
স্বেচ্ছা অবসরে গিয়ে আমার বড় আপার সংগঠন 'খুঁজে পেলাম'-এর সদস্য হয়ে গেলাম। একটু-আধটু লেখালেখি করি বলে বড় আপা আমাকে সংগঠনের নিউজ লেটারের দায়িত্ব দিল। চাকরিজীবনে এ রকম আনন্দের কাজ পেলে আমি এত তাড়াতাড়ি চাকরি ছাড়তাম না। তার ওপরে 'খুঁজে পেলাম' এমন একটা সংগঠন, যেখানে গবেষণারও অবকাশ আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব নারী বীরাঙ্গনা বলে পরিচিতি পেয়েছিলেন, তাঁদের খুঁজে এনে সরকার ঘোষিত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম ওঠানোর কাজ 'খুঁজে পেলাম'-এর। সেদিনের সেই নির্যাতিত নারীদের খুঁজে বের করে সঠিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে উপস্থাপনের মাধ্যমে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও ভাতা আদায়ের দায়িত্ব 'খুঁজে পেলাম'-এর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। কাজটা খুব সহজ নয়। তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন, যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের বয়স কারোরই ষাটের কম নয়। এলাকার লোকজন খোঁজখবর দিলেও অনেক নারী এখন নিজেরা স্বীকার করেন না বা তাঁর আত্মীয়স্বজনের সম্মানের কথা ভেবে মুখ বুজে থাকেন। মা-বাবা, স্বামী বা আত্মীয়স্বজন যাঁদের পরিত্যাগ করেছিল, কেবল সেইসব একাকী হতদরিদ্র নারীর কেউ কেউ নির্যাতনের কথা স্বীকার করেন। আমি নিজে আমাদের গ্রামে গিয়েছিলাম একজনের খোঁজে। আমরা জানতাম তাঁর কথা। কিন্তু তিনি কিছুতেই মুক্তিযোদ্ধা হতে রাজি নন, এমনকি ভাতাটাতাও তাঁর দরকার নেই বলে দিয়েছেন। আমি আবারও তাঁর কাছে যাব বলে এসেছি। পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি বছরের এই নারীকে মনে হচ্ছিল অশীতিপর বৃদ্ধা। চোখেও ভালো দেখেন না।
'আমাকে চিনতে পেরেছেন?'
দু'বার জিজ্ঞাসা করার পর তিনি আমার হাত স্পর্শ করেন। হ্যাঁ-না কিছু বলেন না। গালের গভীর বলিরেখা অস্বচ্ছ অশ্রুর থেমে থাকা ঘোলাটে হ্রদ হয়ে ওঠে।
**
কৈশোরের সেই দিনগুলো এখনও কেমন ঝকঝকে কাঁসার বাসনের মতো। চাচাতো ভাই কিশোর হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমাদের আসর তছনছ করল। ওকে আমরা সচরাচর খেলায়-গল্পে নিই না। আমাদের চেয়ে বয়সে ছোট, মোটাবুদ্ধি, খাইকুঁড়ি। কিন্তু মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সেই ভিখারিটার মতো আচরণ করে মাঝেমধ্যে। যে ভিখারির নামই ছিল হরিশপুর। জওয়ান মরদ। কুড়ের বাদশা। মানুষজন ওকে ভিক্ষাটিক্ষা কম দিত। আমার দাদি অবস্থাপন্ন ঘরের বউ। দাদার অনেক বিঘা জমি। দাদাবাড়ির সদর দরজায় চেয়ে খাওয়া মানুষের ভিড়। সেই ১৯৭৪ সাল। তখন নাকি একটা দুর্ভিক্ষ এসেছিল, আমরা টের পাইনি। ছুটিছাটায় চাচাতো-ফুপাতো ভাই-বোনেতে দাদাবাড়ি জমজমাট। একদিন সেই ভিখারি, যার নাম হয়ে গিয়েছিল হরিশপুর, দুপুরে দরজায় ঘা।
'ও মা দরজা খোল মা, হরিশপুর ফ্যাদ্দাফ্যারাং'
আমার দাদি ওর নাম জানত। বেশি দূরের গ্রাম নয় হরিশপুর। দাদির সইয়ের শ্বশুরবাড়ি। হরিশপুরে আবার কী হলো?
'হ্যারে জব্বার, কী হয়েছে হরিশপুরে?'
