স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের সঙ্গে আমার পরিচয় নব্বইয়ের দশকে; যদিও আমি তাঁকে আগ থেকেই একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিনতাম। তিনি সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে রেখে একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি রণাঙ্গনে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেন। আমরা দেখেছি, স্থাপত্যের বাইরেও তিনি তাঁর জগৎকে আরও বড় করে নিয়েছেন। তাঁকে আমরা প্রায় সকল নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় যোদ্ধা হিসেবে পেয়েছি। পাশাপাশি তিনি খেলাধুলার সঙ্গেও যুক্ত হন। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। সম্মিলিত ক্রীড়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক মোবাশ্বের হোসেনকে আমরা দেখেছি, দেশের ক্রীড়াঙ্গনের যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন।
আমরা দেখেছি, ধানমন্ডি মাঠ ও তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের পাশে ছিলেন। মাঠসহ নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে তিনি সোচ্চার ছিলেন। পরিবেশ আন্দোলনেও তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার কেন্দ্রীয় সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার কারণে তিনি অনেকের চক্ষুশূল হয়েছেন, তবু সত্য বচনে পিছপা হননি।

মোবাশ্বের হোসেন তাঁর মূল পেশাগত জায়গা তথা স্থাপত্যের ক্ষেত্রে যে কাজ করে গেছেন, সেটিও অনেকের প্রেরণা। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি এসোকনসাল্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এবং তাঁর এ প্রতিষ্ঠানটি এবার ৫০ বছরে পা দিয়েছে। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে তিনি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন। যার কারণে আমরা দেখেছি, তিনি বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি হিসেবে পাঁচবার দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের বাইরেও তিনি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আরও ছিলেন আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের সদস্য। কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টস ও আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল অব এশিয়ার সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে প্রশিকা ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক ভবন ও চট্টগ্রাম রেলস্টেশন।
মোবাশ্বের হোসেনের জীবনযাপন ৭৯ বছরের। বয়স যা-ই হোক, তাঁর ছিল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা তারুণ্য। তিনি তরুণদের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং তাঁর কাজের প্রকাশ দেখেছি বিভিন্নভাবে। বাংলাদেশ স্কাউটসের সঙ্গে যেমন তিনি কাজ করেছেন; তরুণদের সংগঠন গ্রিন ভয়েস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাঁর প্রেরণা রয়েছে। গ্রিন ভয়েসের স্লোগান- যুবরাই লড়বে/ সবুজ পৃথিবী গড়বে। তিনি তরুণদের বলতেন, তোমরা এ যুগের মুক্তিযোদ্ধা। আমি অস্ত্র দিয়েছি, কিন্তু চেতনা বিক্রি করিনি। সে জন্যই আমরা দেখেছি, তিনি দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ছিলেন অকুতোভয়। সত্যের পথে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আপস করে যাননি। এ কারণে অনেক হুমকিধমকি, মামলাও মোকাবিলা করতে হয়েছে। তারপরও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে কার্পণ্য করেননি। তাঁর প্রতিবাদী মানসিকতা ও কাজের কারণে তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন। মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় তাঁর আশ্রয়।
মোবাশ্বের হোসেনের নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ১৯৪৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। মৃত্যুর আগে তিনি দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। সর্বশেষ দুই মাস তাঁকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) রাখা হয়েছিল। তখন তাঁর ডায়ালাইসিস করা যাচ্ছিল না। ধীরে ধীরে শরীরের অবস্থা সংকটাপন্ন হলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তাঁর শরীরের নাজুক অবস্থার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায়ই তিনি চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।

মোবাশ্বের হোসেন সশরীরে বিদায় নিলেও আমি বিশ্বাস করি, কাজের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবেন। বিশেষ করে নগর আন্দোলনে ও মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রয়াত আনিসুল হক, সাঈদ খোকনসহ অন্যরা যেভাবে ঢাকা শহরের জন্য কাজ করে গেছেন, মোবাশ্বের হোসেনও ঢাকাকে নাগরিকের বসবাসের উপযোগী করে গড়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। নাগরিকদের অধিকার হরণের কিছু ঘটলে তিনি মাঠ নেমেছেন। শুধু শহরই নয়; গ্রাম-গঞ্জেও যেখানে মাঠ সংরক্ষণসহ মানুষের অধিকারসংশ্নিষ্ট বিষয় ছিল, তিনি সেখানে চলে যেতেন। নদী ও পরিবেশ সুরক্ষায় তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিশেষ করে পরিবেশদূষণের বিরুদ্ধে তিনি যে ভূমিকা পালন করে গেছেন, সেটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
স্থাপত্যে অবদানের জন্য ২০০৯ সালে মোবাশ্বের হোসেন আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্ক্টিটেক্টস (এআইএ) প্রেসিডেন্ট মেডেল লাভ করেন এবং ২০০৮ সালে ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের গোল্ড মেডেল অর্জন করেন। তাঁর বিদায়ে যেভাবে মানুষ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছেন এবং মানুষের প্রার্থনায় যেভাবে তিনি রয়েছেন, এটি তাঁর কাজেরই ফল। শারীরিকভাবে আমাদের ছেড়ে গেলেও তিনি আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবেই থাকবেন। মোবাশ্বের হোসেনের বিদায়ে আমরা শোকাহত।
ইকবাল হাবীব: স্থ্থপতি ও যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)