গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ওষুধের প্রয়োজন হলে মুখে খাওয়ার ট্যাবলেটের পরিবর্তে ইনসুলিন ব্যবহার নিরাপদ ও অধিক কার্যকরী। গর্ভধারণের পূর্ব থেকে ডায়াবেটিস থাকলে মুখে খাওয়ার ওষুধ পরিবর্তন করে চিকিৎসকের পরামর্শে ইনসুলিন শুরু করতে হবে

গর্ভধারণ প্রত্যেক নারীর জন্য আনন্দময় বিশেষ একটি সময়। মাতৃত্বের স্বাদ প্রতিটি নারীর পরম পাওয়া। কিন্তু এই পরম চাওয়া বিশেষ আনন্দময় সময়গুলো ঝুঁকিপূর্ণ ও অধিক মানসিক চাপ যুক্ত হয়ে যেতে পারে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে। বিশ্বের যেসব দেশে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তের হার বেশি তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে প্রায় ১০ শতাংশ নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা থেকে নিঃসৃত হরমোন ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিস দেখা দেয়। আর গর্ভাবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস বিপদ ডেকে আনতে পারে মা ও গর্ভস্থ শিশুর উভয়েরই।

গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি?
-অজ্ঞাত কারণে পেটে অথবা জন্মের পরপরই সন্তান মারা যাওয়ার ইতিহাস থাকলে
-গর্ভথলিতে পানির (অ্যামনিয়াটিক ফ্লুইড) পরিমাণ বেশি থাকলে
-গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন ইনফেকশনের লক্ষণ, যেমন- তলপেটে ব্যথা, মাসিকের রাস্তায় চুলকানি, চর্মরোগ ইত্যাদি দেখা দিলে
-পূর্ববর্তী গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থাকলে।

উপরোক্ত যে কোনো এক বা একাধিক ঝুঁকি থাকলে অবশ্যই গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস আছে কিনা, তা শনাক্তকরণের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট বা ওজিটিটি পরীক্ষা করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে চিকিৎসকের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে এবং ফলাফল স্বাভাবিক থাকলেও পরবর্তী সময়ে গর্ভকালীন ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে আবার একই পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। সাধারণত গর্ভের প্রথম ১২ সপ্তাহে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে, তাদের আগেই ডায়াবেটিস ছিল হিসেবে ধরা হয়। আর গর্ভের ২৪ সপ্তাহের পর যে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, তা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে মা ও গর্ভস্থ শিশুর সম্ভাব্য জটিলতা
গর্ভকালীন সময়ে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে মায়ের একলাম্পশিয়া বা খিঁচুনি হতে পারে। সময়ের আগে প্রসববেদনা শুরু বা অপরিপকস্ফ সন্তান প্রসবের ঝুঁকি থাকে। গর্ভথলিতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ঘন ঘন ইনফেকশন হওয়া ও ইনফেকশনের কারণে সময়ের আগেই পানি ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্রসব-পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।

গর্ভের সন্তানের ওজন অনেক কম বা বেশি হতে পারে। সদ্যোজাত সন্তানের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গিয়ে খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট এবং দেহে তাপমাত্রা বজায় রাখার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এতে পরিস্থিতি জটিল হয়ে মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। ভবিষ্যতে শিশুর ওজন আধিক্য বা ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা
গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ওষুধের প্রয়োজন হলে মুখে খাওয়ার ট্যাবলেটের পরিবর্তে ইনসুলিন ব্যবহার নিরাপদ ও অধিক কার্যকরী। গর্ভধারণের পূর্ব থেকে ডায়াবেটিস থাকলে, মুখে খাওয়ার ওষুধ পরিবর্তন করে চিকিৎসকের পরামর্শে ইনসুলিন শুরু করতে হবে। সবার ইনসুলিন লাগবে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে শুধু খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও হালকা ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই সময় সবারই সঠিক পরিমাণে সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিতভাবে হালকা হাঁটা বা ব্যায়াম করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ভারী কাজ বা ব্যায়াম করা যাবে না। এ সময় অনেকেরই খাবারে অরুচি, বমি ভাব বেড়ে যায়। আবার বিশেষ কিছু খাবারের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যেতে পারে। ফলে ডায়াবেটিসের মাত্রা খুব বেশি ওঠানামা করতে পারে। তাই নিয়মিতভাবে ডায়াবেটিসের মাত্রা নিরূপণ করতে হবে।

সম্ভব হলে বাসায় জ্ঞু্নকোমিটারের সাহায্যে নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ইনসুলিনের মাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থা। তাই গর্ভাবস্থায় আপনার গাইনোকোলজিস্টের সঙ্গে নিয়মিত পরামর্শের পাশাপাশি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন ডায়াবেটিস ও হরমোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের বেশিরভাগেরই সন্তান প্রসবের পর ছয় সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস আর থাকে না।

তবে গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের ১৭ শতাংশের ক্ষেত্রে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে আর ২৫ শতাংশ ১৫ বছরের মাথায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ডেলিভারির ৬ সপ্তাহ পর মায়ের রক্তে ওজিটিটি পরীক্ষা করতে হবে এবং পরে স্বাভাবিক থাকলেও প্রতিবছর কমপক্ষে একবার করে ওজিটিটি পরীক্ষা করা ভালো। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, দৈহিক পরিশ্রম ও ওজন নিয়ন্ত্রণ সর্বোপরি স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে পারলে ভবিষ্যৎ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমানো যায়।

[কনসালট্যান্ট, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন রোগ বিভাগ সিডব্লিউসিএইচ ও ইমপালস হাসপাতাল তেজগাঁও, ঢাকা]