হন্তদন্ত হয়ে দাদির জিজ্ঞাসা।
'ও মা শোননিকো, হরিশপুর ফ্যাদ্দাফ্যারাং'
ফ্যাদ্দাফ্যারাং শব্দের অর্থ ছিন্নবিচ্ছিন্ন। দাদি যতবার জিজ্ঞাসা করে ও ততবার তুমুল উত্তেজনায় ওই একই উত্তর দেয়-
হরিশপুর ফ্যাদ্দাফ্যারাং।
হরিশপুরে কী ঘটেছে, জানার জন্য দাদি ওকে ভালোমতো বসিয়ে পেট ভরে খাইয়ে সব শুনতে চাইল। খেয়েদেয়ে জব্বার বলল-
'বাজারের মদ্যি দিয়ি আসার সুমায় শুনতি পালাম মানুষজন বুলাবুলি কচ্চে হরিশপুরি মেম্বারের বাড়িত নোকজন আগুন দিইছে। এতবড় ঘটনা সবাক জানাতি হবে না'-
বলে মুখ মুছে সে গ্রামের মধ্যে 'হরিশপুর ফ্যাদ্দাফ্যারাং' বলে চেঁচিয়ে বেড়াতে লাগল। মানুষজন তাকে ডেকে কেউ দু'চার আনা পয়সা, কেউ এক পালি মুড়ি, কেউ একটা বিড়ি, কেউ গাছের লাউ-শিম দিয়ে হরিশপুরের কাহিনি শোনে। মেম্বারের বাড়িতে নাকি বস্তা বস্তা মজুত চাল। আগুন লেগেছে বেশ হয়েছে। জব্বারের মিশন সাকসেসফুল।
তো কিশোরকেও আমরা আড়ালে হরিশপুর ডাকি। আমাদের পাঁচ কাজিনের আড্ডায় প্রবেশের জন্য ওর ছুতোও খানিকটা হরিশপুরের মতোই। আমরা আমাদেরই দূরসম্পর্কের এক ভাইয়ের প্রেম নিয়ে গুজুর গুজুর করছিলাম। কিশোরের প্রবেশ। চোখেমুখে হরিশপুর ফ্যাদ্দাফ্যারাং।
'দখিন পাড়ায় নবার বউয়ের বার উঠেছে। দলে দলে মানুষ দেখতে যাচ্ছে।'
বার মানে কী?
আমরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। কিশোর এ প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিল।
'কাজের খালা দাদিকে বলছিল নবার বউকে জিনে আসর করেছে। সে গড়গড় করে না দেখে কোরআন শরিফ মুখস্থ বলে যাচ্ছে। ভবিষ্যদ্বাণীও করতে পারছে।'
কিশোর হাঁপাচ্ছে।
ও, বার মানে তাহলে জিনের আসর? মহা পাকা আমার সেজো ফুপুর মেজো মেয়ে সঠিক বিশ্নেষণ হাজির করল-
'জিনের আসর ঠিক আছে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট বারে এই আসর হয় বলে তাকে বার ওঠা বলে।'
'হ্যাঁ হ্যাঁ প্রতি সোমবারে নাকি ওঠে'-
বলে পুঁচকি কিশোর আমাদের সাথে তার অংশগ্রহণ জায়েজ করে। দেখতে যেতে হয়। বড় ফুপুর বড় ছেলে মানে আমাদের মুকুল ভাই ওদের কলেজের একটা মেয়ের জন্য জান কোরবান। তাকে পাবে কিনা ভবিষ্যদ্বাণীটা জেনে নেয়া জরুরি। কিন্তু দাদি দেখলে সর্বনাশ। কিশোর বিজ্ঞের মতো বলে দিল মা-ফুপুদের নিয়ে দাদি পিঠা বানাতে ব্যস্ত। এটাই সুযোগ। দখিন পাড়া তো দু'কদম দূরেই। আমরা হরিশপুরের মাথায় প্রশংসার চাঁটি মেরে এগিয়ে গেলাম।
নবার বউ আমাদের ভারি চেনা। আমরা বছরখানেক আগেও দাদার বাড়িসংলগ্ন ধানের খামারে ওকে ধান ঝাড়তে দেখেছি। অমন রূপবতী আশপাশের পাঁচ গ্রামের মধ্যে কেউ ছিল না। ধান ঝাড়তে ঝাড়তে ওর হাতে-মুখে ধুলোর আস্তরণ কুয়াশার চাদর বিছিয়ে দিত। মনে হতো ও যেন সেই ছদ্মবেশী রাজকন্যা, যে কালিঝুলি মেখে অভিমানে রাজপুত্রকে ফিরিয়ে দিতে এসেছিল। আমরা অকারণে খামারে গিয়ে দাঁড়াতাম শুধু ওকে দেখার জন্য। দাদি খিড়কির বারান্দায় আরামকেদারায় বসে অন্য মুনিশদের নজরে রাখতেন। নবার বউয়ের সাথে নো হাংকিপাংকি। আমার দাদি ছাড়া তো কেউ নবার বউকে কাজে নিত না। কারণ, নবার বউ যে অশুচি। পাকিস্তানি সেনারা তাকে নষ্ট করে গেছে। নবা নাকি ভারত থেকে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে এসেছিল যুদ্ধের সময়। নবাকে না পেলে কী হবে? মুক্তিযোদ্ধার বউও দেশের শত্রু। নবারই আপন চাচাতো ভাই মবারক ডিম কিনে দেয়ার অজুহাতে এক পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে নবার বাড়ি ঢোকে। নবার বউ মুরগি পোষে।
'ঘরমে কেউ হায়? আন্ডা হায়?'
