
সেদিনও আব্বার ঘুম ভাঙে, দিনে-রাতে এক বেলার আধখোরাকির লজিং মাস্টার, মাদ্রাসার দাখিল ক্লাসের ছাত্র ছাব্বির হোসেনের গলায় ফজরের আজান শুনে। আর যা হোক, ছেলেটার গলা ভালো, ভরাট আর সুরেলা। আব্বা বিছানা ছেড়ে ওঠেন না, শুয়ে শুয়েই তার তারিফ করেন। একসময় কোলবালিশের পাশ বদল করে, নিজে পাশ ফিরে, ফের চোখ বোজেন।
অন্যদিন এই সময়টা বড় আরামের। ভোরের শীত শীত হাওয়ায়, আজানের সুর লহরিতে ভেসে ভেসে ঘুমের রাজ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। যেন নিঃশব্দে উড়ে চলা হাউই, অবাধ, বন্ধনহীন- আব্বা ঊর্ধ্বলোকে ছুটে চলেন। তখন ফসলের মাঠ-কাঁপানো এক ঝলক দমকা হাওয়া, ছাব্বির হোসেনের লংক্লথের পাঞ্জাবির ভেতর অতর্কিতে ঢুকে দাপাদাপি জুড়ে দেয়। মওলানা ভাবে, এ শয়তানের কারসাজি, আজান ভণ্ডুল করতে কাছারির সামনে ইবলিশ চর পাঠিয়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও, গত পাঁচ বছরে মিহি গলা ভরাট হলো, কোমল-পেলব থুতনি ফুঁড়ে হামাগুড়ি দিয়েছে ডজনখানেক ছাগলদাড়ি, কই মওলানার সুর কিংবা কথা তো এক চুলও এদিক-ওদিক হয়নি!
আজকে দমকা হাওয়া কি শয়তানের কারসাজি ছাড়াই ছাব্বির হোসেন বড় বেশি উতলা। সে যে সুতো ছেড়ে ছেড়ে আজানের রঙিন ঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিল, এখন লাটাই দু'হাতে আঁকড়ে ধরেও তা সামাল দিতে পারছে না। কানের ওপর হাত নয় যেন সাঁড়াশি, জোরেশোরে চেপে বসে। আর গলার ভেতর অস্বস্তির দলা। ঘুড়িটা ভোঁকাট্টা হওয়ার জন্য ডিগবাজি খায়, আকাশময় তড়পাতে থাকে। হাইয়্যা আলাছছালাহ আর হাইয়্যা আলালফালাহ-র মাঝখানে কচি ফিনফনে ছাগলদাড়ি ডান থেকে বামে ঘোরার আগেই ছাব্বির হোসেন বমি করতে শুরু করে।
সুরের এই আকস্মিক বিপর্যয় আব্বার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসেন। পাশেই দাদাজানের আমলের কারুকাজময় এক দুয়ারি পালঙ্ক। তাতে আধডজন ছানা-পোনায় ডানা মেলে আম্মা ঘুমিয়ে আছেন। যুদ্ধের দিন। কারোরই রাতের ঘুম ভালো হয় না। দিনটা কাটে ছটফট করে। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় খানিকটা ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য আব্বা বিছানার বাইরে মৃত্যুভয় ঠেলে সরিয়ে দিতে কোশিশ করেন। কিন্তু পারেন না। তেষ্টায় তাঁর গলা ফেটে রক্ত পড়ার উপক্রম হয়। তিনি হাত বাড়িয়ে জলের গেলাস টেবিল থেকে তুলতে গিয়েও বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন। এই অবস্থায় আব্বা স্বপ্টম্ন দেখেন :
বনভূমির স্বচ্ছ জলাশয়ের পাশে ভয়বিহ্বল নিঃসঙ্গ এক হরিণ। শুকনো পাতার খসখস আওয়াজও যাকে উৎকর্ণ করে রাখে। মুখ নামিয়ে জলে চুমুক দেওয়ার ঝুঁকি সে নিতে পারে না। পাখির কুজন কখন থেমে গেছে। মাথার ওপর নুয়ে পড়া বৃক্ষশাখে হঠাৎ কিচকিচিয়ে ওঠে একটি সংকেতধারী বানর।
ভোরের কুয়াশা সরে যাওয়ার আগেই আব্বা বাড়ির বাইরের গোলকধাঁধায় এসে পড়েন। কোন দিকে যাবেন, কী করবেন- বুঝতে পারেন না। বানরের সংকেত পেয়ে ভয়বিহ্বল হরিণ ছুট লাগায়। দু'জোড়া পায়ের মাঝখানে দূরত্ব বাড়িয়ে ক্রমে সে পরিণত হয় স্বয়ং গতিদিব্যতায়। মানুষ কেন তা পারে না?
সামনেই বড় আব্বার দিগন্তঘেরা তালুক- ফসলের জমি। ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়ার পর, নিজস্ব যা ছিল, দু'দশক ধরে তা বেচে-কিনে, আব্বার হাতে এসে পড়েছে মাত্র বিঘে চারেক। তাতে ভাগে ভাগে নানান রবিশস্য ফলানোর পর ইরির চারা লাগিয়েছিলেন। সবুজ কিশলয় মৃদুমন্দ হাওয়ায় তিরতিরিয়ে কাঁপছে। এত আদুরে আর সোহাগী যে, হাত বাড়ালেই শুস্ক ফাটা মাটি ছেড়ে একলাফে কোলে চড়ে বসবে।
আগে এই সময়টায় চার গাঁয়ের মধ্যমণি, একমাত্র ডিপ টিউবওয়েল প্রবল উচ্ছ্বাসে জল ছিটাত। মুখে মাটি কাঁপানো ঠা-ঠা হাসি। এ বছর মুখ বাঁধা। সোয়া মাইল দূরে থানা শহর। ওখানে আর্মি ক্যাম্প। কারও সাহস হয় না ডিপ টিউবওয়েল স্টার্ট দেওয়ার। এর মাটি কাঁপানো হাসি, কান পাতলেই শোনা যায় এখন মানুষের বুকের তলায় কেমন ধুকপুকিয়ে বাজে। আর তাদের গাল বেয়ে ঝরে এর অথই জল- নিঃশব্দ, উচ্ছ্বাসহীন।
একজন কান্নাভেজা মানুষ আর বিশাল সবুজতার মাঝখানে চৈত্রের কৈয়ের মতো ছাব্বির হোসেন উজিয়ে ওঠে। আব্বার দেওয়া রিজিক সে বমি করে ফেলে দিয়েছে ভোরের আজান শেষ করার আগেই। এখন ভারমুক্ত, ফুরফুরে। নামাজ কায়জা করে টানা ঘুমিয়েওছে। দুনিয়াজুড়ে এখন কুয়াশার আব্রু। ষড়যন্ত্র লুকোনোর জন্য বাড়তি পর্দার দরকার হয় না। সে কুয়াশার ভেতর নেমে পড়ে। হঠাৎ আব্বার মুখোমুখি হতেই নিজেকে তার বেআব্রু, নাঙ্গা মনে হয়। যেন কোমর প্যাঁচানো লুঙ্গিটা গিঁট খুলে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। আর আব্বাও 'কী মওলানা, সকাল সকাল কার খিদমত করতে যাইতেছো' বলে, চোখে পানি নিয়ে যে হাসেন, তাতে ছাব্বির হোসেনের মনের ভারাক্রান্ত ভাবটা আবার ফিরে আসে। সে বিরক্ত হয়। আজন্মের সহবৎ 'আসসালামু আলাইকুম' ভুলে নিঃশব্দে হেঁটে চলে যায়।
আব্বা দেখেন, যবনিকা সরে গেছে। মঞ্চে ছাব্বির হোসেন একা হাঁটছে আর সবার বিপরীতে উজানের দিকে। দূর্বাঘাসের ওপর পায়ে চলা সিঁথিপথ পেরিয়ে ইট বাঁধানো সড়কে উঠে বামে সে মোড় নেয়। ওদিকে সোয়া মাইল হেঁটে গেলে থানা শহর, আর্মি ক্যাম্প।
