অ্যানার্কি বলতে এমন একটি সমাজের কথা ভাবা হয়, যেখানে কোনো ধরনের কতৃত্ব থাকবে না। ইংরেজিতে অ্যানার্কি শব্দটি প্রথম ব্যবহূত হয় ১৫৩৯ সালে এবং যার অর্থ করা হয় 'রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি'। অথচ বাংলায় ভুলভাবে অনূদিত হলো 'নৈরাজ্য' নামে। ১৮৪০ সালে পিয়ের জোসেফ প্রুঁধো তার 'সম্পত্তি কী?' শীর্ষক লেখায় অ্যানার্কি ও অ্যানাকিস্ট শব্দদ্বয়কে ব্যবহার করেন এবং অ্যানার্কিজমকে একটি নতুন রাজনৈতিক দর্শন এবং সামাজিক আন্দোলনের রূপরেখা হিসেবে তুলে ধরেন, যেখানে সমাজ হবে রাষ্ট্রহীন এবং স্বেচ্ছাসেবী সমিতির ওপর ভর করে সমাজ পরিচালিত হবে।
অ্যানার্কিস্টদের অনেক স্কুল অব থট আছে, মার্ক্সবাদের মতোই। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো সোশ্যালিস্ট অ্যানার্কিস্ট ধারা, যার প্রবক্তা মূলত আলেক্সান্দার বাকুনিন এবং জোহান মোস্ট। সাধারণভাবে অ্যানার্কিস্টরা সব ধরনের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে এবং সেই একই কারণে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করে। বাকুনিন মনে করতেন যে, রাষ্ট্র পুঁজির জন্ম দিয়েছে। রাষ্ট্র বিলুপ্ত হলে পুঁজিরও বিলুপ্তি ঘটবে। শ্রমিকদের গুরুতর, চূড়ান্ত ও সম্পর্ণ মুক্তি শুধু একটি শর্তে সম্ভব- মূলধনের বণ্টন, অর্থাৎ কাঁচামাল এবং শ্রমের সমস্ত সরঞ্জাম, জমিসহ, শ্রমিকদের অধীনে নিয়ে আসা। অন্যদিকে মার্ক্সবাদীরা মনে করে, পুঁজির প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি। মার্ক্সবাদ রাষ্ট্রের গুরুত্বকে শুধু স্বীকারই করে না, বরং মনে করে, পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সময়কালে রাষ্ট্র হবে সর্বহারা শ্রেণির একটি হাতিয়ারবিশেষ।
লেনিন মনে করতেন, মার্ক্সবাদ নৈরাজ্যবাদ থেকে আলাদা এই কারণে যে, এটি সাধারণভাবে বিপ্লবের সময়কালে এবং বিশেষ করে সম্পদের সামাজিক মালিকানায় বিশ্বাস করলেও কার্ল মার্ক্সের সর্বহারা শ্রেণির একনায়কতন্ত্রকে মানতে অ্যানার্কিস্টরা নারাজ। ফলে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংগঠন 'প্রথম আস্তর্জাতিক' কার্ল মার্ক্স ও বাকুনিনের মতবিরোধকে কেন্দ্র করে ভেঙে যায় এবং কার্ল মার্ক্স বাকুনিনকে প্রথম আন্তর্জাতিক থেকে বহিস্কার করেন।
অন্যদিকে লেনিন এটাও বলেন, "অ্যানার্কিজম হলো বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ-এর উল্টো পিঠ। অ্যানার্কিজম হলো হতাশার ফসল। সর্বহারার বিপরীতে অস্থিরমতি বুদ্ধিজীবী বা ভবঘুরের মনস্তত্ত্ব। সর্বহারার শ্রেণি সংগ্রামকে উপলব্ধি করার ব্যর্থতা। বুর্জোয়া সমাজের রাজনীতির হাস্যকর নেতীকরণ। শ্রমিকদের সংগঠন ও শিক্ষার ভূমিকাকে উপলব্ধির ব্যর্থতা। কতকগুলো একপেশে, অসংলগ্ন উপায়ের সর্বরোগের দাওয়াই। রাজনীতির নেতীকরণের নামে শ্রমিকশ্রেণিকে বুর্জোয়া রাজনীতির অধীন করে তোলা।" (নৈরাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্র, সংগৃহীত রচনাবলি, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩২৭-২৮)