পাকিস্তানি সেনার চাটুকার মবারক গলার রগ ফুলিয়ে হাঁক ছাড়ে।
নবার বউ একহাত ঘোমটা টেনে ছেলে কোলে করে হেঁশেলের খুঁটি ধরে দাঁড়ায়। নিরাবরণ দু'পায়ের গোছা দেখেই লম্পট সেনার মাথা ঘুরে যায়। মনে হচ্ছিল মোম গলে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। দাঁতে ঘোমটা কেটে নবার বউ জবাব দেয়-
'সে তো বাড়ি নি মিয়াভাই। খ্যাতে গি।'
'তুমি ঝুট বাত বলছ। নবা গেরিলা হায়। এ বেটি গেরিলা কা বহু হায় স্যার'
'বহু নেহি, বিবি। তুম লোগ ও বাচ্চাকো বাহারমে লে যাও'-
বলে নবার বউকে টেনেহিঁচড়ে ঘরে তুলে দরজা লাগিয়ে দেয় হানাদার আর্মি।
তো দেশ স্বাধীন হলে সালিশ বসে। নবা বউয়ের কোল থেকে দুধের বাচ্চা কেড়ে নিয়ে বউকে তালাক দেয়। কিন্তু নবার বউ যাবে কোথায়? দুই গ্রাম উত্তরে বাপের বাড়ি গিয়েছিল কিন্তু তারা ঘরে ঠাঁই দেয়নি। কেউ কেউ বলেছিল বাজারের খাতায় নাম লেখাতে। শেষ পর্যন্ত বাগদিপাড়ার শেষ মাথায় ছেনুমণ্ডলের বাঁধা মেয়েমানুষ চাঁপাবানু (যাকে তিন যুগ আগে বেশ্যাপাড়া থেকে তুলে এনে গ্রামের প্রান্তে ঘর তুলে দিয়েছিল ছেনু) নবার বউয়ের হাত ধরে তার ঘরে আশ্রয় দেয়। নবার বউ পেটের দায়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজের জন্য যায়। কয়েকদিন কাজ করার পর গৃহস্থ বা তাদের জওয়ান ছেলেদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য গৃহিণীরা নবার বউকে সরিয়ে দিত। আমার দাদি কড়া নজরে রেখেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি। দাদি তার ভাইয়ের ছেলেকে জমাজমি দেখার ভার দিয়েছিল। সেই সময় নবার বউ ধান ঝাড়ার কাজে ছিল আমাদের বাড়ি। সে ধান ঝাড়ত আর ছেলের জন্য কাঁদত। ভিনগ্রাম থেকে আসা আমাদের ওই হারু চাচা সুন্দরীর কান্না সহ্য করতে পারছিল না। দাদি একদিন আবিস্কার করে সন্ধ্যার অন্ধকারে গোয়ালের মধ্যে হারু চাচা নবার বউয়ের সাথে চুম্বনরত। নবার বউয়ের পরনে মচমচে তাঁতের শাড়ি। নবার বউ রাতে বাড়ি ফিরে গেলে দাদি পান মুখে দিয়ে হারু চাচাকে ডাকে।
'তিন মাস হয়ে গেল। টাকাপয়সা বুঝে নিয়ে কাল বাড়ি যাও বাবা। বউ বাচ্চারা অপেক্ষায় আছে'
'ধান তোলা এখনও তো শেষ হয়নি ফুম্মা। সামনের মাসে যাব'
'আমার ধান পচুক গলুক, সে আমি বুঝব। তোমাকে ভাবতে হবে না'
হারু চাচা হাত কচলায়। তার নড়ার লক্ষণ নেই দেখে দাদি বলে-
'নবার বউ সম্পর্কে কিছু জানো?'
হারু চাচা দাদির পা চেপে ধরে। আকুল কণ্ঠে আবেদন জানায়-
'আমি জানি ফুম্মা। বড় দুঃখী মেয়ে সে। তার বুকের ধন কেড়ে নিয়ে তাকে অকুল পাথারে ফেলে গেছে সেই পাষণ্ড'
'তো? তুমি তাকে উদ্ধার করতে চাও? সব জানো তো?'
'বড় দুঃখী'
'তাকে যে পাকিস্তানিরা নষ্ট করে গেছে সে খবর জানো তো?'