ঘণ্টাখানেক পর একই পথের উল্টো দিক থেকে গায়ের সুরমা বুবি ছুটতে ছুটতে আসে। তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে আসে পাঁচটা কাক। বোবা বুড়ি আব্বাকে ওখানে না পেয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে, কাঁইকুঁই করে কাক তাড়ানোর চেষ্টা করে। কাকগুলো সমস্বরে এমন জোরে কা-কা শুরু করে যে গাঁয়ের বেশ ক'জন লোক তাতে সচকিত হয়। এ ছাড়া সোয়া মাইল পথ আসতে আসতে সুরমা বুবি নানান অঙ্গভঙ্গি করে লিস্টির যাকে যেখানে পেয়েছে, তাদের যে গল্পটা বলতে বলতে এসেছে, তারা তা পুরোপুরি না বুঝলেও ঠিকই বিপদের গন্ধ পেয়ে যায়। কার কখন বিপদ আসে, যুদ্ধের দিন বলেই হয়তো, এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে তারা অযথা সময় নষ্ট করেনি। যে যার নিজের সর্বনাশ আসন্ন ভেবে তখনই পালাতে শুরু করেছে।
সপরিবারে দু'দিন উপোস করে বুবির ছেলে ঘরের একমাত্র ডেরকি-মুরগি দিয়ে ভোরবেলা মাকে সদরে পাঠায়। যাওয়ার পথে বুবি দেখেছে আব্বাকে উবু হয়ে ধানগাছে বিলি কাটতে। সে সদরে পৌঁছায় যখন তখনও হাট বসেনি। কেবল কয়েকটা নেড়িকুকুর গত রাতের স্তূপীকৃত আবর্জনার ওপর কামড়াকামড়ি করছিল। বুবি ডেরকি কোলে হাটের মাঝখানের বটতলায় বসে পড়ে। তার চারদিকে তখনও এমন ঘন কুয়াশা যে, দশ গজ দূরত্বের ব্যবধানে আর্মি আর মানুষ কেউ কাউকে শনাক্ত করতে পারার কথা নয়। ডেরকি ও বুবি দু'জনেরই কুয়াশার আড়ালে এক ফাঁকে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। তখন দু'জন বন্দুকধারী এসে বুবির কোল থেকে মুরগিটা তুলে নিয়ে, এক লাত্থিতে তাকে মাটিতে উল্টে ফেলে চলে যায়। সুরমা বুবি মরিয়া। সে ডেরকির কককক অনুসরণ করে কুয়াশার ভেতর দিয়ে ঠিক ঠিক পৌঁছে যায় আর্মি ক্যাম্পে। সেখানেই সে ছাব্বির হোসেনকে আর্মির লিস্টে আব্বাসহ আরও ছয়জনের নাম লেখাতে দেখেছে।
বুবি আর কাকের সংঘর্ষ যখন বাঁধে, আব্বা তখন গাঁয়ের শেষ সীমানায়। ওখান থেকেই তিনি কাকের কা-কা চিৎকার শুনতে পান। সামনেই যমজ বোনের শ্বশুরবাড়ি। কখন কী হয়, কাকগুলো এমন চিল্লাচিল্লি করছে, নাড়ি-ছেঁড়া বোনটিকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য তিনি আলপথ ছেড়ে বসতবাড়িতে ওঠেন। তখন বাড়ির দাওয়ায় বসে যমজ বোনের বায়ূচড়া স্বামী তেতুল মেখে পান্তা ভাত খাচ্ছিল। তার দু'পাশে দুটি পলিশ-মসৃণ বেতের লাঠি। ডান দিকের লাঠি তুলে সে বিড়ালের পিঠে বাড়ি মারে আর বাম দিকেরটা দিয়ে হাঁস-মুরগি তাড়ায়। মুরগির লাঠি নামিয়ে রেখে, আব্বা উঠোনে পা রাখার সময়, সে সবে বিড়াল মারার বেত হাতে তুলে নিয়েছে। পলায়নপর বিড়াল আর আব্বা তখন মুখোমুখি। বিড়ালটাই সরে দাঁড়িয়ে আব্বাকে পথ ছেড়ে দেয়। আর তা করতে গিয়ে মোক্ষম একটা বাড়ি খায় পিঠের ওপর। বিড়ালটা রবারের বলের মতো লাফিয়ে ওঠে আর কী আশ্চর্য কোৎ শব্দটা বেরোয় আব্বার মুখ থেকে।
'হে-হে দ্যাশে এত বড় যুদ্ধ'- যমজ বোনের স্বামী লাঠি নামাতে নামাতে বলে, 'শালা দেহি সামান্য লাডিরে ডলায়!' কথাটা সে আব্বা না বিড়াল, কাকে উদ্দেশ করে বলে, আব্বা ঠিক বুঝতে পারেন না।
খাওয়া শেষে যমজ বোনের স্বামী লাঠি দুটি গামছা দিয়ে মুছে বেড়ার আলাদা দুটি হুকে ঝুলিয়ে দেয়। বিড়ালের লাঠি বিড়ালের জায়গায়, হাঁস-মুরগিরটা হাঁস-মুরগির জায়গায়। আব্বা তার কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে দমে যান। তারপরও দু'জন মুখোমুখি পান সাজিয়ে বসেন ভারত যাওয়ার পরিকল্পনা করতে।
যমজ বোনের স্বামী মুক্তিযুদ্ধ করতে রাজি, তবে সে আগরতলা কিছুতেই যাবে না। তার এক কথা, 'ঔহানো ঠাহুরের সাত পোলা ওত পাইত্যা রইছে।' সেই যে প্রেমানন্দ ঠাকুর, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বছর যাঁর বসতবাড়ি, হাঁস-চরা পুকুর, যমজ বোনের স্বামীরা তিন ভাই মিলে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছিল, তিনি তো ক'দিন আগে সগগে গেছেন। তার ছেলেপিলেরা এখন সোনামুড়া, আগরতলায়। মাত্র ছ'বছর সময়। ওপারে যাওয়া মাত্র তারা খপ করে ধরবে না একদম ঘেঁটিতে! সাত ঠাকুরের চোখ বাঁচিয়ে তাকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পে তোলার সাধ্য নেই আব্বার। টানা এক ঘণ্টা আলোচনার পর দু'জনেই শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে একমত হন। আব্বা তখন এতটাই বিভ্রান্ত যে, যমজ বোনকে না বলেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। তাঁর অবশ্য বাড়ি ফেরারও তাড়া ছিল। যমজ বোনের স্বামী পরামর্শ দিয়েছেন- আর্মির গতিবিধি নিয়ে ছাব্বির হোসেনের সঙ্গে অতিসত্বর কথা বলতে।
আব্বা বাড়ি এসে শোনেন, মওলানা সেই যে সকালে বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি। অবশ্য এখন তার ফেরার কথাও নয়। সে রোজ বাড়ি এসে খেতে বসে, আব্বা যখন স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরের পর বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশন, অস্থির হাতে রেডিওর নব ঘোরান অন্ধকারে রাতের বেলা- ঠিক তখন। যুদ্ধ লাগার আগে ছাব্বির হোসেন দুপুরে খেত আব্বাদের ঘরে আর রাতের বেলা বড় হুজুরের সঙ্গে দাওয়াত খেয়ে বেড়াত গরিব-মিসকিনের বাড়ি বাড়ি। ধনী লোকের ঘরে বড় হুজুরের দাওয়াত পড়লেও, তালেবুল আলিমকে সঙ্গে নেওয়ার সাহস তার ছিল না। এখন সকাল-দুপুর ব্যাটা খায় কী, যায় কই?
