
রূপসী বাংলার অপরূপ সম্পদ নদী। মানবসভ্যতার অগ্রগতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবন-জীবিকা, শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গেও নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে নদীমাতৃক এ দেশের বেশিরভাগ নদীর অবস্থাই এখন সংকটাপন্ন। অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে অনেক নদ-নদী। এক সময়ের খরস্রোতা নদীর বুকজুড়ে এখন ধু-ধু বালুচর। সুষ্ঠু পরিচর্যার অভাবে নাব্য হারাচ্ছে জলপ্রবাহ। তিন সুহৃদের লেখায় তিনটি নদীর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজন...
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিষ্ণুবীছড়া, রাঙাছড়া ও পশ্চিম দিকের রমফা নদীর স্রোতধারা মিলে উৎপত্তি সোমেশ্বরী নদীর। গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষে বয়ে নেমে আসা অসাধারণ সৌন্দর্যে ভরা ইতিহাস-ঐতিহ্যে বিখ্যাত টংক আন্দোলনের রাশিমণি হাজংয়ের রক্তে স্নাত ইতিহাসখ্যাত নদী সোমেশ্বরী। এটি বাংলাদেশ ও ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে দুর্গাপুরের রানীখং পাহাড়ের পাশ দিয়ে। নদীটির বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ ১১৪ মিটার। সোমেশ্বরীর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, মেঘ, আকাশ, পাহাড় ও নদীর স্বচ্ছ পানির ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানোর নয়নাভিরাম দৃশ্যে ভ্রমণপিপাসুদের বিমোহিত করে।
সোমেশ্বরীসহ ৫৮টি নদ-নদী, ৮১টি হাওর, খাল-বিলের জলরাশির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নেত্রকোনার দুর্গাপুর। নেত্রকোনাতেও বড় শহর, বাণিজ্যকেন্দ্র, বাজার, জেলেপাড়া, গ্রাম নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। সোমেশ্বরী নদী থেকে নিয়মবহির্ভূত বালু উত্তোলন করার কারণে পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য, কৃষি ব্যবস্থা ও মাছসম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। শত শত ড্রেজারের প্রপেলারের আঘাত, নির্গত পোড়া মবিল ও তেলের কারণে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণিজসম্পদ বিলুপ্তপ্রায়। বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে সোমেশ্বরীর মহাশোল প্রাপ্তি এখন ভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোমেশ্বরী পাহাড়ি ঝরনা থেকে প্রবহমান হওয়ায় জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তন ও অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে নদীর স্বাভাবিক গতি এখন আর নেই।
সোমেশ্বরী নদীতে সরকার ঘোষিত বালুমহাল রয়েছে পাঁচটি। সেগুলো হচ্ছে- বিজয়পুর ভবানীপুর থেকে সর্বনাশা কাজ শুরু হয়েছে। দুর্গাপুরের তেরীবাজার ঘাট হয়ে শিবগঞ্জ বাজার ঘাট পর্যন্ত, দুর্গাপুর তেরীবাজার ঘাট হয়ে শিবগঞ্জ বাজারঘাট থেকে চৈতাটী, দুর্গাপুর বিরিশিরি ঘাট থেকে কেরনখলা, গাঁওকান্দিয়া মৌজার উত্তর সীমানা থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত বালুমহাল এবং ঝাঞ্জাইল থেকে উত্তর শংকরপুর পর্যন্ত বালুমহাল।
প্রতি বছর চৈত্র মাসে ইজারার জন্য বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা ২০১০-এর আইন অনুসারে কার্য সম্পাদিত হয়ে থাকে। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের ধারা অনুযায়ী পাম্প, ড্রেজার বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলন করা যাবে না। নিয়ম হলো, বালুমহাল থেকে কতটা বালু কাটা হবে তা সমীক্ষা করে নিতে হবে, বালু উত্তোলনে ড্রেজার ব্যবহার করতে হবে।
যাতে নদীতে সুইং করে তলদেশে সমভাবে খনন করা যায়। নদীর বুকে ৭০০-৮০০ অবৈধ ড্রেজার দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে এসব বালুমহাল থেকে। ফলে নদীর বিভিন্ন স্থানে তৈরি হচ্ছে বড় বড় গর্ত। ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে নদীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ। এ ছাড়া ড্রেজার থেকে নির্গত মবিল নদীর পানিতে মিশে মাছ ও জলজ প্রাণীর ক্ষতি হচ্ছে। নদীর তলদেশ থেকে পাথর উত্তোলনের ফলে নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। আশপাশ গ্রামের টিউবওয়েলগুলোয় ফাল্কগ্দুন-চৈত্র মাসে পানি ওঠে না।
উপদেষ্টা, সুহৃদ সমাবেশ ও সমন্বয়কারী, বারসিক নেত্রকোনা
মন্তব্য করুন