জীবন-সংগ্রামকে ছাপিয়ে কখনও কখনও সিনেমার পর্দায় ভেসে ওঠে ঐতিহাসিক যুদ্ধ কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র। বিভিন্ন দেশের গৌরবময় যুদ্ধভিত্তিক কয়েকটি সিনেমা নিয়ে এই আয়োজন। লিখেছেন উপমা পারভীন

পার্ল হারবার [২০০১]
পার্ল হারবার! নামটি শুনলেই খানিকটা শিউরে উঠতে হয়। চোখ বুজলেই কল্পনায় দেখা মেলে একটি যুদ্ধক্ষেত্র। কল্পনায় শুনতে পাওয়া যায় যুদ্ধবিমানের কান ফাটানো সাইরেন! ক্ষণে ক্ষণে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আগুনে ঝলসে যাওয়া একটি দ্বীপের ছবি। সারাবিশ্বের সিনেমাপ্রেমীরা এই নামটির সঙ্গে পরিচিত। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত যত সিনেমা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে 'পার্ল হারবার' সিনেমাটিতেই ব্যবহার করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিস্ম্ফোরক দ্রব্য! ছবিতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় যুদ্ধ দেখানো হয়েছে। 'পার্ল হারবার' ছবির গল্প দুই পাইলট রেফ ম্যাককলি [বেন অ্যাফ্লেক] ও ড্যানিয়েল ওয়াকার [জশ হার্টনেট] এবং তাঁদের প্রেমিকা ইভিলিন জনসনকে [কেট বেকিনসলে] কেন্দ্র করে। মাইকেল বে পরিচালিত এই সিনেমা নির্মাণে খরচ হয়েছিল ১৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ছবিটি বিশ্বব্যাপী আয় করে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

ট্রয় [২০০৪]
স্পার্টার রাজার স্ত্রী হেলেনকে নিয়ে পালিয়ে আসেন ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস। অথচ প্যারিস স্পার্টার রাজার অতিথি হয়ে ওই রাজ্যে গিয়েছিলেন। হেলেন দেবতাধিরাজ জিউসের কন্যা। গ্রিক ও রোমান পুরাণের সর্বাধিক আলোচিত নারী চরিত্র এই হেলেনকে নিয়ে রাজপুত্র প্যারিস পালিয়ে আসেন। তখন তাঁকে উদ্ধার এবং গ্রিসের সম্মান রক্ষার্থে প্রায় এক হাজার জাহাজ নিয়ে ট্রয়ের উদ্দেশে রওনা দেয় গ্রিক যোদ্ধারা। জাহাজ থেকে প্রথমে নেমে আসেন বীর অ্যাকিলিস। প্রথম যুদ্ধেই ট্রয় নগরীর বন্দর দখল করে নেয় যোদ্ধারা। এভাবে টানা প্রায় ১০ বছর বন্দর ও রাজ্য অবরোধ করে রাখে গ্রিকরা। যুদ্ধে সহজে জয়লাভ না করতে পেরে গ্রিকরা আশ্রয় নেয় প্রতারণার। জন্ম নেয় ইতিহাসের এক জঘন্যতম প্রতারণার প্রতীক ট্রোজান হর্স। কাঠের ঘোড়ায় লুকিয়ে থাকা গ্রিক সৈন্যরা রাতের আঁধারে বেরিয়ে এসে ট্রয় রাজ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এককালের সাজানো সুন্দর ট্রয় নগরী! ভোলফগাংকু পিটারসন পরিচালিত এই সিনেমায় অভিনয় করেন ব্র্যাড পিট, এরিক বানা, অরল্যান্ডো ব্লুম, ডিয়ান ক্রুগা। ১৮৫ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত ছবিটি বিশ্বব্যাপী আয় করে ৫০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

হ্যাকস রিজ [২০১৬]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধে আমেরিকান মিলিটারিতে যোগ দেন ডেসমন্ড ডস। মিলিটারিতে যোগ দিয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন- কাউকে গুলি করবেন না, মানুষ হত্যা করবেন না। কীভাবে সম্ভব? যুদ্ধ মানেই তো হানাহানি, গোলাগুলি। তাই যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকতে হলে শত্রুদের হত্যা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন ডেসমন্ড ডস। একজন মানুষকেও হত্যা না করে, একটি গুলিও না ছুড়ে তিনি বীরত্বের জন্য পান 'মেডেল অব অনার'। কীভাবে? সেই কাহিনি নিয়ে সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে 'হ্যাকস রিজ' সিনেমাটি। মেল গিবসন পরিচালিত এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন অ্যান্ড্রু গারফিল্ড, স্যাম ওয়ার্থিংটন, লুক ব্র্যাসি, টেরিজা পামার, হুগো ওয়েভিং, রেচেল গ্রিফিথস প্রমুখ। ৪০ মিলিয়ন ডলারে নির্মিত এই ছবিটি বিশ্বব্যাপী আয় করেছে ১৭৬ মিলিয়ন ডলার।

ফিউরি [২০১৪]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন ভীষণ নাটকীয় রূপ নিয়েছে। জার্মান বাহিনী কোণঠাসা। মিত্রবাহিনীর কাজ এখন জার্মানি দখল করা। অভিজ্ঞ জেনারেলরা দায়িত্ব দিলেন নর্থ আফ্রিকান চাম্পিয়নজয়ী ডন কলিয়ারকে [ব্র্যাড পিট]। ফিউরি নামে একটি ট্যাঙ্কের সঙ্গে আরও তিনটি ট্যাঙ্ক নিয়ে জার্মান ভূমিতে পা রাখেন ডন। সঙ্গে চার অভিজ্ঞ সেনানী ও নবিশ নরম্যান। সম্মুখযুদ্ধ কতটা হিংস্র- নবিশ নরম্যান তা বুঝতে পারেন না। যুদ্ধে নেমে তিনি শত্রুকে গুলি করতে ভয় পান। তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই অভিজ্ঞ যোদ্ধা ডন তাঁকে দিয়ে জোর করে শত্রুপক্ষের জেনেভা চুক্তি লঙ্ঘনকারী এক সৈন্যকে হত্যা করতে বাধ্য করেন। অনভিজ্ঞ নরম্যান কান্নায় ভেঙে পড়েন। ডন আরও সামনে এগিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড় রক্ষার দায়িত্ব পান। পথ্যে নরম্যান এক জার্মান রূপসীকে মন দিয়ে বসেন। অন্যদিকে এগিয়ে আসছে হিটলার বাহিনীর ৩০০ সৈন্য। ডন কীভাবে পাঁচ সেনা নিয়ে ৩০০ জার্মান সেনার মোকাবিলা করেন- সেই গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ছবিটি। ডেভিড আয়ার পরিচালিত এই সিনেমা নির্মাণে খরচ হয়েছিল ৮০ মিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাপী ছবিটি আয় করেছে ২১৫ মিলিয়ন ডলার।

সেভিং প্রাইভেট রায়ান [১৯৯৮]
১৯৪৪ সালের ৬ জুন থেকে ১৩ জুন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই আট দিনের ঘটনাকে পুরো সিনেমায় বর্ণনা করেছেন প্রখ্যাত নির্মাতা স্টিফেন স্পিলবার্গ। সিনেমার শুরু বর্তমান সময়ে হলেও ফ্লাশব্যাক চলে যায় ১৯৪৪ সালের ৬ জুন, পশ্চিমা মিত্রশক্তি কর্তৃক ফ্রান্সের নরম্যান্ডি আক্রমণের দিন। সে দিন মার্কিন বাহিনী সেকেন্ড রেঞ্জার ব্যাটালিয়নের ক্যাপ্টেন মিলারের [টম হ্যাঙ্কস] নেতৃত্বে ওমাহা বিচ আক্রমণ করে। এদিকে ওয়াশিংটনে মার্কিন ওয়ার ডিপার্টমেন্ট জানতে পারে, রায়ান বংশের তিন ভাই যুদ্ধে নিহত হয়েছে। বেঁচে থাকা বাকি একজন জেমস ফ্রান্সিস রায়ান [ম্যাট ডেমন] নরম্যান্ডিতে যুদ্ধরত। বংশের একমাত্র প্রদীপ তখন রায়ান, তাই তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। স্বয়ং সেনাপ্রধান জেনারেল জর্জ মার্শাল আদেশ দেন- রায়ানকে যে কোনো মূল্যে ফিরিয়ে এনে তাঁর মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে। এই গুরু দায়িত্বের ভার পড়ে ক্যাপ্টেন জন মিলারের হাতে। জার্মানি দখলকৃত ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো রায়ানকে খোঁজার মিশনে নামে মিলার ও তাঁর দল। এই সিনেমা নির্মাণে খরচ হয়েছিল ৭০ মিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাপী ছবিটি আয় করেছে ৪৮৬ মিলিয়ন ডলার।