এটি যথেষ্টই ভাবনার বিষয়। কিন্তু আব্বা বেশিদূর এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনার সুযোগ পান না। কারণ তখনই তিনি শোনেন, ঘণ্টা দুই আগে সুরমা বুবি এসেছিল, সঙ্গে ছিল পাঁচটা কাক। বুবির ছেলে কামলা মানুষ, ক্ষেতের কাজ নেই, রোজ বন্ধ, সাহায্য চাইতে মাকে সে পাঠাতেই পারে। কিন্তু সেই কাক পাঁচটা?
আব্বা রেডিওর দিকে তাকান। কুঁচি দেওয়া ঢাকনা গায়ে, যেন তার ছোট্ট মেয়ে, ফুলেল জামার ঘের ছড়িয়ে সাইড টেবিলের ওপর বসে আছে। আজকালকার দিনে ঘরে মেয়ে আর রেডিও রাখা নিরাপদ নয়। তিনি রেডিওটা বগলে নিয়ে ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। আম্মা ঘরে এসে মেয়ে-খোঁজার মতো করে যে রেডিও খুঁজবেন, সেদিকে আজ তার খেয়ালই নেই।
পুথিবীর বুক থেকে কুয়াশার ভারী পর্দাটা খানিক আগে সরে গেছে। পথে নেমে আব্বার মনে হয়, তিনি যেন সেই নিঃসঙ্গ হরিণ, যে আজন্ম-চেনা বনভূমিতে ভয়বিহ্বল, দিশেহারা। গাছের পাতা ফিসফিসিয়ে ভয়ের শিহরণ জাগায়। বাতাসে ষড়যন্ত্রের কম্পন। তিনি এলোমেলো হাঁটতে লাগলেন আগের সেই আলপথ দিয়ে। সামনেই যমজ বোনের শ্বশুরবাড়ি। তার হাঁটায় ছেদ পড়ে। তিনি ভাবেন, এই নশ্বর জীবনে মায়া বাড়িয়ে কী লাভ, তাঁর তো আম্মা আর আধডজন বাচ্চাকাচ্চার কাছ থেকেও বিদায় নেওয়া হয়নি।
এখন আব্বার গন্তব্য ওপারে, আগরতলায়। পথের অনুপুঙ্খ বর্ণনা, গত সপ্তাহ তিনি আর স্কুলের গেম টিচার শুনেছিলেন একজন গাইডের কাছে। ছোকরা লোক নিয়ে ওপারে গেছে। ফিরবে আগামীকাল। আব্বার হাতে সময় নেই। তিনি একাই ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁকে বিশ মাইল পথ খানিকটা রিকশায় আর বেশিরভাগ পায়ে হেঁটে বেলা থাকতে থাকতে কংসনগর বাজার পৌঁছাতে হবে। বাজার পার হলেই গোমতী নদী। নদীর হাঁটুজলে প্যাচ প্যাচ শব্দ করে শত শত নরনারীর রাতের আঁধারে দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা তিনি গাইডের কাছে শুনেছেন। নদী পেরিয়ে নাম না-জানা গাঁয়ের পথে দেশছাড়া মানুষের কাফেলা। আব্বাও তাদের একজন। তাঁর সঙ্গে কেবল তিন ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। রাতের বেলাটা কোনো এক স্কুলঘরে কাটিয়ে ভোরে আবার সেই পথ। গাইড বলেছিল, মানুষের কাফেলা বড় হতে থাকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। একসময় পূর্বদিগন্তে দেখা যায় উঁচু উঁচু পাহাড়, যার একটিতে সাদা রঙের সীমান্ত পোস্ট।
আব্বা দাঁড়িয়ে পড়েন। সামনেই যমজ বোন। বাড়ির মুখের কলামুড়ায় কলাপাতা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সে। দু'মিনিট আগে-পরে জন্মানোর সুবাদে আব্বা যার বড় ভাই, তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি কিনা মাঠে মাঠে পাগলের মতো ঘুরছেন! সে কলামুড়ার একগাদা ঝুরঝুরে বালিসহ ক্ষেতের আলে নেমে আসে। আর কাঁদতে কাঁদতে বলে, সুরমা বুবি আব্বাকে খুঁজতে এসেছিল, তার সঙ্গে ছিল পাঁচটা কাক। আব্বা বিরক্ত হন। এখনও গাঁয়ের সীমানা অতিক্রম করতে পারেননি, দুপুর গড়িয়ে যায়, ওপারে পৌঁছবেন কখন! ঠিক তখন থেকেই তিনি নিজের ওপর আস্থা হারাতে শুরু করেন। এমনকি তাঁর মনে হয়, বড় আব্বার তালুকের গোলকধাঁধায় তিনি আটকা পড়ে গেছেন, এখান থেকে একা বেরোনোর সাধ্য তাঁর নেই। এ অবস্থায় স্কুলের সহকর্মী গেম টিচারকে তাঁর দরকার।
লোকটার আবেগ-উদ্যম দুই-ই আছে। রেডিওতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে ঢাকা ছুটে গিয়েছিল। পরদিন উঠানের বাঁশঝাড়ে কুড়াল পড়ল। সেই দিনই তৈরি হলো শ-খানেক বাঁশের লাঠি। তাই দিয়ে স্কুলছাত্রদের দুই শিফটের ট্রেনিং শুরু হলো। ছাত্ররা সব নির্দলীয়। জীবনে কোনো দিন পাকিস্তানি দেখেনি। তবে ইতিহাস বইয়ে পড়া তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা, ২৫ মার্চের আগপর্যন্ত তাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
গেম টিচারের বাড়ির দরজায় তালা ঝুলছে। আর উঠোনের ন্যাড়া বাঁশঝাড়ে একটি রাস্তার কুকুর, দু'পা ফাঁক করে যেন অতন্দ্র প্রহরী, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আব্বা তো অবাক। লোকটা ঝাড়ে-বংশে পালাল কখন! গতকাল দেখা, বললেও পারত, ভাই আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি, এখানে থাকলে মারা পড়বেন, চলেন যুদ্ধ করে মরি। ক্যাম্পের লিস্টিতে স্কুলের গেম টিচারের যদি নাম থাকে তো হেডমাস্টার বাদ পড়ে কোন হিসাবে? যে লোকের ওপর আব্বার এত আস্থা, সে কিনা বাড়িতে কুকুরের পাহারা বসিয়ে, কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে গেছে!
