
সপ্তাহ দুই আগে একটি ছবি ফেসবুকের নীল পর্দায় দেখা গেল। বুড়িগঙ্গা নদীতে একটি ছোট আকারের লঞ্চের ছাদে কয়েকজন গোল হয়ে বসে আছেন। সবাই মোনাজাতের ভঙ্গিতে বসা। মাথায় টুপি। তাঁদের মাঝে একজন আছেন মৌলবি। প্রথম দেখায় মনে হবে স্বাভাবিক ঘটনা- যেনবা নদীতে নতুন লঞ্চের যাত্রা উপলক্ষে দোয়া মাহফিল। ভালো করে তাকাতেই দেখা গেল পেছনেই রয়েছে একটি ব্যানার। ব্যানারের লেখা পড়ে প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না! পরক্ষণেই মনে হলো, আরে! যাঁরা মোনাজাত ধরে বসে আছেন, তাঁদের সবার শরীরেও তো একই রকম পোশাক। ছবিতে টানানো ব্যানারে লেখা- আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সাফল্য কামনায় বিশেষ দোয়া! মোনাজাত ধরে বসে থাকা সবার শরীরে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের জার্সি।
এই একটি ছবি দিয়ে কাতার ফুটবল বিশ্বকাপের ২২তম আসরের উত্তাপ বুঝি টের পাওয়া গেল। মধ্যপ্রাচ্যের মরুর দেশ কাতারে 'দ্য গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ'খ্যাত ফুটবল বিশ্বকাপের ঢেউ এসে লেগেছে বঙ্গোপসাগরের বদ্বীপ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। বিশ্বকাপে এবার অংশ নিয়েছে ৩২টি দেশ। অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় বাংলাদেশ না থাকলেও উৎসবের কোনো কমতি নেই। শহর, গ্রাম ও পাড়া-মহল্লায় উড়ছে প্রিয় ফুটবল দলের পতাকা। রাস্তায় নামলে চোখে পড়ছে প্রিয় দলের জার্সি পরিহিত সমর্থকদের। এটা তো গেল অ্যাকচুয়াল দুনিয়ার ছবি! ভার্চুয়াল দুনিয়া হিসেবে পরিগণিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে আবার তাকাই। ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার, কাভার পিকচার থেকে শুরু করে মাই ডে স্টোরি এবং সদ্য চালু হওয়া রিল জুড়েও বিশ্বকাপের আলো ঝলমল ছবি। সেখানেও প্রিয় দলের জার্সি পরিহিত ছবি। আবার প্রিয় খেলোয়াড়ের ছবি পোস্ট করে শুভকামনা জানাচ্ছেন অনেকে।
ফেসবুকে বিশ্বকাপের আঁচ টের পাওয়া যায় অতীতের ফলাফল অনুসারে তুলনামূলক বড় দলের খেলাকে কেন্দ্র করে। মাঠের খেলার প্রতিযোগিতা শুরুর আগেই ফেসবুকে শুরু হয়ে যায় পক্ষ-বিপক্ষের লড়াই! এই লড়াই চলে অতীতের পরিসংখ্যান ঘেঁটে। সেখানে হাজির করা হয় নানা তথ্য-উপাত্ত। প্রিয় দল বিষয়ে, দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে একেকজন যেন উইকিপিডিয়া! একই সঙ্গে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যত রকম তথ্য আনা দরকার, সবই দেখা মেলে ফেসবুকের দেয়ালে। বাংলাদেশের ফুটবল অনুরাগীদের দলে দলে বিভক্ত হয়ে লড়াইয়ের আরেকটি মজার দিক হলো- তাঁরা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নানা কোড ব্যবহার করেন। যেমন- আর্জেন্টিনা কবে চার গোল খেয়েছিল জার্মানির কাছে, তা স্মরণ করে বলা হয় এক হালি ডিমের উদাহরণ টেনে। আবার ব্রাজিলের ৭ গোলে পরাজয়কে স্মরণ করা হয় 'সেভেন আপ' উচ্চারণের মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশে ফুটবলভক্তের একটি বড় অংশ আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সমর্থক। এর বাইরে জার্মানি, ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, স্পেনের