এসিন ছেলেবি বায়রু- তুরস্কের কোনিয়া শহরে চিরনিদ্রায় শায়িত মানবিকতার প্রতিভূ সুফি কবি জালাল উদ্দিন রুমির ২২তম বংশধর। রুমি সশরীরে নেই, কিন্তু তিনি যেন রুমিরই প্রতিনিধি। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে আসে রুমির ধর্মচিন্তা, সমাজ, সেক্যুলারিজমসহ বিভিন্ন বিষয়। ইস্তাম্বুলে থাকেন। সেখানকার এক ক্যাফেতে বসে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাকিল রেজা ইফতি
শুরুতেই জানতে চাই শুরুর কথা।
সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে আমার জন্ম ১৯৪৯ সালে। ১৯২৫ সালে তুরস্কে 'মেভলেভিহানে' অর্থাৎ মেভলানা রুমির ইসলামী দর্শন শেখানোর কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রুমিপুত্র সুলতান ভেলেদ এবং দৌহিত্র উলু আরিফ ছেলেবি। এই কেন্দ্রের প্রধান হিসেবে যিনি নির্বাচিত হতেন, তাঁকে বলা হতো 'মাকাম ছেলেবিসি'। সবসময় রুমির রক্তের আত্মীয়কে প্রধান নির্বাচন করা হতো। ১৯২৫-এর দিকে আমার বাবার দাদা আব্দুল হালিম ছেলেবি ছিলেন 'মাকাম ছেলেবিসি'। আতাতুর্ক তাঁকে আঙ্কারায় একবার আমন্ত্রণ জানান এবং তাঁরা উভয়েই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে তুরস্কের সীমানার মধ্যে মেভলেভিহানে বন্ধ করা হবে কিন্তু সেলছুক ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি হয়েছিল যেসব অঞ্চলে, সেসব অঞ্চলে মেভলেভিহানের কেন্দ্রগুলো খোলা থাকবে। তাই কোনিয়ার মেভলেভিহানে বন্ধ হয় এবং আলেপ্পো শহরে চলমান থাকে। আব্দুল হালিম ছেলেবির মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে অর্থাৎ আমার দাদা বাকির ছেলেবি 'মাকাম ছেলেবিসি' হন। আমার বাবার জন্ম হয় আলেপ্পোতে। আমরা পাঁচ ভাইবোনের চারজনই ওখানে জন্মগ্রহণ করি। দাদার মৃত্যু খুব অল্প বয়সেই হয়। তাই মাত্র ১৭ বছর বয়সে আমার বাবাকে 'মাকাম ছেলেবেসি' হয়ে যেতে হয়। পরবর্তী সময়ে ওখানকার মেভলেভিহানেও বন্ধ হয়ে যায়। তাই আমরা ইস্তাম্বুলে চলে আসি।
রাস্তার অন্যপাশে মসজিদের পাশেই একটি স্কুলের নাম 'ইস্তাম্বুল ইশিক লিসেসি'। এর বাংলা অর্থ দাঁড়ায়- 'ইস্তাম্বুল আলো বিদ্যালয়'। এসিন ছেলেবি বলেন, 'ওই স্কুলেই আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। ওখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে আমি ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের 'আরবি-ফারসি ভাষাবিদ্যা' বিভাগে ভর্তি হই। ১৯৯৬ সালে আমার বাবা আন্তর্জাতিক মেভলানা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে আমার ভাই ফারুক ছেলেবি এই ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং আমি সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
রুমির সাহিত্য ও দর্শনের সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় ঘটে কখন?
মাওলানা রুমির কথা থেকে আমি যা অনুমান করেছি এবং আমার লোকদের বলেছি এবং কোরআন-হাদিসেও আছে বলে আমরা জানি- আল্নাহ পরিচিতি ও ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে একটি সম্মানিত সত্তা হিসেবে সৃষ্টি করে এই মহাবিশ্ব মানুষের আদেশাধীন করেছেন। আমাদের এটি থেকে একটি শিক্ষা নেওয়ার আছে- জানা ও ভালোবাসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রথমে নিজেকে জানতে ও ভালোবাসতে হবে। এটি অবশ্যই অহম বোঝায় না। সর্বদাই ঈশ্বর আমাদের উপহার দেন। আমাদের তা উপলব্ধি করতে জানতে হবে। আমাদের জীবনে দাদিমার ভূমিকা অনেক। তাঁর মুখে গল্প-কবিতা শুনে শুনেই আমাদের শৈশব কেটেছে। বড় হওয়ার পর যখন 'মসনবি' হাতে পেয়েছি, দেখি এর সবকিছুই আমার জানা। দাদিমা আমাদের ছোট থেকেই এর সব শুনিয়ে বড় করেছেন। এমনকি এগুলো শুনতে শুনতে আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে সুন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দাদিমা আমাদের শুধু গল্প শোনাতেন না; শোনানোর পর সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন, আমাদের মতামত জানতে চাইতেন। গল্পগুলো যে 'মসনবি' থেকে নেওয়া, সেটি না জেনেই আমরা আমাদের চিন্তাভাবনা, মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতাম।