এভাবে না-বলে যেতে যেতে, অনেক দিন আগে, একবার গাঁ উজাড় হয়ে গিয়েছিল। আব্বা তখন বেশ ছোট। ক্লাস সিক্সে বোধহয় পড়েন। ফকির বাড়ির ওরসের দিন মহিষের মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে, গায়ের কানা ভিখিরির মাঝরাতে দাস্তবমি শুরু হয়। তারপর দাবানলের মতো বাড়ির পর বাড়ি কলেরা মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়ে। কবর খুঁড়ে খুঁড়ে কুলানো যাচ্ছিল না। সেবারও গাঁয়ের সব বাঁশঝাড় লাশ শোয়ানোর চাটাই বুনতে বুনতে শেষ হয়ে যায়। আব্বা সেবারই গাঁয়ে প্রথম কলেরা তাড়ানোর ওঝা দেখেন। জিগির শোনাও সেই প্রথম। মৃত্যুশীতল গাঁয়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জিগিরের ঐকতান, সেই বয়সে জেগে ওঠে মনে হয়েছিল- আসমানের আজরাইল মাটিতে নেমে এসে বুঝি গাইছে।
মহামারি শেষ হওয়ার পর গাঁয়ের কুকুরগুলো সব পাগল হয়ে গিয়েছিল। মরা খেতে খেতে মানুষের মাংসে এরা নেশাসক্ত হয়ে পড়ে। জ্যান্ত মানুষ একলা পেলেই তাড়া করত।
আব্বা আড়চোখে গেম টিচারের বাড়ির পাহারাদার কুকুরের দিকে তাকান।
সদর থেকে ক'দিন ধরে রোজই একটি-দুটি লাশ খালের পানিতে ভেসে ভেসে গাঁয়ের চড়ায় এসে লাগছে। মানুষগুলো ফুলে ঢোল, শকুনে খাওয়া। আর আশ্চর্য শকুনগুলোও চড়া পর্যন্ত এসে অর্ধভুক্ত লাশ তুলে দেয় কুকুরের হাতে। এই কুকুরটা মড়া খেয়ে মুখ মুছে আসা বকতপস্বী না তো, যে এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দেওয়ার ভান করছে! আব্বা এক-পা দু-পা করে পেছনের দিকে সরতে থাকেন। ঠিক তখন তার দুশ গজ দূরে কাকগুলো সমস্বরে কা-কা করে ওঠে।
সুরমা বুবি অদৃশ্য। ধানক্ষেতের আড়ালে অনাহারক্লিষ্ট, হাড় জিরজির ক্লান্ত শরীরটা ঢাকা পড়ে গেছে। পাঁচটা কাক সারাদিন তার পিছ ছাড়েনি। দিন শেষে সে যখন আর চলতে পারে না, আব্বার চরকি-ঘোরা আলপথের একটিতে যখন হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে, তখনও এরা ওর চারপাশে। সামনে-পেছনে, ওপর-নিচে ওড়াউড়ি করে, ডানা ঝাপটে, কা-কা চিৎকার করে তাকে আবার দাঁড় করিয়ে দিতে চাচ্ছে। বুড়ি ওঠে না, নড়েও না। সে শুধু শুকনো জিব সাপের মতো খানিক পরপর বের করে। মাঠের কোথাও এক ফোঁটা জল নেই। সে জন্য বুবির যে কোনো অসুবিধা হচ্ছে তা না, সে জিব বের করে কথা বলতে না-পারা বোবা মানুষের নিগূঢ় কষ্ট থেকে। সুরমা বিবি বুঝ হওয়ার পর থেকে শুনে আসছে, জিবটা তার অসাড়, আর দশজনের মতো সচল নয়। এমনিতে জিব যে সঙ্গে একটা আছে, সারাজীবন ক'জন মানুষ তা টের পায়? এক শুধু অসুখ-বিসুখে ডাক্তারখানায় জিব বের করতে হয় ফরমাশ পেয়ে, স্বল্প সময়ের জন্য, কোনো রকম কষ্ট ছাড়াই। অথচ এই অসাড় জিব নিয়ে বুবির তিন কুড়ি বছর কেটেছে নানা কসরত করে সামান্য কটা ধ্বনি ফোটাতে। আজ সে অনেকখানিই সার্থক। আব্বা ছাড়া লিস্টির বাকি ছ'জন তো তার বোবা কথাতেই গাঁ ছেড়ে পালিয়েছে। এখন আলপথে শুয়ে বুবি মনে করতে পারে না, আব্বা না ডেরকি, কাকে সে সারাদিন খুঁজেছিল আর কাকেই-বা সঙ্গে করে তার ঘরে ফিরতে হবে। এখন সে অবশ্য কোথাও আর ফিরতেও চায় না। দিন শেষ হয়। সন্ধ্যা নামে। সুরমা বুবি সঙ্গের পাঁচটা কাক নিয়ে আব্বার বাড়ি ফেরার পথ জুড়ে শুয়ে থাকে। আব্বা পথ বদল করেন। অবশেষে বড় আব্বার তালুকের গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আগরতলায় নয়, তিনি সদরে যাওয়ার ইটের রাস্তায় ওঠেন। ওখানেই ছাব্বির হোসেন আছে। গত পাঁচ বছরে কোনো প্রতিদান ছাড়াই তিনি যার মুখে রোজ একবেলা অন্ন দিয়েছেন, এই দুর্দিনে সে কি তাঁকে বাঁচাবে না? এ শুধু দাবি নয়, এখন তাঁকে যদি কেউ বাঁচাতে পারে, সে ছাব্বির হোসেন- এ অমোঘ সত্য।
আব্বার সদর পর্যন্ত যাওয়া হয় না। মাঝপথেই তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে ভয়ার্ত হরিণের মতো চকিতে চারপাশ তাকান। রাস্তার দু'ধারের গাঁ নিথর- পাখির কুজন কখন থেমে গেছে। মাথার ওপর বৃক্ষ নেই, সন্ধ্যার আকাশ পাখপাখালি শূন্য, হায় দূরের তারাগুলোও কত উদাসীন। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষটি দিন শেষে আর একাকিত্বের যন্ত্রণা অনুভব করেন না। তিনি স্তব্ধতার ফাঁদ ন্যাতাকানির মতো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখেন। তাঁর ডান-বাম আর সামনের মাটি ফুঁড়ে যখন বেরিয়ে আসে এক দঙ্গল আর্মি, সঙ্গে বুটের আওয়াজ, আব্বা তখন পেছন দিকের মুক্ত সড়ক ধরে দৌড়াতে থাকেন। হরিণ যা পারে, মানুষ কেন তা পারবে না? দু'পায়ের মাঝখানের দূরত্ব বাড়িয়ে ক্রমে তিনি পরিণত হন স্বয়ং গতিদিব্যতায়।
গুলির শব্দে সুরমা বুবি কেঁপে ওঠে স্থির হয়ে যায়। আশ্চর্য এমন বিকট আওয়াজ শুনে কাকগুলো উড়ে যায় না, কোনো শব্দও করে না। বুবির প্রাণহীন দেহ ঘিরে পাঁচটা কাক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের চোখে অশ্রু।
অন্যদিন এই সময়টা বড় আরামের। ভোরের শীত শীত হাওয়ায়, আজানের সুর লহরিতে ভেসে ভেসে ঘুমের রাজ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। যেন নিঃশব্দে উড়ে চলা হাউই, অবাধ, বন্ধনহীন- আব্বা ঊর্ধ্বলোকে ছুটে চলেন। তখন ফসলের মাঠ-কাঁপানো এক ঝলক দমকা হাওয়া, ছাব্বির হোসেনের লংক্লথের পাঞ্জাবির ভেতর অতর্কিতে ঢুকে দাপাদাপি জুড়ে দেয়। মওলানা ভাবে, এ শয়তানের কারসাজি, আজান ভণ্ডুল করতে কাছারির সামনে ইবলিশ চর পাঠিয়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও, গত পাঁচ বছরে মিহি গলা ভরাট হলো, কোমল-পেলব থুতনি ফুঁড়ে হামাগুড়ি দিয়েছে ডজনখানেক ছাগলদাড়ি, কই মওলানার সুর কিংবা কথা তো এক চুলও এদিক-ওদিক হয়নি!
