আর পাঁচজন সাধারণ নারীর মতো নন সালমা আদিল। পারিবারিক ও মনোজাগতিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে সামনের দিকে এগিয়েছেন। নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়েছেন। করপোরেট জগতে নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন দৃঢ়ভাবে। অনেক নারী-শিশু ও দুস্থের কল্যাণে কাজ করছেন নীরবে। কাজ করছেন সমাজের বিভিন্ন অসংগতি ও দুর্দশা নিরসনে

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা সালমা আদিলের। পড়াশোনা করেছেন সেখানেই। দাদা আমিরুল হজ খান বাহাদুর বদি আহমদ চৌধুরীর নির্দেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠান বৈলছড়ী নজমুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। শহরে পড়াশোনা করার সব ব্যবস্থা থাকলেও দাদার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পড়েছেন। অষ্টম শ্রেণিতে পুরো বাঁশখালী উপজেলার মধ্যে একমাত্র তিনিই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান। তারপর গ্রামের স্কুল ছেড়ে শহরের স্কুলে আসেন। ভর্তি হন চট্টগ্রামের বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। গ্রামের স্কুল থেকে এসে শহরের স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে পারতেন না। স্কুলের মেয়েরাও মিশত না। বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেনি তাঁকে। বেশ কিছু প্রতিবন্ধক তাঁর জীবনে আসে।

সেসব প্রতিবন্ধককে তোয়াক্কা না করে নিজের পড়াশোনার দিকে মনোযোগী হয়েছেন। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, বন্ধুহীনতা ও অন্যান্য সমস্যাকে বড় করে না দেখে নিজের পড়াশোনা করে গেছেন এক মনে। পারিবারিকভাবে গার্লস স্কুল ও কলেজে পড়ার রেওয়াজ থাকলেও, বলয় ভেঙে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। মা-বাবাও সায় দেন। সেখানে ছেলেমেয়ে একসঙ্গেই পড়াশোনা করে। তারপর জীবনে আরও কিছু প্রতিবন্ধকতা আসে। আসে পরিবর্তন। এরপর উচ্চ মাধ্যমিক শেষে তিনি ভর্তি হন সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে। বেশ কিছু কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ কমে যায়।

তবুও দৃঢ় প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যান। ফিন্যান্স বিষয়ে পড়াশোনা করেন। স্নাতক-স্নাতকোত্তরের পর এক পর্যায়ে বিয়ে হয় উদ্যমী তরুণ জিয়াউদ্দিন আদিলের সঙ্গে। সন্তানও আসে সংসারে। এরই মধ্যে নিজের দক্ষতা বাড়াতে থাকেন। ইংরেজির ওপর বরাবরই জোর দেন তিনি। মনে করেন ভালো ইংরেজি না জানলে নিজেকে প্রমাণ করা যাবে না। সব ধরনের ভালো গুণ ও দক্ষতাকে গ্রহণ করতে ভালোবাসেন। করেছেন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জিং কাজও। সে সময়ে অর্থাৎ ২০০০ সালের শুরুতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে পড়েছেন। সংসার, সন্তান, পড়াশোনা সবকিছু একসঙ্গে সামলেছেন।

অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ পরিবারে জন্ম নিয়েও ঘরবন্দি জীবন তিনি চাননি। চেয়েছেন পরিবার, সমাজ ও মানুষের জন্য কাজ করতে। জীবনের প্রথম চাকরির সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মার্কিন দূতাবাসে। সেখানে চাকরি হয়ে যায়। দীর্ঘ ১০ বছর সাফল্যের সঙ্গে সেখানে কাজ করেন। তারপর স্বামী জিয়াউদ্দিন আদিলের সঙ্গে টপ অব মাইন্ড, মাস্টহেড পিআর ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হোন। সেখানেও অর্থ বিভাগের দায়িত্ব নেন। স্বামীর সঙ্গে ব্যবসায়ে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। তারপর একে একে যুক্ত হন অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'মানুষ একদিনে ব্যবসায়ী হন না। ব্যবসা করার আগে একজন মানুষ যে বিষয় নিয়ে কাজ করতে চান, সে বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। সে বিষয়ে নিজের কতটুকু জ্ঞান ও দক্ষতা আছে তা জানতে হবে। ধীরে ধীরে দক্ষতা বাড়াতে হবে। কীভাবে দায়িত্ব, কাজ ও কর্মী সামলাতে হবে তাও জানতে হবে।'

সালমা আদিল জানান, উদ্যোক্তা হওয়ার পর থেকে তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। নিজের ইচ্ছেমতো অফিসে যেতে পারেন। হোম অফিস করতে পারেন। এমনকি সংসার ও সন্তানদের সময় দিতে পারেন।