এমা গোল্ডম্যান সোশ্যালিস্ট অ্যানার্কিস্ট ছিলেন। এমার জন্ম রাশিয়ার জার্মানির সীমান্তে কারল্যান্ড প্রদেশে, ২৭ জুন ১৮৬৯ সালে। এমন এক সময়ে তাঁর জন্ম যখন রাশিয়ার পিতাদের সাথে পুত্রদের, কন্যাদের সাথে পিতাদের এক আপসহীন লড়াই চলছে। ইভান তুর্গেনেভের 'পিতারা ও পুত্ররা' বের হয়েছে তাঁর জন্মেরও ৭ বছর আগে। সেই সময় রাশিয়ার নতুন প্রজন্ম পুরাতন বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, পরিবার ও রাষ্ট্রের একনায়কসুলভ আচরণ, ধর্ম ও চার্চের বন্ধন থেকে নিজেদের মুক্ত করার এক দুর্মর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সব কিছু ভেঙে-চুরে এক নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখছে।
এমাকে তার বাবা-মা নানিবাড়ি থেকে রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে নিয়ে আসেন ১৮৮২ সালে। আগের বছর 'পিপলস্‌ উইলস্‌'-এর হাতে জার আলেক্সান্দার-২ খুন হয়েছেন। সোফিয়া পেরোভস্কায়া, ঝিলিয়াবভ, গ্রিনেভিতঝস্কি, রিসাকভ, কিবালচিতখ ও মিখাইলভকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। প্রেগন্যান্ট থাকায় জেসি হেফম্যানকে ফাঁসি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তরুণ এমা ক্ষমতা, জারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের স্বাধীনতার লড়াই দেখে বড় হচ্ছেন- সময়টা তখন এমনই। এটি এমন এক সময় যখন লিঙ্গভেদ ভুলে রাশিয়ার নারী-পুরুষ একসঙ্গে লড়ছে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এমা তখন রাশিয়ান বিপ্লবী লেখকদের বইপত্র পড়তে শুরু করেন। ইউজিন মার্লিটের রোমান্টিক বইয়ের জায়গায় তিনি পড়তে শুরু করেন নেক্রাসেভ ও তারনেশেভস্কি।
এই যুগের লড়াইয়ের ঢেউ লাগে গোল্ডম্যান পরিবারেও। চিন্তার স্বাধীনতা বলে পরিবারে কিছু ছিল না। ফলে এমা কী ভাবে, তাতে পরিবারের কারো আসে যায় না। এমার কাছে পরিবারকেও তখন একটা কারাগার মনে হতে থাকে। একমাত্র বড় বোন হেলেনাই ছিল তার প্রতি সমব্যথী। টিনএজার এমা স্কুলে ভর্তি হতে বাবাকে অনেক অনুনয় করে শুধু ব্যর্থই হয় না, তার বইপত্রে আগুন দিয়ে তার বাবা বলেন, -মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করতে হয় না। ইহুদি মেয়েদের শেখা উচিত কীভাবে জেফিলেট ফিশ প্রস্তুত করতে হয়, কীভাবে নুডলসগুলো সুন্দর করে কাটতে হয় এবং অধিক সংখ্যক সন্তান জন্ম দিতে হয়-।
এমা দেখে শত শত নারী-পুরুষ ক্যারিয়ার ছেড়ে পিপলস উইলসে যোগ দিচ্ছে। পরিবারের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এমাও একটি করসেট শপে কাজ নিতে বাধ্য হন। এমা প্রথম কিছুটা স্বাধীনতার স্বাদ পায়। আর একই সাথে সে সেল্কম্ফ এডুকেটেড হতে শুরু করে। এমা সেই সময় নিকোলাই চেরনিশেভস্কির লেখা উপন্যাস 'কী করিতে হইবে?' পড়েন এবং ঐ উপন্যাসের নায়িকা 'ভেরা' তার জীবনের ওপর শুধু ছাপই ফেলে না, তিনি ঊনবিংশ শতকের অন্যান্য রুশ নারী বিপ্লবীর মতোই ভীষণভাবে প্রভাবিত হন।