আজকে দমকা হাওয়া কি শয়তানের কারসাজি ছাড়াই ছাব্বির হোসেন বড় বেশি উতলা। সে যে সুতো ছেড়ে ছেড়ে আজানের রঙিন ঘুড়ি আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিল, এখন লাটাই দু'হাতে আঁকড়ে ধরেও তা সামাল দিতে পারছে না। কানের ওপর হাত নয় যেন সাঁড়াশি, জোরেশোরে চেপে বসে। আর গলার ভেতর অস্বস্তির দলা। ঘুড়িটা ভোঁকাট্টা হওয়ার জন্য ডিগবাজি খায়, আকাশময় তড়পাতে থাকে। হাইয়্যা আলাছছালাহ আর হাইয়্যা আলালফালাহ-র মাঝখানে কচি ফিনফনে ছাগলদাড়ি ডান থেকে বামে ঘোরার আগেই ছাব্বির হোসেন বমি করতে শুরু করে।
সুরের এই আকস্মিক বিপর্যয় আব্বার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসেন। পাশেই দাদাজানের আমলের কারুকাজময় এক দুয়ারি পালঙ্ক। তাতে আধডজন ছানা-পোনায় ডানা মেলে আম্মা ঘুমিয়ে আছেন। যুদ্ধের দিন। কারোরই রাতের ঘুম ভালো হয় না। দিনটা কাটে ছটফট করে। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় খানিকটা ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য আব্বা বিছানার বাইরে মৃত্যুভয় ঠেলে সরিয়ে দিতে কোশিশ করেন। কিন্তু পারেন না। তেষ্টায় তাঁর গলা ফেটে রক্ত পড়ার উপক্রম হয়। তিনি হাত বাড়িয়ে জলের গেলাস টেবিল থেকে তুলতে গিয়েও বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন। এই অবস্থায় আব্বা স্বপ্টম্ন দেখেন :
বনভূমির স্বচ্ছ জলাশয়ের পাশে ভয়বিহ্বল নিঃসঙ্গ এক হরিণ। শুকনো পাতার খসখস আওয়াজও যাকে উৎকর্ণ করে রাখে। মুখ নামিয়ে জলে চুমুক দেওয়ার ঝুঁকি সে নিতে পারে না। পাখির কুজন কখন থেমে গেছে। মাথার ওপর নুয়ে পড়া বৃক্ষশাখে হঠাৎ কিচকিচিয়ে ওঠে একটি সংকেতধারী বানর।
ভোরের কুয়াশা সরে যাওয়ার আগেই আব্বা বাড়ির বাইরের গোলকধাঁধায় এসে পড়েন। কোন দিকে যাবেন, কী করবেন- বুঝতে পারেন না। বানরের সংকেত পেয়ে ভয়বিহ্বল হরিণ ছুট লাগায়। দু'জোড়া পায়ের মাঝখানে দূরত্ব বাড়িয়ে ক্রমে সে পরিণত হয় স্বয়ং গতিদিব্যতায়। মানুষ কেন তা পারে না?
সামনেই বড় আব্বার দিগন্তঘেরা তালুক- ফসলের জমি। ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়ার পর, নিজস্ব যা ছিল, দু'দশক ধরে তা বেচে-কিনে, আব্বার হাতে এসে পড়েছে মাত্র বিঘে চারেক। তাতে ভাগে ভাগে নানান রবিশস্য ফলানোর পর ইরির চারা লাগিয়েছিলেন। সবুজ কিশলয় মৃদুমন্দ হাওয়ায় তিরতিরিয়ে কাঁপছে। এত আদুরে আর সোহাগী যে, হাত বাড়ালেই শুস্ক ফাটা মাটি ছেড়ে একলাফে কোলে চড়ে বসবে।
আগে এই সময়টায় চার গাঁয়ের মধ্যমণি, একমাত্র ডিপ টিউবওয়েল প্রবল উচ্ছ্বাসে জল ছিটাত। মুখে মাটি কাঁপানো ঠা-ঠা হাসি। এ বছর মুখ বাঁধা। সোয়া মাইল দূরে থানা শহর। ওখানে আর্মি ক্যাম্প। কারও সাহস হয় না ডিপ টিউবওয়েল স্টার্ট দেওয়ার। এর মাটি কাঁপানো হাসি, কান পাতলেই শোনা যায় এখন মানুষের বুকের তলায় কেমন ধুকপুকিয়ে বাজে। আর তাদের গাল বেয়ে ঝরে এর অথই জল- নিঃশব্দ, উচ্ছ্বাসহীন।
একজন কান্নাভেজা মানুষ আর বিশাল সবুজতার মাঝখানে চৈত্রের কৈয়ের মতো ছাব্বির হোসেন উজিয়ে ওঠে। আব্বার দেওয়া রিজিক সে বমি করে ফেলে দিয়েছে ভোরের আজান শেষ করার আগেই। এখন ভারমুক্ত, ফুরফুরে। নামাজ কায়জা করে টানা ঘুমিয়েওছে। দুনিয়াজুড়ে এখন কুয়াশার আব্রু। ষড়যন্ত্র লুকোনোর জন্য বাড়তি পর্দার দরকার হয় না। সে কুয়াশার ভেতর নেমে পড়ে। হঠাৎ আব্বার মুখোমুখি হতেই নিজেকে তার বেআব্রু, নাঙ্গা মনে হয়। যেন কোমর প্যাঁচানো লুঙ্গিটা গিঁট খুলে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। আর আব্বাও 'কী মওলানা, সকাল সকাল কার খিদমত করতে যাইতেছো' বলে, চোখে পানি নিয়ে যে হাসেন, তাতে ছাব্বির হোসেনের মনের ভারাক্রান্ত ভাবটা আবার ফিরে আসে। সে বিরক্ত হয়। আজন্মের সহবৎ 'আসসালামু আলাইকুম' ভুলে নিঃশব্দে হেঁটে চলে যায়।
আব্বা দেখেন, যবনিকা সরে গেছে। মঞ্চে ছাব্বির হোসেন একা হাঁটছে আর সবার বিপরীতে উজানের দিকে। দূর্বাঘাসের ওপর পায়ে চলা সিঁথিপথ পেরিয়ে ইট বাঁধানো সড়কে উঠে বামে সে মোড় নেয়। ওদিকে সোয়া মাইল হেঁটে গেলে থানা শহর, আর্মি ক্যাম্প।
ঘণ্টাখানেক পর একই পথের উল্টো দিক থেকে গায়ের সুরমা বুবি ছুটতে ছুটতে আসে। তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে আসে পাঁচটা কাক। বোবা বুড়ি আব্বাকে ওখানে না পেয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে, কাঁইকুঁই করে কাক তাড়ানোর চেষ্টা করে। কাকগুলো সমস্বরে এমন জোরে কা-কা শুরু করে যে গাঁয়ের বেশ ক'জন লোক তাতে সচকিত হয়। এ ছাড়া সোয়া মাইল পথ আসতে আসতে সুরমা বুবি নানান অঙ্গভঙ্গি করে লিস্টির যাকে যেখানে পেয়েছে, তাদের যে গল্পটা বলতে বলতে এসেছে, তারা তা পুরোপুরি না বুঝলেও ঠিকই বিপদের গন্ধ পেয়ে যায়। কার কখন বিপদ আসে, যুদ্ধের দিন বলেই হয়তো, এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে তারা অযথা সময় নষ্ট করেনি। যে যার নিজের সর্বনাশ আসন্ন ভেবে তখনই পালাতে শুরু করেছে।
