- ফিচার
- অন্য এক আলোর 'দেশান্তর'
অন্য এক আলোর 'দেশান্তর'

'দেশান্তর' সিনেমায় রোদেলা সুহাসিনী টাপুর ও ইয়াশ রোহান
তিন কারণে দেশান্তর দেখলাম। এক কবি নির্মলেন্দু গুণ, দুই আশুতোষ সুজন, তিন ইয়াশ-টাপুর। টিভি নাটকে আশুতোষ সুজন আমার প্রিয় পরিচালকদের একজন। পাশাপাশি ইয়াশ রোহান আমার ছবি 'মায়াবতী'তে কাজ করেছে আর টাপুরের প্রথম সিনেমায় অভিনয়। কবি নির্মলেন্দু গুণ সবসময়ই বড় কবি। লেখক। তাঁর লেখা 'দেশান্তর' সিনেমার গল্পে তার সাক্ষ্য মেলে। এতটা মানবিক, দেশপ্রেম তুলনাহীন। হিন্দু পরিবারগুলো দেশ ছেড়ে যাওয়ার নির্মম সব গল্প। সংকট তৈরি হয় সদ্য বিবাহিত ইয়াশ-টাপুরের ভারত যাওয়ার কাহিনিতে। টাপুর যেতে চায় না। ইয়াশ মা-বাবার বাধ্য ছেলে।
সালিশ বসে বাড়ির আঙিনায়। গ্রাম্য মাতব্বর মামুনুর রশীদ। সালিশে এক পাশে মা-বাবাসহ ইয়াশ। বাবা-মা সুভাশিষ ভৌমিক ও মোমেনা চৌধুরী। অন্যদিকে টাপুরের মা-বাবা আহমেদ রুবেল ও চলচ্চিত্রের মৌসুমী [মৌসুমী অনেকেই আছেন, চলচ্চিত্রের একজনই বিশেষ পরিচিত]। শিল্পীদের নামগুলোতেই বোঝা যায় নির্মাতা এই জায়গাতে আপস করেননি। সুঅভিনয়ে সেই সাক্ষ্যও মেলে। মন ভরিয়ে দিয়েছে সবার অভিনয়। বিশেষ করে ছবির অন্যতম অভিনেত্রী টাপুরের কথা বলতে হয়। ছবি দেখে মনে হয়নি টাপুর জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রে কাজ করেছে।
বলা যায়, যোগ্য মা-বাবার যথাযথ কন্যা টাপুর। আমি আমার অনুমান থেকে বলতে পারি, আগামীকালের সুঅভিনেত্রী হতে চলেছে টাপুর। অন্যদিকে গ্রামের মাতব্বর মামুনুর রশীদ। তাঁর অসাধারণ অভিনয়ের কথা আলাদাভাবে কিছু বলার নেই। বরাবরের মতো দারুণ সুন্দর কাজ ছিল তাঁর। ছোট্ট এক চরিত্র। কিন্তু তাঁর অভিনয়ের ব্যাপ্তি মাত্রা দিয়েছে। যেমন আহমেদ রুবেল কাজ করেছেন। তাঁর অভিনয়ের গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। করেছেনও তেমনই তিনি। এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন বেগবান। 'স্বাভাবিক' অভিনয়ে দর্শক হৃদয় কেড়েছেন রুবেল।
