নাম আব্দুল সালেক। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। প্রায় তিন দশক ধরে ফুটপাতে মৌসুমি ফলের ব্যবসা করেন। বাবা ছিলেন কলার ব্যবসায়ী, তাঁর হাত ধরেই এ পথে যাত্রা শুরু। বর্তমানে তিনি তেজগাঁও নাখালপাড়ার ফুটপাতে কলার ব্যবসা করছেন। তা দিয়েই সংসার চালান। তাঁর সঙ্গে কথা বলে লিখছেন ফরিদুল ইসলাম নির্জন

মৌসুমি ফল ব্যবসার কথা চিন্তা করলেন কীভাবে?
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা তেমন ভালো লাগত না। স্কুলে যাওয়ার কথা শুনলেই অন্য খানে পালিয়ে যেতাম। বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। তবে মা-বাবা চেষ্টা করেছেন আমাকে পড়াশোনা করানোর জন্য; কিন্তু আমি সে পথে এগোতে পারিনি। বাবা কলার ব্যবসা করতেন। হাটে-বাজারে কলা বিক্রি করতেন। আমিও বাবার সঙ্গে নেমে যাই ব্যবসায়। ভাবলাম, পড়াশোনা যেহেতু হবে না, ব্যবসা করে পরিবারে কিছু আয় করি। চলছিল ভালোই। পরে এক সময় বিয়ে করি। ভাবলাম, বাবার সঙ্গে ব্যবসা করলে আগের আয় দিয়ে সংসার চালানো যাবে না। একসময় ঢাকায় চলে আসি। এখানে মাস্টার ভাই নামে একজন লোকের সঙ্গে পরিচিত হই। তিনি আমায় ফুটপাতে কলার ব্যবসার কথা বলেন। তারপর বাবার সেই কলার ব্যবসা শুরু করি। কলা নিয়ে রাস্তায় বসে যাই।
আপনার সন্তানদের কি এই পেশায় আনবেন?
আমি চাই সন্তানরা আমার পেশায় না আসুক। তারা শিক্ষিত হয়ে চাকরি করুক। এসি রুমে থাকুক, এসি গাড়িতে উঠুক। আমার মতো ফুটপাতে না বসুক। রোদে বা বৃষ্টিতে টেনশনে অস্থির না হোক। কোথায় বসবে, তা নিয়ে বাড়তি চিন্তা না করুক। কয়েকদিন টানা বৃষ্টিতে সংসার চালানো নিয়ে চিন্তা না করুক। আমার তিন মেয়ে, এক ছেলে। সবাইকে পড়াশোনা করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
কোন বিষয়টি সবচেয়ে সমস্যা বলে মনে করেন?
আমি তেমন সমস্যার কিছু মনে করি না। কারণ আমি দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অনেকেই নিয়মিত আসেন কিনতে। আমাকে চেনেন। তবে খুব খারাপ লাগে কখনও কখনও। যদি বলি, এই দামে কিনেছি আমি। তারপরও বিশ্বাস করেন না। উল্টো শুনিয়ে দেন, 'লাভ না হলে কেনা দামে কেউ ব্যবসা করে। আরও কম নেন।' কেনা দামেও কেউ কেউ নিতে চান না। তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়।
যে আয় করেন তা দিয়ে সংসার চালাতে পারেন?
বেশ ভালোই চলে। না হলে কি আর এত বছর ধরে একই ব্যবসায় আছি। সংসার খরচের পর কিছু সঞ্চয় করি। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি এ ব্যবসার টাকার সঞ্চয়ে। তবে মাঝে মধ্যে ঝুঁকি আসে।
ক্রেতার সঙ্গে কোনো একটি ঘটনা বলুন।
এখানে অনেক দিন ধরে একজন শিক্ষার্থী কলা নিতেন। সপ্তাহে অন্তত তিনবার রাত ১০টার পর তিনি আসতেন। কম দামে কলা কিনতেন। কোনো দিন কলা শেষ হয়ে গেছে, তারপর এসেছেন। কলা না পেয়ে মন খারাপ করে চলে যেতেন। আমি তাকে 'লেট মামা' বলতাম। একপর্যায়ে বলতাম, মামা আপনি কবে কবে আসবেন- সেটা বলে দিলে কলা কিছু রেখে দিতাম। এরপর তিনি শনি, সোম ও বুধবার আসতেন কলা নিতে। কলা শেষের দিকে হলে তার জন্য রেখে দিতাম। এভাবে তিনি কলা নিতেন। কোনোদিন হয়তো আসতে পারতেন না। আমি অপেক্ষা করে অন্য ক্রেতাকে দিয়ে দিতাম। এভাবে তার সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো- তিনি পড়াশোনা শেষ করে এখন চাকরিতে আছেন। বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছেন। 'লেট মামা' এখনও কলা নেন শেষ বেলায়।