ্যুত্থান নিয়ে তিনি যেভাবে হাস্যকৌতুক করার চেষ্টা করেছেন তার ব্যাখ্যা ওই রক্ষণশীলতার ভেতরেই সংরক্ষিত রয়েছে।
বাংলা গদ্য এসেছে নবীন মধ্যবিত্তের হাত ধরে। এই মধ্যবিত্ত লেখাপড়া শিখেছে, টাকাপয়সাও করেছে, আনুকূল্য পেয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। শ্রেণিটি ছিল কৃত্রিম ও জনবিচ্ছিন্ন; তাদের তৈরি গদ্যেও ওই দুই জিনিসের ছাপ এসে পড়ল। গদ্যের কৃত্রিমতা বিশেষভাবে প্রকাশ পেল সংস্কৃত ভারাক্রান্ততায়। কৃত্রিম এই ভাষার নাম দেওয়া হয়েছিল সাধুভাষা; অর্থাৎ ভদ্রলোকের ভাষা; চলিত ভাষা নয়। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভাষা থেকে স্বতন্ত্র। বাংলা গদ্যকে ওই দুই দোষ থেকে মুক্ত হবার চেষ্টাতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে; তবুও নিস্তার মেলেনি।
কোম্পানি শাসনের সময়ে লালন ফকির গান তৈরি করছিলেন, মেহনতিদের ভেতরে বসবাস করে। কিন্তু সে-রচনা যতই সরল ও স্বাভাবিক হোক, সে তো কবিতাই, গদ্য নয়। তদুপরি থাকেন তিনি রাজধানী কলকাতা থেকে অনেক দূরে, শ্রেণিগত পরিচয়ে তিনি দেহাতী মেহনতি বই নন। তাঁর ভাষা ভদ্রসাহিত্যের বাহন হয় কী করে? তাছাড়া লালনের যে গান তাতে মেহনতিদের জীবন ও সংগ্রামের কথা যে খুব একটা ছিল, এমনও নয়। ওটা তাই মুখের ভাষা বটে, তবে পুরোপুরি মেহনতি মানুষের ভাষা নয়।
আসলে ভাষা যে কেবল পোশাকে কাটে এমন তো নয়, ভাষার ভরসা ভেতরের বিষয়বস্তুর ওপরই। তাই দেখি পরে যখন সাধুকে সরিয়ে দিয়ে চলিত চলে এলো তখনও যে তাতে কৃষক ও শ্রমিকের জীবনসংগ্রাম, যা আসলে শ্রেণিসংগ্রামই, সেটা জায়গা পেল এমন নয়। গদ্যের ভাষা ও বিষয় রইল মধ্যবিত্তের দখলেই। যেমন প্রমথ চৌধুরীর। তিনি ছিলেন চলিত ভাষার পক্ষে, কিন্তু তাই বলে তাঁর বিষয়বস্তুতে যে সমাজ বিপ্লবের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কোনো ছোঁয়া ছিল তা নয়। রায়তের কথা তিনি লিখেছেন, তাতে রায়তের দুঃখের কথা আছে, কিন্তু বেচারাদের দুঃখের কারণটা যে-জমিদারি ব্যবস্থা তার অবসান ঘটানোর দাবিটা নেই। বোঝা যায় শ্রেণির সীমা কেমন অলঙ্ঘনীয়।
বঙ্কিমচন্দ্রের উদাহরণ তো না দিলেই নয়। তাঁর 'বঙ্গদেশের কৃষক' প্রবন্ধে অল্প কথায় কৃষকের জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণার খবর যেভাবে উঠে এসেছে সেভাবে অন্য কোথাও এসেছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু প্রবন্ধের উপসংহারে এসে সিদ্ধান্তটা কী? না, জমিদারি ব্যবস্থাটা থাকবে। কেন থাকবে? কারণ, না থাকলে আধুনিক বঙ্গ সমাজ ভেঙে পড়বে; ভীষণ অরাজকতা দেখা দেবে। আর এটা তো জানা কথাই, বলেছেন তিনি, যে আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। আমরা অর্থ মধ্যবিত্তরা। বাংলা সাহিত্যে মধ্যবিত্তের উদারনীতির প্রান্তসীমা এমন পরিস্কারভাবে আর কেউ দেখিয়ে দেননি। অনেক বছর পরে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অবশ্য বলে দিয়েছেন, 'সহে না সহে না প্রাণে/ জনতার জঘন্য মিতালী'। তবে প্রাণাঘাতের সেই আশঙ্কাবাণী তেমন একটা প্রচার পায়নি। অসামান্য লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের ভেতর ছিল স্বাধীনতার প্রবল স্পৃহা, কিন্তু পাশাপাশি সাম্যের সুপ্ত ভীতি। এই স্পৃহা, ওই ভীতি- এদের ভেতরই চিহ্নিত অবস্থায় রয়েছে সেকালের এবং একালেরও উদারনীতিকদের বিচরণসীমার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রটি। তাঁরা ভদ্র, কিন্তু বিপ্লববিরোধী। সেটা ঘটেছে ভদ্রতার খাতিরেই এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির 'পবিত্রতা' রক্ষার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধতার কারণেই।