
ঝাঁজ মরে আসছে রোদমন্দ বিকেলের। বুনো লতাপাতার ঝালর, বিষ-কাঁটালির ঝোপ ধরে উঠে আসছে হাল্ক্কা ছায়া। ধুলোর ছোপ ধরা হইচই শূন্য লম্বা শান-বারান্দার ফাটলের পর ইজি চেয়ারে মমিনউদ্দিন একা বসে- মাথার নিচে দুই হাতের ভাঁজ। দাঁতের মাড়ির পাশে জমানো মিহি পান জিভ দিয়ে টেনে চুষতে গলায় দানা দানা আরাম রেখে নিচে নেমে যায়। চোখজোড়া ঢুলুঢুলু। অসময়ে টেনে ধরছে ময়দার লেইয়ের মতো আঠালো নরম ঝিমুনি। নিজের তেজে তা নাকচ করবেন কি, আশপাশের গুলির আওয়াজ ছাদ-কার্নিশে আছড়ে পড়লে তার খানিকটা ফাঁকফোকরে ঘুরেফিরে বাতাস কুড়িয়ে আনে। পড়ন্ত বেলায় এই শব্দ নিঝুম বোবা শহরে ছড়ালে তিনিও সচকিত হয়ে ওঠেন। চোখের পর্দায় জড়ানো ঘোর সহসা চৌচির হয়ে পড়ে। নড়েচড়ে হাত-পা'র খিল ফেরাতে নজরও টলে আশপাশ হয়। চশমার মাইনাস বদল ছাড়া, নাহ-ঠোঁটের ওপর আরও কি বিড়বিড়ানি জমিয়ে রেখেই দ্যাখেন, গেট পেরিয়ে ভিতরে আসার মুখে বা পাশে যুদ্ধের ৯ মাসে গৈ-গ্রামের মতো জমে খাওয়া ফালতু আগাছার পাশ দিয়ে কে একজন হেঁটে গেল মন্থর পায়ে। কে? মমিনউদ্দিনের অস্টম্ফুট স্বর। গলার সাজগোজ জম্পেশ না হওয়ায় মনের খটকা ঘুরে ওঠে হাহাকার হয়ে। কে হতে পারে? তাঁর অনুমানে কারও চেহারা, গড়ন, আধখানা ঘষা মুখ উদয় হলেও ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। মগজের ধার কি পুরোটাই ভোঁতা হয়ে গেল?
ক'দিন ঘুমের ঘোরে ছাইপাশ বদস্বপ্টেম্নর পীড়নে উঠে বসছেন বিছানায়। মধ্যরাতে একগলা জমাট অন্ধকারে ফ্যালফ্যাল শিশু চোখে চেয়ে টের পান-কেমন মাথা ধরা ধরা, চিড়িক মারছে ডান কপালের শিরা। কণ্ঠায় তেষ্টার চাপ। উপযুক্ত বল নেই হাতে-পায়ে। চাঙ্গা নেই পেশি। আজকাল নামাজে সেজদা দেওয়ার পর উপুড় হলে আর উঠতে পারেন না। মাজার কাছে চাপ চাপ ব্যথার দলা। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে জোর জমানোর পর দাঁড়াতে হয়। সমস্ত কিছুর পর কখনও ঝাল, কখনও তেতো বিরক্তি। বলকারক কিছু পেটে দেবেন সে উপায়ও খতম। সংসারের হাল এখন তাঁর মুঠিছাড়া। ওই ফালতু আগাছার মতোই পুরো তুচ্ছ সে। কে? ফের ছায়াময় আড়ালের দিকে প্রশ্ন পাঠিয়ে ষোলো আনা হুঁশ নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর মনস্থ করলেও মাজা আর ওঠে না। এই এক ফ্যাসাদ। বাড়ির মুরব্বি বলেও মান্যিগণ্যি, কি গ্রাহ্যি কেউ আমলে আনবে না? বড় ছেলে, মেজ ছেলের কাছে তাঁর একরত্তি মূল্য নেই। সদ্য ঘাড়ে বাড়ন্ত ছোট ছেলেরও আজকাল টং মেজাজ। আচমকা ঠাস ঠাস পশ্চিম মসজিদের পুকুরের ওপাশে ভুট্টা ক্ষেতের কোনাকুনিতে গর্জে ওঠা গুলি যেন অবৈধভাবে মমিনউদ্দিনের কোলে এসে পড়ে। তাঁর চমকানি থরথরিয়ে পা অবধি নেমে এলে একপাটি স্পঞ্জ সরে যায়।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ এখন যায় যায়; ভুঁইডাঙা থানা-জেলা সব মুক্তিবাহিনীর কব্জায়; তবু তাঁদের ভয়-সন্ত্রাস ঘটানো কাণ্ড? ঘোর অন্যায়। খামাখা গুলি খরচের এত কী? মমিনউদ্দিনের বোধ বিবেচনায় বিরক্তির সূচনা হতেই তা নিমেষ মাত্র, নাকি এখন নিজেরা নিজেরা? ভাবতেই জমানো উৎকণ্ঠা ফেটে যায়। মুখের রং বদলাতে থাকে। পাকিস্তান পয়দা করতে তার মতো অকেজো খড়কুটোর জানলবেজান কম হয়েছে? নাক টিপলে দুধ বেরোবে মুক্তিবাহিনীর এসব ছেলে-ছোকরা তাঁর কদর কি বোঝে? মগজ কই? আরে পাকিস্তান কি রাইফেল বন্দুকে মরে? যত বেদিন নাজায়েজ কায়কারবার। গুম মারা রোষ কলকল করে উঠলে ধীরে কাটতে থাকে চোখে জমা ঝাপসা লবণ। ধাক্কাধাক্কি করে ছবির পর ছবি এসে দাঁড়াতে বড় সংকটে ছেঁড়া ছেঁড়া দ্যাখেন- চৌদ্দ আগস্ট এলো মেলো ক'জোড়া বেসুরো গলার পাকসার জমিন শাদবাদ-সামনে শামিয়ানার নিচে অন্যমনস্ক কাচ্চাবাচ্চার মুখ-ভাঙাচোরা, অসন্তুষ্ট মুরব্বি তিনি স্টেজে। ঐ তো জিন্নাহ সাহেব, চুপসানো চোয়াল, লম্বাটে মুখ, মাথায় সাদা-কালো ক্যাপ-মোরগের পাখনা রঙের ... তিনি জড়িয়ে গেছেন বক্তৃতার প্রতি পরতে। সঙ্গে সঙ্গে কথার জোরও খুলে পড়ে। ঘুরে পড়ে যান। জিন্নাহ সাহেব, তাঁকে কখন দেখেছেন তিনি ? বাৎচিত? ঘুরে ঘুরে মুখটা কেন এত কাছাকাছি এসে যাচ্ছে? জিন্নাহর