সপরিবারে দু'দিন উপোস করে বুবির ছেলে ঘরের একমাত্র ডেরকি-মুরগি দিয়ে ভোরবেলা মাকে সদরে পাঠায়। যাওয়ার পথে বুবি দেখেছে আব্বাকে উবু হয়ে ধানগাছে বিলি কাটতে। সে সদরে পৌঁছায় যখন তখনও হাট বসেনি। কেবল কয়েকটা নেড়িকুকুর গত রাতের স্তূপীকৃত আবর্জনার ওপর কামড়াকামড়ি করছিল। বুবি ডেরকি কোলে হাটের মাঝখানের বটতলায় বসে পড়ে। তার চারদিকে তখনও এমন ঘন কুয়াশা যে, দশ গজ দূরত্বের ব্যবধানে আর্মি আর মানুষ কেউ কাউকে শনাক্ত করতে পারার কথা নয়। ডেরকি ও বুবি দু'জনেরই কুয়াশার আড়ালে এক ফাঁকে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। তখন দু'জন বন্দুকধারী এসে বুবির কোল থেকে মুরগিটা তুলে নিয়ে, এক লাত্থিতে তাকে মাটিতে উল্টে ফেলে চলে যায়। সুরমা বুবি মরিয়া। সে ডেরকির কককক অনুসরণ করে কুয়াশার ভেতর দিয়ে ঠিক ঠিক পৌঁছে যায় আর্মি ক্যাম্পে। সেখানেই সে ছাব্বির হোসেনকে আর্মির লিস্টে আব্বাসহ আরও ছয়জনের নাম লেখাতে দেখেছে।
বুবি আর কাকের সংঘর্ষ যখন বাঁধে, আব্বা তখন গাঁয়ের শেষ সীমানায়। ওখান থেকেই তিনি কাকের কা-কা চিৎকার শুনতে পান। সামনেই যমজ বোনের শ্বশুরবাড়ি। কখন কী হয়, কাকগুলো এমন চিল্লাচিল্লি করছে, নাড়ি-ছেঁড়া বোনটিকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য তিনি আলপথ ছেড়ে বসতবাড়িতে ওঠেন। তখন বাড়ির দাওয়ায় বসে যমজ বোনের বায়ূচড়া স্বামী তেতুল মেখে পান্তা ভাত খাচ্ছিল। তার দু'পাশে দুটি পলিশ-মসৃণ বেতের লাঠি। ডান দিকের লাঠি তুলে সে বিড়ালের পিঠে বাড়ি মারে আর বাম দিকেরটা দিয়ে হাঁস-মুরগি তাড়ায়। মুরগির লাঠি নামিয়ে রেখে, আব্বা উঠোনে পা রাখার সময়, সে সবে বিড়াল মারার বেত হাতে তুলে নিয়েছে। পলায়নপর বিড়াল আর আব্বা তখন মুখোমুখি। বিড়ালটাই সরে দাঁড়িয়ে আব্বাকে পথ ছেড়ে দেয়। আর তা করতে গিয়ে মোক্ষম একটা বাড়ি খায় পিঠের ওপর। বিড়ালটা রবারের বলের মতো লাফিয়ে ওঠে আর কী আশ্চর্য কোৎ শব্দটা বেরোয় আব্বার মুখ থেকে।
'হে-হে দ্যাশে এত বড় যুদ্ধ'- যমজ বোনের স্বামী লাঠি নামাতে নামাতে বলে, 'শালা দেহি সামান্য লাডিরে ডলায়!' কথাটা সে আব্বা না বিড়াল, কাকে উদ্দেশ করে বলে, আব্বা ঠিক বুঝতে পারেন না।
খাওয়া শেষে যমজ বোনের স্বামী লাঠি দুটি গামছা দিয়ে মুছে বেড়ার আলাদা দুটি হুকে ঝুলিয়ে দেয়। বিড়ালের লাঠি বিড়ালের জায়গায়, হাঁস-মুরগিরটা হাঁস-মুরগির জায়গায়। আব্বা তার কাণ্ডকারখানা দেখে মনে মনে দমে যান। তারপরও দু'জন মুখোমুখি পান সাজিয়ে বসেন ভারত যাওয়ার পরিকল্পনা করতে।
যমজ বোনের স্বামী মুক্তিযুদ্ধ করতে রাজি, তবে সে আগরতলা কিছুতেই যাবে না। তার এক কথা, 'ঔহানো ঠাহুরের সাত পোলা ওত পাইত্যা রইছে।' সেই যে প্রেমানন্দ ঠাকুর, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বছর যাঁর বসতবাড়ি, হাঁস-চরা পুকুর, যমজ বোনের স্বামীরা তিন ভাই মিলে ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছিল, তিনি তো ক'দিন আগে সগগে গেছেন। তার ছেলেপিলেরা এখন সোনামুড়া, আগরতলায়। মাত্র ছ'বছর সময়। ওপারে যাওয়া মাত্র তারা খপ করে ধরবে না একদম ঘেঁটিতে! সাত ঠাকুরের চোখ বাঁচিয়ে তাকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পে তোলার সাধ্য নেই আব্বার। টানা এক ঘণ্টা আলোচনার পর দু'জনেই শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে একমত হন। আব্বা তখন এতটাই বিভ্রান্ত যে, যমজ বোনকে না বলেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। তাঁর অবশ্য বাড়ি ফেরারও তাড়া ছিল। যমজ বোনের স্বামী পরামর্শ দিয়েছেন- আর্মির গতিবিধি নিয়ে ছাব্বির হোসেনের সঙ্গে অতিসত্বর কথা বলতে।
আব্বা বাড়ি এসে শোনেন, মওলানা সেই যে সকালে বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি। অবশ্য এখন তার ফেরার কথাও নয়। সে রোজ বাড়ি এসে খেতে বসে, আব্বা যখন স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরের পর বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশন, অস্থির হাতে রেডিওর নব ঘোরান অন্ধকারে রাতের বেলা- ঠিক তখন। যুদ্ধ লাগার আগে ছাব্বির হোসেন দুপুরে খেত আব্বাদের ঘরে আর রাতের বেলা বড় হুজুরের সঙ্গে দাওয়াত খেয়ে বেড়াত গরিব-মিসকিনের বাড়ি বাড়ি। ধনী লোকের ঘরে বড় হুজুরের দাওয়াত পড়লেও, তালেবুল আলিমকে সঙ্গে নেওয়ার সাহস তার ছিল না। এখন সকাল-দুপুর ব্যাটা খায় কী, যায় কই?