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্রোহী ছিলেন। সাহেব হতে গিয়ে তিনি কিন্তু উল্টো ঘটনাই ঘটালেন, বাঙালি হয়ে গেলেন। ঔপনিবেশিক শাসনে পীড়িত বাংলার আর্তহৃদয় তাঁর 'মেঘনাদবধ' কাব্যে আর্তনাদ করে উঠেছে। কিন্তু তিনিও দেখা যাচ্ছে তাঁর ওই মহাকাব্যে সতীদাহের মতো নারকীয় ভারতীয় প্রথা রীতিমতো আদর্শায়িত করে দিয়েছেন। এবং যদিও সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় অসামান্য দুটি প্রহসন লিখেছেন যাতে রক্ষণশীল জমিদারদের প্রজা পীড়নের এবং নব্য সাহেবদের উচ্ছৃঙ্খলতাকে তীব্র পরিহাস করা হয়েছে, তথাপি সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা যে সাহিত্যের যথার্থ ভাষা হতে পারে, এমন 'অলক্ষুনে' কথা মুখে আনেননি। বলেছেন ও তো জেলেদের ভাষা। যতই বলুন যে তিনি খাঁটি বাঙাল, যশোহরের, শেষ বিচারে তিনি ভদ্রলোকই তো।
রবীন্দ্রনাথ বহু দিক দিয়েই অসাধারণ। প্রায় সকল অগ্রগতির সঙ্গেই তিনি যুক্ত থেকেছেন। ভূমিকা রেখেছেন। ছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ব্যাপ্ত ও গভীর। শিক্ষিত বাঙালি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রুচির ব্যাপারে তাঁর কাছ থেকে নিরন্তর শিক্ষা নিয়েছে। কিন্তু শ্রেণিগত সীমা ছিল তাঁরও। কৃষকের জীবনে প্রবেশ করতে পারেননি, সে-কথা অন্যে বলবে কী, তিনি নিজেই বলে গেছেন; নিজের ভাষায়, খেদের সঙ্গে। জমিদারি ব্যবস্থা যে অন্যায় সেটা অবশ্যই জানতেন, কিন্তু ওই ব্যবস্থার উচ্ছেদে যে কৃষকের কোনো সুবিধা হবে, এমনটা ভাবতে পারেননি। বিপ্লব-পরবর্তী রুশ দেশে গিয়ে, সেখানকার উন্নতি দেখে তো প্রায় অভিভূতই হয়েছিলেন; কিন্তু বিপ্লবের ভেতরে যে বলশেভিক কার্যকরণ ছিল তার প্রশংসা করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি বইতে স্ট্যালিন তো নেই-ই, লেনিনও নেই।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিয়ে গেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্বে। বিশ্বযুদ্ধ যখন তুমুল দশা। ঠিক সেই সময়েই জাপান ও আমেরিকায় ভ্রমণে গিয়ে তাদের জাতীয়তাবাদের নিন্দা জানিয়ে বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু সংকটটা যে পুঁজিবাদের নিজের হাতে তৈরি, ওই জাতীয়তাবাদ যে আসলে পুঁজিবাদী জাতীয়তাবাদ, এটা পরিস্কার করে বলেননি। নিন্দা যা প্রাপ্য ছিল সে তো পুঁজিবাদেরই। কিন্তু মনুষ্যত্ববিদ্বেষী ওই শত্রুটিকে পুঁজিবাদ বলে চিহ্নিত করেননি। বাধাটা ছিল বিশ্বকবির অন্তর্গত উদারনীতির। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার তদানীন্তন ও ভবিতব্য তাণ্ডব থেকে বের হবার পথটা যে কোথায় তাও বলেননি। ওই পথের পরিস্কার উন্মোচন ঘটিয়েছিল বলশেভিক বিপ্লবীরা, জাতীয়তাবাদ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার কয়েক মাসের মধ্যেই। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ভারতের সমস্যাটা রাজনৈতিক নয়, সামাজিক। তা সামাজিক তো ঠিকই, কিন্তু সমাজ তো থাকে রাষ্ট্রের অধীনেই। রাষ্ট্রের ওই কর্তৃত্বের কথাটা রবীন্দ্রনাথ বলতে উৎসাহবোধ করলেন না। উৎসাহের অভাবটা তাঁর উদারনীতি থেকেই এসেছে।
