১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট রক্তক্ষয়ী হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পটভূমিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এই রাষ্ট্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এর দুটি পৃথক অঞ্চলের মধ্যে ভৌগোলিক ব্যবধান। পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান শুধু যে একই রাষ্ট্রের দুটি পৃথক প্রদেশ ছিল তাই নয়, এই দুই প্রদেশের মধ্যে ছিল সহস্র মাইলের ব্যবধান এবং এর বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে অবস্থান করছিল 'বৈরী' ভারত রাষ্ট্র। ফলে দুই প্রদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ দৈনন্দিন অর্থনৈতিক যোগাযোগ ভৌগোলিক কারণেই সম্ভব ছিল না। শুধু সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ব্যবধান নয়, মৌলিক সম্পদের বিন্যাস এবং মৌলিক অর্থনৈতিক ধ্রুবকগুলোর নিরিখেও পূর্ব বাংলা (এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে পূর্ব বাংলা ব্যবহূত হবে) তার জন্মলগ্ন থেকেই একটি 'পৃথক উৎপাদনকারী ও ভোগকারী' অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সমগ্র পাকিস্তানের আয়তন ছিল ৩৬৫ হাজার ৫২৯ বর্গমাইল এবং মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৫৬ লাখ। এর মধ্যে মাত্র ৫৫ হাজার ১২৬ বর্গমাইল এলাকা অর্থাৎ পুরো পাকিস্তানের মাত্র শতকরা ১৫ ভাগ এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল পূর্ব বাংলা। অথচ পূর্ব বাংলার মোট জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ১৯ লাখ অর্থাৎ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৫ ভাগ।
'পূর্ব পাকিস্তানের' অর্থনৈতিক অবস্থা
১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব বাংলার একজন নাগরিকের গড়পড়তা বার্ষিক আয় ছিল ২৬৭ টাকা (১৯৫৯-৬০ সালের বাজারদামে) এবং ছয় বছর পর তা মাত্র চার টাকা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৭১ টাকা। এই মন্থর বা অবনতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য দ্বিগুণ। ভয়ংকর মনে হয়েছিল, কারণ এর সঙ্গে একই সময়ে যুক্ত হয়েছিল পাকিস্তানেরই পশ্চিম অংশ তথা পশ্চিম পাকিস্তানের চোখধাঁধানো অগ্রগতির বিপরীত বাস্তবতা। ১৯৪৯-৫০ সালেই পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের পূর্বাংশের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল। কিন্তু ১৯৫৪-৫৫ সালে এই ব্যবধানের হার আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৯.৪৬ শতাংশ। এই বৈষম্যমূলক প্রবৃদ্ধির পেছনে শুধু প্রাগ্‌বিভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চতর অর্থনৈতিক বিকাশস্তরই দায়ী ছিল না, পরবর্তীকালে অনুসৃত নানারকম বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নীতিও এই ব্যবধান বা বৈষম্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সক্রিয় অবদান রেখেছিল।
এই সময় সচেতনভাবে পূর্ব বাংলার স্বর্ণসূত্র পাটের বহির্বাণিজ্যের উদ্বৃত্তকে পশ্চিম পাকিস্তানের ঘাটতি পূরণে ব্যবহার করা হয়েছিল। উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ, অবকাঠামো নির্মাণ, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির লাইসেন্স বিতরণ, প্রশাসনিক পদ বণ্টন, উচ্চশিক্ষার অগ্রগতি ইত্যাদি সব খাতেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার প্রথম থেকেই পূর্বাঞ্চলের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিমাতাসুলভ নীতি পরিগ্রহণ করে আসছিল। বস্তুত এ রকম একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈষম্য প্রথম দিকের নয়, বরং ষাটের দশকের ব্যাপার।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের প্রাথমিক যুগের পরিসংখ্যান এ কথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই। এই প্রক্রিয়ারই একটি ঘনীভূত রাজনৈতিক পরিণতি হচ্ছে পাকিস্তানের জন্মের মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় অনুষ্ঠিত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, যা ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিমূলে প্রথম কুঠারাঘাত হানে।
এই প্রসঙ্গে শুধু পশ্চিম পাকিস্তান নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নমাত্রা কোন স্তরে অবস্থিত ছিল, সেটিও আন্তর্জাতিকভাবে তুলনা করে দেখা যেতে পারে। সৌভাগ্যবশত আমাদের হাতে ১৯৪৯-৫০ সালের জন্য সারাবিশ্বের ৭০টি দেশের মাথাপিছু আয়ের একটি আন্তর্জাতিক তুলনামূলক তালিকা রয়েছে। তাতে দেখা যায়, পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল তখন ৫১ ডলার এবং ওই ৭০টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থান ৫৭তম। পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল তখন ৪৬ ডলার এবং সেই হিসাবে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থান দাঁড়ায় ওই ৭০টি দেশের মধ্যে ৫৯তম। পাঠকের সুবিধার্থে ৭০টি দেশের মধ্যে নির্বাচিত ১২টি দেশের তুলনামূলক মাথাপিছু আয়ের তথ্য ১নং সারণিতে প্রদান করা হলো।

সারণি ১ : ১২টি নির্বাচিত দেশের জনসংখ্যা,
মাথাপিছু আয় এবং ক্রমিক অবস্থানের চিত্র, ১৯৪৯
দেশের নাম জনসংখ্যা (হাজারে) মাথাপিছু আয়ের আয় ১৯৪৯ (ডলারে) মাথাপিছু আয়ের মানদণ্ডে ৭১টি দেশের মধ্যে ক্রমিক অবস্থান আমেরিকা ১৪৯২১৫ ১৪৫৩ ১ ব্রিটেন ৫৩৬৩ ৭৭৩ ৬ সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৩০০০ ৩০৮ ২৩ জাপান ৮২৬৩৩৬ ১০০ ৪৫ শ্রীলঙ্কা ৭২৯৭ ৬৭ ৫৪ ভারত ৩৪৬০০ ৫৭ ৫৫ আফগানিস্তান ১২০০০ ৫০ ৫৮ পাকিস্তান (সমগ্র) ৭৩৮৫৫ ৫১ ৫৭ পূর্ব পাকিস্তান ৪২২৫০ ৪৬ ৫৯ ফিলিপাইন ১৯৩৫৬ ৪৪ ৬০ দক্ষিণ কোরিয়া ২০১৮৯ ৩৫ ৬৯ ইন্দোনেশিয়া ৭৯২৬০ ২৫ ৭১
[টীকা : ১. ১৯৪৯-৫০ সালে জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অফিসের অর্থনৈতিক শাখা কর্তৃক প্রকাশিত ন্যাশনাল অ্যান্ড পার ক্যাপিটাল ইনকাম অব সেভেন্টি কান্ট্রিজ, এক্সপ্রেসড ইন ইউএস ডলার, নিউইয়র্ক, অক্টোবর ১৯৫০ : ১৪-১৬নং থেকে সংকলিত। ২. পূর্ব বাংলার মাথাপিছু ডলার আয়ের হিসাব নির্ণয়ের জন্য তৎকালীন সরকারি বিনিময় হার (১ ডলার = ৩.৩০ টাকা) ব্যবহার করা হয়েছে এবং চলতি দামে ১৯৪৯ সালে মাথাপিছু আয় ২১৭ টাকা ধরা হয়েছে যেহেতু ১৯৫৯-৬০ সালের বাজারদামের তুলনা ১৯৪৯-৫০ সালের বাজারদাম প্রায় ২০ শতাংশ কম ছিল। ৩. 'পূর্ব পাকিস্তান'কে তালিকাভুক্ত করায় তুলনীয় দেশের সংখ্যা ৭১-এ দাঁড়ায়।
উৎস : ডব্লিউ এন পিচ, এম উজির এবং জি ডব্লিউ রাকার বেসিক ডাটা অব দ্য ইকোনমি অব পাকিস্তান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, (করাচি ১৯৫৯), ২৯-এ উদ্ধৃত ১৫নং সারণি দ্রষ্টব্য।]
এই সারণি থেকে পূর্ব বাংলার তলের দিকে অর্থনৈতিক অবস্থান (৫৯তম) সম্পর্কে যেমন কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না, তেমনি এটাও আমরা দেখতে পাই ১৯৪৯-৫০ সালে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে পূর্ব বাংলার অবস্থান ছিল এমনকি ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার ওপরে। সুতরাং সূচনাপর্বে পৃথিবীর বহু দেশের তুলনায় আমরা এগিয়ে ছিলাম। যদিও পাকিস্তানের ভেতরে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় আমরা ছিলাম পিছিয়ে। আজ অবশ্য বহু দেশের তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি কিন্তু পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে গেছি।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিমাতাসুলভ ভূমিকা
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এ আইন অনুসারে পাকিস্তান যেসব অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল সেসব অঞ্চলে অতীত থেকে বিরাজমান গণপরিষদের (Constituent Assembly) ওপরই ঔপনিবেশিক শাসকরা নতুন রাষ্ট্রের শাসনভার অর্পণ করে। সেই হিসেবে পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে উত্তরাধিকারসূত্রে যে 'ফেডারেল অ্যাসেমব্লিটি' পেয়েছিল তার মোট সদস্যসংখ্যা ছিল ৬৯, যার মধ্যে ৪৯ জন মুসলিম লীগ, ১৬ জন কংগ্রেস এবং বাকি চারজন অন্যান্য দলভুক্ত সদস্য ছিলেন। ১৯৫৩ সাল নাগাদ এর সদস্যসংখ্যা ৭৯-তে উন্নীত হয়। এর মধ্যে ষাটজন মুসলিম লীগ দলভুক্ত, ১১ জন কংগ্রেস দলভুক্ত এবং তিনজন অন্যান্য দলভুক্ত ছিলেন (বাকি পাঁচটি পদ শূন্য ছিল)। এসব তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা প্রথম থেকেই মুসলিম লীগের একচেটিয়া কর্তৃত্বের অধীনে ছিল। আরও যেটা লক্ষণীয় তা হচ্ছে, ৭৯টি সদস্যপদের মধ্যে ৪৪টিই ছিল পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত সদস্যের পদ এবং বাকি ৩৫টি আসনের মধ্যে ছিল ২২টি পাঞ্জাব, পাঁচটি সিন্ধু, চারটি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং একটি করে বেলুচিস্তান, ভাওয়ালপুর এবং খয়েরপুরের আসন। এ থেকে বোঝা যায়, পাকিস্তানের 'ফেডারেল অ্যাসেমব্লিতে' প্রথমদিকে পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত সাংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু এ থেকে এই সিদ্ধান্ত টানলে খুবই ভুল হবে যে, তারা সর্বদা পূর্ব বাংলার স্বার্থেই সংসদে সরব ছিলেন। বরঞ্চ মূল শাসকদল মুসলিম লীগের সদস্য হিসেবে তাঁরা প্রধানত মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় অবাঙালি কমান্ডের নির্দেশেই নিজেদের পরিচালনা করতেন। তাঁদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র বিদ্রোহী অংশ ছিল, কিন্তু তাঁরা শাসকদলে বা শাসকদল অনুসৃত মূল অর্থনৈতিক নীতিমালায় বিশেষ কোনো প্রভাব বিস্তারে সক্ষম ছিলেন না। শ্রেণিগত দিক থেকেও তাঁদের চরিত্র ছিল প্রতিকূল। এ সম্পর্কে গবেষক মুশতাক আহমেদ লিখেছেন-
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত ও সামন্ত শ্রেণি জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে প্রায় একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করেছে। উভয় প্রদেশে কৃষক শ্রেণির বলতে গেলে কোনো প্রতিনিধিত্বই ছিল না। এবং শ্রমিক শ্রেণি ও শিল্প খাত এখনও দেশের অর্থনৈতিক মানচিত্রে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, যেজন্য এরা রাজনৈতিক স্বীকৃতির দাবি করতে পারে।
এসব তথ্য থেকে এ কথা সহজেই অনুমেয় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নকারী রাজনৈতিক মূল কর্তৃত্বের সঙ্গে কৃষক-শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা ছিল শুরু থেকেই একটি বাস্তব ব্যাপার। আর পূর্ব বাংলার আসনসংখ্যা গণপরিষদে বেশি হলেও রাষ্ট্রীয় নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য যে রাষ্ট্রযন্ত্রটি তখন গড়ে উঠেছিল সেখানে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদেরই একাধিপত্য। এ ছাড়া শাসকদলেও পশ্চিম পাকিস্তানিরাই ছিল মূল নেতৃত্বের অধিকারী। ১৯৫৫ সালের এক হিসাব থেকে জানা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে ১৯ জন সচিবের মধ্যে সব ক'জনই ছিলেন অবাঙালি, ৪১ জন যুগ্ম সচিবের মধ্যে মাত্র তিনজন ছিলেন বাঙালি, ১৩৩ জন উপসচিবের মধ্যে মাত্র ১০ জন ছিলেন বাঙালি এবং ৫৪৮ জন অধস্তন সচিবের (Under Secretary) মধ্যে মাত্র ৩৮ জন বাঙালি। এসব তথ্য থেকে সহজেই অনুমিত হয় যে, কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রশাসন উভয়েই পূর্ব বাংলায় শুরু থেকে যেসব অর্থনৈতিক নীতিমালা কার্যকর হয়েছিল তাতে পশ্চিমাদের নিজস্ব আঞ্চলিক ও শ্রেণিগত পক্ষপাতিত্বের সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছিল।
অন্যায় বৈষম্য ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
সমগ্র পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যে বিশেষ ধনিকগোষ্ঠীকে (২২ ধনী পরিবার, যার মধ্যে এ.কে খানের পরিবারটি ছিল একমাত্র বাঙালি পরিবার) টার্গেট করে অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করেছিলেন, ঐতিহাসিকভাবে তাদের অধিকাংশই পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দা ছিলেন বলে এই নীতির আরেকটি মারাত্মক কুফল প্রতিফলিত হয়েছিল ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক বৈষম্যের মধ্যে। পাকিস্তান ১৯৫০-১৯৫৪-৫৫ কালপর্বে পরিকল্পিত মোট উন্নয়নব্যয় বরাদ্দের শতকরা ৮০ ভাগই ব্যয় করা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানে এবং মাত্র ২০ ভাগ ব্যয় করা হয়ে বাংলায়। পরবর্তী ১৯৫৫-৬০ কালপর্বে তথা প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে পূর্ব বাংলার জন্য বরাদ্দকৃত অংশ সামান্য বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় শতকরা ২৬ ভাগ। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় শতকরা ৩২ ভাগ। অখণ্ড পাকিস্তানের সর্বশেষ পরিকল্পনা তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে (১৯৬৫-৬৯-৭০) ব্যয়ের হার ছিল সর্বাধিক মাত্র ৩৬ শতাংশ। অথচ পূর্ব বাংলায় এই সমগ্র কালপর্বে সর্বদাই পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি বসবাস করত। শুধু ব্যয়ের ক্ষেত্রেই এই বৈষম্য সীমাবদ্ধ ছিল না, পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার অব্যাহত ছিল। ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত দুই দশকে মোট সম্পদ পাচারের হিসাব করেছেন পূর্ব বাংলার তদানীন্তন নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিবিদগণ এবং তাদের হিসাব থেকে দেখা যায় যে, এর মোট পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১১২ কোটি টাকা অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছর পূর্ব বাংলার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ১০ শতাংশ এ সময় পশ্চিমে পাচার হয়ে যাচ্ছিল। সমস্ত ব্যাংক-বীমা-বৃহৎ কলকারখানা-ব্যবসা-বাণিজ্য সবই কেন্দ্রীভূত হয় ২২ পরিবারের মালিকানায়। তাই বলা যায়, মূলত জাতীয় বৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্যের যুগপৎ কারণে ১৯৭০ সালের পরপরই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভেঙে যায় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: এই লেখার জন্য দ্যু প্রকাশনীর কাছে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কারণ, এই লেখায় দ্যু প্রকাশনী প্রকাশিত আমার লেখা পুস্তিকা 'স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পটভূমি' থেকে উদারভাবে নানা রচনাংশ ব্যবহার করা হয়েছে।]