এটি যথেষ্টই ভাবনার বিষয়। কিন্তু আব্বা বেশিদূর এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনার সুযোগ পান না। কারণ তখনই তিনি শোনেন, ঘণ্টা দুই আগে সুরমা বুবি এসেছিল, সঙ্গে ছিল পাঁচটা কাক। বুবির ছেলে কামলা মানুষ, ক্ষেতের কাজ নেই, রোজ বন্ধ, সাহায্য চাইতে মাকে সে পাঠাতেই পারে। কিন্তু সেই কাক পাঁচটা?
আব্বা রেডিওর দিকে তাকান। কুঁচি দেওয়া ঢাকনা গায়ে, যেন তার ছোট্ট মেয়ে, ফুলেল জামার ঘের ছড়িয়ে সাইড টেবিলের ওপর বসে আছে। আজকালকার দিনে ঘরে মেয়ে আর রেডিও রাখা নিরাপদ নয়। তিনি রেডিওটা বগলে নিয়ে ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। আম্মা ঘরে এসে মেয়ে-খোঁজার মতো করে যে রেডিও খুঁজবেন, সেদিকে আজ তার খেয়ালই নেই।
পুথিবীর বুক থেকে কুয়াশার ভারী পর্দাটা খানিক আগে সরে গেছে। পথে নেমে আব্বার মনে হয়, তিনি যেন সেই নিঃসঙ্গ হরিণ, যে আজন্ম-চেনা বনভূমিতে ভয়বিহ্বল, দিশেহারা। গাছের পাতা ফিসফিসিয়ে ভয়ের শিহরণ জাগায়। বাতাসে ষড়যন্ত্রের কম্পন। তিনি এলোমেলো হাঁটতে লাগলেন আগের সেই আলপথ দিয়ে। সামনেই যমজ বোনের শ্বশুরবাড়ি। তার হাঁটায় ছেদ পড়ে। তিনি ভাবেন, এই নশ্বর জীবনে মায়া বাড়িয়ে কী লাভ, তাঁর তো আম্মা আর আধডজন বাচ্চাকাচ্চার কাছ থেকেও বিদায় নেওয়া হয়নি।
এখন আব্বার গন্তব্য ওপারে, আগরতলায়। পথের অনুপুঙ্খ বর্ণনা, গত সপ্তাহ তিনি আর স্কুলের গেম টিচার শুনেছিলেন একজন গাইডের কাছে। ছোকরা লোক নিয়ে ওপারে গেছে। ফিরবে আগামীকাল। আব্বার হাতে সময় নেই। তিনি একাই ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁকে বিশ মাইল পথ খানিকটা রিকশায় আর বেশিরভাগ পায়ে হেঁটে বেলা থাকতে থাকতে কংসনগর বাজার পৌঁছাতে হবে। বাজার পার হলেই গোমতী নদী। নদীর হাঁটুজলে প্যাচ প্যাচ শব্দ করে শত শত নরনারীর রাতের আঁধারে দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা তিনি গাইডের কাছে শুনেছেন। নদী পেরিয়ে নাম না-জানা গাঁয়ের পথে দেশছাড়া মানুষের কাফেলা। আব্বাও তাদের একজন। তাঁর সঙ্গে কেবল তিন ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও। রাতের বেলাটা কোনো এক স্কুলঘরে কাটিয়ে ভোরে আবার সেই পথ। গাইড বলেছিল, মানুষের কাফেলা বড় হতে থাকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। একসময় পূর্বদিগন্তে দেখা যায় উঁচু উঁচু পাহাড়, যার একটিতে সাদা রঙের সীমান্ত পোস্ট।
আব্বা দাঁড়িয়ে পড়েন। সামনেই যমজ বোন। বাড়ির মুখের কলামুড়ায় কলাপাতা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সে। দু'মিনিট আগে-পরে জন্মানোর সুবাদে আব্বা যার বড় ভাই, তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি কিনা মাঠে মাঠে পাগলের মতো ঘুরছেন! সে কলামুড়ার একগাদা ঝুরঝুরে বালিসহ ক্ষেতের আলে নেমে আসে। আর কাঁদতে কাঁদতে বলে, সুরমা বুবি আব্বাকে খুঁজতে এসেছিল, তার সঙ্গে ছিল পাঁচটা কাক। আব্বা বিরক্ত হন। এখনও গাঁয়ের সীমানা অতিক্রম করতে পারেননি, দুপুর গড়িয়ে যায়, ওপারে পৌঁছবেন কখন! ঠিক তখন থেকেই তিনি নিজের ওপর আস্থা হারাতে শুরু করেন। এমনকি তাঁর মনে হয়, বড় আব্বার তালুকের গোলকধাঁধায় তিনি আটকা পড়ে গেছেন, এখান থেকে একা বেরোনোর সাধ্য তাঁর নেই। এ অবস্থায় স্কুলের সহকর্মী গেম টিচারকে তাঁর দরকার।
লোকটার আবেগ-উদ্যম দুই-ই আছে। রেডিওতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে ঢাকা ছুটে গিয়েছিল। পরদিন উঠানের বাঁশঝাড়ে কুড়াল পড়ল। সেই দিনই তৈরি হলো শ-খানেক বাঁশের লাঠি। তাই দিয়ে স্কুলছাত্রদের দুই শিফটের ট্রেনিং শুরু হলো। ছাত্ররা সব নির্দলীয়। জীবনে কোনো দিন পাকিস্তানি দেখেনি। তবে ইতিহাস বইয়ে পড়া তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা, ২৫ মার্চের আগপর্যন্ত তাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
গেম টিচারের বাড়ির দরজায় তালা ঝুলছে। আর উঠোনের ন্যাড়া বাঁশঝাড়ে একটি রাস্তার কুকুর, দু'পা ফাঁক করে যেন অতন্দ্র প্রহরী, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আব্বা তো অবাক। লোকটা ঝাড়ে-বংশে পালাল কখন! গতকাল দেখা, বললেও পারত, ভাই আমরা যুদ্ধে যাচ্ছি, এখানে থাকলে মারা পড়বেন, চলেন যুদ্ধ করে মরি। ক্যাম্পের লিস্টিতে স্কুলের গেম টিচারের যদি নাম থাকে তো হেডমাস্টার বাদ পড়ে কোন হিসাবে? যে লোকের ওপর আব্বার এত আস্থা, সে কিনা বাড়িতে কুকুরের পাহারা বসিয়ে, কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে গেছে!