হারু চাচা হাঁ করে থাকে। এ খবর তার জানা ছিল না। তওবা। তওবা। আল্লাহ মাফ করুন।
আমরা আমাদের কিশোর হরিশপুরের কথায় নেচে নবার বউকে দেখতে ছুটলাম। আহা সেই নবার বউ। সুন্দরী নবার বউ। তাকে অনেকদিন দেখি না।
ভাদ্রের পচা গরম। ওইটুকু পথ পার করে জাবেদ আলির বাড়ি পৌঁছাতেই আমরা ঘেমে নেয়ে একাকার। দোচালা টিনের ঘর। দুটো ছোট জানালা আর একটা শিকল ঝোলানো দরজা। মানুষের ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢোকা দায়। আমরা গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের শহরে থাকা ছেলেমেয়ে। উপরন্তু জাবেদ আলি আমাদের জমি আধি করে। দুই মেয়েকে মাদুরের ওপর শুইয়ে রেখে অনতিদূরে ভেটুল গাছের নিচে বসে জাবেদ আলির বউ বিনা ব্লাউজে জোরে জোরে হাতপাখা চালাচ্ছে। সে জোরে যতটা না বাতাস কাটতে তারচে অধিক রাগে। কী যেন গজগজও করছিল আপন মনে। আমরা ভিড় ঠেলে নবার বউকে দেখতে উন্মুখ। আমাদের দেখে কয়েকজন সমীহ করে জায়গা ছেড়ে দিল। দেখলাম জাবেদ আলির মতো আরও একজন জওয়ান মরদ নবার বউয়ের দুই বগলের নিচে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে। আরও তিনজন মাথার ওপর সমানে হাতপাখা চালাচ্ছে। নবার বউ শরীর ও মাথায় তুমুল আন্দোলন তুলে অনর্গল কোরআন শরিফ মুখস্থ আওড়াচ্ছে। মাঝেমাঝেই 'আল্লাহু' ও 'খালাকাল ইনসান' ছাড়া অন্য কোনো শব্দ বোঝার উপায় নেই। আমার ফুপাতো বোন মহাপাজি টিকলি চেঁচাতে লাগল-
'এই নবার বউ, এই নবার বউ, দেখো আমরা। তুমি এমন করছ কেন?'
আমাদের দেখে জাবেদ আলি একটু থতমত খেয়ে নবার বউকে ছেড়ে দিল। নবার বউয়ের আন্দোলনও আগের বেগ হারাল। জাবেদ আলি বলল-
'বুবুরা, সে তো একেনে নেই। তিনি আছেন'
'তিনি কে?'
'তিনি ভর কইরিছেন উর ওপর।'
বাতাস করা একজন বলল-
'আপনাদের কিছু জানার থাকলে টাকা ফেলে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।'
'টাকা কেন?'
'জিনির নামে সিন্নি হবে'
টিকলি এক টাকা ফেলে সুরা বাকারার প্রথম পারা পড়তে বলল। সেই মুহূর্তে এক জব্বর ঝাঁকি দিয়ে নবার বউ দুই জওয়ানের বাহুমুক্ত হলো। পিঠ ছড়িয়ে থাকা উশকো চুল তুলে খোঁপা করতে করতে নবার বউ চোখে আতঙ্ক, মুখে হাসি নিয়ে যেন সংবিৎ ফিরে জিজ্ঞাসা করল-
'ও মা! বুবুরা? তুমরা ককুন আইলি? দাদি ভালো আ-আচে?'
দেখলাম নবার বউয়ের সে সৌন্দর্য তখনও অটুট। কেবল মুখখানা বেশ মলিন। অলৌকিক পথ অবলম্বন ছাড়া তার একার জীবনের চাহিদা মেটানোও আর সম্ভব হচ্ছিল না। জাবেদ আলিও বিনিয়োগ ব্যতিরেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে লাভের মুখ দেখছিল। জাবেদ আলির বউয়ের রাগের কারণ বুঝে নিয়ে আমরা দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলাম।
***
এক মাসের মাথায় আবার গেলাম আমার ছোটবেলার গ্রামে। আচ্ছা, নবার বউয়ের নাম কী? আমরা তো কোনোদিন জানতে চাইনি। যেন তাঁর নামই নবার বউ। এবার সেই ভাঙা কুঁড়ের পিড়ের ওপর এক শক্তসমর্থ যুবককে বসে থাকতে দেখলাম। সে হাসিমুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। বলল-
'চানমনি খাতুন আমার মা। পিতা মৃত মুক্তিযুদ্ধা নবারক আলি। আমার মা একজন পঙ্গু মুক্তিযুদ্ধা। এ মা, বাইর হয়ি আয়। আপারা আইছেন।'
পঙ্গু? কই সেদিন তো নবার বউকে স্বাভাবিকই দেখেছিলাম।
'আপনাকে তো সেদিন দেখিনি। আপনি কি আপনার মায়ের দেখভাল করেন?'
'আমি না দেখলি কিডা দ্যাকপে? উর পাতে কিডা ভাত দেবে?'