এমার বয়স যখন ১৫ তখন তার বাবা বিয়ের জন্য চাপ দেন এবং বিয়েতে রাজি না হওয়ায় তার বাবা তাকে 'চরিত্রহীন' বলে আভিহিত করেন। তবে সে জানায়, ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো কারণে সে বিয়ে করবে না। করসেট শপে তখনও তিনি কাজ করেন এবং সেই সময় একটি হোটেল রুমে তিনি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, যাকে এমা বলেছেন, 'সহিংস ঘটনা' এবং তার দু'জন জীবনীকার অন্তত সেটিকে 'ধর্ষণ' বলে অভিহিত করেছেন। এই ঘটনার কিছুদিন পর তার বৈমাত্রেয় বোন হেলেনা আমেরিকার নিউইয়র্কে তার অন্য বোন লেনা ও তার স্বামীর কাছে চলে যেতে চাইলে এমাও তার সাথে যেতে জেদ করেন এবং তার বাবা তাতে বাধা দেন। বাধ্য হয়ে এমা বলেন তাকে যেতে না দিলে তিনি নেভা নদীতে ডুবে মরবেন। অবশেষে তার বাবা রাজি হলে ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বরে তিনি আমেরিকা পৌঁছান। এমার বয়স তখন ষোলো। আমেরিকা পৌঁছে এমার প্রথম অনুভূতি হলো এরকম যে- আহ্‌ আমেরিকা! স্বাধীনতার প্রতীক!! জার নেই, পরিবার নেই, কসাক নেই, নেই চার্চের ছড়ি। এমার ভুল ভাঙে কিছুদিন পরেই। সে দেখে কসাকের জায়গায় পুলিশ; 'চিনভনিক' এর জয়গায় ফ্যাক্টরি শ্রমিক।
পরের বছর ১৮৮৬ সালের মে মাসে 'হে মার্কেটে' শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটে। পুলিশের ওপর বোমা ও গুলি নিক্ষেপের ঘটনায় আদালত ৪ জনকে ফাঁসি দেয় পারসন্স, স্পাইস, লিজ্ঞ, ফিশার ও এঞ্জেলকে। তারা সবাই অ্যানার্কিস্ট। এমা দেখল রাষ্ট্র নির্মম- কাকুতি-মিনতি করে লাভ নেই। এক্ষেত্রে স্বৈরতান্ত্রিক জারের রাশিয়া আর 'গণতান্ত্রিক' আমেরিকার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।
আমেরিকা এসে এমা যোগ দেয় গারসন কোম্পানিতে- একটি সেলাই কারখানায়। সপ্তাহে ২.৫ ডলার মজুরিতে। ভোর থেকে রাত ১৪/১৫ ঘণ্টা কাজ- শ্রমিকরা দিনের আলো দেখতে পায় না। নারী শ্রমিকরা ফোরম্যান ও মালিকদের ভোগের শিকার হয়, প্রতিবাদ করলে তাদের রাস্তায় বের করে দেওয়া হয়। সেই কারখানায় এক শ্রমিকের সাথে তার পরিচয় হয় এবং তাকে বিয়ে করে। আর বিয়ের রাতেই এমা আবিস্কার করেন তার স্বামী একজন নপুংশক। এমা তার স্বামীকে ছেড়ে যেতে চাইলে তার স্বামী জ্যাকব কার্শনার বারবার আত্মহত্যার হুমকি দিতে থাকে। এমা দেখে বিয়ে নারীর জন্য আরেকটা বন্দিদশা- নিজের ও নারীত্বের অপমান।
রচেস্টার শহরে চাকরির সংকট, যেমনটা আছে পৃথিবীর সব শহরে। এমা যেতে চায় নিউইয়র্ক কিন্তু তার বাবা বলেন, 'কোন শহর ভাল?' উত্তরে এমা বলে-নিউইয়র্কে অন্তত প্রতিবাদটা আছে। বিয়ের এক বছর না পেরোতেই স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে ১৮৮৭ সালে তিনি চলে যান নিউইয়র্কে।