বিশ্বজুড়ে এই যুদ্ধ-বিবাদ, ধর্মের নামে বিভাজন, হত্যা ইত্যাদিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ইসলাম সর্বদা শান্তির পথ প্রদর্শন করলেও বিশ্বে ধর্মের অপব্যবহার দেখা যায়। কখনও কখনও ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষ সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়। দুর্ভাগ্যবশত যারা এই ভীতি এবং এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, তারা আসলে ইসলামকে জানে না এবং ইসলামের অপব্যবহার করে। আল্নাহ্‌র সর্বোত্তম আদেশ হলো- 'তোমরা সহজ করো, কঠিন করো না।' এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নবী বলেছেন, 'ধর্মকে ভালোবাসো!' আজকের বিশ্বে ঘটে যাওয়া সব অন্যায় ও যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানা রুমি একটি অত্যন্ত সংগতিপূর্ণ উদাহরণ। আমরা জানি, মাওলানা রুমির জীবদ্দশায় মোঙ্গল আক্রমণ মানুষকে খুব বিচলিত করেছিল। তবে তখন শত্রুর পরিচয় অন্তত জানা ছিল। এখন দুর্ভাগ্যবশত শত্রু কে তা না জেনেই আমরা বেঁচে আছি এবং বিশ্বের এই বিভ্রান্তিকর অবস্থায় মানুষ শান্তি খুঁজছে। আমার বিশ্বাস, তারা মাওলানা রুমির কথায় শান্তি ও মানবতার সন্ধান পেয়েছে বলেই আরও পড়তে ও বুঝতে চেষ্টা করছে। মূল বিষয় হলো, যা পড়ছেন তা চর্চায় রাখা। না হলে শুধু পড়াটা নিরর্থক। শুধু পড়লেই হবে না। অর্জিত জ্ঞান ব্যক্তিজীবনে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজে না লাগালে, এই পাঠের কোনো গুরুত্বই থাকবে না।
বিশ্বশান্তি রক্ষায় সেক্যুলার দর্শনের গুরুত্ব কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের দেশে আমরা 'লাইকলিক' (সেক্যুলারিজম) বলে থাকি- ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি পৃথক থাকা উচিত। কারণ রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিতে বস্তুগত দিক বেশি। কিন্তু ধর্মীয় বিষয়গুলোর ভিত্তি আধ্যাত্মিকতার ওপর, মানুষের আত্মার শান্তির জন্য যেসব নিয়ম জানতে হবে তার ওপর। তাই এই দুটিকে পৃথক করা অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে ধর্মেই বিশ্বাস করি না কেন, রাষ্ট্রের ছত্রচ্ছায়ায় আমাদের রাষ্ট্রীয় নিয়ম মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া প্রত্যেকেরই নিজস্ব বিশ্বাস রয়েছে।
পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ভাবছেন?
পৃথিবীর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে মনে করি। আমি আমন্ত্রণের সূত্রে বিশ্বের বহু জায়গায় প্রায়ই ভ্রমণ করি। যেখানেই যাই, মাওলানা রুমি এবং তাঁর উপলব্ধি থেকে ইসলামকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। একে জমিতে বীজ রোপণের মতো ধরে নেওয়া যায়। হয়তো আজ আমি দেখতে পাব না যে এর গুরুত্ব কতখানি কিন্তু আমার বিশ্বাস এই বীজগুলো অঙ্কুরিত হবে এবং তরুণ প্রজন্ম এর দ্বারা উপকৃত হবে।
মাওলানা রুমি বলেন-
'কাছে এসো, কাছে, আরও কাছে!
এ যাত্রা আর কত দিনের?
যেহেতু তুমিই আমি এবং আমিই তুমি,
তাহলে এই আমিত্ব ও অহমিকা কেন?
আমরা ঈশ্বরের আলো, ঈশ্বরের আয়না।
তবে আমরা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করি কেন?
একটি আলো অন্য আলো থেকে এভাবে দূরে চলে যেতে চায় কেন?
আসো, এই অহমিকা ত্যাগ করি এবং সকলের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলি।
যতক্ষণ তুমি কেবল নিজের মধ্যে থাকবে ততক্ষণ তুমি শুধু একটি শস্যদানা, একটি কণা।
কিন্তু একবার সকলের সাথে ঐক্যবদ্ধ হলে, ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করলে,
তুমি পরিণত হও রত্নে, গভীর সমুদ্রে।'
আজকের পৃথিবীর জন্য এ কথাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।
বিদায়বেলায় এসিন ছেলেবি তাঁর লেখা একটি বই উপহার দিলেন। নাম 'লাভ ইজ সামথিং বিউটিফুল'। বললেন, 'আমার লেখা বই আমি কখনও উপহার দিই না। কারণ এগুলো থেকে যে সম্মানী পাই, তা সরাসরি মেভলানা ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে ব্যবহূত হয়। কিন্তু তোমাকে দিচ্ছি। কারণ তুমি বাংলাদেশের প্রতিনিধি। মনে হচ্ছে যেন পুরো বাঙালি জাতিকে উপহার দিচ্ছি।' ভালোবাসা সত্যিই খুব সুন্দর এক বিষয়!

বিষয় : জালাল উদ্দিন রুমি এসিন ছেলেবি বায়রু

মন্তব্য করুন