সমর্থকও রয়েছেন। তবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়েই মাতামাতিটা বেশি। আবার খেলোয়াড়দের মধ্যে মেসি-নেইমার-রোনালদোকে নিয়ে আড্ডাও বেশ সরব। অতীতে কার কী রেকর্ড, গোলের পরিসংখ্যান, সাম্প্রতিক ফর্ম- এসব নিয়ে চলে চুলচেরা বিশ্নেষণ। আবার কোন খেলোয়াড় খেলার মাঠে কী আচরণ করেন, তা নিয়ে হয় হাসাহাসি ও পরিহাস। যেমন- ব্রাজিলের নেইমারকে বলা হয় 'অভিনেতা'! বিশ্ববিদ্যালয়পড়ূয়া এক তরুণী ফেসবুকে লিখেছেন- খেলার সময়ে মাঠে যাতে বাতাস না ঢুকে পড়ে, সেদিকে ফিফার নজর দিতে হবে। নইলে নেইমার উল্টে যেতে পারেন! সেখানে তরুণীর ভাই এসে কমেন্ট করেছেন- আর্জেন্টিনার সাপোর্টাররা হচ্ছে কল্পলোকের বাসিন্দা। একই পোস্টে এই দুই তরুণ-তরুণীর বাবা এসে কমেন্ট করেছেন- ঠিক আছে পরেরবার তোমাদের কাউকে সেভেনআপ কিংবা এক হালি ডিম দেওয়া হবে না। আরও ভালো কিছু দেওয়া হবে। মন্তব্যের সঙ্গে তিনি জুড়ে দিয়েছেন একটি জার্মানির পতাকা। বোঝা গেল তিনি জার্মানির সমর্থক।
ফেসবুকে একটি জনপ্রিয় বিষয় হচ্ছে- সমসাময়িক বিষয় নিয়ে মিম তৈরি। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়েও এমন অসংখ্য মিম দেখা যাচ্ছে ফেসবুকে। এমনই এক পেজে দেখা গেল মেসির হাতে প্লাস্টিকের বদনা ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, বিশ্বকাপের বদলে বদনা উপস্থাপন করা হয়েছে। আবার আরেক পেজে দেখা গেল নেইমারের হাতে লাউয়ের ছবি দেওয়া হয়েছে। এসব মিম তৈরি করা হচ্ছে নিছক আনন্দের জন্য।
বিশ্বকাপ ফুটবলের মৌসুমে সংবাদমাধ্যমেও অনেক মজার খবর প্রকাশ হয়। প্রিয় দলের জার্সি শরীরে চাপিয়েই নয় কেবল, কেউ কেউ পুরো বাড়ি রং করেছেন আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকার রঙে। আবার গ্রামের মেঠোপথে কয়েক মাইলজুড়ে টানানো হয়েছে জার্মানি দলের পতাকা। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনার ব্যতিক্রমী দৃশ্য। প্রিয় দলের সাদা-আকাশি জার্সি গায়ে ফসলি জমিতে সারিবদ্ধভাবে ধান কাটার অপরূপ দৃশ্য দেখে বোঝার উপায় নেই লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনার সঙ্গে বাংলাদেশের হাজার মাইলের দূরত্ব। এ ছাড়া শহরের বাসা-বাড়ির ছাদ, দোকান ও গাড়িতে বিভিন্ন দেশের রং- বেরঙের পতাকা। বাংলাদেশের পর্যটন এলাকা রাঙামাটিতে দেখা গেছে একেবারে ভিন্ন চিত্র। শহরের চারটি ব্রিজ রাঙানো হয়েছে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের আকাশি-সাদা আর সবুজ-হলুদ রঙে। অনেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে পোস্ট করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফেসবুক যেন হয়ে পড়েছে একটি বর্ণিল প্ল্যাটফর্ম। বিশ্বে এই মুহূর্তে আলোচিত অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ, মানবিক বিপর্যয়, সুশাসন- ফুটবল যেন সব ভুলিয়ে দিচ্ছে! বিশ্বকাপের যে বাঁশি কাতারে বেজে চলেছে, সেই বাঁশির সুর-উচ্ছ্বাস বাঁধ ভেঙেছে ফেসবুকের নীল দুনিয়ায়। উৎসবের রং সর্বত্র এক, ফুটবল তা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিল। া
অমিতাভ রেজা চৌধুরী
চলচ্চিত্র নির্মাতা
১১টা ফরওয়ার্ড নিয়ে নামবে, হেল্প লাগলে আসতেছি কাতারে..