১৯২০-৩০-এর আধুনিক লেখকদের অনেকেই নিজেদের আন্তর্জাতিক বলে ভাবতে পছন্দ করতেন। আসলে তাঁরা ছিলেন অধঃপতিত পুঁজিবাদী সংস্কৃতির অনুরাগী। তাঁদের আধুনিকতা ছিল পশ্চিমী বুর্জোয়াদের অনুকরণের। তাঁদের মধ্যে কারও কারও জন্য যৌবন হয়ে দাঁড়িয়েছিল জীবনযন্ত্রণা। অগ্রসর যাঁরা, যেমন- বিষুষ্ণ দে, তাঁরা আবার মার্কসবাদকে মেলাতে চাইলেন ঘোরতর রক্ষণশীল টি এস এলিয়টের সঙ্গে। দুধ ও জলকে এক করার চেষ্টা; তাতে দুধের ক্ষতি, জলের লাভ। কারও কারও আধুনিকতা আবার রওনা দিয়েছে মার্কিনদেশাভিমুখী।
যথার্থ আধুনিক ছিলেন কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম। বলশেভিক বিপ্লব পুঁজিবাদবিরোধী যে নতুন এক আন্তর্জাতিকতা তৈরি করেছিল তিনি তাঁকে ধারণ করেছেন নিজের মধ্যে। কেবল বিদ্রোহী ছিলেন না, বিপ্লবীই ছিলেন। নজরুলের জন্ম ১৮৯৯-তে। একই বছর জন্মেছেন স্পেনের লোরকা এবং চিলির পাবলো নেরুদা। পুঁজিবাদবিরোধিতার যে আধুনিকতা ও আন্তর্জাতিকতা তা তাঁদের তিনজনের মধ্যেই ছিল। তবে বাস্তব ঘটনা তো এই যে লোরকা ও নেরুদা যে ধরনের ইউরোপীয় পরিসর পেয়েছিলেন নজরুল তা পাননি, তবুও আবদ্ধ দেশে এবং দুঃসহ দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও নিজের ভেতরে তিনি একটি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিলেন। নজরুল, লোরকা ও নেরুদা- তিনজনই ছিলেন মার্কসবাদী।
নজরুল এবং জীবনানন্দ দাশের জন্ম একই বছরে। নজরুল এতটাই প্রবল এবং জীবনানন্দ এমনই গ্রহণ-মনস্ক ছিলেন যে জীবনানন্দের প্রথম জীবনের কবিতায় নজরুলের প্রভাব বিলক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু মৌলিক মনীষা-সম্পন্ন ছিলেন যেহেতু, তাই ওই প্রভাবে তিনি আবদ্ধ থাকেননি; বের হয়ে গেছেন অচিরেই। জীবনানন্দও পুঁজিবাদকে চিনেছিলেন, নিজের জীবনাভিজ্ঞতা ও পঠন-পাঠনের ভেতর দিয়ে। পুঁজিবাদ তাঁকে খাপ-খাওয়া মানুষ হতে দেয়নি। উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ জীবনানন্দ দাশ। পরিবারে সাহিত্যচর্চা ছিল, তাঁর মাতাও কবিতা লিখতেন। কিন্তু জীবিকার অনিশ্চয়তায় তাঁকে ভুগতে হয়েছে। তাঁর কবিতায় ও গল্পে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরোধিতা আছে, যদিও তিনি বিপ্লবী ছিলেন না মোটেই। সার্বক্ষণিক যন্ত্রণা তাঁকে বিষণ্ণ করে রাখত।
জসীমউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর মিল আছে মনে হবে, কারণ দু'জনেই গ্রামবাংলা নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু পার্থক্য একেবারেই মৌলিক। জসীমউদ্দীন পুঁজিবাদের মোকাবিলা করেননি, জীবনানন্দ করেছেন। জসীমউদ্দীনের বাংলা-ভূখণ্ডও পুঁজিবাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত, কিন্তু লেখেন তিনি গ্রামীণ জীবনের কথাই। ইতিহাসের যে চেতনা জীবনানন্দের কবিতাকে গভীরতা দিয়েছে জসীমউদ্দীনের কবিতাতে তা থাকবার কথা নয়, থাকেওনি।
নজরুল যে শেষাবধি টিকতে পারলেন না, নির্বাক হয়ে গেলেন অকালে, তার প্রধান কারণ পুঁজিবাদী নিষ্পেষণ। সংসারে অনটন ছিল, তার মধ্যে আবার দেখা দিল শোক ও ব্যাধি। আরেকটি কারণ সমাজ পরিবর্তনের রাজনৈতিক আন্দোলনের পক্ষে অগ্রসর হতে না-পারা। এ প্রসঙ্গে সমর সেনের কথা আসে। তিনিও বিপ্লবী ধারাতেই থাকতে চেয়েছিলেন; কিন্তু আন্দোলন যে এগুচ্ছে না সেটা বুঝতে পারছিলেন, এবং টের পেলেন যে আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অভিজ্ঞতাকে মেলানো যাচ্ছে না। নিজের সীমানা তাঁর জানা ছিল, সে-জন্য ১৯৪৬-তে এসে কবিতা লেখাই ছেড়ে দিলেন। এর পরেও অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, কিন্তু কবিতা থেকে গেল পেছনেই। সুকান্ত ভট্টাচার্যের থামবার কথা নয়, কারণ কমিউনিস্ট পার্টির কাজের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল একেবারে