নিউইয়র্কে এসে পরিচয় হয় আলেক্সান্দার বার্কম্যানের সাথে, যে কিনা অ্যানার্কিস্ট এবং সেই সূত্রেই পরিচয় অন্য অ্যানার্কিস্টদের সাথে, এমনকি জোহান মোস্টের সাথেও, যিনি সোশ্যাল অ্যানার্কিজমের একজন বড় তাত্ত্বিক ও বিখ্যাত বক্তাও বটে। তার 'ফ্রিহাট' পত্রিকা বেশ বিখ্যাত। বার্কম্যানের সাথে এমার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না, আবার একই সাথে জোহান মোস্ট তাকে প্রলুব্ধ করে। বিশ বছরের একটি নারীকে যখন মধ্য বয়সী খ্যাতনামা জোহান মোস্ট বলে-তাকে বোঝার মতো, টেককেয়ার করার মতো কেউ নেই; আর এসব বলে এমাকে দুর্বল করার পাশাপাশি এমাকে একজন বক্তা হিসেবে, সহযোগী হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলে প্রলুব্ধ করে, এমার পক্ষে সেই আকর্ষণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
বার্কম্যান বারবার এমাকে সতর্ক করার পরও এমার বুঝতে কিছুটা সময় লাগে। এই ঘটনায় মোস্টের ক্রোধ গিয়ে পড়ে যতটুকু না এমার ওপর অনেক বেশি বার্কম্যানের ওপর। আর সেই প্রতিশোধ তিনি নিলেন শ্রমিক হত্যার প্রতিশোধ নিতে বার্কম্যান যখন কারখানার ম্যানেজার ফ্রিককে ব্যর্থ হত্যাচেষ্টায় ধরা পড়ে জেলে গেল। মোস্ট বক্তৃতায় বলতে লাগলেন- সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে বার্কম্যান খেলনা পিস্তল নিয়ে একজন পুঁজিপতি হত্যার নাটক করেছে। বিচারে বার্কম্যানের ২২ বছর জেল হয়। মোস্ট ব্যক্তিগত আক্রোশ এভাবেই মেটালেন এবং চিরদিনের জন্য এমা মোস্টের সাথে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করেন।
এমা ব্যক্তি ও রাজনীতিকে আলাদা করে দেখতেন না। তিনি বলতেন যে, 'যা ব্যক্তিগত, তাও রাজনৈতিক'। গোল্ডম্যান ক্রপোতকিনের পারস্পরিক সহযোগিতার তত্ত্বকে নিটশে এবং ইবসেন প্রভাবিত ব্যক্তি স্বাধীনতার তত্ত্বের সাথে মিলিয়ে নিলেন।
যৌনতা এবং প্রজনন সম্পর্কে এমার ধারণাগুলো প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক এবং সেগুলো তার জীবনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। তার জার্নাল 'মাদার আর্থ'- এ সমকামিতার পক্ষে তিনি লেখালেখি করেন এবং সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমকামিতা নিয়ে প্রচুর বক্তব্য রাখেন। এমা সম্ভবত সেই ব্যক্তি, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওই সময়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে এই বিষয়গুলো নিয়ে যাবার জন্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। একই সাথে তিনি অ্যানার্কিস্ট তত্ত্বে যৌনতা এবং প্রজনন শ্রমের বিশ্নেষণ করেন। আর এটা করতে দিয়ে তিনি ক্রপোতকিনের মতো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। কারণ অন্যরা যৌনতার মতো বিষয়গুলো দেখেছিলেন রাজনৈতিক তত্ত্বের বাইরে। পারিবারিক সমস্যা এবং গার্হস্থ্য ক্ষেত্রে প্রজননের ভূমিকাগুলো সমাজবিজ্ঞান এবং অ্যানার্কিস্টদের তত্ত্বগুলোতে সেই সময় অনুপস্থিত ছিল।
এমা দিনের পর দিন বক্তৃতা করেছেন 'জন্মনিয়ন্ত্রণ' (এমার যুক্তি- সন্তান ধারণ করা বা না করার সিদ্ধান্ত নারীর); 'প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবাহের সমস্যা' (এমার বক্তব্য-প্রেমের সাথে বিবাহের কোনও সম্পর্ক নেই'); 'দেশপ্রেম' (যা, এমার কাছে বিড়ম্বনার শেষ আশ্রয়), এবং 'মুক্ত ভালোবাসা' নিয়ে (স্বাধীন না হলে ভালোবাসা আবার কী?)।
জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এমা বলতেন,-আমার বিচার হতে পারে, আমাকে জেলে নেওয়া হতে পারে কিন্তু আমি চুপ করে থাকবো না, আমি পরাজয় মানবো না, রাষ্ট্রের কাছে নতিও স্বীকার করবো না; আমি এই সিস্টেমের সাথে কোনো আপসও করবো না- যে সিস্টেম নারীকে ইনকিউবেটরে রেখে নিরাপদ শিকারে পরিণত করে। আমি এখন, এই মুহূর্ত থেকে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছি এবং যতক্ষণ না একটি স্বাধীন মাতৃত্ব, একটি সুস্থ, আনন্দময় ও সুখী শৈশবের পথ প্রশস্ত হচ্ছে ততক্ষণ আমি বিশ্রাম নেবো না।-
১৮৯৭ সালে তিনি লিখলেন, -আমি নারীর স্বাধীনতা দাবি করি যাতে সে নিজের অধিকার, নিজের জন্য বাঁচার, যাকে খুশি তাকে ভালোবাসার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।- এমার কাছে মুক্তি কেবল বাহ্যিক অত্যাচার থেকে স্বাধীনতা নয়। তার দৃষ্টিতে, যাকে তিনি-অভ্যন্তরীণ অত্যাচারী- বলেছিলেন তা জীবন এবং বৃদ্ধির জন্য অনেক বড় হুমকি। এই অভ্যন্তরীণ অত্যাচারীরা হলো নৈতিক এবং সামাজিক নিয়ম-নীতি এবং সামাজিক ও নৈতিক নিয়ন্ত্রণের চর্চা ও কৌশল। প্রকৃত মুক্তির জন্য প্রয়োজন-কুসংস্কার, ঐতিহ্য এবং রীতিনীতির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হওয়া-।
এমা যে সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করেন তার একটি হলো- বিয়ে। তিনি মনে করতেন, 'প্রেম থেকে বিবাহ হতে পারে, তবে কদাচিৎ বিয়ে থেকে প্রেম আসে'। তার দৃষ্টিতে- বিয়ে মূলত একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, একটি বীমা চুক্তি। এটা সাধারণ জীবন বীমা চুক্তির থেকে পৃথক শুধু এই ক্ষেত্রে যে, এটি আরো শক্ত, আরো নির্ভুল। বিনিয়োগের তুলনায় এর আয় খুবই নগণ্য। একটি বীমা পলিসি গ্রহণ করার সময় কেউ তার জন্য ডলার এবং সেন্টে অর্থ প্রদান করে, তবে সবসময় তার প্রিমিয়াম বন্ধ করার স্বাধীনতা থাকে। যদি মহিলার প্রিমিয়াম একজন স্বামী হয়, তবে সে তার নাম, তার গোপনীয়তা, তার আত্মসম্মান, তার জীবন, -মৃত্যুর আগ পর্যন্ত- বহন করতে বাধ্য হয়।
এমার দৃষ্টিতে ভালোবাসা হলো জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং গভীরতম উপাদান, মানুষের আশা এবং আনন্দের আরেক নাম। ভালোবাসা সব আইনের ঊর্ধ্বে; ভালোবাসা হবে মুক্ত।
