শীতের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। আশপাশে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে গোচারণভূমি। সকাল থেকে চলছে বন্যপ্রাণীর ওপর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার কাজ। কালেভদ্রে দু-একজন মানুষ। হঠাৎ মাথার ওপর দিয়ে পাতি চখাচখির বড় এক ঝাঁক উড়ে গিয়ে বসল খালের ওপারে। উৎসুক মন ছুটে চলল তাদের পেছনে। কিন্তু খালে জোয়ারের পানি, ক্রমেই তা বাড়ছে এই জনমানবহীন দ্বীপে। সাহস করে নেমে পড়লাম, ক্যামেরা উঁচু করে ধরে হাঁটু পর্যন্ত আঠালো কাদা আর গলাসমান পানি পাড় হয়ে খাল পেরোতেই যা চোখে পড়ল, মনে হয় জলচর পাখিদের এক স্বর্গে এসে পড়লাম। কী নেই! বুনোকর রাজহাঁস, কাদম্ব রাজহাঁস, পাতি চখাচখি, খয়রা চখাচখি, ভূতিহাঁস, মৌলভি হাঁস, জিরিয়া, বাটান, উল্টোঠুঁটি, গুলিন্দা গাংচিল, পানচিলসহ বিচিত্র সব পাখি উড়াল দিচ্ছে মাথার ওপর। এ এক চোখ জুড়ানো নয়নাভিরাম দৃশ্য- যা হয়তো সহজে চোখে পড়ে না। এই গল্পটা চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপের।
পৃথিবীজুড়ে জীববৈচিত্র্য গবেষণায় এবং সংরক্ষণে বর্তমানে উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। কারণ, এখানে রয়েছে পৃথিবীর সংকটাপন্ন বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে পাখিদের বিশাল এক সম্ভার। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর আগমন ঘটে হাজারো পাখপাখালির, যারা বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশে গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সন্দ্বীপ হলো উপকূলীয় এলাকায় পাখিদের ঠিক এমনি এক গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল।
বঙ্গোপসাগরের বুকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত উপজেলা সন্দ্বীপ; যার আয়তন ৭৬২.৪২ বর্গকিলোমিটার। অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা দ্বীপটি বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রাচীন একটি দ্বীপ।
২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণী গবেষক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান ও সহকারী অধ্যাপক মো. মাহাবুব আলমের তত্ত্বাবধানে মাঠ পর্যায়ে মো. ফজলে রাব্বির নেতৃত্বে সন্দ্বীপ উপজেলায় বন্যপ্রাণীর ওপর এক বিস্তৃত গবেষণা চালানো হয়। বন্যপ্রাণী গবেষণার আধুনিক বিভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয় এই গবেষণায়। মূলত তিনটি প্রধান এলাকায় ভাগ করে ১৪৫টি গ্রিডে পুরো এলাকা ভাগ করা হয়। প্রতিটি গ্রিড ধরে সংগ্রহ করা হয় বন্যপ্রাণীর তথ্য। প্রাণীদের আবাসস্থলকে ৬টি ধাপে ভাগ করা হয় এ গবেষণায় এবং প্রতিটি আবাসস্থল গবেষণার সময় সার্ভে করা হয়। দিনের পাশাপাশি রাতেও উভচর ও সরীসৃপজাতীয় প্রাণীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সংগ্রহ করা হয় বন্যপ্রাণীর ওপর মানুষের ধারণা।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, সন্দ্বীপে বর্তমানে মোট ১৫১ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বসবাস, যাদের মধ্যে ১১৯ প্রজাতির পাখি, ১৪ প্রজাতির উভচর, ১৩ প্রজাতির সরীসৃপ ও পাঁচ প্রজাতির স্তন্যপায়ী রয়েছে। গবেষণায় উল্লেখযোগ্য এক স্থানজুড়ে রয়েছে পরিযায়ী, জলচর ও স্থলজ পাখির কথা। সেখানে বলা হয়েছে- সন্দ্বীপ এলাকা এসব প্রাণীর জন্য একটি উল্লেখযোগ্য আবাসস্থল। স্থানীয় পাখির পাশাপাশি শীতে পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে সন্দ্বীপে। বিভিন্ন প্রজাতির ঈগল, মাছমুরাল, চিল, মধুবাজ এখানের শিকারি পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ছয় প্রজাতির বুনো পরিযায়ী হাঁসের দেখা মেলে সন্দ্বীপে। রয়েছে ২৭ প্রজাতির সৈকত পাখি। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ঘুঘু, কোকিল, মুনিয়া, আবাবিল, ফিঙে, খঞ্জন, ছাতিঘুরানি, শ্বেতাক্ষী, বগা বগলা, কাঠঠোকরা, প্যাঁচা, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
সম্প্রতি এসব তথ্য ও গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত স্পিঞ্জার পাবলিশার্স কর্তৃক প্রকাশিত ট্রপিক্যাল ইকোলজি নামক আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে। মাঠ পর্যায়ে সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্ত বিভিন্ন ধরনের নতুন পদ্ধতিতে বিশ্নেষণ করা হয়। সাগরতীরের গ্রামীণ এলাকায় সর্বোচ্চসংখ্যক পাখির দেখা মেলে। আবাসস্থল হিসেবে গবেষণায় সমুদ্রতীরবর্তী এলাকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্বীপ এবং উপকূলীয় এলাকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা বর্তমান সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবাসস্থল ধ্বংস, দূষণ, শিকার, নগরায়ণসহ বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে আমাদের এই দ্বীপ অঞ্চলের বন্যপ্রাণীরা। সন্দ্বীপের এই গবেষণা এসব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে যুক্ত করবে অনন্য এক মাত্রা। া