প্রত্যক্ষ; ওই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সাংগঠনিকভাবে ব্যস্ত ছিলেন, অঙ্গীকার ছিল খুবই দৃঢ়। কিন্তু সুকান্ত তো মারা গেলেন ১৯৪৭ সালে পৌঁছেই, মাত্র একুশ বছর বয়সে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও আন্দোলনে ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি, দলত্যাগ করে চলে গেছেন রক্ষণশীলদের দলে। শ্রেণিগত অবস্থান তিনি ত্যাগ করবেন ভেবেছিলেন, চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষাটা হয়নি। অবিকল না হলেও আর, একই রকমের ঘটনা কিন্তু ঘটেছে সমরেশ বসুর বেলাতেও। মেহনতিদের জীবন নিয়ে তিনি 'গঙ্গা' লিখেছেন ১৯৫৫-তে। মনে হচ্ছিল আরও এগুবেন। পারলেন না। শ্রেণি তাঁকে আটকে দিল। ১৯৬৫-তে তাঁকে লিখতে হয়েছে 'বিবর', গঙ্গা থেকে সে অনেক দূরের। ঢাকার সোমেন চন্দ মনেপ্রাণে যুক্ত হয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে, কিন্তু তিনিও সুকান্তের মতোই বেঁচে ছিলেন ওই একুশ বছরই। নিহত হয়েছেন জাতীয়তাবাদীদের হাতে। জাতীয়তাবাদে সমাজতন্ত্রে দ্বন্দ্বটা তখন বেশ প্রকট হয়ে উঠেছিল।
বুদ্ধদেব বসু ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম একই বছরে, ১৯০৮ সালে। কিন্তু পার্থক্য অনেক। একজন মূলত কবি, অপরজন পুরোপুরি কথাসাহিত্যিক। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যবধান একেবারে গোড়াতেই। বুদ্ধদেব ভাববাদী, মানিক বস্তুবাদী। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম দুই উপন্যাস- 'পুতুল নাচের ইতিকথা' এবং 'পদ্মা নদীর মাঝি' অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য রচনা; সে-দুটি উপন্যাসে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মেহনতি মানুষের জীবনযাত্রার বাস্তব ছবি আছে; কিন্তু মার্কসবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের পরে তিনি যা লিখেছেন সে রচনা অন্যরকম, সেখানে শ্রেণি তো আছেই, সঙ্গে রয়েছে মেহনতি মানুষের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের সংগ্রামের কথা। এই লেখাগুলো কিন্তু তেমন প্রচার পায়নি; কারণ বুর্জোয়াভাবাপন্ন গণমাধ্যমের জন্য এরা উপাদেয় বস্তু ছিল না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও দীর্ঘজীবন লাভ করেননি। বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৮ বছর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় গণনাট্য সংঘ ছিল। সংঘের কর্মীরা গান লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, তাঁদের কাজ যথেষ্ট চাঞ্চল্য, এমনকি উদ্দীপনারও সৃষ্টি করেছিল। গণনাট্য সংঘ কিন্তু যথার্থ অর্থে বিপ্লবী সংগঠন ছিল না। সেজন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিরোধও দেখা দেয়; শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র আলাদা হয়ে যান, হেমাঙ্গ বিশ্বাস বের হয়ে গিয়ে নতুন সংগঠন গড়েন, সলিল চৌধুরীকে বোম্বে-কলকাতা করতে হয়, ভূপেন হাজারিকা শেষ পর্যন্ত শামিল হন বিজেপিতে। এসবের পেছনে বড় একটা কারণ তাদের আনুকূল্য দেবার মতো জোর ছিল না তৎকালীন বিপ্লবী আন্দোলনের।
সমাপ্ত।