মুখ, তাঁর ক্লান্তিময় চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে কথার খেই আর খুঁজে পান না। কে একজন কানের কাছে তাঁর এই বাখান ব্রেক দিতে বললেন ফিসফিস করে। এই মধ্যপথে? অসম্ভব! জিন্নাহ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর দিকে। এই করগ্রহণের স্পর্শ কী নরম, কী সুখ। নিজের পাঞ্জা এগিয়ে দেয়ার আগেই টান পড়ে তাঁর শেরওয়ানির পেছনে। এক লহমায় কে কার আগে এমন পাল্লা দিয়ে কতগুলো যুবক মহফিল দলামোচা করে দিল বেশ ওস্তাদি হাতে। কোথায় জিন্নাহ? চোখের সামনে স্কুল মাঠের পেছনের গেট। তিড়িংয়ে লাফ দিয়ে তিনি কেটে এসেছেন। বাঁচোয়া, খানিক জোশ হুড়মুড়িয়ে শরীরে বুড়ো হাড়ের গেরোয় ঢুকে পড়েছিল।
এ অবধি এসে সাফসুতরা না থাকায় পুরোনো বিস্কুটের মতো ভেঙে যেতে থাকে ধুলোয় জমা ছবিগুলো। এবার পুরোটাই পড়ে যায় আশপাশের গুলির শব্দ, গাড়ির পেট ফাটানো গর্জন, কমান্ডিং স্বরের সন্ত্রাসে। মমিনউদ্দিন সজাগ হলেও চোখে সেটে থাকে পেঁয়াজের খোসার মতো অতিরিক্ত পাতলা ঘোর। দোজাহানের কিঞ্চিৎ নেকি নিশ্চয় অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে। তার বরাত জোর এটা। ঐদিন একটুও আঁচড় পড়ল না, দিব্যি অক্ষত থেকে গেল সুরতহাল। গভর্নর মোনায়েম খানের পেয়ারে বান্দা আমজাদ আলী, তাঁর দোস্ত হলো গিয়ে ইসহাক মিয়া, সেও শেরওয়ানি পরে ফিটফাট স্টেজে ছিল। তরতাজা মানুষটা কেমন সোজা হাসপাতালের বেডে চলে গেল।
ধুস, ভারি মুশকিল, বিস্তর ছবি আসছে একে অন্যকে ধাওয়া করে। ধারাবাহিকতা ভেঙে যাচ্ছে। চাপ সামলে ওঠার হিমশিমে পড়ে যান মমিনউদ্দিন। তবে ছবির কোনোটার কোনা ছেঁড়া অর্ধেক স্বচ্ছ তো কোনোটার বাকিটুকু ঝাপসা, আর কালো নেগেটিভ ছবিগুলো কিছুই প্রকাশ করে না। এমন হিজিবিজি প্যাঁচে পড়ে ক্লান্তিতে হাই আসে। চোখে পানি জমে খানিক স্বচ্ছতার সংস্থান হলে দ্যাখেন, নিজের দুই পুত্তুরের মুখ। কত বড় বেতমিজ, তাঁরই সামনে টং কণ্ঠে গরম বাষ্প উড়ানো, কী সাংঘাতিক বাগড়া দেয়া কথা-
'জন্মদাতা আর যাই হন, যত্তসব, মদোমাতালদের আবার ইসলাম? পাকিস্তান? বুজরুকি?'
কী ইতর তাচ্ছিল্য করে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেয়া তাঁকে। তাজ্জব করা ভেঙচি। মুখ আর রইল কই? ইজ্জতের ওপর রীতিমতো মুগুর পেটানো। এতদিনের পজিশন পয়মাল করে দিল ঘরের শত্রু দুই পুত্তুরে। সাধ করে দেড় বছরের ছোট-বড় এই বেতরিবত দুই চাঁদের নাম রাখা কিনা জিন্নাহ লিয়াকত?
-'কে ওখানে?'
মচমচ জুতোর দাম্ভিক আওয়াজের লক্ষ্যে স্বর ছুটে গেলে আলগোছে খুলে পড়ে পুরোনো স্মৃতির ফ্রেম।
-'কেন কী? নিকেশ দিতে হবে?'
পাটকেল মারা মেজাজি জবাব খাম্বার আড়াল থেকে ফিরে এলে মমিনউদ্দিন মুখে কুলুপ এঁটে নেন।
মেজ ছেলে- এ বড় ভয়ংকর ঘাড়। খুঁচিয়ে ঘা বড় করার সাহস হয় না তাঁর। চ্যাট্যাং চ্যাটাং কথা তো না যেন আস্ত খোয়া এক-একটা।
ফটাস শব্দে হঠাৎ বারান্দার দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগও উল্টে যায় মমিনউদ্দিনের। এতক্ষণের চালু, ফ্লাশব্যাক ছিঁড়ে যেতে সাদাকালো আলো-ছায়ার খেলা হয়। পলকা ক'মুহূর্তে, হতবুদ্ধি ঝেড়ে ঘাড় ঘোরাতে দ্যাখেন- পায়ে গামবুট, পরনে টাইট প্যান্ট, ঘাড়ে ওটা কী উঁচু নল, জাঁহাবাজের মতো স্পর্ধায় বুক ফুলিয়ে মিলিটারি চালে হেঁটে আসছে ছোট ছেলে শরিফুল।
-'অ্যা, 'এসব কী, অ্যা।'
ভয়ে-উত্তেজনায়-বিস্ময়ে তাঁর আধফোটা স্বর খণ্ড খণ্ড হয়। কী অবিশ্বাস্য অথচ জ্যান্ত দৃশ্য। ছাতলা পড়া চোখ আকারে বড় হলে রুগ্ণ নূরে চশমে তেজীয়ান ভাব চলে আসে। আশ্চর্য, যথেষ্ট পরিস্কার দেখছেন : শরিফুলের ডোন্ট কেয়ার বুকের পাটা। এক হাত প্যান্টের পকেটে রেখে আর এক হাত হাওয়ায় নাচল-
'ও এটা, বায়েজিদ ভাইয়ের। মেজ ভাইয়ের ফ্রেন্ড। আম্মাকে দেখালাম। এখন ফেরত দিতে যাচ্ছি।'
জঙ্গি বাহাদুরের চালে শরিফুল গটমট সরে গেলে মমিনউদ্দিন হুঁশজ্ঞানের কিনার খোঁজেন। শেষ অবধি ছোট ছেলেও? কষ্ট যন্ত্রণার কোপে পুরোদস্তুর আহত হতেই দিব্যি স্বচ্ছ একটা ছবি অবাধ্য বেগে লাফ দিয়ে উঠে বসে।
-'মমিন কৌন হ্যাঁয়?'