১৯৮৬ সালে প্রথম ফুটবল খেলা দেখা সকল মুরুব্বি আর্জেন্টিনা সাপোর্টারের কাছে আমি আগামীকাল ব্রাজিলের জন্য খাস দিলে দোয়া চাই।
আজকের উত্তরার রাস্তা কাতারের ডিফেন্সের মতো যেকোনো দিক দিয়ে ঢুকে পড়া যায়। কিন্তু মামা বনানী আসার পর জার্মানির ডিফেন্স, লাতিনদের ছোট পাস, চিপাচুপা কোনোদিকে কিছু নড়ানো যাচ্ছে না, ইস ব্রাজিলের ডিফেন্সটা যদি এবার বনানীর মতো হতো।
ইমতিয়াজ মাহমুদ
কবি
আর্জেন্টিনা যদি পরের ম্যাচে জিতে আর সৌদি ভাইয়ারা যদি পরের ম্যাচে ড্র করে তাহলে শেষ ম্যাচে পোল্যান্ডের সঙ্গে আর্জেন্টিনা ড্র করলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ থাকবে।
ইকুয়েশন তো এখন খুবই সহজ!
সবচেয়ে বড় ব্যাপার মেক্সিকো-পোল্যান্ড ড্র হওয়ায় আর্জেন্টিনার সেকেন্ড রাউন্ড এখন নিজেদের হাতে।
দুটি ম্যাচ জিতলে অন্য দলের দিকে আর তাকাতে হবে না।
আলহামদুলিল্লাহ ফর এভ্রিথিং।
আর্জেন্টিনার সমর্থক হওয়া একটা ভাগ্যের ব্যাপার। প্রতিবার বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্যায়ে গণিত চর্চা করতে করতে আমরা আগের চেয়েও আরও বেশি মেধাবী হয়ে উঠি।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
ুচলচ্চিত্র নির্মাতা
এই মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবলে আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় মেসি। মেসির হাতে একটা বিশ্বকাপ দেখার ইচ্ছা আমারও। কিন্তু পাশাপাশি একটা কথাও বলা দরকার। আমাদের তরুণ বন্ধুরা আজকাল এক ধরনের আতিশয্যের বশে মেসিকে ম্যারাডোনার চেয়েও ওপরে তুলে ফেলেন।
ম্যারাডোনা এবং মেসি দু'জনকেই দুর্বল সতীর্থদের নিয়ে খেলতে হয়েছে। কিন্তু এ দু'জনের মধ্যে পার্থক্য এই, ম্যারাডোনা এ পরিস্থিতিতেও একাই ম্যাচ বের করে নিয়ে গেছে বহুবার, কাপ জিতেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মেসি এই জায়গায় পিছিয়ে।
আশফাক নিপুণ
ুচলচ্চিত্র নির্মাতা
গতকাল সৌদি আরব, আজকে জাপান! আর্জেন্টিনা আর জার্মানির মতো পরাশক্তিকে হারিয়ে দিল এশিয়ানরা। বিশ্বকাপ জমে গেছে!