'উদ্যোক্তা হলে নিজের আইডিয়া, সৃজনশীলতার প্রয়োগ করা যায়। সব থেকে বড় বিষয় অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া যায়'- বলেন সালমা আদিল।

এই নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানে নারীরা মর্যাদার সঙ্গে কাজ করেন। তিনটি প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। নারীকে আরও এগিয়ে যেতে সাহায্য করছেন তিনি। 'আমার সাফল্য তখনই, যখন কেউ আমাকে দেখে অনুপ্রেরণা পাবেন এবং আমার মতো হতে চাইবেন। তিনি হয়তো আমার মতো হবেন না। তবে তিনি তাঁর মতো ভালো কিছু করবেন'- বলেন সালমা আদিল।

করপোরেট জগতে শীর্ষ পর্যায়ের কাজের পাশাপাশি তিনি জনসচেতনতা ও সমাজসেবামূলক কাজও করেন। মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সালমা আদিল ফাউন্ডেশন। আছে 'সেইফ হ্যান্ডস' নামের একটি ফেসবুক পেজ। মূলত পরিবারের বড়দের থেকেই মানুষের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। তাঁর দাদা সমাজসেবামূলক কাজ করতেন। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় তিনিও অন্যের জন্য কাজ করেন। ২০১৯ সালে সালমা আদিল ফাউন্ডেশন চালু হলেও, তার আগে থেকেই দরিদ্রদের অর্থ প্রদান, পাশে দাঁড়ানো, সব ধরনের সহযোগিতা, স্বাবলম্বী করার জন্য গরু-ছাগল কিনে দেওয়া, চোখের ছানি অপারেশন ইত্যাদি কর্মসূচি পরিচালনা করেছেন। তাঁর কথায়, ২০১৯ সালের পর থেকে সমাজসেবামূলক কিছু কাজ এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে পরিচালনা করছেন। বিদেশি ও অন্য কারও অনুদান ছাড়াই এই ফাউন্ডেশন পরিচালনা করেন সালমা আদিল। তিনি মনে করেন, মানুষ যদি অন্যের জন্য কিছু না করেন কেবল নিজের জন্য বাঁচেন তাহলে জীবনের কোনো সার্থকতা থাকে না।

সালমা আদিলের পরিবার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হলেও, তিনি রাজনীতিতে জড়াতে চান না আপাতত। মানুষের সেবা করতে হলে রাজনীতির মাধ্যমে করতে হবে তাও বিশ্বাস করেন না। তবে ভবিষ্যতে যদি এমন কোনো সুযোগ আসে, যার মাধ্যমে দেশের মানুষের কল্যাণ করা যাবে, তাহলে সেই সুযোগ নিতে চান তিনি। নারীর জন্য এখন অনেক সুযোগ আছে বলে মনে করেন সালমা আদিল। তিনি মনে করেন, নারীকে সামনে এগোনোর জন্য শক্তি ও সাহস দরকার। নিজেকে ভেঙে গড়তে হবে। ভয়কে জয় করতে হবে। খোলস থেকে বেরুতে হবে। উদ্যোক্তা হতে হলেও আগে নিজেকে সমৃদ্ধ হতে হবে। অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে।
নারী ও শিশু নিয়ে আরও অনেক কাজ করতে চান সালমা আদিল। বাল্যবিয়ে রোধ, বুলিং নিয়ে আরও বিস্তারিত কাজ, সচেতনতা সৃষ্টি, পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর বিষয়ে দেশব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদিতে নিজেকে নিয়োজিত করতে চান তিনি।

সালমা আদিল বলেন, 'দিনশেষে একটি হাসিমুখের পরিবারই মানুষের সবকিছু। সারাদিনের কাজ শেষে আমি যদি আমার পরিবারকে পাশে পাই সেটিই আমার বড় শক্তি হয়ে থাকে। '

স্বামী উদ্যোক্তা জিয়াউদ্দিন আদিল, দুই কন্যা মারফুয়া ফাইজা আদিল, তানজিনা নাজিফা আদিল ও পুত্র আম্মার মোহাম্মদ আদিলকে নিয়ে তাঁর সংসার। 'স্বামীকে পাশে নিয়ে মানুষের জন্য অনেক দূর পর্যন্ত যেতে চাই'- সবশেষে বলেন হাস্যময়ী, আত্মপ্রত্যয়ী সালমা আদিল।

ছবি :ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য

বিষয় : সালমা আদিল নারী উদ্ধোক্তা

আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন