ষোলো ডিসেম্বর বিজয় ঘোষিত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেশে ফিরে, তখন তারা বিজয়ী বীরের গর্বে দিশেহারা। যুদ্ধফেরত কয়েকজন অস্ত্র ঘাড়ে নিয়েই গ্রামে দাপিয়ে বেড়ায়, কেউবা অকারণে আকাশে গুলি ছুড়ে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধার দর্প দেখায়, আর অস্ত্র ক্যাম্পে জমা দিয়ে খালি হাতে যারা ফিরেছে এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য ইন্ডিয়া গিয়েও যারা অস্ত্র-ট্রেনিং কিংবা যুদ্ধ করার সুযোগ পায়নি, স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দে জয় বাংলা ধ্বনি তাদের কণ্ঠেই বরং অধিক সোচ্চার। অন্যদিকে অবরুদ্ধ দেশে ৯ মাস লুকিয়ে-চুরিয়ে থেকেও যারা ছিল ষোলো আনা স্বাধীনতাপ্রত্যাশী, তারাও অনেকেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিশে প্রকাশ্য মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। সশস্ত্র ও নিরস্ত্র- সব মিলিয়ে আমাদের ইউনিয়নে অন্তত বিশজন যুবকের একটি মুক্তির দল প্রকাশ্য হয়ে ওঠে বিজয়ের মাসে। সাধারণ গ্রামবাসীর চোখে মুক্তিবাহিনী এখন স্বাধীন বাংলাদেশের মালিকের মতো মর্যাদাবান। অস্ত্রধারীদের দেখে ভয়ও পায় অনেকে।
আমাদের দলটির মধ্যে অস্ত্রধারীর সংখ্যা মাত্র তিন। তাদের মধ্যে আমজাদ সামান্য লেখাপড়া সম্বল ও গরিব চাষির ছেলে হয়েও সবার কাছে কমান্ডারের মর্যাদা পায়। কারণ, হাতে একটি স্টেনগান ছাড়াও কোমরে বাঁধা একটি গ্রেনেড নিয়ে গ্রামে ফিরেছে সে। রাইফেলধারী অন্য দুই মুক্তিও তাকে ওস্তাদ ডাকে। মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে একজন সেকশন কমান্ডার হিসেবে বারোজনের গ্রুপ নিয়ে অনেকগুলি অপারেশন চালিয়েছে সে। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা অপারেশনে পেছন থেকে ইন্ডিয়ান আর্মি হেভি অস্ত্রসহ কভার দিয়েছে। আর ৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার পর, মুক্তিবাহিনীর ওপর ভরসা না করে ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে চারদিক থেকে সম্মুখসমরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্থল-নৌ-আকাশপথে তারা বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকে পড়ে। মিত্রবাহিনীর কমান্ড মেনেই বিজয়ের মাত্র এক দিন আগে চৌদ্দজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমজাদ পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ক্যাম্পে গেরিলা আক্রমণ চালাতে নদীপথে বালাবাড়ী অপারেশনে এসেছিল। উল্টোদিক থেকে ইন্ডিয়ান আর্মি শত্রু ক্যাম্পে হেভি মর্টারশেল বর্ষণ শুরু করলে, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র খই ফুটিয়েছে। আমজাদ তার হাতের স্টেনগানটি দিয়ে তিনজন খানসেনাকে খতম করেছে। আর শত্রু ক্যাম্পে তার গ্রেনেড বিস্টেম্ফারণে হতাহত হয়েছে যারা, তাদের সংখ্যা কমসে কম চল্লিশ-পঞ্চাশ তো হবে। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে ভোরবেলা পাকিস্তানি বাহিনী পতাকা উড়িয়ে ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। বন্দি পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের অস্ত্রশস্ত্র ভারতীয় সৈন্যরা গাড়িতে করে নিজেদের ক্যাম্পে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে যুদ্ধ করতে করতে শেষ অপারেশনে নিজের জেলায় চলে এসেছিল বলে, কমান্ডার আমজাদের ইচ্ছে ছিল পরাজিত শত্রু বাহিনীর অন্তত একজনের কল্লা হাতে নিয়ে বাড়িতে ফেরার। কিন্তু মিত্রবাহিনীর বাধার কারণে পারেনি। মৃত পাকিস্তানি সেনাদের লাশগুলি মুক্তিরা নদীতে ও বড় একটি গর্তে ছুড়ে দিয়েছে। কুত্তা-শিয়ালের সুবিধা করে দিতে ভালো করে মাটিচাপাও দেয়নি।
নতুন করে আমজাদের বীরত্বগাথার গল্প শুনে তার শেষ ইচ্ছেটি সমর্থন জানাতে এবং কার্যকর হতে না পারার আফসোস নিয়েও আমাদের দলের এক নিরস্ত্র মুক্তি প্রস্তাব দেয়-
'ক্যান্টনমেন্টে সারেন্ডার করার পর পাকিস্তানি বাহিনীকে শোরের পালের মতো বন্দি করিয়া রাখছে ইন্ডিয়ান মিলিটারি। চলেন আমজাদ ভাই, আমরা ক্যান্টনমেন্টে গিয়া মিত্রবাহিনীর ভাইদের রিকোয়েস্ট করিয়া অন্তত দুই-চাইরটা শোরের বাচ্চাকে নিজেদের জিম্মায় নিয়া আসি। তারপর গ্রামে আনিয়া চামড়া ছিলে লবণ দেব, শত্রুর কাটা মুণ্ড দিয়া ফুটবল খেলব।'
দেশে পালিয়ে থেকেই মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করেছে এবং এখনও জীবন দিয়ে হলেও যে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, এমন এক মুক্তি প্রস্তাবটি সমর্থন করে জোরগলায় মন্তব্য করে-
'হামরার স্বাধীন দেশত ইন্ডিয়ান আর্মির মাতবরি মানব না হামরা। চলেন, সবাই মিলিয়া যাই আমরা ক্যান্টনমেন্টে। দাবি জানাই, জাতশত্রুকে শেল্টার না দিয়া হামরার হাতে ছাড়িয়া দাও। যা বিচার করার হামরাই করমু।'
কিন্তু মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে দেশি নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার এমন চোটপাট পছন্দ হয় না প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের। কারণ সবাই জানে, মুক্তিযুদ্ধে ইন্ডিয়া তো আর উড়ে এসে বাংলাদেশে জুড়ে বসেনি। যুদ্ধ শুরু হলে আশি লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের কায়দাকৌশল শিখিয়েছে। অস্ত্র দিয়েছে, আবার পেছনে থেকে ইন্ডিয়ান ফৌজ হেভি অস্ত্র দিয়ে কভারিং ফায়ার দিয়েছে। সবশেষে সর্বশক্তি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বলেই দেশ এত জলদি স্বাধীন হয়েছে। সেই মিত্র বাহিনীর সঙ্গে বাহাসের প্রস্তাব শুনে কমান্ডার আমজাদ হুংকার দেয়-
'নিমকহারাম, মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দ করবি না কেউ। আগে ঘরের শত্রু বিভীষণদের খতম করতে হবে আগে। পাকিস্তানি বাহিনীর দালাল রাজাকাররা কোথায় পালাইছে. মাথার উঁকুনের মতো উটকায় বাইর করো।'
আমাদের এলাকা শত্রুমুক্ত হয়েছে আসলে ষোলো ডিসেম্বরের বেশ আগে। পাকিস্তানি বাহিনী আসছে আসবে শুনেই আতঙ্কে ঘর ছেড়েছিল অনেকে। ভাগ্য ভালো প্রত্যন্ত গ্রামবাসীর, শেষ পর্যন্ত আসেনি খানসেনারা। তবে রাজাকার বাহিনী ক্যাম্প করেছিল বাজারের স্কুলে। শান্তি কমিটিও হয়েছিল। তারা ষোলো ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সারেন্ডারের খবর এবং বিজয়ী মুক্তিফৌজ গ্রামে ফিরছে শুনেই গা-ঢাকা দিয়েছে সবাই। গ্রামে ফিরেই এলাকার কুখ্যাত রাজাকার ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের পরিচয় এবং তাদের কুকীর্তির খবর জানতে দেরি হয়নি আমাদের। এদের মধ্যে পাশের ইউনিয়নের কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার আমাদের গ্রামেও মুক্তিবাহিনী সমর্থকদের ওপর যথেষ্ট হামলা নির্যাতন করেছে। খোরশেদকে ধরতে আমজাদের নেতৃত্বে আমরা রাতের অন্ধকারে এক দিন খোরশেদের বাড়িতে হানা দিয়েছি। শত্রুকে না পেয়ে তার বাড়িঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও ঘরের শত্রু বিভীষণদের ওপর প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা কমেনি মুক্তিযোদ্ধাদের। আক্রোশটা ভুক্তভোগী গ্রামবাসীদেরও কম নয়। কমান্ডার আমজাদের হুকুম পেয়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে গ্রামবাসীও পলাতক রাজাকাদের খোঁজে ঝানু গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
ঠিক এ সময়ে তিস্তার চরে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের এক জাতশত্রুর খবর পাই আমরা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে সে সৈয়দপুর থেকে পালিয়ে তিস্তার নিভৃত চরে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলা সে বোঝে না, বলতেও পারে না। আশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল চরুয়া গরিব গেরস্ত কাসেদ। কাসেদের স্ত্রী একসময় রংপুর শহরে এক বিহারি বড়লোকের বাড়িতে কাজ করেছিল। তাদের অনেক আত্মীয়স্বজন ও খানসেনা সৈয়দপুরে ছিল। কাসেদ ও তার স্ত্রী উর্দু বাৎচিত কিছুটা বোঝে। আশ্রিত সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ পড়শিদের সে জানিয়েছে, ছেলেটি বিহারি হলেও বাঙালিদের মারেনি। ক্ষতিও করেনি। কিন্তু তাই যদি হবে, কেন সে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীকে ছেড়ে এতদিন চরে লুকিয়ে আছে? কেনইবা এতদিনেও নিজবাড়ি সৈয়দপুরে ফিরে যাওয়ার সাহস পায়নি? কাসেদের এই বিহারি মেহমানের কারণে চরুয়া গ্রামবাসী গণ্ডগোলের টাইমে ভয়ে ভয়ে ছিল। কবে যে পাকিস্তানি বাহিনী উড়ে এসে চরেও বোমা ফেলে! আবার লুকানো শত্রুর খবর মুক্তিবাহিনী দূরে থাক, শেখ মুজিবের দলের কর্মী আমার মাতবর পিতাকেও বলার সাহস পায়নি। পাছে কাসেদ পাকিস্তানি বাহিনীকে দিয়ে বড় প্রতিশোধ নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ থেকে আমি ফিরেছি শুনেই সে আমাদের বাড়িতে ছুটে এসে গোপন খবরটা প্রথম আমার কাছেই ফাঁস করল। আমি যদি তার সঙ্গে চরে যাই, কাসেদও তার মেহমানকে দেখিয়ে দিতে পারবে, ধরিয়ে দিতেও পারবে।
খবরটা শুনে আমি বেশ চঞ্চল হয়ে উঠি। মুক্তিবাহিনীর লিডার ভেবে লোকটা খবরটা প্রথম আমার কানে দিয়েছে। কিন্তু নিরস্ত্র অবস্থায় একা অজ্ঞাত শত্রুর মোকাবিলা করব, এতটা বোকা আমি নই। বাবার পরামর্শ নিই। যাদের ভয়ে আমার মুজিব-ভক্ত বাবাও রাতে ৯ মাস নিজবাড়িতে ঘুমানোর সাহস পায়নি, তাদেরই একজন মাত্র দু-তিন মাইল দূরের চরুয়া গ্রামে বহাল তবিয়তে আছে শুনে নতুন করে আতঙ্ক-উত্তেজনা বোধ করে সে। পাড়ার একটি ছেলেকে দিয়ে আমজদাসহ সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের জরুরি আসার জন্য খবর পাঠাই আমি। সাইকেল নিয়ে ছুটে যায় সে। বাবাও গ্রামের অনুগত নিরস্ত্র সমর্থকদের লাঠিশড়কি নিয়ে তৈরি হতে বলে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সশস্ত্র ও নিরস্ত্র মিলিয়ে লড়াকু মুক্তিযোদ্ধার বড় একটি দল তৈরি হয় আমাদের বাড়ির প্রাঙ্গণে।
মুক্তিবাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার সাহস ও যোগ্যতা দেখাতে খবরটা উত্তেজিত কণ্ঠে শুনিয়ে আদেশ দিই-
'বন্ধুগণ, কালবিলম্ব না করে এই অপারেশনটা এখনই চালাতে হবে আমাদের।'
কমান্ডার আমজাদ বলে- 'ভাই, আমরা সাধারণত রাতে সব অপারেশন চালাইছি। দিনের মধ্যে এত লোক লাঠিশড়কি নিয়া চরে গেলে শত্রু পালায় যাবে।'
যুক্তিটা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। অতএব স্থির হয়, তথ্যদাতা চরুয়া লোকটাকে গাইড হিসেবে সঙ্গে নিয়ে সাইকেলে আমরা আটজন মুক্তিযোদ্ধা আগে ছুটে যাব। বাকিরা লাঠিশড়কি নিয়ে কভার দিতে চুপচাপ গাবুর চরে কাসেদের বাড়ির দিকে আসবে। চরুয়া পাকিস্তানি বাহিনীর দালালরা যদি দলবেঁধে মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করতে আসে, তবে আমাদের পক্ষের লোকজনও লাঠিশড়কি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। চর দখলের মতো দালাল খতমের বড় ধরনের একটা লড়াই হবে। তবে রহস্যময় আসল শত্রুকে হাতের মুঠোয় না পাওয়া পর্যন্ত কোনোরকম হইচই করা যাবে না।
সময়টা ছিল ডিসেম্বর মাসের ত্রিশ তারিখ। দিনটা নিজের জন্মদিন বলে ঘটনাটি নিজের কাছে অবিস্মরণীয়। শীতের সকালে ছয়টি বাইসাইকেলে আমরা ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা তিস্তার চরের দিকে ছুটে চলি। ভোরের কুয়াশা কেটে গেলেও প্রান্তর মিষ্টি রোদ শরীর এলিয়ে দেয়নি এখনও। মেঠোপথের ধূলি-ঘাস এখনও ভেজা। আর মুক্তিযোদ্ধাদের সবার পরনে লুঙ্গি, গায়ে চাদর-মাফলার, চাদরের নিচে তিনজনের ঘাড়ে অস্ত্র। নিরস্ত্র মুক্তি চারজনও আজ সাইকেলে লাঠি ও বল্লম বেঁধে নিয়েছে। দলের মধ্যে আমার গায়ে একটি জ্যাকেট, পরনে প্যান্ট, কিন্তু পকেটে একটা চাকুও নেই। ফলে অপারেশনে বেরিয়ে উত্তেজনাটা বোধহয় আমার ভিতরেই কাজ করে বেশি। এর আগে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েও কোনো অপারেশনে যাইনি বলেই হয়তো।
তিস্তার চরে পৌঁছে বালু কেটে সাইকেল আর এগোতে চায় না। আমরা সাইকেল থেকে নেমে সাইকেল ঠেলে এগোতে থাকি। গাইড জানায়, বেশি দূরে নয়, মাইলখানেক বালুর রাস্তা ভাঙলেই নদীর কাছেই গাবুর চরে কাসেদের বাড়ি চোখে পড়বে। অদূরে নদীর ধূসর শরীর ও বিস্তীর্ণ বালুচর, কিন্তু আমরা হাঁটছি বেলেমাটিতে ফলানো সবুজ ফসলের রাজ্যপাটের মাঝ দিয়ে। এসব জমি প্রতি বছর বন্যায় ভাসে, আবার পলি জমে ফসল হয় বাড়বাড়ন্ত। ধান-গম, আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, কলাই নানারকম শস্যের ক্ষেত বালুচরে সবুজ গাঢ় রং বিছিয়ে দিয়েছে যেন। একটি ক্ষেতে কয়েকজন কামলা নিড়ানির কাজ করছে। একমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের মতো ঐতিহাসিক জাতীয় ঘটনাও পলিমাটিতে ফসল ফলানোর দায় ও নেশা দমাতে পারেনি তাদের। ক্ষেতের কামের চাষি-মজুর ও নদীতে মাছ ধরার জেলে-মাঝি ছাড়া চরুয়া জনপদে আসা হয় না কায়েমি গাঁয়ের বাসিন্দাদের। ফলে এখানকার প্রকৃতি ও লোকজন অচেনা। কিন্তু আমাদের দলবেঁধে হাঁটতে দেখে ক্ষেতের লোকগুলি আমাদের চিনতে পারে। কাজ থামিয়ে একজন উঠে দাঁড়ায় এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে- 'আপনে সরকারের ব্যাটা মুক্তি না? দ্যাশ স্বাধীন কইরা ফিরছেন হুনলাম। তা এই বিহানবেলা বাহিনী লইয়া কই যান?'
লোকগুলিকেও নিজেদের পক্ষে রাখার কৌশলে জবাব দিই-
'পাকিস্তানি বাহিনী গেছে, কিন্তু স্বাধীন দেশে যারা মানুষের সুখশান্তি কাইড়া নিতে চায়, তাদের খুঁইজা বের করব আমরা। আপনারা আমাদের পক্ষে আছেন না?'
'হ্যাঁ বাপু, আমরা সব সময় শেখ মুজিবুর আর মুক্তিবাহিনীর পক্ষে। তোমার বাপরে জিগায় দেইখ।'
বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার সাহস দেখিয়ে বলি-
'তোমরা সবাই সাইকেলগুলো এখানে রাখো। স্বাধীন দেশে আর চুরি-ডাকাতি হবে না। আমাদের সাইকেলে কেউ হাত দিলে এরাই ঠেকাবে। এখন অস্ত্র হাতে তৈরি হয়েই আমাদের আগানো উচিত। কী বলো আমজাদ?'
ক্ষেতের লোকগুলির কাছে সাইকেলে এবং সাইকেলের সঙ্গে গায়ের চাদরও ফেলে রাখে মুক্তিযোদ্ধারা। পরনের লুঙ্গি মালকোঁচা দেয় কেউ কেউ। লুকানো অস্ত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে সবার হাতে ও পিঠে। অচেনা কাসেদের বাড়ির দিকে জোরপায়ে এগিয়ে চলি আমরা।
ইন্ডিয়া থেকে আসার সময়ে রাস্তা-রেললাইনের বহু ব্রিজ ভগ্নদশায় দেখেছি। কোথাওবা গোলাগুলি বর্ষণে বিধ্বস্ত দালানকোঠা। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি গোলাগুলি বিনিময়ের স্থানগুলিতে এখনও হয়তো পড়ে আছে কত লাশ। কিন্তু তিস্তার নিভৃত ও দুর্গম জনপদে যুদ্ধের কোনো দাগ বা অস্বাভাবিকতা নজরে পড়ে না। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হানাদার মিলিটারি, রাজাকার কিংবা মুক্তিবাহিনী দেখার সুযোগ হয়নি চরুয়া লোকজনের। আজ আমাদের সশস্ত্র দলকে হাঁটতে দেখে আশপাশ ক্ষেতের চাষি ও গেরস্তবাড়ির বাসিন্দা কৌতূহলী হয়ে ওঠে। পিছু নেয় অনেকে।
প্রায় প্রতি বছরে বানের পানিতে ভাসতে হয় এবং ভাঙনের ফলে ভিটেমাটি ছাড়তে হয় বলে চরের বাড়িঘরও তেমন পাকাপোক্ত নয়। বড় গাছপালাও নেই। বেশির ভাগই দোচালা-চৌচালা খড়ো চালের ঘরবাড়ি। সব বাড়ি ঘিরে তরিতরকারির গাছ, বড়জোর কলাগাছের ঝোপ আর পাটকাঠির বেড়ার আব্রু। গাবুর চরে কাসেদের বাড়িটিও ব্যতিক্রম নয়। তবে বাড়ির সামনে বাঁধা দুটি দুর্বল গরু ও খড়ের ঢিপি। আমাদের গাইড চাপা গলায় আমাকে সতর্ক করে- 'আমি যে খবর দিয়া আপনাদের ডাইকা আনছি, এই কথা কইবেন না কিন্তু।'
এরপর চেঁচিয়ে বাড়িঅলাকে ডাকতে ডাকতে ভিতরে ঢোকে- 'ও কাসেদ ভাই, সরকারের ব্যাটা মুক্তিবাহিনী লইয়া তোমার বাড়ি আইছে। বারায় আইসো, ডাকে তোমারে।'
কমান্ডার আমজাদ এবার অপারেশনের নেতৃত্ব নিজ হাতে নেয়। সঙ্গীদের বাড়িটা ঘেরার নির্দেশ দিয়ে আমাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকে। অস্ত্র উঁচিয়ে আমজাদই থাকে সামনে। পেছন থেকে অকারণে আমার বুক কাঁপে। বাড়ির ভিতরে উঠানে বাচ্চাসহ একটি মুরগি ছুটে পালাতে চায়। ঘোমটা মাথায় এক মহিলা। গাইড বলে- 'কাসেদ ভাই জাল নিয়া নদীতে গেছে।'
আমজাদ আমাকে হুকুম দেয়-
'ঘরে ঢুকে সার্চ করেন।'
একা ঘরে ঢোকার সাহস হয় না আমার। আমি আমজাদের পেছনে থাকি। টিনের চালা ঘরটায় লুকিয়ে থাকার মতো স্থান-পরিসর তেমন নেই। তারপরও আমরা ধান রাখার বাঁশের ডোলা, মাটির হাঁড়ি, লাউয়ের বস, শিকায় ঝোলানো হাঁড়িপাতিল এবং চৌকির কাঁথা-বালিশ চটকে দেখি। ডোলায় সামান্য ধান ও জিনিসপত্র দেখে সন্দেহ থাকে না যে, কাসেদ আসলে গরিব গেরস্ত। অন্য খেড়ি ঘরটায় রাখা লাঙল, মই, কোদাল, কিছু জমানো খড় ও পাটকাঠি। একদিকে একটি মাটির চুলা। শত্রু পালানোর হতাশা-ক্ষোভ ঝাড়ার জন্য উঠানে যখন গাইড ও মহিলাটিকে আমজাদ হুংকার দেয়, ঠিক সে সময় জাল ও খালই হাতে বাড়িঅলা কাসেদ হাজির হয়। মাথায় টুপি ও দাড়িও সন্দেহ জাগানিয়া। শুধু কাসেদ নয়, আঙিনায় ও বাইরে কৌতূহলী লোকজন জড়ো হয়েছে। গাইড আশ্রয়দাতাকে চিনিয়ে দিলে আমি প্রথম জেরা করি-
'তুমিই কাসেদ? যুদ্ধের সময় কাকে বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছ? কোথায় সে?'
জাল ও খালই রেখে আতঙ্কিত কাসেদও তাকে খোঁজে- 'আমার লগেই তো নদীতে গেছিল বসির। বাড়িতে এতা লোক দেইখা কই গেল? বাইরে আছে নাকি দেখি।'
কাসেদের সঙ্গে আমরাও বাইরে আসি। বাড়ি থেকে কেউ পালিয়ে যায়নি, কিন্তু চারদিক থেকে যারা ছুটে এসেছে, তাদের মধ্যেও শত্রু নেই। আমাদের দেখে বাঁধা গরুটা পর্যন্ত ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে, আসল শত্রুর পালানোই স্বাভাবিক। কাসেদের দিকে তাই অস্ত্র তাক করে আমজাদ গর্জে ওঠে-
'তোমার বিহারি বসিরকে এখনই বের করে দাও, না হলে তোমাকেই শেষ করব।'
গুলি খাওয়ার আগে কাসেদ গুলিবিদ্ধ হয় যেন। ভয়ে বিবর্ণ শরীরে কাঁপুনি জাগে। চোখ ঘুরিয়ে চারদিকে বসিরকে খোঁজে। এ সময় ঘোমটা মাথায় মহিলা ছুটে এসে কান্না ও ঝগড়ার কণ্ঠে বলে-
'ছ্যামড়াটা মুক্তিফৌজ দূরে থাউক, একটা বাঙালির পোলারেও মারে নাই। চরের কুনো মাইনষের এক আনা ক্ষতি করে নাই। গণ্ডগোলে হ্যার বাপ-মা মইরা গেছে। এই চরে পলায় আসার পর আমি তারে ধর্মপোলা কইরা নিছি, আমারে মা ডাকে। তারে আপনারা মাইরেন না গো বাবা।'
কাসেদ এবার কম্পিত কণ্ঠে স্ত্রীর সমর্থনে কথা বলে-
'হ্যার বয়সী আমার একটা পোলা আছিল। গেল বছর বড় বানটার সময় নদীতে ডুইবা মরছে। বিহারি পোলাটারে আমার স্ত্রী ধর্মপোলা কইরা নিছে, এই পোলার বাপ-ভাইয়েরাও রাজাকার-মিলিটারি আছিল না।'
'সৈয়দপুর থেকে এতদূরে পালায় আসছে কেন? আমাদের দেখে পালায় গেল কোথায়? শত্রু না হলে মুক্তি দেখে এমনি পালায় কোনো বাঙালি!'
মহিলা এবার আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে- 'মুক্তিরা বসিরের বাপ-ভাইরে মারছে। আপনারা তারে মাইরেন না গো মুক্তি বাবারা। হ্যায় আপনাগো কোনো ক্ষতি করব না, বিহারি হইলেও খারাপ না বসির।'
ঠিক এ সময় ভিড়ের এক কিশোর বলে- 'বসিররে আমি ঘাটের দিকে দৌড়াইতে দেখলাম।'
আমজাদ এবার কুইক সিদ্ধান্ত দেয়- 'তোমরা কয়েকজন কাসেদ আর তার বউকে পাহারা দিয়ে রাখো। যেন পালাতে না পারে। শত্রুকে যারা চেনে, তারা চলেন আমাদের সঙ্গে। এখনও বেশি দূর যেতে পারে নাই। চলেন ঘাটের দিকে ছুটতে হবে। কুইক। ডবল মার্চ।'
বসিরকে চিনিয়ে দেয়ার জন্য সন্ধানদাতা কিশোরসহ স্থানীয় আরও কয়েকজনকে নিয়ে আমরা ঘাটের দিকে ছুটতে থাকি। নদীর পাড় ধরে বালুচরের ওপর ম্যারাথন প্রতিযোগিতা শুরু হয় যেন। অপারেশনে নিজের যোগ্যতা দেখাতে দৌড়ে আমজাদের পিছু থাকতে চাই বলে শীতের সকালেও শরীরে ঘাম ছোটে। অবশেষে ঘাটের কাছে পৌঁছার আগেই চোখে পড়ে, আমাদের সামনে নদীপাড় ধরে একজন দৌড়াচ্ছে। তার দিকে আঙুল তুলে একজন বলে-
'ওই যে, ওই যে! ওইডাই বিহারি বসির।'
আমজাদসহ আমরা কয়েকজন ছেলেটির কাছাকাছি হতেই নদীতে লাফ দেয় সে। নদীতে সাঁতরাতে থাকে। শত্রুকে চোখে দেখার পরও হাতের নাগালের বাইরে যেতে দিতে রাজি নয় কেউ। আমজাদ হাতের স্টেন উঁচু করে হুংকার দেয়-
