চোখের ছানি রোগের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। তবে আমাদের সেই ছানির ধারণা মূলত বড়দের ঘিরেই। শিশুদের ছানির কারণ কিন্তু একটু ভিন্নতর। ছানি জিনিসটি কী, সেই ধারণা পেলেই শিশুদের ছানির ব্যাপারটিও পরিস্কার হয়ে যাবে। আমাদের চোখে এক ধরনের লেন্স রয়েছে, যার কাজ চোখে আলোর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং দেখতে সাহায্য করা। কোনো কারণে লেন্সটি স্বচ্ছতা হারিয়ে ফেললে তখন চোখে আলো প্রবেশ বাধাপ্রাপ্ত এবং দেখার কাজটি বিঘ্নিত হয়। প্রাকৃতিক লেন্সের স্বচ্ছতা হারানোর এই অবস্থাটিকে বলা হয় ছানি বা ক্যাটারেক্ট।
বয়স্কদের মাঝে ছানি বেশি দেখা গেলেও অনেক শিশু চোখে ছানি নিয়ে জন্ম নিতে পারে। এটিকে বলা হয়, কনজেনিটাল ক্যাটারেক্ট বা জন্মগত ছানি।
জন্মগত ছানির ক্ষেত্রে জেনেটিক প্রভাব বা ক্রোমোজমের ত্রুটি, অন্তঃসত্ত্বাকালীন সংক্রমণ যেমন- রুবেলা, টক্সোপ্লাজমা, সাইটোমেগালো ভাইরাস, ভেরিসেলা ভাইরাস, সিফিলিস, এইচআইভি ইত্যাদি এবং মেটাবলিক ডিসঅর্ডার যেমন- ডায়াবেটিস অন্যতম।
বয়স্কদের ছানি হলে দেখার সমস্যা হয় এবং এই সমস্যাটি সাময়িক। কোনো একসময় অপারেশন করে লেন্সটি প্রতিস্থাপন করলে সমস্যা কেটে যায়। কিন্তু শিশুদের ছানি বেশ জটিল। কারণ জন্মের সময় শিশু আংশিক দৃষ্টি নিয়ে জন্মায় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি পরিপকস্ফতা লাভ করে। এতে পাঁচ-ছয় বছর সময় নিয়ে থাকে। এই সময়ে যদি শিশুদের চোখে ছানি বা পর্দা পড়ে যায়, তবে দৃষ্টি পরিপকস্ফতা লাভে ব্যর্থ হয়। এই অবস্থাটিকে বলা হয়, অলস চোখ বা এমব্লায়োপিয়া। এটি সময়মতো চিকিৎসা না হলে স্কুইন্ট বা ট্যারা চোখের মতো জটিলতা দেখা দেয়। এ জন্য জন্মগত ছানি দ্রুত শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
জন্মগত ছানি শনাক্তকরণে কয়েকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- শিশু কোনো কিছুর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে কিনা, আলোর উৎসের দিকে তাকায় কিনা, খেলনা ইত্যাদি ধরার চেষ্টা করে কিনা, চোখে ট্যারা ভাব আছে কিনা, নিসটেগমাস বা চোখে কাঁপুনি ভাব আছে কিনা ইত্যাদি। ট্যারা ভাব ও নিসটেগমাস বা চোখে কাঁপুনি থাকলে এটি খারাপ লক্ষণ।
ছানির একমাত্র চিকিৎসা হলো অপারেশন। প্রাথমিক অবস্থায় লেন্স অপসারণ এবং পরে কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন। অনেকেই প্রথমেই কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন করে। এটি নির্ভর করে অপারেশনের সময় শিশুর বয়স এবং এক চোখ না দুই চোখে ছানি তার ওপর। কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন করলে অথবা না করলেও চশমার প্রয়োজন হবে। কনজেনিটাল ক্যাটারেক্ট এবং অপারেশন-পরবর্তী সারাজীবন এর ফলোআপ প্রয়োজন হয়। কারণ জন্মগত ছানির বিষয়টি অপারেশন পরবর্তীকালে দীর্ঘমেয়াদে বয়স্কদের মতো জটিলতাবিহীন নয়। দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার মধ্যে গ্লুকোমা ও রেটিনাল ডিটাচমেন্ট অন্যতম।
জন্মগত ছানি মানে সারাজীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দৃষ্টি। তাই ছানি হলে যেমন দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি, তেমনি ছানি যাতে না হয়, অর্থাৎ জন্মগত ছানি প্রতিরোধও জরুরি। কোন শিশু ছানি নিয়ে জন্মাবে আগে থেকে সেটি জানা না গেলেও কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে অনেক সময় রোগটি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তা হলো, অন্তঃসত্ত্বাকালীন মায়ের সঠিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা। বিশেষ করে ভাইরাসের সংক্রমণ, মেটাবলিক ডিসঅর্ডার ইত্যাদি বিষয় অ্যান্টিনেটাল চেকআপে থাকলে আগেই দৃষ্টিগোচর হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। আবার ক্রোমোজমের ত্রুটির বিষয়টিও অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিনেটাল চেকআপে দৃষ্টিগোচর হলে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মাকে আগে থেকেই সতর্ক করা সম্ভব। মেটাবলিক ডিসঅর্ডার বা অন্তঃসত্ত্বা মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে, তা আগেভাগে ধরা পড়লে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সব ক্ষেত্রেই যে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে, তা নয়। তবে আগে থেকে বিষয়টি জানা এবং প্রস্তুতি থাকলে জন্মগত ছানির ক্ষেত্রে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ার কাজটি সহজতর হবে।া

[ভিসি বিএসএমএমইউ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন, চেয়ারম্যান চক্ষু বিভাগ, বিএসএমএমইউ]