-samakal-63a296b64057f.jpg)
সকাল প্রায় সাড়ে ১১টা। হুট করেই মাথায় চেপে বসল মোটরবাইকে চড়ে পাহাড় দেখার নেশা। মেসেঞ্জারে নক করলাম আরও কয়েক ভ্রমণপিপাসুকে। শুরুতে নিছক মজা করছি এ রকমটাই কেউ কেউ ভাবল। যখন দেখল আমি সিরিয়াস, তখন আরও পাঁচজন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তার পর ছুটলাম পাহাড়ের নতুন আকর্ষণ সিন্দুকছড়ির উদ্দেশে। যেতে যেতে মিরসরাই রাত। যেখানে রাত, সেখানেই কাত। সুবিধাজনক এক স্থানে তাঁবু খাটিয়ে রাত যাপনের প্রস্তুতি নিই। পরদিন ফটিকছড়ির হেয়াকো সেলফি রোডে ঢুঁ মারলাম। অনেক ভালো লাগল রাবার বাগানের মাঝে চকচকে সড়ক। চারপাশটা অসাধারণ সৌন্দর্যে ভরপুর। মন চাচ্ছিল এখানেই দিনটা কাটিয়ে দিই। কিন্তু না। এর পর চলতে শুরু করি রামগড় চা বাগান হয়ে সিন্দুকছড়ির দিকে। যাওয়ার সময় দেখা হয়, ফেনী নদীর ওপর নবনির্মিত রামগড়-সাব্রুম সীমান্ত সেতু। ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। আর এপারে খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলা। কয়েক কিলোমিটার দূরেই সকালের নাশতার জন্য বাইকের ব্রেক কশলাম রামগড় বাজারে। তেলে ভাজা লাল পরোটা, ডিম মামলেট আরও কত কি খেয়ে নিলাম। হালকা-পাতলা বিশ্রাম নিয়ে আবারও দে-ছুট। জালিয়াপাড়া হয়ে বাইক ছুটছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দুর্গম পাহাড়ের বুকে নির্মিত, রাঙামাটির সঙ্গে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক হলো সিন্দুকছড়ি। কিছুক্ষণ চলার পরই কথিত পর্যটকদের বয়ান বাংলার লাদাখের সৌন্দর্যের ঝাপটা শুরু।
ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ হতে আমি নিজের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অন্য কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করার মাঝে রয়েছে বেশ অনীহা। আমার দেশের প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্য কোনো দেশের চাইতে কম যায় না। তেলতেলে সড়কে বাইক ছুটছে। কোথাও উঁচু, আবার কোথাওবা নিচু। কখনওবা মনে হবে, এই বুঝি আমি সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে যাচ্ছি। দৃষ্টির গোচরে এমন সব দৃশ্য মনের মাঝে অসাধারণ ভালো লাগা ভর করেছে। নয়নাভিরাম সড়কটা মহলছড়ি হয়ে রাঙামাটি চলে গেছে। যেতে যেতে বাইক থামে তিন রাস্তার মোড় সিন্দুকছড়ি জোনের সামনে। পাহাড়ের গায়ে খুব সুন্দর করে লেখা শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়ন। আসলেও তাই। স্থিতিশীলতা ছাড়া এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। লেখার সামনে শুয়ে, বসে দাঁড়িয়ে কিশোরদের মতো ছবি তুললাম ইচ্ছামতো। এর পর আবারও বাইক স্টার্ট। ওয়াও! এই আমি যাচ্ছি কোন পথে/ পথের সৌন্দর্য আমায় মাতাল করে/ আমি তো প্রকৃতির প্রেমে/ আরো খাবো হাবুডুবু/ এই আমি যাচ্ছি কোন পথে/ ডানে উঁচু পাহাড়/ বামে গভীর গিরিখাদ।
যেতে যেতে আবারও থামলাম পথের পাশে থাকা ছাউনিতে। সিন্দুকছড়ি সড়কের এই জায়গাটাতে যেন পাহাড়ের প্রকৃতি তার সবটুকুন রূপ মেলে ধরেছে। যতদূর চোখ যায়, শুধু ঢেউ খেলানো সবুজে মোড়ানো পাহাড়ের সারি। আমাদের সিন্দুকছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্য। পার্শ্ববর্তী কোনো দেশের নান্দনিকতার চাইতে কম নয়। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে, মনমতো দুই নয়নে মায়াময় সিন্দুকছড়ির রূপের নির্জাস গোগ্রাস করে আবারও চেপে বসি শখের অ্যাভেঞ্জারের পিঠে। বিশুদ্ধ নির্মল বাতাসের ঝাপটায় কাঠফাটা রোদের তেজ ম্লান করে বাইক ছুটছে তার আপন গতিতে। মহলছড়ি ছাড়িয়ে নানিয়ারচরের পথে বাইক। যেতে যেতে হঠাৎ ব্রেক না কশে আর পারলাম না। পথের পাশে পাহাড়ের ঢালুতে উপজাতিরা বাঁশকোড়ল, পেঁপে, কাজুবাদাম, আনারসসহ নানা পাহাড়ি ফলের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। আনারস ও কাজুবাদামের স্বাদ চেখে, পরিবারের জন্য গাছ আলু নিয়ে আবারও অদম্য ছুটে চলা। আমবাগান, লিচুবাগানের পাশ দিয়ে সরু সড়কে ছুটতে ছুটতে জুমার সময় ঘনিয়ে এলো। ধারের কাছের এক লোকালয়ে বাইক রেখেই মসজিদে ঢুকে যাই। নামাজ শেষে পেটে টান। রাঙামাটি শহরে যাব, নাকি কাপ্তাই চলে যাব।
এ রকমটা ভাবতে ভাবতেই শহরের কোলাহল এড়ানোর জন্য বাইকের চাকা ঘুরে কাপ্তাইয়ের পথে। পথের মনমাতানো সৌন্দর্যে মন আমাদের এতটাই মজে গিয়েছিল যে, ক্ষুধা কখন যে পাহাড়ের খাদে লুকিয়েছিল তা টেরই পাইনি। যেতে যেতে বিকেল ৩টার মধ্যে পৌঁছলাম কাপ্তাইয়ের বালুচর। আর দেরি না করে ঢুকে যাই এক রেস্টুরেন্টে। কাপ্তাই লেকের সুস্বাদু রুই আর সবজি দিয়ে উদরপূর্তি চলে। আয়েশ করে খেয়ে-দেয়ে চলে যাই লেকের ধারে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সূর্যটা হেলে পড়ায় লেকের পানির রঙে ভিন্নতা আছড়ে পড়েছে। ধীরে ধীরে সেদিনের জন্য সূর্যটা লাল আভা ছড়িয়ে নীলিমার সঙ্গে মিশে যেতেই আমরাও রাতটা আরামে কাটানোর জন্য নিরাপদ জায়গার সন্ধানে ছুটলাম। 'যেখানে রাইত, সেখানেই কাইত' এর নামই দে-ছুট। তবুও তো নিরাপত্তার ব্যাপারটা মাথায় রাখতেই হয়।
যাবেন কীভাবে :মোটরবাইকের ওপর যাঁদের ভালো দখল রয়েছে, একমাত্র তাঁরাই মোটরবাইকে চড়ে যেতে পারেন- এ রকম রোমাঞ্চকর বাইক ভ্রমণে। যাঁদের বাইক কিংবা ড্রাইভিংয়ে দক্ষতা নেই, তাঁরা খাগড়াছড়ির বাসে চড়ে রামগড় বা জালিয়াপাড়া নেমে যাবেন। সেখান থেকে ভাড়ায় খাটা মোটরসাইকেল কিংবা সিএনজিতে চড়ে ঘুরে আসতে পারেন নয়নাভিরাম সিন্দুকছড়ি। এ ছাড়া কাপ্তাই পর্যন্ত যেতে পারেন মাঝেমধ্যে গাড়ি বদলে। বিজয়ের মাসে ঘুরে দেখতে পারেন দেশ বিজয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান নানিয়ারচরে চিরশায়িত ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতিস্তম্ভ।
থাকা-খাওয়া : পাহাড় আর আগের মতো নেই। সঙ্গে তাঁবু না থাকলেও লোকালয়গুলোতে হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্ট মিলবে।
খরচাপাতি : অনর্থক খরচের অভ্যাস না থাকলে হাজার তিনেক টাকা হলেই দুই রাত এক দিনের ভ্রমণ অনায়াসেই সেরে আসা যাবে।
সতর্কতা :বাইকে দূরে কোথাও ভ্রমণ করা ঠিক নয়। সামান্য অসাবধানতার কারণে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। তবে বাইকে লং ট্যুরে গেলে আপনি যতই দক্ষ চালক হন না কেন, বাইকের গতি হাইওয়েতে ঘণ্টায় ৮০- ৯০ কিলোমিটারের বেশি তুলবেন না। সড়কের গতিবিধি মেনে বাইক চালাবেন। অন্য বাইকারদের সঙ্গে, অন্য যানবাহনের সঙ্গে গতির প্রতিযোগিতা করবেন না। বাইক চালানোর সময় ট্রাক-বাস থেকে সাবধান থাকতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া কোনো যানবাহনকেই ওভারটেক করা থেকে বিরত থাকবেন। শীতে বাইক চালানোর সময় গরম কাপড়, গ্লাভস ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে রাখবেন। হাইওয়েতে আপনার বাইকের টেইল লাইট, হেডলাইট কিংবা ফগ লাইট জ্বালিয়ে রাখবেন। বেশি কুয়াশায় কম স্পিডে বাইক চালাবেন।
মন্তব্য করুন