খুব অসম্মানজনক কথাবার্তা। আমরা আর কথা বাড়ালাম না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সহায়তায় নবার বউকে গাড়িতে তুলে নিলাম। আমাদের সংগঠনের হোস্টেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। আমার শরীরের সাথে লাগোয়া একজন মুক্তিযোদ্ধার শরীর। আমি গর্বে কাঁপছিলাম। আর নবার বউ নয়, একজন ব্যক্তি চানমনিকে খুঁজে পেলাম। পাশে বসে চানমনির একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিতে গেলে তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। কয়েকবার জিজ্ঞাসার পর যা বললেন শুনে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। দিন পনেরো আগে তাঁর ছেলে এসে তাঁকে বীরাঙ্গনা স্বীকার করে নিতে জবরদস্তি করে। তিনি রাজি হচ্ছিলেন না দেখে সে তার হাত মুচড়ে ভেঙে দিয়ে বলে-
'তেনারা আলি পরে বুলবি যে তুই খালি মুক্তিযুদ্ধা না, পঙ্গু মুক্তিযুদ্ধা। পঙ্গু মুক্তিযুদ্ধার ভাতা বেশি। তা না হলি তোর ছিনালিপনার কথা কিন্তুক আমি বুইলি দেব।'
'আমাকে চিনতে পেরেছেন?'
দু'বার জিজ্ঞাসা করার পর তিনি আমার হাত স্পর্শ করেন। হ্যাঁ-না কিছু বলেন না। গালের গভীর বলিরেখা অস্বচ্ছ অশ্রুর থেমে থাকা ঘোলাটে হ্রদ হয়ে ওঠে।
**
কৈশোরের সেই দিনগুলো এখনও কেমন ঝকঝকে কাঁসার বাসনের মতো। চাচাতো ভাই কিশোর হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আমাদের আসর তছনছ করল। ওকে আমরা সচরাচর খেলায়-গল্পে নিই না। আমাদের চেয়ে বয়সে ছোট, মোটাবুদ্ধি, খাইকুঁড়ি। কিন্তু মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সেই ভিখারিটার মতো আচরণ করে মাঝেমধ্যে। যে ভিখারির নামই ছিল হরিশপুর। জওয়ান মরদ। কুড়ের বাদশা। মানুষজন ওকে ভিক্ষাটিক্ষা কম দিত। আমার দাদি অবস্থাপন্ন ঘরের বউ। দাদার অনেক বিঘা জমি। দাদাবাড়ির সদর দরজায় চেয়ে খাওয়া মানুষের ভিড়। সেই ১৯৭৪ সাল। তখন নাকি একটা দুর্ভিক্ষ এসেছিল, আমরা টের পাইনি। ছুটিছাটায় চাচাতো-ফুপাতো ভাই-বোনেতে দাদাবাড়ি জমজমাট। একদিন সেই ভিখারি, যার নাম হয়ে গিয়েছিল হরিশপুর, দুপুরে দরজায় ঘা।
'ও মা দরজা খোল মা, হরিশপুর ফ্যাদ্দাফ্যারাং'
আমার দাদি ওর নাম জানত। বেশি দূরের গ্রাম নয় হরিশপুর। দাদির সইয়ের শ্বশুরবাড়ি। হরিশপুরে আবার কী হলো?
'হ্যারে জব্বার, কী হয়েছে হরিশপুরে?'
হন্তদন্ত হয়ে দাদির জিজ্ঞাসা।
'ও মা শোননিকো, হরিশপুর ফ্যাদ্দাফ্যারাং'
ফ্যাদ্দাফ্যারাং শব্দের অর্থ ছিন্নবিচ্ছিন্ন। দাদি যতবার জিজ্ঞাসা করে ও ততবার তুমুল উত্তেজনায় ওই একই উত্তর দেয়-
হরিশপুর ফ্যাদ্দাফ্যারাং।
হরিশপুরে কী ঘটেছে, জানার জন্য দাদি ওকে ভালোমতো বসিয়ে পেট ভরে খাইয়ে সব শুনতে চাইল। খেয়েদেয়ে জব্বার বলল-
'বাজারের মদ্যি দিয়ি আসার সুমায় শুনতি পালাম মানুষজন বুলাবুলি কচ্চে হরিশপুরি মেম্বারের বাড়িত নোকজন আগুন দিইছে। এতবড় ঘটনা সবাক জানাতি হবে না'-
বলে মুখ মুছে সে গ্রামের মধ্যে 'হরিশপুর ফ্যাদ্দাফ্যারাং' বলে চেঁচিয়ে বেড়াতে লাগল। মানুষজন তাকে ডেকে কেউ দু'চার আনা পয়সা, কেউ এক পালি মুড়ি, কেউ একটা বিড়ি, কেউ গাছের লাউ-শিম দিয়ে হরিশপুরের কাহিনি শোনে। মেম্বারের বাড়িতে নাকি বস্তা বস্তা মজুত চাল। আগুন লেগেছে বেশ হয়েছে। জব্বারের মিশন সাকসেসফুল।
তো কিশোরকেও আমরা আড়ালে হরিশপুর ডাকি। আমাদের পাঁচ কাজিনের আড্ডায় প্রবেশের জন্য ওর ছুতোও খানিকটা হরিশপুরের মতোই। আমরা আমাদেরই দূরসম্পর্কের এক ভাইয়ের প্রেম নিয়ে গুজুর গুজুর করছিলাম। কিশোরের প্রবেশ। চোখেমুখে হরিশপুর ফ্যাদ্দাফ্যারাং।
'দখিন পাড়ায় নবার বউয়ের বার উঠেছে। দলে দলে মানুষ দেখতে যাচ্ছে।'
বার মানে কী?
আমরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। কিশোর এ প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিল।
'কাজের খালা দাদিকে বলছিল নবার বউকে জিনে আসর করেছে। সে গড়গড় করে না দেখে কোরআন শরিফ মুখস্থ বলে যাচ্ছে। ভবিষ্যদ্বাণীও করতে পারছে।'
কিশোর হাঁপাচ্ছে।
ও, বার মানে তাহলে জিনের আসর? মহা পাকা আমার সেজো ফুপুর মেজো মেয়ে সঠিক বিশ্নেষণ হাজির করল-
'জিনের আসর ঠিক আছে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট বারে এই আসর হয় বলে তাকে বার ওঠা বলে।'
'হ্যাঁ হ্যাঁ প্রতি সোমবারে নাকি ওঠে'-
বলে পুঁচকি কিশোর আমাদের সাথে তার অংশগ্রহণ জায়েজ করে। দেখতে যেতে হয়। বড় ফুপুর বড় ছেলে মানে আমাদের মুকুল ভাই ওদের কলেজের একটা মেয়ের জন্য জান কোরবান। তাকে পাবে কিনা ভবিষ্যদ্বাণীটা জেনে নেয়া জরুরি। কিন্তু দাদি দেখলে সর্বনাশ। কিশোর বিজ্ঞের মতো বলে দিল মা-ফুপুদের নিয়ে দাদি পিঠা বানাতে ব্যস্ত। এটাই সুযোগ। দখিন পাড়া তো দু'কদম দূরেই। আমরা হরিশপুরের মাথায় প্রশংসার চাঁটি মেরে এগিয়ে গেলাম।
নবার বউ আমাদের ভারি চেনা। আমরা বছরখানেক আগেও দাদার বাড়িসংলগ্ন ধানের খামারে ওকে ধান ঝাড়তে দেখেছি। অমন রূপবতী আশপাশের পাঁচ গ্রামের মধ্যে কেউ ছিল না। ধান ঝাড়তে ঝাড়তে ওর হাতে-মুখে ধুলোর আস্তরণ কুয়াশার চাদর বিছিয়ে দিত। মনে হতো ও যেন সেই ছদ্মবেশী রাজকন্যা, যে কালিঝুলি মেখে অভিমানে রাজপুত্রকে ফিরিয়ে দিতে এসেছিল। আমরা অকারণে খামারে গিয়ে দাঁড়াতাম শুধু ওকে দেখার জন্য। দাদি খিড়কির বারান্দায় আরামকেদারায় বসে অন্য মুনিশদের নজরে রাখতেন। নবার বউয়ের সাথে নো হাংকিপাংকি। আমার দাদি ছাড়া তো কেউ নবার বউকে কাজে নিত না। কারণ, নবার বউ যে অশুচি। পাকিস্তানি সেনারা তাকে নষ্ট করে গেছে। নবা নাকি ভারত থেকে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে এসেছিল যুদ্ধের সময়। নবাকে না পেলে কী হবে? মুক্তিযোদ্ধার বউও দেশের শত্রু। নবারই আপন চাচাতো ভাই মবারক ডিম কিনে দেয়ার অজুহাতে এক পাকিস্তানি সেনাকে নিয়ে নবার বাড়ি ঢোকে। নবার বউ মুরগি পোষে।
'ঘরমে কেউ হায়? আন্ডা হায়?'