অন্যদিকে গোল্ডম্যান নারী পাচার এবং যৌন ব্যবসার আইনগত প্রতিক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। গোল্ডম্যান খেয়াল করেন যে, যারা সংস্কার চান তাদের মনোযোগ যৌন ব্যবসার প্রকৃত যারা শিকার সেই যৌনকর্মীদের প্রতি নয়। তিনি বললেন যে, 'পতিতাবৃত্তি হলো এমন এক পেশা যারা অন্যের আনন্দের জন্য (মুনাফা বা উদ্বৃত্ত মূল্য) তাদের শ্রম (তাদের দেহ) বিক্রি করতে বাধ্য হয়। শিল্প পুঁজিবাদ দরিদ্র এবং শ্রমজীবী মহিলাদের শ্রম পছন্দ সীমিত করে'।
পাশাপাশি এমা যৌনশিক্ষাকে নারীর স্বায়ত্তশাসন বাড়ানোর এবং নারীর শরীর ও শ্রমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে মনে করতেন। তিনি নিরাপদ কনডম ব্যবহারের জন্য এবং ঘরে বানানো গর্ভনিরোধক পদ্ধতির পক্ষে ক্রমাগত কথা বলেছেন। তিনি গর্ভনিরোধ, যৌনশিক্ষা এবং বিলম্বে বিয়ে বা বিয়ে না করার মাধ্যমে নারীদের বর্ধিত স্বায়ত্তশাসন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ চেয়েছিলেন। এগুলো শুধু বলেই ক্ষান্ত হন নি, প্রকাশ্যে যৌন শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করতে গিয়ে তিনি গ্রেপ্তারও হন।
১৯১৬ সালের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করলেন তখন আমেরিকার সামরিক প্রস্তুতির বিরোধিতা করতে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে তার পত্রিকা মাদার আর্থে বিরোধিতা করতে শুরু করেন। এই আন্দোলনকে চূর্ণ করতে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন দেশপ্রেমের হাওয়া তোলে পরিকল্পিতভাবে। যুদ্ধের বিরোধিতা করে এমন অন্যান্য সাময়িকীসহ মাদার আর্থকে নিষিদ্ধ করা হয়। এমা গোল্ডম্যান এবং তার সহকর্মী আলেক্সান্ডার বার্কম্যানকে ১৯১৬ সালের ১৫ জুন গ্রেপ্তার করা হয়। পরে শত শত বিদেশি বংশোদ্ভূতদের নির্বাসন দেয়া হয়, তাদের মধ্যে এমা ও বার্কম্যান উল্লেখযোগ্য। ফলে ১৯১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর, গোল্ডম্যান, বার্কম্যান এবং আরো দুশো বিদেশি-জন্মগ্রহণকারীসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্দেশে যাত্রা করে।
১৯১৯ সালে আমেরিকা থেকে বহিস্কৃত হয়ে এমা গোল্ডম্যান যখন রাশিয়া যাচ্ছেন তখন জে অ্যাডগার হুভার তাকে উল্লেখ করে লিখলেন, 'আমেরিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক নারীদের একজন'। উত্তরে এমা বললেন, 'আমেরিকা থেকে বহিস্কৃত হওয়া প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলনকারী হতে পেরে নিজেকে সম্মানিত জ্ঞান করছি।'
রাশিয়ায় গিয়ে ক্রমশ গোল্ডম্যান ও বার্কম্যান হতাশ হতে শুরু করেন এবং ১৯২১ সালে নৌ-বিদ্রোহ দমনে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার পর তারা রাশিয়া ত্যাগ করেন। ১৯৩৪ সালে সংক্ষিপ্ত নব্বই দিনের বক্তৃতা সফর ছাড়া, এমা গোল্ডম্যান তার জীবনের বাকি ১৮ বছর (১৯২২-১৯৪০) সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং কানাডায় কাটিয়েছেন। ১৯৪০ সালে এই মহান নারী কানাডায় মারা যান এবং আমেরিকাতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।