রাষ্ট্র ও তার অধীন আর্থসামাজিক ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের চর্চাকেও নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। ধরা যাক, আধুনিক বলে কথিত বাংলা কবিতার কথা। এর উদ্ভব ও বিকাশ ইংরেজ শাসনের সূত্রপাতের পর থেকেই। দু'হাতে কবিতা লিখেছেন ঈশ্বর গুপ্ত। তাঁর ভাষাটা আধুনিক। সামাজিক অসংগতি নিয়ে তিনি চমৎকার হাসিঠাট্টা করেছেন। ইংরেজানুকরণ তাঁর ব্যঙ্গবিদ্রুপের বাইরে থাকেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে তিনি যেন ইয়ার্কি-ফাজলামো করছেন। যে অভিযোগ তাঁর অনুরাগী বঙ্কিমচন্দ্রের ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ঈশ্বর গুপ্তের আধুনিকতার অন্তরে ছিল অসংশোধনীয় এক রক্ষণশীলতা। সিপাহি অভ্যুত্থান নিয়ে তিনি যেভাবে হাস্যকৌতুক করার চেষ্টা করেছেন তার ব্যাখ্যা ওই রক্ষণশীলতার ভেতরেই সংরক্ষিত রয়েছে।
বাংলা গদ্য এসেছে নবীন মধ্যবিত্তের হাত ধরে। এই মধ্যবিত্ত লেখাপড়া শিখেছে, টাকাপয়সাও করেছে, আনুকূল্য পেয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। শ্রেণিটি ছিল কৃত্রিম ও জনবিচ্ছিন্ন; তাদের তৈরি গদ্যেও ওই দুই জিনিসের ছাপ এসে পড়ল। গদ্যের কৃত্রিমতা বিশেষভাবে প্রকাশ পেল সংস্কৃত ভারাক্রান্ততায়। কৃত্রিম এই ভাষার নাম দেওয়া হয়েছিল সাধুভাষা; অর্থাৎ ভদ্রলোকের ভাষা; চলিত ভাষা নয়। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভাষা থেকে স্বতন্ত্র। বাংলা গদ্যকে ওই দুই দোষ থেকে মুক্ত হবার চেষ্টাতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে; তবুও নিস্তার মেলেনি।
কোম্পানি শাসনের সময়ে লালন ফকির গান তৈরি করছিলেন, মেহনতিদের ভেতরে বসবাস করে। কিন্তু সে-রচনা যতই সরল ও স্বাভাবিক হোক, সে তো কবিতাই, গদ্য নয়। তদুপরি থাকেন তিনি রাজধানী কলকাতা থেকে অনেক দূরে, শ্রেণিগত পরিচয়ে তিনি দেহাতী মেহনতি বই নন। তাঁর ভাষা ভদ্রসাহিত্যের বাহন হয় কী করে? তাছাড়া লালনের যে গান তাতে মেহনতিদের জীবন ও সংগ্রামের কথা যে খুব একটা ছিল, এমনও নয়। ওটা তাই মুখের ভাষা বটে, তবে পুরোপুরি মেহনতি মানুষের ভাষা নয়।
আসলে ভাষা যে কেবল পোশাকে কাটে এমন তো নয়, ভাষার ভরসা ভেতরের বিষয়বস্তুর ওপরই। তাই দেখি পরে যখন সাধুকে সরিয়ে দিয়ে চলিত চলে এলো তখনও যে তাতে কৃষক ও শ্রমিকের জীবনসংগ্রাম, যা আসলে শ্রেণিসংগ্রামই, সেটা জায়গা পেল এমন নয়। গদ্যের ভাষা ও বিষয় রইল মধ্যবিত্তের দখলেই। যেমন প্রমথ চৌধুরীর। তিনি ছিলেন চলিত ভাষার পক্ষে, কিন্তু তাই বলে তাঁর বিষয়বস্তুতে যে সমাজ বিপ্লবের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কোনো ছোঁয়া ছিল তা নয়। রায়তের কথা তিনি লিখেছেন, তাতে রায়তের দুঃখের কথা আছে, কিন্তু বেচারাদের দুঃখের কারণটা যে-জমিদারি ব্যবস্থা তার অবসান ঘটানোর দাবিটা নেই। বোঝা যায় শ্রেণির সীমা কেমন অলঙ্ঘনীয়।
বঙ্কিমচন্দ্রের উদাহরণ তো না দিলেই নয়। তাঁর 'বঙ্গদেশের কৃষক' প্রবন্ধে অল্প কথায় কৃষকের জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণার খবর যেভাবে উঠে এসেছে সেভাবে অন্য কোথাও এসেছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু প্রবন্ধের উপসংহারে এসে সিদ্ধান্তটা কী? না, জমিদারি ব্যবস্থাটা থাকবে। কেন থাকবে? কারণ, না থাকলে আধুনিক বঙ্গ সমাজ ভেঙে পড়বে; ভীষণ অরাজকতা দেখা দেবে। আর এটা তো জানা কথাই, বলেছেন তিনি, যে আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। আমরা অর্থ মধ্যবিত্তরা। বাংলা সাহিত্যে মধ্যবিত্তের উদারনীতির প্রান্তসীমা এমন পরিস্কারভাবে আর কেউ দেখিয়ে দেননি। অনেক বছর পরে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অবশ্য বলে দিয়েছেন, 'সহে না সহে না প্রাণে/ জনতার জঘন্য মিতালী'। তবে প্রাণাঘাতের সেই আশঙ্কাবাণী তেমন একটা প্রচার পায়নি। অসামান্য লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের ভেতর ছিল স্বাধীনতার প্রবল স্পৃহা, কিন্তু পাশাপাশি সাম্যের সুপ্ত ভীতি। এই স্পৃহা, ওই ভীতি- এদের ভেতরই চিহ্নিত অবস্থায় রয়েছে সেকালের এবং একালেরও উদারনীতিকদের বিচরণসীমার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রটি। তাঁরা ভদ্র, কিন্তু বিপ্লববিরোধী। সেটা ঘটেছে ভদ্রতার খাতিরেই এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির 'পবিত্রতা' রক্ষার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধতার কারণেই।