পাকিস্তানি সেনার চাটুকার মবারক গলার রগ ফুলিয়ে হাঁক ছাড়ে।
নবার বউ একহাত ঘোমটা টেনে ছেলে কোলে করে হেঁশেলের খুঁটি ধরে দাঁড়ায়। নিরাবরণ দু'পায়ের গোছা দেখেই লম্পট সেনার মাথা ঘুরে যায়। মনে হচ্ছিল মোম গলে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। দাঁতে ঘোমটা কেটে নবার বউ জবাব দেয়-
'সে তো বাড়ি নি মিয়াভাই। খ্যাতে গি।'
'তুমি ঝুট বাত বলছ। নবা গেরিলা হায়। এ বেটি গেরিলা কা বহু হায় স্যার'
'বহু নেহি, বিবি। তুম লোগ ও বাচ্চাকো বাহারমে লে যাও'-
বলে নবার বউকে টেনেহিঁচড়ে ঘরে তুলে দরজা লাগিয়ে দেয় হানাদার আর্মি।
তো দেশ স্বাধীন হলে সালিশ বসে। নবা বউয়ের কোল থেকে দুধের বাচ্চা কেড়ে নিয়ে বউকে তালাক দেয়। কিন্তু নবার বউ যাবে কোথায়? দুই গ্রাম উত্তরে বাপের বাড়ি গিয়েছিল কিন্তু তারা ঘরে ঠাঁই দেয়নি। কেউ কেউ বলেছিল বাজারের খাতায় নাম লেখাতে। শেষ পর্যন্ত বাগদিপাড়ার শেষ মাথায় ছেনুমণ্ডলের বাঁধা মেয়েমানুষ চাঁপাবানু (যাকে তিন যুগ আগে বেশ্যাপাড়া থেকে তুলে এনে গ্রামের প্রান্তে ঘর তুলে দিয়েছিল ছেনু) নবার বউয়ের হাত ধরে তার ঘরে আশ্রয় দেয়। নবার বউ পেটের দায়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজের জন্য যায়। কয়েকদিন কাজ করার পর গৃহস্থ বা তাদের জওয়ান ছেলেদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য গৃহিণীরা নবার বউকে সরিয়ে দিত। আমার দাদি কড়া নজরে রেখেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি। দাদি তার ভাইয়ের ছেলেকে জমাজমি দেখার ভার দিয়েছিল। সেই সময় নবার বউ ধান ঝাড়ার কাজে ছিল আমাদের বাড়ি। সে ধান ঝাড়ত আর ছেলের জন্য কাঁদত। ভিনগ্রাম থেকে আসা আমাদের ওই হারু চাচা সুন্দরীর কান্না সহ্য করতে পারছিল না। দাদি একদিন আবিস্কার করে সন্ধ্যার অন্ধকারে গোয়ালের মধ্যে হারু চাচা নবার বউয়ের সাথে চুম্বনরত। নবার বউয়ের পরনে মচমচে তাঁতের শাড়ি। নবার বউ রাতে বাড়ি ফিরে গেলে দাদি পান মুখে দিয়ে হারু চাচাকে ডাকে।
'তিন মাস হয়ে গেল। টাকাপয়সা বুঝে নিয়ে কাল বাড়ি যাও বাবা। বউ বাচ্চারা অপেক্ষায় আছে'
'ধান তোলা এখনও তো শেষ হয়নি ফুম্মা। সামনের মাসে যাব'
'আমার ধান পচুক গলুক, সে আমি বুঝব। তোমাকে ভাবতে হবে না'
হারু চাচা হাত কচলায়। তার নড়ার লক্ষণ নেই দেখে দাদি বলে-
'নবার বউ সম্পর্কে কিছু জানো?'
হারু চাচা দাদির পা চেপে ধরে। আকুল কণ্ঠে আবেদন জানায়-
'আমি জানি ফুম্মা। বড় দুঃখী মেয়ে সে। তার বুকের ধন কেড়ে নিয়ে তাকে অকুল পাথারে ফেলে গেছে সেই পাষণ্ড'
'তো? তুমি তাকে উদ্ধার করতে চাও? সব জানো তো?'
'বড় দুঃখী'
'তাকে যে পাকিস্তানিরা নষ্ট করে গেছে সে খবর জানো তো?'
হারু চাচা হাঁ করে থাকে। এ খবর তার জানা ছিল না। তওবা। তওবা। আল্লাহ মাফ করুন।
আমরা আমাদের কিশোর হরিশপুরের কথায় নেচে নবার বউকে দেখতে ছুটলাম। আহা সেই নবার বউ। সুন্দরী নবার বউ। তাকে অনেকদিন দেখি না।
ভাদ্রের পচা গরম। ওইটুকু পথ পার করে জাবেদ আলির বাড়ি পৌঁছাতেই আমরা ঘেমে নেয়ে একাকার। দোচালা টিনের ঘর। দুটো ছোট জানালা আর একটা শিকল ঝোলানো দরজা। মানুষের ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢোকা দায়। আমরা গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের শহরে থাকা ছেলেমেয়ে। উপরন্তু জাবেদ আলি আমাদের জমি আধি করে। দুই মেয়েকে মাদুরের ওপর শুইয়ে রেখে অনতিদূরে ভেটুল গাছের নিচে বসে জাবেদ আলির বউ বিনা ব্লাউজে জোরে জোরে হাতপাখা চালাচ্ছে। সে জোরে যতটা না বাতাস কাটতে তারচে অধিক রাগে। কী যেন গজগজও করছিল আপন মনে। আমরা ভিড় ঠেলে নবার বউকে দেখতে উন্মুখ। আমাদের দেখে কয়েকজন সমীহ করে জায়গা ছেড়ে দিল। দেখলাম জাবেদ আলির মতো আরও একজন জওয়ান মরদ নবার বউয়ের দুই বগলের নিচে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে। আরও তিনজন মাথার ওপর সমানে হাতপাখা চালাচ্ছে। নবার বউ শরীর ও মাথায় তুমুল আন্দোলন তুলে অনর্গল কোরআন শরিফ মুখস্থ আওড়াচ্ছে। মাঝেমাঝেই 'আল্লাহু' ও 'খালাকাল ইনসান' ছাড়া অন্য কোনো শব্দ বোঝার উপায় নেই। আমার ফুপাতো বোন মহাপাজি টিকলি চেঁচাতে লাগল-
'এই নবার বউ, এই নবার বউ, দেখো আমরা। তুমি এমন করছ কেন?'