মোহিত কামাল
কথাসাহিত্যিক
মনোচিকিৎসক
খেয়েছে গোল আর্জেন্টিনা
পরাণ বলে ভয় পাবি না।
মেনে নেওয়া বড় কথা
তবু বুকে বাজে ব্যথা।
আর্জেন্টিনা হলো চিৎ
খেলায় আছে হারজিত।
জাকির তালুকদার
কথাসাহিত্যিক
ফুটবল আমি যতটুকু বুঝি।
আর্জেন্টিনার এই দল বিশ্বকাপ জিততে পারবে না। প্রধান কারণ, মূল খেলোয়াড়দের বয়স বেশি। স্ট্যামিনা কম। তাদের অনেকেই ইউরোপে খেলেন বটে। তবে ইউরোপের আবহাওয়ার সঙ্গে মরু-কাতারের আবহাওয়ার কোনো মিল নেই। তাই তারা এখানে গরমের কারণে স্ট্যামিনার ঘাটতিতে ভুগবেন। ব্রাজিল তুলনামূলক তরুণ দল হলেও তারা ইউরোপিয়ানদের স্ট্যামিনা এবং গতির কাছে মার খাবে। তাদের বেশি দূর যাওয়ার আসা করি না। আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো টেম্পারমেন্ট এখনও অর্জন করতে পারেনি। চ্যাম্পিয়ন হবে ইউরোপেরই কোনো দল। সেটি হতে পারে ফ্রান্স বা জার্মানি। কারণ স্কিল এবং টেম্পারামেন্টের দিক থেকে তারা স্পেন বা ইংল্যান্ডের চেয়ে এগিয়ে।
সেজান মাহমুদ
লেখক
আমি বিশ্বকাপের কোনো খেলা পারতপক্ষে মিস করি না। সবচেয়ে ভালো খেলাগুলো হয় প্রথম দিকেই। মনে আছে মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় রাত ২টা পর্যন্ত পড়ালেখা করে আড়াইটা-তিনটায় খেলা দেখে পরদিন সকাল সাড়ে ৭টায় ক্লাসে যেতাম।
এবার প্রতিটি খেলা শুরু হয় ভোর ৪টা বা ৫টায় (যুক্তরাষ্ট্র)। খেলা দেখে নাশতা করে ৭টায় তৃষ্ণাকে হাসপাতালে নামিয়ে দিই। ওর গাড়িটা এক্সিডেন্টের পর এখনও গ্যারেজে। যতক্ষণ পথে থাকি ফোনে লাইভ স্ট্রিমিং থাকে। তখন দেখার চেয়ে শুনি। আবার কাজে বা বাসায় দেখতে থাকি। এভাবেই চলবে আশা করি পুরো মাস।
কাতারের দোহা আমার খুব প্রিয় জায়গা। বাংলাদেশ যাওয়া আর আসার সময় এক রাত থাকি ওখানে। বিশেষ করে আসার সময়। তাহলে ভালো বিশ্রাম হয়। বিশাল হোটেলে ব্যাপক খাওয়া-দাওয়া ফ্রি। আমার পরিচিত অনেকেই বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের এরা বাংলাদেশের লোকজনকে মিসকিন ভাবে। হয়তো বা। আমাদের আমেরিকার পাসপোর্ট দেখে কিন্তু রীতিমতো জামাই আদর করে। দুবাই, সৌদিতে বিশাল বেতনের চাকরি প্রত্যাখ্যান করেছি স্বাধীনতাহীনতার জন্য। কিন্তু দোহার হোটেল ম্যানেজার আমেরিকান পাসপোর্ট দেখে বলেন, স্যার ডু ইউ নিড সামথিং এলস?
এই সামথিং এলস কিন্তু দামি মদ থেকে শুরু করে মাৎসর্য কোনোটাই বাদ নয়। প্রতিটি সমাজেই ভণ্ডামি থাকে আমি জানি। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে অপ্রেশন ও ভণ্ডামি এই যুগে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
এবার বিশ্বকাপ নিয়ে কাতার অনেক সমালোচনার মুখে। কিন্তু তাদের গোঁড়ামির বাইরে গিয়ে বানানো এই মাসকাটগুলো কিন্তু সত্যিই ভালো লেগেছে। হ্যাঁ, এভাবেই গোঁড়ামির জাল থেকে বের হবে বদ্ধ সমাজগুলো। এ জন্য অন্তত সাধুবাদ কাতারকে। সকালের খেলা শুরুর আগে পর্যন্ত কাতারের এদিকটাকে অভিনন্দন জানাই!
মন্তব্য করুন