'ওই বিহারির বাচ্চা পালানোর চেষ্টা করলে তোকে গুলি করব।'
একইসঙ্গে বাহিনীর কয়েকজনকেও আদেশ দেয়- 'চেয়ে দেখছ কী! নদীতে লাফ দাও, পাকড়াও ব্যাটাকে।'
স্থানীয় চরুয়া লোকজনসহ আমাদের দু'জন মুক্তিযোদ্ধা নদীতে লাফিয়ে নামে। আমিও সোয়েটার খুলে নদীতে লাফাব কিনা দ্বিধা করি। এ সময় একটা খালি ডিঙি নৌকা আসছিল পাড় ঘেঁষে, তাকে আদেশ করি- 'ওই মাঝি, ওই ছেলেটাকে ধরে দাও।'
কিছুক্ষণের মধ্যে নদীর পানিতে হাবুডুবু খাওয়া শত্রু মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। তাকে টেনে তোলা হয় ওপরে। আমজাদ আদেশ দেয়- 'চলো, বিচ্ছুটাকে নিয়ে কাসেদের বাড়িতে। সেখানেই বিচার হবে।'
কাসেদের বাড়ির প্রাঙ্গণ তখন লোকারণ্য। আমাদের গ্রাম থেকেও শত্রুকে মোকাবিলা করতে লাঠিশড়কি হাতে অনেকে এসেছে। হয়তো আমার পিতাই মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে পাঠিয়েছে তাদের। শত্রুকে আশ্রয়দাতা কাসেদ ও তার স্ত্রীর সামনে এনে আমজাদ আবার হুংকার দেয়- 'এই বিচ্ছু মুক্তিবাহিনী দেখে পালায় কেন? এর সত্যি পরিচয় দাও। তোমরাইবা শেল্টার দিয়ে রেখেছ কেন? এবার সত্য জবাব দাও। নইলে তোমাদেরও শেষ করে নদীতে ভাসায় দেব।'
কাসেদের স্ত্রী কান্নাকাতর কণ্ঠে ভিড়কে উদ্দেশ্য করে আকুল ফরিয়াদ জানায়- 'বিশ্বাস করেন বাবারা, হ্যারে আগে আমরা জীবনেও দেহি নাই। চিনতামও না। হ্যার কথা হুইনা বুঝছি, গণ্ডগোলের টাইমে হ্যার বাপ-মা-ভাই মইরা গেছে। বাড়িও পুইড়া দিছে। ডরে এই চরে পালায় আইছে বসির। আমারে মা ডাকছে দেইখা আশ্রয় দিছি। তোমগোর পায়ে পড়ি, আমারে গুলি কইরা নদীতে ভাসায় দাও, তবু এতিম পোলাটারে মাইরেন না আপনারা।'
জাত-ধর্মের সীমা ডিঙানো মাতৃহৃদয়ের আবেগ, নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও ছেলেটিকে বাঁচানোর আকুলতা দেখে আমি কিছুটা থমকে যাই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের আবেগ এবং স্বাধীনতার অবশিষ্ট শত্রুদের খতম করার আক্রোশ, অপারেশনে এসে এত দৌড়ঝাঁপ কি সামান্য এক নারীর কান্নায় এত সহজে ধুয়েমুছে যেতে পারে? বিশেষ করে নদীতে লাফিয়ে যারা নিজেরাও এখন ভেজা বস্ত্র, শত্রুকে খতম করার উত্তাপ-উত্তেজনা তাদেরই যেন বেশি দরকার। একজন ভিজে নেতানো শত্রুর দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে- 'দেখছেন, পানিতে ভিইজা আমরা জাড়ে কাঁপি, কিন্তু এই বিহারি ব্যাটার কুনো ভয়ডর নাই!'
তার ঘাড়ে একটা গাট্টা মেরে সে জিজ্ঞাসাবাদ করে- 'এই ব্যাটা, তোর আসল পরিচয় কী? তিস্তার চরে পালায় আছিস কেন? মতলব কী তোর?
ছেলেটি কাঁদে না, জবাবও দেয় না। সে বাংলা জানে না ভেবে ভাঙা উর্দুতে জিজ্ঞেস করে একজন- 'এই লাড়কা, মাউড়া কা বাচ্চা, সাচ বাত বল, মোকাম কাঁহা তোর? কৌন তোমারা বাপ-মাকো মার ডালা?'
এইবার ছেলেটি কম্পিত অস্টম্ফুট কণ্ঠে জবাব দেয়-
'জয় বাংলা।'
'কিঁউ মার ডালা? তোমারা বাবা-ভাই মিলিটারি হ্যায়, জয় বাংলা কো দুশমন হ্যায় না? সাচ বাত বলো।'
ছেলেটি কোনো জবাব দেয় না। আমাদের এক ভেজা বস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা অধৈর্য কণ্ঠে কমান্ডার আমজাদের কাছে হুকুম চায়-
'ওস্তাদ, হুকুম দেন, এই ব্যাটা আর তার শেল্টারদাতা এই ভাটিয়া গেরস্ত আর তার বউকেও খতম করি দিয়া নদীতে ভাসায় দিই। এরা যে মুক্তিযুদ্ধ আর জয় বাংলার জাত শত্রু, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর বাড়িঘর জ্বালায় দিয়া এই গরুটা দুইটা জবাই করি আজ পিকনিক করব আমরা।'
লেখাপড়ায় বেশি এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রভাবশালী লোকের সন্তান বলেই হয়তো আমজাদ আমার দিকে তাকায়, জানতে চায়-
'কী করা যায় ভাই?'
আশ্রয়দাতা মহিলার কান্না ছাড়াও নদীতে হাবুডুবু খাওয়া শত্রুর বিধ্বস্ত চেহারা আমার ভিতরের উত্তেজনা শুষে নিতে শুরু করেছে। কত বয়স হবে ছেলেটার? বড়জোর তেরো-চৌদ্দ। এ যেন বনে বড় বাঘ মারতে এসে ছোট ইঁদুর ধরা। চকিতে মনে পড়ে, অসহযোগ আন্দোলনের সময় শহরে এক বিহারির দোকান লুটপাট এবং এক বিহারি-বাড়িতে আগুন দেয়ার দৃশ্য নিজেও দেখেছি। সৈয়দপুরে যেহেতু অনেক অবাঙালি বসবাস করে, তাদের সঙ্গে মিশে এই কিশোরের বাপ ও ভাইয়েরা হয়তো সত্যিই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু নিরপরাধ কিশোর, তার আশ্রয়দাতা কাসেদ ও কাসেদের বউ কী ক্ষতি করেছে?
শুধু আমজাদ নয়, ভিড়ের উপস্থিত সবাই যেন আমার রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি সাহসী কথা বলার জন্য গলা খাঁকারি দিই, তারপর সাত মার্চের ভাষণ স্মরণ করে চেঁচিয়ে বলতে থাকি-
'মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা, যে নেতার হুকুমে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করলাম, তার কথা স্মরণ করেন। নেতা এখনও আমাদের স্বাধীন দেশে অনুপস্থিত। পাকিস্তানি জল্লাদ মিলিটারির কারাগারে সে বাঁচি আছে না মরি গেছে, আমরা এখনও জানি না। কী হুকুম দিয়েছিলেন নেতা আমাদের ৭ই মার্চে? এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। স্বাধীন দেশ আমরা পাইলাম, কিন্তু নেতা এবং বাঙালির মুক্তি এখনও আসে নাই। কাজেই যুদ্ধ আমাদের শেষ হয় নাই। এখন সতর্ক হয়ে নেতার ও বাঙালির মুক্তির জন্য আমাদের আরও বড় যুদ্ধ চালাতে হবে। সেই জন্য এই বিহারি ছেলেটা আর তার আশ্রয়দাতাদের আমরা টোপ হিসেবে রেখে দেব। বড় বড়শিতে ছোট মাছকে টোপ হিসেবে গেঁথে দিয়ে যেমন বড় বোয়াল মাছ ধরা হয়, তেমনি এই টোপকে দিয়ে আমরা বড় শত্রুকে ধরব। ততদিন এই টোপ বসিরকে কাসেদের পরিবারই পাহারা দিয়ে রাখবে। যদি পালিয়ে যায়, কাসেদ ও তার বউকে আমরা আস্ত রাখব না, খোরশেদ রাজাকারের মতো তার বাড়িও জ্বালিয়ে দেব। কী, আমার প্রস্তাবে রাজি আছেন আপনারা?'
হাত তুলে এবং চেঁচিয়েও স্বতঃস্টম্ফূর্ত সমর্থন জানায় সবাই। জীবনের প্রথম বক্তৃতার সাফল্য ও শ্রোতাদের দৃষ্টি ও কণ্ঠ উছলানো প্রশস্তিময় সমর্থন অসমাপ্ত মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার সাহস বাড়ায় আমার। আদেশের সুরে ভিড়কে বলি-
'মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা, চলো এখন, আমাদের বাড়িতে গিয়ে চা-মুড়ি খেতে খেতে আমজাদের কমান্ডে নতুন অপারেশনের প্ল্যান করব আমরা।'
রহস্যময় অবাঙালি কিশোর ও তার আশ্রয়দাতাদের জীবন আপাতত বাঁচাতে পারার সাফল্যে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করেও আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে আপন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আনন্দ-উত্তেজনায় মুক্তিবাহিনীকে নিয়ে ফেরার সময় গলা ছেড়ে স্লোগানও হাঁকি-
জয় বাংলা।