দেশে ছোট-বড় নানা শিল্পদুর্ঘটনা ঘটলেও তাজরীন ফ্যাশনস ও রানা প্লাজা বিপর্যয় ছিল সবচেয়ে হৃদয়বিদারক। প্রায় সাড়ে ১২শ শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে এতে। আহত হন আরও অনেকে। পাশাপাশি প্রভাব পড়ে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্পে। তখন ভবন নির্মাণ এবং কারখানার কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষ থেকে আসতে থাকে একের পর এক কঠিন শর্ত, যার মূল কথা হলো- রপ্তানির জন্য অবশ্য কারখানা ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এসব শর্তের অন্যতম একটি হলো অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষ থেকে দেওয়া শর্ত এবং সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের ফলে পরবর্তী সময়ে অনেক কলকারখানা ও বাণিজ্যিক ভবন অগ্নিনিরাপত্তায় মনোযোগী হয়েছেন মালিকরা। বাসাবাড়ির মালিকরা এখন আগের চেয়ে বেশি সচেতন। সব মিলিয়ে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা জোরদার করতে বাড়ছে বিভিন্ন অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ও সরঞ্জামের চাহিদা। এর ফলে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে এসব পণ্যের বাজার। এক দশক আগের শতকোটি টাকার বাজারের আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে এখন প্রায় হাজার কোটি টাকায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শতভাগ আমদানিনির্ভর এ খাতের পণ্য আমদানিতে করহার কমানো দরকার। দেশেই এসব পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া কিছু নীতি-সহায়তা দিলে খাতটির দ্রুত বিকাশ ঘটবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এক সময় রপ্তানি করাও সম্ভব হবে।

কেন ঘটছে দুর্ঘটনা

বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরগুলো দ্রুত নগরায়ণ হলেও এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি শ্নথগতির। দিন দিন উঁচু ভবনে ঠাসা শহরে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বরাবরই উপেক্ষিত। বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুযায়ী, যে কোনো স্থাপনা নির্মাণের সময় ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। উঁচু ভবনের ক্ষেত্রে এসবের সঙ্গে ফায়ার ডিটেক্টর, স্মোক ডিটেকটর এবং স্প্রিংকলা সিস্টেমও রাখতে হয়। কিন্তু দেশে বেশিরভাগ ভবন নির্মাণে এসব কোড ঠিকমতো মানা হয় না, যার ফলে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটে।

সম্প্রতি ইলেকট্রনিকস সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইসাব) এবং ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স যৌথভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বর্তমানে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ১ হাজার ১৮৭টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ ৩ হাজার ৫১৮টি স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতে রয়েছে ১ হাজার ৬৯টির বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২ হাজার ৫৮৩টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা। ঢাকায় এসব বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় গড়ে উঠেছে অফিস, গার্মেন্ট, শিল্পকারখানা, মার্কেট ও শপিংমল। এর মধ্যে অনেকেরই সংশ্লিষ্ট সংস্থার বৈধ অনুমোদন নেই। মানা হয়নি বিল্ডিং কোড। অনেক কারখানায় ছোট ছোট কক্ষে বসানো হয়েছে ভারী যন্ত্রপাতি। নেই ওঠানামার জন্য প্রশস্ত সিঁড়ি বা জরুরি বহির্গমনের আলাদা পথ।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ হলো- নিয়ম না মেনে ভবন বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা। স্থাপনা নির্মাণের পর অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটতে পারে যেসব কারণে, সেগুলো নিরসনে পরিকল্পনা না থাকা। নিজেদের স্বার্থেই প্রতিটি স্থাপনায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এক সময় অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম নিয়ে মানুষের মাঝে তেমন ধারণা না থাকলেও বর্তমানে একটি সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হয়েছে এটি। যদিও দেশে এসব পণ্য শতভাগ আমদানিনির্ভর। এর প্রধান ভোক্তা পোশাক শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যিক ভবন। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পেও এসব সরঞ্জাম ব্যবহার হয়। এই খাতে মূল লক্ষ্য হলো, যে কোনো ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। চাকরির বাজারেও এগিয়েছে খাতটি। অনেক তরুণেরই এখন আকর্ষণের জায়গা ফায়ার সেফটি, সিকিউরিটি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাত। এ খাতে ইতোমধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি কারিগরি বা প্রকৌশলীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমাগত বড় হচ্ছে এর পরিধি।