মৌসুমী যথার্থ অভিনয়ে মুগ্ধ করেছেন। পাশাপাশি মোমেনাও মন কেড়েছেন, যেমন তিনি করেন। বিশেষত অশোক ব্যাপারীর নাতিদীর্ঘ কাজ। নতুন রসায়ন ছিল তাঁর কাজে। তাঁর দেশত্যাগ, আপন ভিটার প্রতি ভালোবাসা মোচড় দেয়। চোখের জল ধরে রাখা দুরূহ। এক পর্যায়ে হলভর্তি দর্শককে আদৃত করে। করে আবিষ্ট। একজন সুঅভিনেতা কতটা বাঙ্ময় করে তোলেন চরিত্র চিত্রণে, অশোকের কাজ তা স্পষ্ট করে তোলে ছবিটিতে। যেমন স্পষ্ট করলেন বাবার ভূমিকায় সুভাশিষ ভৌমিক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মায়ের চরিত্রের মোমেনা। যেমন অভিনয়, তেমনি চরিত্র ফুটিয়ে তোলা তাঁর। অংশত ভিলেন তিনি। কিন্তু অভিনয়ে নতুন মাত্রা দান করেন ছবিটিতে।
'দেশান্তর' ছবির নদীর পাড়ের গ্রামের দৃশ্যপট অসাধারণ হয়েছে। বিশেষ করে দিনের দৃশ্যগুলো। কিন্তু সন্ধ্যার পর বিশেষ করে রাতের নৌকাগুলোয় আলোর ব্যবহারে দুর্বলতা দেখা গেছে; যা পরিচালকের নয়; সিনেম্যাটোগ্রাফারের দুর্বলতা। সুজন আরও একজন দক্ষ চিত্রগ্রাহক বাছাই করলে হয়তো বেশি সঠিক হতো। সিনেমার কয়েকটি দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে, পরিচালক সিনেমা নয়, নাটক নির্মাণ করেছেন। তবে সিনেমার বেশ কয়েকটি ট্রলি শট দারুণ লাগে। মুভমেন্ট শট আরও থাকলে ভালো হতো। আরও প্রাণবন্ত লাগত। তারপরও বলতে হয়, এটিই হয়তো পরিচালকের নিজস্বতা। স্ট্যাটিক শটে তাঁর আগ্রহ।
ছবির আবহ সংগীত আরও ভালো হতে পারত। এখানে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। প্রখ্যাত নির্মাতা সত্যজিৎ রায় তাঁর 'পথের পাঁচালী' ছবির আবহ সংগীত করিয়েছিলেন পণ্ডিত রবি শংকরকে দিয়ে। যদিও সত্যজিৎ নিজেও একজন অসাধারণ সংগীতবোদ্ধা ছিলেন। ছবির অ্যামবিয়েন্স আরও ভালো হতে পারত। এ ক্ষেত্রে পরিচালকের অন্তরায় বাজেট। অনুদানের ছবির বাজেট সাধারণত কত হয়, তা আমাদের জানা। ব্যান্ড পার্টির ভিজুয়াল ব্যবহারও স্পর্শ করে না অনেক দর্শককে। যেমন প্রত্যাশিত ছিল না ভাষার ব্যবহার। ময়মনসিংহের গুরুচণ্ডালি সংলাপ কানে বিঁধে মাঝেমধ্যে।
প্রয়োজন ছিল বৃষ্টির ব্যবহারও, মেঘের গর্জনে হুটহাট বর্ষা ভালো লাগেনি। যেমন ভালো হয়নি ছবিটির প্রচার ও প্রসারের আয়োজন। মুম্বাইয়ের কোনো সিনেমা আর আমাদের দেশের মূলধারার সিনেমার প্রচার যেভাবে করা হয়, তার কণামাত্র ছিল না দেশান্তর সিনেমার ক্ষেত্রে। কারণ একটি সিনেমার মূল প্রাণ দর্শক। দর্শক হলে যাওয়ার তাড়না অনুভব করেন প্রচারের মাধ্যমে। শুধু কিছু পোস্টারের ব্যবহার, ইউটিউব আর অনলাইনে গান প্রকাশের মাধ্যমে হলমুখী হন না দর্শককুল। পরিচালকের এই বিষয়ে যথেষ্ট যত্নবান হওয়ার প্রয়োজন ছিল। যাই হোক, যেহেতু সুজনের এটি প্রথম সিনেমা, তাই আশা করছি, আগামীতে তিনি আরও যত্নবান হবেন।
মন্তব্য করুন