দুপুর সূর্যের তাতানো তাপ মাথায় নিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে সাত-আটটা ষণ্ডা কিসিমের পাকিস্তানি সেনা। ঘেমো শরীর। পয়লা নজরে তাঁর হূৎপিণ্ড ছিঁড়ে গালের মধ্যে যেন উঠে আসে। হাঁটুর বল পড়ে যায়। সামনের দরজা তো বন্ধ। নিশ্চয় পেছন দরজার নড়বড়ে পাল্লা উড়িয়ে ঢুকেছে। ক্রাইম, রীতিমতো ক্রাইম। ভাবতেই চুনের পোঁচ টানার মতো সাহসের পরত পড়ে মনে। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান করেছেন ৪০-৪৫ বছরের ওপরে, কত আগের, সেদিক থেকে নিজেও একজন ওয়াতন কা সিপাহি। রাইফেল বন্দুক ঘাড়ে নেননি, তাতে কী! খানিকটা সমীহ আদায়ের জন্য গলা নরম করেন-
'আইয়ে উপরমে, বৈঠিয়ে।'
কিন্তু স্বরের কাঁপুনি রোধ করতে পারলেন না। তাঁর এ খাতির জমানো মিঠা কথা বুটে পিষে ইজ্জত খতম করে দেয় আগ বাড়ানো মোটা সিপাহিটা। া
-'মালাউনকা বাচ্চা, মমিনউদ্দিন কৌন হ্যাঁয়?'
-'জি আমি, ম্যায়, হাম হ্যায়।'
গোঁজামিলে এলোপাতাড়ি জবাবের সঙ্গে থরহরি খাবি খেতে থাকেন। নিশ্চয় এতদিনের বাসি রাগের শোধ নিতে এই নচ্ছার পাজির ঝাড়কে গরম করেছে রহমান কাজী? শান্তি কমিটির পালের গোদা সে। মোক্ষম চান্স বটে তাঁর। নচেৎ এই সাচ্চা পাকিস্তানিকে বেইজ্জতি করার উস্কানি কোত্থেকে এরা জোগান পায়? তবু গলা ঘষে-মেজে নিজের কদরকে আস্তাকুঁড় থেকে তুলে আনতে মরিয়া হয়ে ওঠেন-
'বৈঠিয়ে, আপলোগ পাকিস্তান কা সাচ্চা আদমি, মুসলিম। ম্যায়ও মুসলিম। আইয়ে উপরমে।'
-'লিয়াকত জিন্নাহ কিদার?'
আরেক দফা মমিনউদ্দিনের পুরো বাগজাল পাত্তা না দিয়ে দুই পুত্তুরের উদ্দেশ্যে সোজাসাপটা জিজ্ঞেস তাঁর বুকের যন্ত্রপাতি কাঁপিয়ে দেয়। ফের ধমক পড়লে হাড়-পেশি-নখও খুলে পড়বে যেন। তা এতদিনের বয়সী ঝুনো মাথা কি বিগড়ে গেছে? প্রশ্নটা নিজেকে শোনালেও জলজ্যান্ত এই বিনাশ ঘটানো বিপর্যয়ে শাঁই শাঁই মগজ ঘুরতে থাকে। মাত্র ক'সেকেন্ড, জবরদস্ত এক ফন্দি তাঁর ঘিলুর ওপর জিয়ল গাছের আঠার মতো সেটে যায়। আলমারির কাগজ, কাপড় জামা সরিয়ে ন্যাপথলিনের গন্ধ থেকে নিয়ে এলেন জিন্নাহর বাঁধানো ছবিটা।
-'ইয়ে হ্যায় জিন্নাহ। বিলকুল পাকিস্তানি কদর করতা। কায়েদে আযম। বহুত উঁচা ম্যান। হামিও পাকিস্তান পয়দাছে লড়তা হ্যায়। ইসলাম জিন্দা তো পাকিস্তানও জিন্দা রহেগা।'
মমিনউদ্দিনের পুরোনো কাসুন্দির সঙ্গে জিন্নাহকে মেশানো এ কথা যে কী, তা না বুঝে বা শাসালো এমন কিছু সাধারণ মাথার না, ভেবে সিপাহিদের বয়স্কজন-
'ঠিক হ্যাঁয়, ঠিক হ্যাঁয়' বলে, সঙ্গীদের ফেরত নিয়ে চলে গেল-
অ্যাবাউট টার্ন, মার্চ।
তখন বাইরে সর্বনাশা কারফিউ। অকরুণ আকাশে শকুনগুলো উঁচু থেকে পাক খেতে খেতে উল্টো পাক দিয়ে শাঁ করে কোথায় যেন নেমে যায়। কারফিউ শিথিল হলে এ সুযোগে দৌড়ে বাজার নিয়ে ফিরে বারেকের গলা খলবল বেজে উঠে-
'কী কবো চাচি, বন্দুকির নল দিয়ে মারতি মারতি ছ্যামরাডারে নিয়ে গেল। শালা মুক্তি কাঁহাকা বইলে সে কী বেদম মাইর।
শুনেই গলা চেপে আতঙ্কে কাঁদতে বসেন লুৎফুননেছা। পানি যেন ফোঁটা ফোঁটা চোখের কোলে মজুত ছিল। আর পারা গেল না; ফাইফরমায়েশ খাটুয়ে এই বারেক ছোকরাকে কো-অপারেটিভ ব্যাংকের আলফাজ মিয়া এনে গছিয়ে দিয়েছিলেন। এই উজবুককে পই পই নিষেধ করেও শেখাতে পারেননি- ঘরের কথা বাইরে না, বাইরের কথা ঘরে না। কিন্তু হাভাতে চ্যাংড়া হাবাগোবাই থেকে গেল নিরেট। 'হারামজাদা গুল-গপ্প মারতি বারণ করিছি না'-
বিরক্ত হয়ে রেগে মমিনউদ্দিন চড় উঁচু করতেই হা-খোলা দরজার চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে এক গোঙানো যুবক।
'বাঁচান আমারে, আমার ধম্মের বাপ আপনি।'
কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরো পরিবেশ ঘোরের ভেতরে রেখে মমিনউদ্দিনের পা চেপে ধরে। ভয়ে আঁতকে উঠে লুৎফুননেছা নিজেকে আড়াল করে নিলেন ছোট ছেলের চৌখুপিতে।
যুবকের ফ্যাকাশে মুখ কান-পিঠ জুড়ে দরদরে ঘাম, গায়ে আধময়লা শার্ট।
'আমাদের তাড়া করিছে ওরা। ধরলি আর বাঁচা নেই। বাঁচান আমারে।'
ভয়খেকো স্বরের সঙ্গে ফুসফুসের বাতাস বেরিয়ে এলে শুকনো মুখ আরও কাতর হয়ে ওঠে। দেয়াল লাগোয়া খাট- উই ধরা মচমচে। নিচের গাঁটরি-বোঁচকা, ভাঙা ঝাঁপি, তেবড়ানো টিনবাক্স আরও কী কী রাখার কারণে ঘোলা অন্ধকার জমে আছে। ডুকরে উঠে যুবক হামাগুড়ি দিয়ে নিজেকে গায়েব করে দেয় তার ভেতর। মুহূর্ত মাত্র পাঁচ-পাঁচটা তাগড়া ঘাড়ে গর্দানে আঁট বাঁধুনির খানসেনা কপাটে বুট মেরে বল্লম বেগে ঢুকে পড়ে।
'মুক্তি কাঁহা গিয়া? বোলো ইদার দৌড়কে আঁকার অন্দরমে ঘুসনে দেখা। বোলো মুক্তি কাঁহা?'
তছনছ করা মেজাজে শোরগোল তুলে তন্নতন্ন করে। নিমেষে লন্ডভন্ড হয়ে যায় ঘরের তৈজসপত্র। পায়ের লাথিতে গড়াতে গড়াতে যায় ঘটিবাটি। এক সিপাহি গরম হয়ে কষে থাপ্পড় মারে বারেকের গালে। ওই এক চড়ে তাঁর জবান বন্ধ হয়ে যায়। রাইফেলের বাঁট এসে পড়ে এবার মমিনউদ্দিনের পাছার ওপর-
'মুক্তি কাঁহা?'
চড়া স্বরের ধমক আর ব্যথা মাথার তালু অবধি উঠে আঁচড়াতে যন্ত্রণায় শিথিল হয়ে যায় মমিনউদ্দিনের চোয়ালচাপা কাঠিন্য। মর্দগুলোর ঘাড় তো না রীতিমতো ষাঁড়ের কু'কুদ, আর তা ফুলতে দেখে মমিনউদ্দিনের মগজও ফাঁক হয়ে যায়। আঙুল তুলে খাটের তলা দেখিয়ে ঘুরে দেয়াল ধরে বসে পড়েন। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করা হয় যুবককে। আশ্চর্য, নির্ঘাত মরণ জেনে বুঝি এখন চেহারায় ছিটেফোঁটাও ভয় নেই তাঁর। রাইফেলের বাঁট পড়ে ডান ভ্রুর ওপরে। টাল খেয়ে ঘুরে পড়লে পেছন থেকে চড়াৎ শব্দে চড় পড়ে ঘাড়ে। সোজা সটান হয়ে ঢুলতে থাকে যুবক। ডান চোখ, ডান গালের পাশ ঢেকে গেছে রক্ত ছাপিয়ে। দরদর করে নিচে নেমে জামা ভিজিয়ে দেয়। বাঁ চোখ একবার ঘুরে আসে মমিনউদ্দিনের পর। ওই তীব্র চাহনির মুখে কুঁকড়ে যান মমিনউদ্দিন। বোবা মুখ, স্থির পাথুরে চোখ, বড় উত্তেজনা নিয়ে তিনি দ্যাখেন- বেয়নেট চালিয়ে ফুটিফাটা করে পাকিস্তানি সেনারা যুবককে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ধড়ফড় করে জেগে ওঠে মমিনউদ্দিন। জোর করে মুখটা উড়িয়ে দিতে চাইলেন। শিরশিরে হিমস্বাদ টের পাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা দুই ছেলের রুক্ষ কটাশে লম্বা চুল, মুখময় দাড়ি, রোদপোড়া মুখ, ডালিম ফুলের রঙের চোখ, শহর দখল করা জয়ী মেজাজ এনে গুঁজে দিতে চেষ্টা করেন নিজের মনের ফাঁকফোকরে।
তবু 'বাঁচান আমারে আপনি আমার বাপের মতো'- এই করুণ আর্তনাদ কানের কাছে গোঙানির মতো বেজে যেতে থাকলে অপরাধবোধে নুয়ে আসেন তিনি। চারপাশের হা হা শূন্যতা তাঁকে নির্মমভাবে গিলে নেয়। আচমকা কাচভাঙা ঝনঝনাৎ জোরালো আওয়াজ নিস্তব্ধতা ফালা ফালা করে উড়ে এলে সামনে থেকে শাঁ করে মুখটা সরে যায়। ঝটিতি হুঁশজ্ঞানের নাগাল পেয়ে যান।
অন্ধকারে বারান্দা ডুবে গেছে। চোখের সামনে ঘন কালিবিষ অন্ধকার। আলোটা পর্যন্ত কেউ জ্বালেনি। একটা মানুষ বারান্দায় সেই কখন থেকে ঠায় বসে কারও খেয়াল নেই? কষ্ট-অস্বস্তির মধ্যে চোখের নজর ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। ফের কাচ ভাঙা শব্দ বেজে উঠলে ঝাঁকুনি দিয়ে ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পায়ে বুঝি রস জমে গেছে। পাতা ফেলতে পারছেন না। ভারী ঠেকছে। ধীরে সুস্থে শ্বাস ফিরিয়ে পা টেনে টেনে দেয়াল হাতড়ে বারান্দার সুইচ চাপতে অন্ধকারে আলো জ্বলে ওঠে। দাঁড়িয়ে চোখে আলো সয়ে এলে পাশ ফিরলেন।