হয়ে উঠছে সম্ভাবনাময় খাত

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতটি বেশ সম্ভাবনাময়। সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আমদানিনির্ভরতা কমানোর জন্য দেশেই এসব পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করা দরকার। এ খাতের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা যেতে পারে। পাশাপাশি সরকারকে ব্যবসাবান্ধব নীতি-সহায়তা দিতে হবে।

এ বিষয়ে ইসাবের সভাপতি জহির উদ্দিন বাবর সমকালকে বলেন, প্রতিটি ভবনেরই অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। দেশে ভবন যত বাড়ছে, এসব সরঞ্জামের বাজারও তত বড় হচ্ছে। বর্তমানে তিন শতাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা অগ্নিনির্বাপণ ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত সরঞ্জামাদির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ক্রমান্বয়ে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে এ খাতের ব্যবসায়। ফলে এর বাজারের আকার দিন দিনই বাড়ছে।

চ্যালেঞ্জও কম নয়

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আমদানিতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক্ককর অনেক বেশি। ফায়ার ডোর, ফায়ার অ্যালার্ম কেবল ও হোস রিল আমদানিতে ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ শুল্ক্ক দিতে হয়। এ ছাড়া গেটভাল্ক্ব আমদানিতে দিতে হয় ৩৭ শতাংশ, ফায়ার পাম্প ও ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেমে (ডিটেক্টর) ২৬ দশমিক ২ শতাংশ, ফায়ার এক্সটিংগুইশার ১১ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ ও এবিসি ড্রাই পাউডারে ৩১ শতাংশ শুল্ক্ক দিতে হয়। এভাবে কোনো কোনো পণ্য আছে, যেগুলো আমদানিতে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক্ককর দিতে হয়। এ কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে অনেক সময় পর্যাপ্ত অগ্নিপ্রতিরোধী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

কার্বন ডাই-অক্সাইড, ফোম, ড্রাই পাউডারসহ অন্যান্য আগুন প্রতিরোধী গ্যাস ও রাসায়নিক আমদানিতে আলাদা অনুমতির দরকার হয়। কারণ এসব পণ্য আমদানিকারকদের অযথা হয়রানির শিকার হতে হয়।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের এক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ১৯৯৬ সালে সারাদেশে মোট ৫ হাজার ৩৭৬টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬৩ কোটি টাকা। এর পর পর্যাক্রমে বেড়ে সর্বশেষ ২০২১ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ২২২টি। এসব অগ্নিকাণ্ডে ২ হাজার ৫৮০ জন নিহত হন এবং প্রায় ১২ হাজার জন আহত হয়েছেন। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৩০ কোটি টাকার বেশি। এসব পরিসংখ্যানেই বোঝা যায়, অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাজারে যেসব অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বিক্রি হয়, তার একটা বড় অংশ আমদানি করা হয়। বেশিরভাগ আসে চীন থেকে। অগ্নিনির্বাপণ অর্থাৎ আগুন নেভানোর কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ফায়ার অ্যালার্ম, স্মোক ডিটেক্টর বা হিট ডিটেক্টর। এ ছাড়া এবিসি, কার্বন ডাই-অক্সাইড সিলিন্ডার, ফায়ার বাকেট, স্ট্যান্ড, মাস্ক, হোস পাইপও রয়েছে।

দরদাম

অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ও সরঞ্জামের দাম নির্ভর করে এর মানের ওপর। সাধারণত ৬০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় পাওয়া যায় ফোম, ড্রাই পাউডার ও ফায়ার এক্সটিংগুইশার। কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের এক্সটিংগুইশারের দাম ২ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা। ৩০০ থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায় ফায়ার অ্যালার্ম, স্মোক ডিটেক্টর বা হিট ডিটেক্টরের মতো যন্ত্রাংশ। এ ছাড়া ফায়ার বলের দাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা।

কোথায় পাবেন

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় নবাবপুর, গুলিস্তান, হাটখোলা, পুরান ঢাকার এলাকাগুলোতে। এ ছাড়া অনলাইন দোকান যেমন- দারাজ ডটকম, অথবা ডটকম, আজকেরডিল ডটকমসহ বেশ কিছু অনলাইন শপে যন্ত্রটি পাওয়া যায়।