বাবা দরিদ্র ভ্যানচালক। তার সামর্থ্য নেই মেয়েকে ব্যাডমিন্টনের র‌্যাকেট এবং ফ্লাওয়ার কিনে দেবেন। বাবার কুড়িয়ে আনা ফ্লাওয়ার দিয়ে বাড়িতে অনুশীলন চলে। র‌্যাকেট হিসেবে ব্যবহার হয় পরিত্যক্ত স্যান্ডেল। এভাবেই আন্তঃস্কুল ব্যাডমিন্টনে দেশের দ্বিতীয় সেরা খেলোয়াড় হয়েছে রাবেয়া খাতুন। তার স্বপ্ন একদিন বড় মাপের খেলোয়াড় হবে।

অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাবেয়া (১৪) ছোটবেলা থেকেই ফুটবল, কাবাডি, হ্যান্ডবল, উচ্চ লাফ, ব্যাডমিন্টন ও ক্রিকেট খেলায় সমান পারদর্শী। কিন্তু তাদের ঘরে পুরস্কার রাখার মতো জায়গা নেই। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় জেতা সনদ ভাঙা ঘরের বেড়ায় গুঁজে রেখেছে।

সংসারে অভাব, প্রতিবেশীরাও ভালো চোখে দেখত না এক সময়। সব বাধা পেছনে ফেলে শীতকালীন জাতীয় শিশু পুরস্কার-২০২২-এর আন্তঃস্কুল ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় সারাদেশে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে রাবেয়া। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর ঢাকা জাতীয় শিশু একাডেমিতে এই প্রতিযোগিতা হয়। আগামী ২৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করবে রাবেয়া। এ ছাড়া বিভাগীয় কমিশনার ব্যাডমিন্টন, ভলিবল ও হ্যান্ডবল (শীতকালীন) প্রতিযোগিতা-২০২৩-এর ব্যাডমিন্টন খেলায় কুষ্টিয়া জেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সে। গত ২২ জানুয়ারি জেলা প্রশাসনের আয়োজনে কুষ্টিয়া মোহিনী মোহন বিদ্যাপীঠ মাঠে ফাইনাল খেলা হয়। আগামী ২৭ জানুয়ারি খুলনায় বিভাগীয় পর্যায়ে খেলতে যাবে রাবেয়া। গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন তার বাবা।

রাবেয়া কুমারখালী পৌরসভার খয়েরচারা গ্রামের ভ্যানচালক মামুন হোসেনের মেয়ে। সে তেবাড়িয়া শেরকান্দি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট রাবেয়া। মা-বাবা, দাদা-দাদিসহ সাত সদস্যের পরিবার তাদের। সংসারে অভাব আর অভাব। এমনও দিন যায়, জ্বলে না চুলা। না খেয়ে থাকতে হয় পরিবারের সদস্যদের। এই তো গত ২২ জানুয়ারি জেলায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দিনই ঘরে খাবার ছিল না। খবর পেয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেন ইউএনও। তবে অভাবের কাছে হেরে যেতে চায় না রাবেয়া। অদম্য কিশোরীর স্বপ্ন বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে বড় খেলোয়াড় হওয়া। একদিন বিশ্বজয় করার ইচ্ছা তার।

গতকাল মঙ্গলবার রাবেয়াদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল টিনশেড দোচালা একটি ঘর। ভাঙাচোরা বেড়া। এর বারান্দায় মায়ের সঙ্গে বসে তরকারি কাটাকাটি করছে রাবেয়া। তার খেলাধুলার সনদগুলো পাটকাঠির বেড়ায় গুঁজে রাখা হয়েছে। এ সময় কথা হয় রাবেয়ার সঙ্গে। আক্ষেপ করে এই কিশোরী বলে, 'বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে দেশসেরা খেলোয়াড় হতে চাই। কিন্তু বাবার সেই সামর্থ্য নেই। আমি বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ২৭টি খেলায় পুরস্কার ও সনদ পেয়েছি। রাখার জায়গা নেই। সুযোগ পেলে আমিও একদিন হতে পারি সেরাদের সেরা।' বিভিন্ন সময় পুরস্কার হিসেবে পাওয়া প্লেটগুলো মাটিতে সাজিয়ে সমকাল প্রতিনিধিকে দেখায় রাবেয়া।

মেয়ে খেলাধুলায় চ্যাম্পিয়ন হলেও, বাবা মামুন হোসেন জীবনযুদ্ধে পরাজিত সৈনিক। তাঁর ভাষ্য, অন্যের ভ্যান ভাড়ায় চালান তিনি। সাতজনের সংসার। এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ তিনি, উপার্জন বন্ধ। ঘরের খাবার ও টাকা শেষ। গত রোববার রাতে চাল, ডাল, তেল, শাকসবজি, মাংস দিয়ে গেছেন ইউএনও। তিনি বলেন, তাঁর মেয়ে ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন খেলায় পারদর্শী। সহযোগিতা পেলে রাবেয়াকে ভালো খেলোয়াড় বানাতে চান।

কথা হয় রাবেয়ার মা ফরিদা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, 'বাড়ির আশপাশের লোকজন নানা কথা বলতো। আমি ওকে খেলতে মানা করতাম। কিন্তু ও খেলা ছাড়বে না। ভালো খেলা দেখে এখন সবাই ওকে সাপোর্ট করে। আমারও ভালো লাগে। কিন্তু ওর বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় অভাব বেড়ে গেছে সংসারে।' তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা শেষে ফিরে আসার পথে রাবেয়াকে স্যান্ডেল দিয়েই ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখা গেছে।

জানতে চাইলে তেবাড়িয়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামাল হোসেনের দাবি, রাবেয়া খুব ভালো খেলোয়াড়। তাঁদের গর্ব। ও (রাবেয়া) যেন ভবিষ্যতে বড় খেলোয়াড় হয়, সেই প্রত্যাশা সবার।

রাবেয়া সঠিক পরিচর্যা পেলে ভালো কিছু করা সম্ভব বলে মনে করেন উপজেলা ক্রীড়া সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রহমান। তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসা উচিত এলাকাবাসীর।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিতান কুমার মণ্ডল জানান, রাবেয়া দারিদ্র্যকে জয় করে এগিয়ে চলেছে। জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় এবং জেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সে। রাতের খাবার নেই জানতে পেরে কিছু খাদ্যসামগ্রী তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে সেরাদের সেরা হওয়ার জন্য রাবেয়াকে নিয়ে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। কুমারখালী পৌর মেয়র সামছুজ্জামান অরুণ বলেন, রাবেয়া পৌরসভার সম্পদ। রাবেয়াকে তৈরি করার জন্য পৌরসভা সার্বিক
সহযোগিতা করবে।