ও কে বারান্দার নিচে? শরিফুল না? ওখানে? কী ও পায়ের কাছে? আলোর খণ্ডাংশ চোখে রেখে ভালো করে ঠাউরে মমিনউদ্দিন মাথাঘুল্লির পতন দেয়াল ধরে ঠেকিয়ে দেন। এত যত্নে বাঁধানো লুকিয়ে রাখা জিন্নাহর ছবি। কাচ ভেঙে চৌচির। জিন্নাহর মুখের জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। শরিফুল এবার রাগী যুবক গলায় ফুকরে ওঠে-
'কলেজের ক্যাম্পে রাইফেল ঘাড়ে মুক্তিযোদ্ধা অনেককে দেখলাম, আমার বয়সী, আর আমি- আমারে তুমি যুদ্ধে যাতি দেওনি। এই ছবি ভাঙো, পাকিস্তান তো মরিছে, এডারে এহন মারি।
ক'দিন ঘুমের ঘোরে ছাইপাশ বদস্বপ্টেম্নর পীড়নে উঠে বসছেন বিছানায়। মধ্যরাতে একগলা জমাট অন্ধকারে ফ্যালফ্যাল শিশু চোখে চেয়ে টের পান-কেমন মাথা ধরা ধরা, চিড়িক মারছে ডান কপালের শিরা। কণ্ঠায় তেষ্টার চাপ। উপযুক্ত বল নেই হাতে-পায়ে। চাঙ্গা নেই পেশি। আজকাল নামাজে সেজদা দেওয়ার পর উপুড় হলে আর উঠতে পারেন না। মাজার কাছে চাপ চাপ ব্যথার দলা। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ধীরে জোর জমানোর পর দাঁড়াতে হয়। সমস্ত কিছুর পর কখনও ঝাল, কখনও তেতো বিরক্তি। বলকারক কিছু পেটে দেবেন সে উপায়ও খতম। সংসারের হাল এখন তাঁর মুঠিছাড়া। ওই ফালতু আগাছার মতোই পুরো তুচ্ছ সে। কে? ফের ছায়াময় আড়ালের দিকে প্রশ্ন পাঠিয়ে ষোলো আনা হুঁশ নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর মনস্থ করলেও মাজা আর ওঠে না। এই এক ফ্যাসাদ। বাড়ির মুরব্বি বলেও মান্যিগণ্যি, কি গ্রাহ্যি কেউ আমলে আনবে না? বড় ছেলে, মেজ ছেলের কাছে তাঁর একরত্তি মূল্য নেই। সদ্য ঘাড়ে বাড়ন্ত ছোট ছেলেরও আজকাল টং মেজাজ। আচমকা ঠাস ঠাস পশ্চিম মসজিদের পুকুরের ওপাশে ভুট্টা ক্ষেতের কোনাকুনিতে গর্জে ওঠা গুলি যেন অবৈধভাবে মমিনউদ্দিনের কোলে এসে পড়ে। তাঁর চমকানি থরথরিয়ে পা অবধি নেমে এলে একপাটি স্পঞ্জ সরে যায়।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ এখন যায় যায়; ভুঁইডাঙা থানা-জেলা সব মুক্তিবাহিনীর কব্জায়; তবু তাঁদের ভয়-সন্ত্রাস ঘটানো কাণ্ড? ঘোর অন্যায়। খামাখা গুলি খরচের এত কী? মমিনউদ্দিনের বোধ বিবেচনায় বিরক্তির সূচনা হতেই তা নিমেষ মাত্র, নাকি এখন নিজেরা নিজেরা? ভাবতেই জমানো উৎকণ্ঠা ফেটে যায়। মুখের রং বদলাতে থাকে। পাকিস্তান পয়দা করতে তার মতো অকেজো খড়কুটোর জানলবেজান কম হয়েছে? নাক টিপলে দুধ বেরোবে মুক্তিবাহিনীর এসব ছেলে-ছোকরা তাঁর কদর কি বোঝে? মগজ কই? আরে পাকিস্তান কি রাইফেল বন্দুকে মরে? যত বেদিন নাজায়েজ কায়কারবার। গুম মারা রোষ কলকল করে উঠলে ধীরে কাটতে থাকে চোখে জমা ঝাপসা লবণ। ধাক্কাধাক্কি করে ছবির পর ছবি এসে দাঁড়াতে বড় সংকটে ছেঁড়া ছেঁড়া দ্যাখেন- চৌদ্দ আগস্ট এলো মেলো ক'জোড়া বেসুরো গলার পাকসার জমিন শাদবাদ-সামনে শামিয়ানার নিচে অন্যমনস্ক কাচ্চাবাচ্চার মুখ-ভাঙাচোরা, অসন্তুষ্ট মুরব্বি তিনি স্টেজে। ঐ তো জিন্নাহ সাহেব, চুপসানো চোয়াল, লম্বাটে মুখ, মাথায় সাদা-কালো ক্যাপ-মোরগের পাখনা রঙের ... তিনি জড়িয়ে গেছেন বক্তৃতার প্রতি পরতে। সঙ্গে সঙ্গে কথার জোরও খুলে পড়ে। ঘুরে পড়ে যান। জিন্নাহ সাহেব, তাঁকে কখন দেখেছেন তিনি ? বাৎচিত? ঘুরে ঘুরে মুখটা কেন এত কাছাকাছি এসে যাচ্ছে? জিন্নাহর মুখ, তাঁর ক্লান্তিময় চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে কথার খেই আর খুঁজে পান না। কে একজন কানের কাছে তাঁর এই বাখান ব্রেক দিতে বললেন ফিসফিস করে। এই মধ্যপথে? অসম্ভব! জিন্নাহ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর দিকে। এই করগ্রহণের স্পর্শ কী নরম, কী সুখ। নিজের পাঞ্জা এগিয়ে দেয়ার আগেই টান পড়ে তাঁর শেরওয়ানির পেছনে। এক লহমায় কে কার আগে এমন পাল্লা দিয়ে কতগুলো যুবক মহফিল দলামোচা করে দিল বেশ ওস্তাদি হাতে। কোথায় জিন্নাহ? চোখের সামনে স্কুল মাঠের পেছনের গেট। তিড়িংয়ে লাফ দিয়ে তিনি কেটে এসেছেন। বাঁচোয়া, খানিক জোশ হুড়মুড়িয়ে শরীরে বুড়ো হাড়ের গেরোয় ঢুকে পড়েছিল।