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিদ্রোহী ছিলেন। সাহেব হতে গিয়ে তিনি কিন্তু উল্টো ঘটনাই ঘটালেন, বাঙালি হয়ে গেলেন। ঔপনিবেশিক শাসনে পীড়িত বাংলার আর্তহৃদয় তাঁর 'মেঘনাদবধ' কাব্যে আর্তনাদ করে উঠেছে। কিন্তু তিনিও দেখা যাচ্ছে তাঁর ওই মহাকাব্যে সতীদাহের মতো নারকীয় ভারতীয় প্রথা রীতিমতো আদর্শায়িত করে দিয়েছেন। এবং যদিও সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় অসামান্য দুটি প্রহসন লিখেছেন যাতে রক্ষণশীল জমিদারদের প্রজা পীড়নের এবং নব্য সাহেবদের উচ্ছৃঙ্খলতাকে তীব্র পরিহাস করা হয়েছে, তথাপি সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা যে সাহিত্যের যথার্থ ভাষা হতে পারে, এমন 'অলক্ষুনে' কথা মুখে আনেননি। বলেছেন ও তো জেলেদের ভাষা। যতই বলুন যে তিনি খাঁটি বাঙাল, যশোহরের, শেষ বিচারে তিনি ভদ্রলোকই তো।
রবীন্দ্রনাথ বহু দিক দিয়েই অসাধারণ। প্রায় সকল অগ্রগতির সঙ্গেই তিনি যুক্ত থেকেছেন। ভূমিকা রেখেছেন। ছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ব্যাপ্ত ও গভীর। শিক্ষিত বাঙালি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রুচির ব্যাপারে তাঁর কাছ থেকে নিরন্তর শিক্ষা নিয়েছে। কিন্তু শ্রেণিগত সীমা ছিল তাঁরও। কৃষকের জীবনে প্রবেশ করতে পারেননি, সে-কথা অন্যে বলবে কী, তিনি নিজেই বলে গেছেন; নিজের ভাষায়, খেদের সঙ্গে। জমিদারি ব্যবস্থা যে অন্যায় সেটা অবশ্যই জানতেন, কিন্তু ওই ব্যবস্থার উচ্ছেদে যে কৃষকের কোনো সুবিধা হবে, এমনটা ভাবতে পারেননি। বিপ্লব-পরবর্তী রুশ দেশে গিয়ে, সেখানকার উন্নতি দেখে তো প্রায় অভিভূতই হয়েছিলেন; কিন্তু বিপ্লবের ভেতরে যে বলশেভিক কার্যকরণ ছিল তার প্রশংসা করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি বইতে স্ট্যালিন তো নেই-ই, লেনিনও নেই।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিয়ে গেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্বে। বিশ্বযুদ্ধ যখন তুমুল দশা। ঠিক সেই সময়েই জাপান ও আমেরিকায় ভ্রমণে গিয়ে তাদের জাতীয়তাবাদের নিন্দা জানিয়ে বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু সংকটটা যে পুঁজিবাদের নিজের হাতে তৈরি, ওই জাতীয়তাবাদ যে আসলে পুঁজিবাদী জাতীয়তাবাদ, এটা পরিস্কার করে বলেননি। নিন্দা যা প্রাপ্য ছিল সে তো পুঁজিবাদেরই। কিন্তু মনুষ্যত্ববিদ্বেষী ওই শত্রুটিকে পুঁজিবাদ বলে চিহ্নিত করেননি। বাধাটা ছিল বিশ্বকবির অন্তর্গত উদারনীতির। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার তদানীন্তন ও ভবিতব্য তাণ্ডব থেকে বের হবার পথটা যে কোথায় তাও বলেননি। ওই পথের পরিস্কার উন্মোচন ঘটিয়েছিল বলশেভিক বিপ্লবীরা, জাতীয়তাবাদ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার কয়েক মাসের মধ্যেই। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ভারতের সমস্যাটা রাজনৈতিক নয়, সামাজিক। তা সামাজিক তো ঠিকই, কিন্তু সমাজ তো থাকে রাষ্ট্রের অধীনেই। রাষ্ট্রের ওই কর্তৃত্বের কথাটা রবীন্দ্রনাথ বলতে উৎসাহবোধ করলেন না। উৎসাহের অভাবটা তাঁর উদারনীতি থেকেই এসেছে।
১৯২০-৩০-এর আধুনিক লেখকদের অনেকেই নিজেদের আন্তর্জাতিক বলে ভাবতে পছন্দ করতেন। আসলে তাঁরা ছিলেন অধঃপতিত পুঁজিবাদী সংস্কৃতির অনুরাগী। তাঁদের আধুনিকতা ছিল পশ্চিমী বুর্জোয়াদের অনুকরণের। তাঁদের মধ্যে কারও কারও জন্য যৌবন হয়ে দাঁড়িয়েছিল জীবনযন্ত্রণা। অগ্রসর যাঁরা, যেমন- বিষুষ্ণ দে, তাঁরা আবার মার্কসবাদকে মেলাতে চাইলেন ঘোরতর রক্ষণশীল টি এস এলিয়টের সঙ্গে। দুধ ও জলকে এক করার চেষ্টা; তাতে দুধের ক্ষতি, জলের লাভ। কারও কারও আধুনিকতা আবার রওনা দিয়েছে মার্কিনদেশাভিমুখী।
যথার্থ আধুনিক ছিলেন কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম। বলশেভিক বিপ্লব পুঁজিবাদবিরোধী যে নতুন এক আন্তর্জাতিকতা তৈরি করেছিল তিনি তাঁকে ধারণ করেছেন নিজের মধ্যে। কেবল বিদ্রোহী ছিলেন না, বিপ্লবীই ছিলেন। নজরুলের জন্ম ১৮৯৯-তে। একই বছর জন্মেছেন স্পেনের লোরকা এবং চিলির পাবলো নেরুদা। পুঁজিবাদবিরোধিতার যে আধুনিকতা ও আন্তর্জাতিকতা তা তাঁদের তিনজনের মধ্যেই ছিল। তবে বাস্তব ঘটনা তো এই যে লোরকা ও নেরুদা যে ধরনের ইউরোপীয় পরিসর পেয়েছিলেন নজরুল তা পাননি, তবুও আবদ্ধ দেশে এবং দুঃসহ দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও নিজের ভেতরে তিনি একটি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিলেন। নজরুল, লোরকা ও নেরুদা- তিনজনই ছিলেন মার্কসবাদী।
নজরুল এবং জীবনানন্দ দাশের জন্ম একই বছরে। নজরুল এতটাই প্রবল এবং জীবনানন্দ এমনই গ্রহণ-মনস্ক ছিলেন যে জীবনানন্দের প্রথম জীবনের কবিতায় নজরুলের প্রভাব বিলক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু মৌলিক মনীষা-সম্পন্ন ছিলেন যেহেতু, তাই ওই প্রভাবে তিনি আবদ্ধ থাকেননি; বের হয়ে গেছেন অচিরেই। জীবনানন্দও পুঁজিবাদকে চিনেছিলেন, নিজের জীবনাভিজ্ঞতা ও পঠন-পাঠনের ভেতর দিয়ে। পুঁজিবাদ তাঁকে খাপ-খাওয়া মানুষ হতে দেয়নি। উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ জীবনানন্দ দাশ। পরিবারে সাহিত্যচর্চা ছিল, তাঁর মাতাও কবিতা লিখতেন। কিন্তু জীবিকার অনিশ্চয়তায় তাঁকে ভুগতে হয়েছে। তাঁর কবিতায় ও গল্পে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরোধিতা আছে, যদিও তিনি বিপ্লবী ছিলেন না মোটেই। সার্বক্ষণিক যন্ত্রণা তাঁকে বিষণ্ণ করে রাখত।
জসীমউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর মিল আছে মনে হবে, কারণ দু'জনেই গ্রামবাংলা নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু পার্থক্য একেবারেই মৌলিক। জসীমউদ্দীন পুঁজিবাদের মোকাবিলা করেননি, জীবনানন্দ করেছেন। জসীমউদ্দীনের বাংলা-ভূখণ্ডও পুঁজিবাদের আক্রমণে বিধ্বস্ত, কিন্তু লেখেন তিনি গ্রামীণ জীবনের কথাই। ইতিহাসের যে চেতনা জীবনানন্দের কবিতাকে গভীরতা দিয়েছে জসীমউদ্দীনের কবিতাতে তা থাকবার কথা নয়, থাকেওনি।
নজরুল যে শেষাবধি টিকতে পারলেন না, নির্বাক হয়ে গেলেন অকালে, তার প্রধান কারণ পুঁজিবাদী নিষ্পেষণ। সংসারে অনটন ছিল, তার মধ্যে আবার দেখা দিল শোক ও ব্যাধি। আরেকটি কারণ সমাজ পরিবর্তনের রাজনৈতিক আন্দোলনের পক্ষে অগ্রসর হতে না-পারা। এ প্রসঙ্গে সমর সেনের কথা আসে। তিনিও বিপ্লবী ধারাতেই থাকতে চেয়েছিলেন; কিন্তু আন্দোলন যে এগুচ্ছে না সেটা বুঝতে পারছিলেন, এবং টের পেলেন যে আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অভিজ্ঞতাকে মেলানো যাচ্ছে না। নিজের সীমানা তাঁর জানা ছিল, সে-জন্য ১৯৪৬-তে এসে কবিতা লেখাই ছেড়ে দিলেন। এর পরেও অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন, পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, কিন্তু কবিতা থেকে গেল পেছনেই। সুকান্ত ভট্টাচার্যের থামবার কথা নয়, কারণ কমিউনিস্ট পার্টির কাজের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল একেবারে প্রত্যক্ষ; ওই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সাংগঠনিকভাবে ব্যস্ত ছিলেন, অঙ্গীকার ছিল খুবই দৃঢ়। কিন্তু সুকান্ত তো মারা গেলেন ১৯৪৭ সালে পৌঁছেই, মাত্র একুশ বছর বয়সে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও আন্দোলনে ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি, দলত্যাগ করে চলে গেছেন রক্ষণশীলদের দলে। শ্রেণিগত অবস্থান তিনি ত্যাগ করবেন ভেবেছিলেন, চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষাটা হয়নি। অবিকল না হলেও আর, একই রকমের ঘটনা কিন্তু ঘটেছে সমরেশ বসুর বেলাতেও। মেহনতিদের জীবন নিয়ে তিনি 'গঙ্গা' লিখেছেন ১৯৫৫-তে। মনে হচ্ছিল আরও এগুবেন। পারলেন না। শ্রেণি তাঁকে আটকে দিল। ১৯৬৫-তে তাঁকে লিখতে হয়েছে 'বিবর', গঙ্গা থেকে সে অনেক দূরের। ঢাকার সোমেন চন্দ মনেপ্রাণে যুক্ত হয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে, কিন্তু তিনিও সুকান্তের মতোই বেঁচে ছিলেন ওই একুশ বছরই। নিহত হয়েছেন জাতীয়তাবাদীদের হাতে। জাতীয়তাবাদে সমাজতন্ত্রে দ্বন্দ্বটা তখন বেশ প্রকট হয়ে উঠেছিল।
বুদ্ধদেব বসু ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম একই বছরে, ১৯০৮ সালে। কিন্তু পার্থক্য অনেক। একজন মূলত কবি, অপরজন পুরোপুরি কথাসাহিত্যিক। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যবধান একেবারে গোড়াতেই। বুদ্ধদেব ভাববাদী, মানিক বস্তুবাদী। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম দুই উপন্যাস- 'পুতুল নাচের ইতিকথা' এবং 'পদ্মা নদীর মাঝি' অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য রচনা; সে-দুটি উপন্যাসে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মেহনতি মানুষের জীবনযাত্রার বাস্তব ছবি আছে; কিন্তু মার্কসবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের পরে তিনি যা লিখেছেন সে রচনা অন্যরকম, সেখানে শ্রেণি তো আছেই, সঙ্গে রয়েছে মেহনতি মানুষের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের সংগ্রামের কথা। এই লেখাগুলো কিন্তু তেমন প্রচার পায়নি; কারণ বুর্জোয়াভাবাপন্ন গণমাধ্যমের জন্য এরা উপাদেয় বস্তু ছিল না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও দীর্ঘজীবন লাভ করেননি। বেঁচে ছিলেন মাত্র ৪৮ বছর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় গণনাট্য সংঘ ছিল। সংঘের কর্মীরা গান লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, তাঁদের কাজ যথেষ্ট চাঞ্চল্য, এমনকি উদ্দীপনারও সৃষ্টি করেছিল। গণনাট্য সংঘ কিন্তু যথার্থ অর্থে বিপ্লবী সংগঠন ছিল না। সেজন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিরোধও দেখা দেয়; শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র আলাদা হয়ে যান, হেমাঙ্গ বিশ্বাস বের হয়ে গিয়ে নতুন সংগঠন গড়েন, সলিল চৌধুরীকে বোম্বে-কলকাতা করতে হয়, ভূপেন হাজারিকা শেষ পর্যন্ত শামিল হন বিজেপিতে। এসবের পেছনে বড় একটা কারণ তাদের আনুকূল্য দেবার মতো জোর ছিল না তৎকালীন বিপ্লবী আন্দোলনের।
সমাপ্ত।
মন্তব্য করুন