
কবি সুফিয়া কামাল সেই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, যিনি একই সঙ্গে পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রেখে গেছেন। তিনি তাঁর সমকালীন বাস্তবতা পরিবর্তনের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, লিখেছেন, কথা বলেছেন। পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন সংগঠন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। রবীন্দ্রনাথ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থকে স্বাগত জানিয়ে যে চিঠি লিখেছিলেন, সেই চিঠির ভাষাই বলে দেয় সেটা কোনো সৌজন্যমূলক বার্তা নয়; বরং আন্তরিক অভিনন্দন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বিদ্যাসাগরের কর্মস্পৃহা ইংরেজদের মতো, হৃদয় বাঙালি জননীর মতো এবং মনীষা ঋষিদের মতো। এই একই কথা কবি সুফিয়া কামালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা কাজে তিনি ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর সন্তানরাও সেভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন; মাকে অন্য অনেক মায়ের মতো সার্বক্ষণিক পাবেন না। কারণ, তিনি শুধু তাঁদেরই মা নন, তিনি জননী সাহসিকা।
সুফিয়া কামাল সাহসের সঙ্গে যেসব কথা বলে গেছেন, যে কাজ করে গেছেন, সেগুলো অনেকে উচ্চারণ করতেও ভয় পান। একাত্তরের ডায়েরীতে তিনি লিখেছেন- 'আমি বেহেশতেও যেতে রাজি নই। আমার দেশ, আমাদের দেশের মানুষেরা শান্তি পাক, এদেশে যেন আমি মাটিতে শুয়ে থাকতে পারি।' তিনি আরও বলে গেছেন- 'আমার কথা বলা হয় আমি নাকি মেয়েদের নাচিয়ে বেড়াচ্ছি। যারা বলেন, তারা হাজার টাকা দামের শাড়ির উপর তিনশ টাকা দামের বোরকা পরে। আর আমি যাদের জন্য কাজ করি, তাদের একটা মোটা শাড়িও থাকে না।'
এসব কথা সুফিয়া কামাল বলে গেছেন প্রায় চার দশক আগে। তার এসব বক্তব্যকে শুধু নারী কিংবা একটি বিশেষ পোশাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার সুযোগ নেই। বরং এখানে কবির শ্রেণি-সচেতনতা এবং শ্রেণি-সংগ্রামের যে মানসিকতা, সেটা দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। হাজার টাকা দামের শাড়ি এবং তিনশ টাকা দামের বোরকা সমাজের কোন শ্রেণি পরত, সেটা অনুমান করা যায়।
তাহলে কি কবি সুফিয়া কামাল কমিউনিস্ট ছিলেন? ১৯৯১ সালের এক সাক্ষাৎকারে কবি বলছেন- 'কোনো দলের রাজনীতি আমি করি না। সত্য প্রকাশে যে বাধা দেয়, মানবতার লাঞ্ছনা যে ক্ষেত্রে হয়, আমি তখন চুপ থাকতে পারি না। আমার বিবেক আমাকে তাড়িত করে। সেজন্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থেকেও যখন যা আমাকে আঘাত করেছে, তার প্রতিবাদ করেছি।'
ইদানীং কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নারীর মুক্তির কথা সামনে এলে বলা হয়, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, স্পিকার নারী। কেউ কেউ তালিকাকে আরও দীর্ঘ করেন। কিন্তু কবি সুফিয়া কামাল ১৯৯২ সালে দৈনিক ভোরের কাগজে এক সাক্ষাৎকারে বলে গেছেন- 'প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী মহিলা হলেই নারীমুক্তি হয় না। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ন করতে হবে।'
একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসে কবি কি আঁচ করতে পেরেছিলেন, আমরা যে তিমিরে আছি, সেই তিমিরেই থেকে যাব? তাই তো ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি এসে কবি বলছেন- একুশ শতক, আমি যেন না দেখি। একুশ শতকের মানুষেরা যদি মানবধর্ম পালন না করে, তাহলে একুশ শতকের কোনো মূল্য নাই। আবার যেহেতু তিনি রবীন্দ্রনাথের কথায় আস্থা রাখতেন, তাই মানুষের ওপরে বিশ্বাস হারানোকেও নিশ্চয়ই পাপ জ্ঞান করতেন। তাই এ বক্তব্যের সঙ্গেই তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন- বাঙালির জীবনে একুশ শতক আসছে, নারী ও শিশুর ওপর আর নির্যাতন হবে না, তা জনগণ প্রতিষ্ঠা করবে এটা আমার বিশ্বাস।
জননী সাহসিকার ২৩তম প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মন্তব্য করুন