এভাবে না-বলে যেতে যেতে, অনেক দিন আগে, একবার গাঁ উজাড় হয়ে গিয়েছিল। আব্বা তখন বেশ ছোট। ক্লাস সিক্সে বোধহয় পড়েন। ফকির বাড়ির ওরসের দিন মহিষের মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে, গায়ের কানা ভিখিরির মাঝরাতে দাস্তবমি শুরু হয়। তারপর দাবানলের মতো বাড়ির পর বাড়ি কলেরা মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়ে। কবর খুঁড়ে খুঁড়ে কুলানো যাচ্ছিল না। সেবারও গাঁয়ের সব বাঁশঝাড় লাশ শোয়ানোর চাটাই বুনতে বুনতে শেষ হয়ে যায়। আব্বা সেবারই গাঁয়ে প্রথম কলেরা তাড়ানোর ওঝা দেখেন। জিগির শোনাও সেই প্রথম। মৃত্যুশীতল গাঁয়ের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জিগিরের ঐকতান, সেই বয়সে জেগে ওঠে মনে হয়েছিল- আসমানের আজরাইল মাটিতে নেমে এসে বুঝি গাইছে।
মহামারি শেষ হওয়ার পর গাঁয়ের কুকুরগুলো সব পাগল হয়ে গিয়েছিল। মরা খেতে খেতে মানুষের মাংসে এরা নেশাসক্ত হয়ে পড়ে। জ্যান্ত মানুষ একলা পেলেই তাড়া করত।
আব্বা আড়চোখে গেম টিচারের বাড়ির পাহারাদার কুকুরের দিকে তাকান।
সদর থেকে ক'দিন ধরে রোজই একটি-দুটি লাশ খালের পানিতে ভেসে ভেসে গাঁয়ের চড়ায় এসে লাগছে। মানুষগুলো ফুলে ঢোল, শকুনে খাওয়া। আর আশ্চর্য শকুনগুলোও চড়া পর্যন্ত এসে অর্ধভুক্ত লাশ তুলে দেয় কুকুরের হাতে। এই কুকুরটা মড়া খেয়ে মুখ মুছে আসা বকতপস্বী না তো, যে এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দেওয়ার ভান করছে! আব্বা এক-পা দু-পা করে পেছনের দিকে সরতে থাকেন। ঠিক তখন তার দুশ গজ দূরে কাকগুলো সমস্বরে কা-কা করে ওঠে।
সুরমা বুবি অদৃশ্য। ধানক্ষেতের আড়ালে অনাহারক্লিষ্ট, হাড় জিরজির ক্লান্ত শরীরটা ঢাকা পড়ে গেছে। পাঁচটা কাক সারাদিন তার পিছ ছাড়েনি। দিন শেষে সে যখন আর চলতে পারে না, আব্বার চরকি-ঘোরা আলপথের একটিতে যখন হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে, তখনও এরা ওর চারপাশে। সামনে-পেছনে, ওপর-নিচে ওড়াউড়ি করে, ডানা ঝাপটে, কা-কা চিৎকার করে তাকে আবার দাঁড় করিয়ে দিতে চাচ্ছে। বুড়ি ওঠে না, নড়েও না। সে শুধু শুকনো জিব সাপের মতো খানিক পরপর বের করে। মাঠের কোথাও এক ফোঁটা জল নেই। সে জন্য বুবির যে কোনো অসুবিধা হচ্ছে তা না, সে জিব বের করে কথা বলতে না-পারা বোবা মানুষের নিগূঢ় কষ্ট থেকে। সুরমা বিবি বুঝ হওয়ার পর থেকে শুনে আসছে, জিবটা তার অসাড়, আর দশজনের মতো সচল নয়। এমনিতে জিব যে সঙ্গে একটা আছে, সারাজীবন ক'জন মানুষ তা টের পায়? এক শুধু অসুখ-বিসুখে ডাক্তারখানায় জিব বের করতে হয় ফরমাশ পেয়ে, স্বল্প সময়ের জন্য, কোনো রকম কষ্ট ছাড়াই। অথচ এই অসাড় জিব নিয়ে বুবির তিন কুড়ি বছর কেটেছে নানা কসরত করে সামান্য কটা ধ্বনি ফোটাতে। আজ সে অনেকখানিই সার্থক। আব্বা ছাড়া লিস্টির বাকি ছ'জন তো তার বোবা কথাতেই গাঁ ছেড়ে পালিয়েছে। এখন আলপথে শুয়ে বুবি মনে করতে পারে না, আব্বা না ডেরকি, কাকে সে সারাদিন খুঁজেছিল আর কাকেই-বা সঙ্গে করে তার ঘরে ফিরতে হবে। এখন সে অবশ্য কোথাও আর ফিরতেও চায় না। দিন শেষ হয়। সন্ধ্যা নামে। সুরমা বুবি সঙ্গের পাঁচটা কাক নিয়ে আব্বার বাড়ি ফেরার পথ জুড়ে শুয়ে থাকে। আব্বা পথ বদল করেন। অবশেষে বড় আব্বার তালুকের গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আগরতলায় নয়, তিনি সদরে যাওয়ার ইটের রাস্তায় ওঠেন। ওখানেই ছাব্বির হোসেন আছে। গত পাঁচ বছরে কোনো প্রতিদান ছাড়াই তিনি যার মুখে রোজ একবেলা অন্ন দিয়েছেন, এই দুর্দিনে সে কি তাঁকে বাঁচাবে না? এ শুধু দাবি নয়, এখন তাঁকে যদি কেউ বাঁচাতে পারে, সে ছাব্বির হোসেন- এ অমোঘ সত্য।
আব্বার সদর পর্যন্ত যাওয়া হয় না। মাঝপথেই তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে ভয়ার্ত হরিণের মতো চকিতে চারপাশ তাকান। রাস্তার দু'ধারের গাঁ নিথর- পাখির কুজন কখন থেমে গেছে। মাথার ওপর বৃক্ষ নেই, সন্ধ্যার আকাশ পাখপাখালি শূন্য, হায় দূরের তারাগুলোও কত উদাসীন। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষটি দিন শেষে আর একাকিত্বের যন্ত্রণা অনুভব করেন না। তিনি স্তব্ধতার ফাঁদ ন্যাতাকানির মতো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখেন। তাঁর ডান-বাম আর সামনের মাটি ফুঁড়ে যখন বেরিয়ে আসে এক দঙ্গল আর্মি, সঙ্গে বুটের আওয়াজ, আব্বা তখন পেছন দিকের মুক্ত সড়ক ধরে দৌড়াতে থাকেন। হরিণ যা পারে, মানুষ কেন তা পারবে না? দু'পায়ের মাঝখানের দূরত্ব বাড়িয়ে ক্রমে তিনি পরিণত হন স্বয়ং গতিদিব্যতায়।
গুলির শব্দে সুরমা বুবি কেঁপে ওঠে স্থির হয়ে যায়। আশ্চর্য এমন বিকট আওয়াজ শুনে কাকগুলো উড়ে যায় না, কোনো শব্দও করে না। বুবির প্রাণহীন দেহ ঘিরে পাঁচটা কাক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের চোখে অশ্রু।
বিষয় : মুক্তিযুদ্ধের গল্প শাহীন আখতার
মন্তব্য করুন