এ অবধি এসে সাফসুতরা না থাকায় পুরোনো বিস্কুটের মতো ভেঙে যেতে থাকে ধুলোয় জমা ছবিগুলো। এবার পুরোটাই পড়ে যায় আশপাশের গুলির শব্দ, গাড়ির পেট ফাটানো গর্জন, কমান্ডিং স্বরের সন্ত্রাসে। মমিনউদ্দিন সজাগ হলেও চোখে সেটে থাকে পেঁয়াজের খোসার মতো অতিরিক্ত পাতলা ঘোর। দোজাহানের কিঞ্চিৎ নেকি নিশ্চয় অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে। তার বরাত জোর এটা। ঐদিন একটুও আঁচড় পড়ল না, দিব্যি অক্ষত থেকে গেল সুরতহাল। গভর্নর মোনায়েম খানের পেয়ারে বান্দা আমজাদ আলী, তাঁর দোস্ত হলো গিয়ে ইসহাক মিয়া, সেও শেরওয়ানি পরে ফিটফাট স্টেজে ছিল। তরতাজা মানুষটা কেমন সোজা হাসপাতালের বেডে চলে গেল।
ধুস, ভারি মুশকিল, বিস্তর ছবি আসছে একে অন্যকে ধাওয়া করে। ধারাবাহিকতা ভেঙে যাচ্ছে। চাপ সামলে ওঠার হিমশিমে পড়ে যান মমিনউদ্দিন। তবে ছবির কোনোটার কোনা ছেঁড়া অর্ধেক স্বচ্ছ তো কোনোটার বাকিটুকু ঝাপসা, আর কালো নেগেটিভ ছবিগুলো কিছুই প্রকাশ করে না। এমন হিজিবিজি প্যাঁচে পড়ে ক্লান্তিতে হাই আসে। চোখে পানি জমে খানিক স্বচ্ছতার সংস্থান হলে দ্যাখেন, নিজের দুই পুত্তুরের মুখ। কত বড় বেতমিজ, তাঁরই সামনে টং কণ্ঠে গরম বাষ্প উড়ানো, কী সাংঘাতিক বাগড়া দেয়া কথা-
'জন্মদাতা আর যাই হন, যত্তসব, মদোমাতালদের আবার ইসলাম? পাকিস্তান? বুজরুকি?'
কী ইতর তাচ্ছিল্য করে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেয়া তাঁকে। তাজ্জব করা ভেঙচি। মুখ আর রইল কই? ইজ্জতের ওপর রীতিমতো মুগুর পেটানো। এতদিনের পজিশন পয়মাল করে দিল ঘরের শত্রু দুই পুত্তুরে। সাধ করে দেড় বছরের ছোট-বড় এই বেতরিবত দুই চাঁদের নাম রাখা কিনা জিন্নাহ লিয়াকত?
-'কে ওখানে?'
মচমচ জুতোর দাম্ভিক আওয়াজের লক্ষ্যে স্বর ছুটে গেলে আলগোছে খুলে পড়ে পুরোনো স্মৃতির ফ্রেম।
-'কেন কী? নিকেশ দিতে হবে?'
পাটকেল মারা মেজাজি জবাব খাম্বার আড়াল থেকে ফিরে এলে মমিনউদ্দিন মুখে কুলুপ এঁটে নেন।
মেজ ছেলে- এ বড় ভয়ংকর ঘাড়। খুঁচিয়ে ঘা বড় করার সাহস হয় না তাঁর। চ্যাট্যাং চ্যাটাং কথা তো না যেন আস্ত খোয়া এক-একটা।
ফটাস শব্দে হঠাৎ বারান্দার দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগও উল্টে যায় মমিনউদ্দিনের। এতক্ষণের চালু, ফ্লাশব্যাক ছিঁড়ে যেতে সাদাকালো আলো-ছায়ার খেলা হয়। পলকা ক'মুহূর্তে, হতবুদ্ধি ঝেড়ে ঘাড় ঘোরাতে দ্যাখেন- পায়ে গামবুট, পরনে টাইট প্যান্ট, ঘাড়ে ওটা কী উঁচু নল, জাঁহাবাজের মতো স্পর্ধায় বুক ফুলিয়ে মিলিটারি চালে হেঁটে আসছে ছোট ছেলে শরিফুল।
-'অ্যা, 'এসব কী, অ্যা।'
ভয়ে-উত্তেজনায়-বিস্ময়ে তাঁর আধফোটা স্বর খণ্ড খণ্ড হয়। কী অবিশ্বাস্য অথচ জ্যান্ত দৃশ্য। ছাতলা পড়া চোখ আকারে বড় হলে রুগ্ণ নূরে চশমে তেজীয়ান ভাব চলে আসে। আশ্চর্য, যথেষ্ট পরিস্কার দেখছেন : শরিফুলের ডোন্ট কেয়ার বুকের পাটা। এক হাত প্যান্টের পকেটে রেখে আর এক হাত হাওয়ায় নাচল-
'ও এটা, বায়েজিদ ভাইয়ের। মেজ ভাইয়ের ফ্রেন্ড। আম্মাকে দেখালাম। এখন ফেরত দিতে যাচ্ছি।'
জঙ্গি বাহাদুরের চালে শরিফুল গটমট সরে গেলে মমিনউদ্দিন হুঁশজ্ঞানের কিনার খোঁজেন। শেষ অবধি ছোট ছেলেও? কষ্ট যন্ত্রণার কোপে পুরোদস্তুর আহত হতেই দিব্যি স্বচ্ছ একটা ছবি অবাধ্য বেগে লাফ দিয়ে উঠে বসে।
-'মমিন কৌন হ্যাঁয়?'
দুপুর সূর্যের তাতানো তাপ মাথায় নিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে সাত-আটটা ষণ্ডা কিসিমের পাকিস্তানি সেনা। ঘেমো শরীর। পয়লা নজরে তাঁর হূৎপিণ্ড ছিঁড়ে গালের মধ্যে যেন উঠে আসে। হাঁটুর বল পড়ে যায়। সামনের দরজা তো বন্ধ। নিশ্চয় পেছন দরজার নড়বড়ে পাল্লা উড়িয়ে ঢুকেছে। ক্রাইম, রীতিমতো ক্রাইম। ভাবতেই চুনের পোঁচ টানার মতো সাহসের পরত পড়ে মনে। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান করেছেন ৪০-৪৫ বছরের ওপরে, কত আগের, সেদিক থেকে নিজেও একজন ওয়াতন কা সিপাহি। রাইফেল বন্দুক ঘাড়ে নেননি, তাতে কী! খানিকটা সমীহ আদায়ের জন্য গলা নরম করেন-
'আইয়ে উপরমে, বৈঠিয়ে।'
কিন্তু স্বরের কাঁপুনি রোধ করতে পারলেন না। তাঁর এ খাতির জমানো মিঠা কথা বুটে পিষে ইজ্জত খতম করে দেয় আগ বাড়ানো মোটা সিপাহিটা। া
-'মালাউনকা বাচ্চা, মমিনউদ্দিন কৌন হ্যাঁয়?'
-'জি আমি, ম্যায়, হাম হ্যায়।'
গোঁজামিলে এলোপাতাড়ি জবাবের সঙ্গে থরহরি খাবি খেতে থাকেন। নিশ্চয় এতদিনের বাসি রাগের শোধ নিতে এই নচ্ছার পাজির ঝাড়কে গরম করেছে রহমান কাজী? শান্তি কমিটির পালের গোদা সে। মোক্ষম চান্স বটে তাঁর। নচেৎ এই সাচ্চা পাকিস্তানিকে বেইজ্জতি করার উস্কানি কোত্থেকে এরা জোগান পায়? তবু গলা ঘষে-মেজে নিজের কদরকে আস্তাকুঁড় থেকে তুলে আনতে মরিয়া হয়ে ওঠেন-
'বৈঠিয়ে, আপলোগ পাকিস্তান কা সাচ্চা আদমি, মুসলিম। ম্যায়ও মুসলিম। আইয়ে উপরমে।'
-'লিয়াকত জিন্নাহ কিদার?'
আরেক দফা মমিনউদ্দিনের পুরো বাগজাল পাত্তা না দিয়ে দুই পুত্তুরের উদ্দেশ্যে সোজাসাপটা জিজ্ঞেস তাঁর বুকের যন্ত্রপাতি কাঁপিয়ে দেয়। ফের ধমক পড়লে হাড়-পেশি-নখও খুলে পড়বে যেন। তা এতদিনের বয়সী ঝুনো মাথা কি বিগড়ে গেছে? প্রশ্নটা নিজেকে শোনালেও জলজ্যান্ত এই বিনাশ ঘটানো বিপর্যয়ে শাঁই শাঁই মগজ ঘুরতে থাকে। মাত্র ক'সেকেন্ড, জবরদস্ত এক ফন্দি তাঁর ঘিলুর ওপর জিয়ল গাছের আঠার মতো সেটে যায়। আলমারির কাগজ, কাপড় জামা সরিয়ে ন্যাপথলিনের গন্ধ থেকে নিয়ে এলেন জিন্নাহর বাঁধানো ছবিটা।
-'ইয়ে হ্যায় জিন্নাহ। বিলকুল পাকিস্তানি কদর করতা। কায়েদে আযম। বহুত উঁচা ম্যান। হামিও পাকিস্তান পয়দাছে লড়তা হ্যায়। ইসলাম জিন্দা তো পাকিস্তানও জিন্দা রহেগা।'
মমিনউদ্দিনের পুরোনো কাসুন্দির সঙ্গে জিন্নাহকে মেশানো এ কথা যে কী, তা না বুঝে বা শাসালো এমন কিছু সাধারণ মাথার না, ভেবে সিপাহিদের বয়স্কজন-
'ঠিক হ্যাঁয়, ঠিক হ্যাঁয়' বলে, সঙ্গীদের ফেরত নিয়ে চলে গেল-
অ্যাবাউট টার্ন, মার্চ।
তখন বাইরে সর্বনাশা কারফিউ। অকরুণ আকাশে শকুনগুলো উঁচু থেকে পাক খেতে খেতে উল্টো পাক দিয়ে শাঁ করে কোথায় যেন নেমে যায়। কারফিউ শিথিল হলে এ সুযোগে দৌড়ে বাজার নিয়ে ফিরে বারেকের গলা খলবল বেজে উঠে-
'কী কবো চাচি, বন্দুকির নল দিয়ে মারতি মারতি ছ্যামরাডারে নিয়ে গেল। শালা মুক্তি কাঁহাকা বইলে সে কী বেদম মাইর।
শুনেই গলা চেপে আতঙ্কে কাঁদতে বসেন লুৎফুননেছা। পানি যেন ফোঁটা ফোঁটা চোখের কোলে মজুত ছিল। আর পারা গেল না; ফাইফরমায়েশ খাটুয়ে এই বারেক ছোকরাকে কো-অপারেটিভ ব্যাংকের আলফাজ মিয়া এনে গছিয়ে দিয়েছিলেন। এই উজবুককে পই পই নিষেধ করেও শেখাতে পারেননি- ঘরের কথা বাইরে না, বাইরের কথা ঘরে না। কিন্তু হাভাতে চ্যাংড়া হাবাগোবাই থেকে গেল নিরেট। 'হারামজাদা গুল-গপ্প মারতি বারণ করিছি না'-
বিরক্ত হয়ে রেগে মমিনউদ্দিন চড় উঁচু করতেই হা-খোলা দরজার চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে এক গোঙানো যুবক।
'বাঁচান আমারে, আমার ধম্মের বাপ আপনি।'
কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরো পরিবেশ ঘোরের ভেতরে রেখে মমিনউদ্দিনের পা চেপে ধরে। ভয়ে আঁতকে উঠে লুৎফুননেছা নিজেকে আড়াল করে নিলেন ছোট ছেলের চৌখুপিতে।
যুবকের ফ্যাকাশে মুখ কান-পিঠ জুড়ে দরদরে ঘাম, গায়ে আধময়লা শার্ট।
'আমাদের তাড়া করিছে ওরা। ধরলি আর বাঁচা নেই। বাঁচান আমারে।'
ভয়খেকো স্বরের সঙ্গে ফুসফুসের বাতাস বেরিয়ে এলে শুকনো মুখ আরও কাতর হয়ে ওঠে। দেয়াল লাগোয়া খাট- উই ধরা মচমচে। নিচের গাঁটরি-বোঁচকা, ভাঙা ঝাঁপি, তেবড়ানো টিনবাক্স আরও কী কী রাখার কারণে ঘোলা অন্ধকার জমে আছে। ডুকরে উঠে যুবক হামাগুড়ি দিয়ে নিজেকে গায়েব করে দেয় তার ভেতর। মুহূর্ত মাত্র পাঁচ-পাঁচটা তাগড়া ঘাড়ে গর্দানে আঁট বাঁধুনির খানসেনা কপাটে বুট মেরে বল্লম বেগে ঢুকে পড়ে।
'মুক্তি কাঁহা গিয়া? বোলো ইদার দৌড়কে আঁকার অন্দরমে ঘুসনে দেখা। বোলো মুক্তি কাঁহা?'
তছনছ করা মেজাজে শোরগোল তুলে তন্নতন্ন করে। নিমেষে লন্ডভন্ড হয়ে যায় ঘরের তৈজসপত্র। পায়ের লাথিতে গড়াতে গড়াতে যায় ঘটিবাটি। এক সিপাহি গরম হয়ে কষে থাপ্পড় মারে বারেকের গালে। ওই এক চড়ে তাঁর জবান বন্ধ হয়ে যায়। রাইফেলের বাঁট এসে পড়ে এবার মমিনউদ্দিনের পাছার ওপর-
'মুক্তি কাঁহা?'
চড়া স্বরের ধমক আর ব্যথা মাথার তালু অবধি উঠে আঁচড়াতে যন্ত্রণায় শিথিল হয়ে যায় মমিনউদ্দিনের চোয়ালচাপা কাঠিন্য। মর্দগুলোর ঘাড় তো না রীতিমতো ষাঁড়ের কু'কুদ, আর তা ফুলতে দেখে মমিনউদ্দিনের মগজও ফাঁক হয়ে যায়। আঙুল তুলে খাটের তলা দেখিয়ে ঘুরে দেয়াল ধরে বসে পড়েন। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করা হয় যুবককে। আশ্চর্য, নির্ঘাত মরণ জেনে বুঝি এখন চেহারায় ছিটেফোঁটাও ভয় নেই তাঁর। রাইফেলের বাঁট পড়ে ডান ভ্রুর ওপরে। টাল খেয়ে ঘুরে পড়লে পেছন থেকে চড়াৎ শব্দে চড় পড়ে ঘাড়ে। সোজা সটান হয়ে ঢুলতে থাকে যুবক। ডান চোখ, ডান গালের পাশ ঢেকে গেছে রক্ত ছাপিয়ে। দরদর করে নিচে নেমে জামা ভিজিয়ে দেয়। বাঁ চোখ একবার ঘুরে আসে মমিনউদ্দিনের পর। ওই তীব্র চাহনির মুখে কুঁকড়ে যান মমিনউদ্দিন। বোবা মুখ, স্থির পাথুরে চোখ, বড় উত্তেজনা নিয়ে তিনি দ্যাখেন- বেয়নেট চালিয়ে ফুটিফাটা করে পাকিস্তানি সেনারা যুবককে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ধড়ফড় করে জেগে ওঠে মমিনউদ্দিন। জোর করে মুখটা উড়িয়ে দিতে চাইলেন। শিরশিরে হিমস্বাদ টের পাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা দুই ছেলের রুক্ষ কটাশে লম্বা চুল, মুখময় দাড়ি, রোদপোড়া মুখ, ডালিম ফুলের রঙের চোখ, শহর দখল করা জয়ী মেজাজ এনে গুঁজে দিতে চেষ্টা করেন নিজের মনের ফাঁকফোকরে।
তবু 'বাঁচান আমারে আপনি আমার বাপের মতো'- এই করুণ আর্তনাদ কানের কাছে গোঙানির মতো বেজে যেতে থাকলে অপরাধবোধে নুয়ে আসেন তিনি। চারপাশের হা হা শূন্যতা তাঁকে নির্মমভাবে গিলে নেয়। আচমকা কাচভাঙা ঝনঝনাৎ জোরালো আওয়াজ নিস্তব্ধতা ফালা ফালা করে উড়ে এলে সামনে থেকে শাঁ করে মুখটা সরে যায়। ঝটিতি হুঁশজ্ঞানের নাগাল পেয়ে যান।
অন্ধকারে বারান্দা ডুবে গেছে। চোখের সামনে ঘন কালিবিষ অন্ধকার। আলোটা পর্যন্ত কেউ জ্বালেনি। একটা মানুষ বারান্দায় সেই কখন থেকে ঠায় বসে কারও খেয়াল নেই? কষ্ট-অস্বস্তির মধ্যে চোখের নজর ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। ফের কাচ ভাঙা শব্দ বেজে উঠলে ঝাঁকুনি দিয়ে ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পায়ে বুঝি রস জমে গেছে। পাতা ফেলতে পারছেন না। ভারী ঠেকছে। ধীরে সুস্থে শ্বাস ফিরিয়ে পা টেনে টেনে দেয়াল হাতড়ে বারান্দার সুইচ চাপতে অন্ধকারে আলো জ্বলে ওঠে। দাঁড়িয়ে চোখে আলো সয়ে এলে পাশ ফিরলেন।
ও কে বারান্দার নিচে? শরিফুল না? ওখানে? কী ও পায়ের কাছে? আলোর খণ্ডাংশ চোখে রেখে ভালো করে ঠাউরে মমিনউদ্দিন মাথাঘুল্লির পতন দেয়াল ধরে ঠেকিয়ে দেন। এত যত্নে বাঁধানো লুকিয়ে রাখা জিন্নাহর ছবি। কাচ ভেঙে চৌচির। জিন্নাহর মুখের জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। শরিফুল এবার রাগী যুবক গলায় ফুকরে ওঠে-
'কলেজের ক্যাম্পে রাইফেল ঘাড়ে মুক্তিযোদ্ধা অনেককে দেখলাম, আমার বয়সী, আর আমি- আমারে তুমি যুদ্ধে যাতি দেওনি। এই ছবি ভাঙো, পাকিস্তান তো মরিছে, এডারে এহন মারি।
বিষয় : মুক্তিযুদ্ধের গল্প সুশান্ত মজুমদার
মন্তব্য করুন