আমাদের দেখে জাবেদ আলি একটু থতমত খেয়ে নবার বউকে ছেড়ে দিল। নবার বউয়ের আন্দোলনও আগের বেগ হারাল। জাবেদ আলি বলল-
'বুবুরা, সে তো একেনে নেই। তিনি আছেন'
'তিনি কে?'
'তিনি ভর কইরিছেন উর ওপর।'
বাতাস করা একজন বলল-
'আপনাদের কিছু জানার থাকলে টাকা ফেলে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।'
'টাকা কেন?'
'জিনির নামে সিন্নি হবে'
টিকলি এক টাকা ফেলে সুরা বাকারার প্রথম পারা পড়তে বলল। সেই মুহূর্তে এক জব্বর ঝাঁকি দিয়ে নবার বউ দুই জওয়ানের বাহুমুক্ত হলো। পিঠ ছড়িয়ে থাকা উশকো চুল তুলে খোঁপা করতে করতে নবার বউ চোখে আতঙ্ক, মুখে হাসি নিয়ে যেন সংবিৎ ফিরে জিজ্ঞাসা করল-
'ও মা! বুবুরা? তুমরা ককুন আইলি? দাদি ভালো আ-আচে?'
দেখলাম নবার বউয়ের সে সৌন্দর্য তখনও অটুট। কেবল মুখখানা বেশ মলিন। অলৌকিক পথ অবলম্বন ছাড়া তার একার জীবনের চাহিদা মেটানোও আর সম্ভব হচ্ছিল না। জাবেদ আলিও বিনিয়োগ ব্যতিরেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে লাভের মুখ দেখছিল। জাবেদ আলির বউয়ের রাগের কারণ বুঝে নিয়ে আমরা দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলাম।
***
এক মাসের মাথায় আবার গেলাম আমার ছোটবেলার গ্রামে। আচ্ছা, নবার বউয়ের নাম কী? আমরা তো কোনোদিন জানতে চাইনি। যেন তাঁর নামই নবার বউ। এবার সেই ভাঙা কুঁড়ের পিড়ের ওপর এক শক্তসমর্থ যুবককে বসে থাকতে দেখলাম। সে হাসিমুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। বলল-
'চানমনি খাতুন আমার মা। পিতা মৃত মুক্তিযুদ্ধা নবারক আলি। আমার মা একজন পঙ্গু মুক্তিযুদ্ধা। এ মা, বাইর হয়ি আয়। আপারা আইছেন।'
পঙ্গু? কই সেদিন তো নবার বউকে স্বাভাবিকই দেখেছিলাম।
'আপনাকে তো সেদিন দেখিনি। আপনি কি আপনার মায়ের দেখভাল করেন?'
'আমি না দেখলি কিডা দ্যাকপে? উর পাতে কিডা ভাত দেবে?'
খুব অসম্মানজনক কথাবার্তা। আমরা আর কথা বাড়ালাম না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সহায়তায় নবার বউকে গাড়িতে তুলে নিলাম। আমাদের সংগঠনের হোস্টেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। আমার শরীরের সাথে লাগোয়া একজন মুক্তিযোদ্ধার শরীর। আমি গর্বে কাঁপছিলাম। আর নবার বউ নয়, একজন ব্যক্তি চানমনিকে খুঁজে পেলাম। পাশে বসে চানমনির একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিতে গেলে তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। কয়েকবার জিজ্ঞাসার পর যা বললেন শুনে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। দিন পনেরো আগে তাঁর ছেলে এসে তাঁকে বীরাঙ্গনা স্বীকার করে নিতে জবরদস্তি করে। তিনি রাজি হচ্ছিলেন না দেখে সে তার হাত মুচড়ে ভেঙে দিয়ে বলে-
'তেনারা আলি পরে বুলবি যে তুই খালি মুক্তিযুদ্ধা না, পঙ্গু মুক্তিযুদ্ধা। পঙ্গু মুক্তিযুদ্ধার ভাতা বেশি। তা না হলি তোর ছিনালিপনার কথা কিন্তুক আমি বুইলি দেব।'
বিষয় : মুক্তিযুদ্ধের গল্প উম্মে মুসলিমা
মন্তব্য করুন