- ফিচার
- ফাগুন হাওয়ায়
ফাগুন হাওয়ায়

'ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/ তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/ আমার আপনহারা প্রাণ, আমার বাঁধন-ছেঁড়া প্রাণ/ তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান...' -রবীন্দ্রনাথ
বসন্ত আসুক আর না আসুক, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক, বসন্তের গান শুনলেই মন আনন্দে নাচে। অকারণেই সুখের ঝরনা বয়ে যায় সাঁই সাঁই করে। গাছে গাছে কচি পাতা, কোকিলের ডাক- প্রকৃতির এমন রূপ বাতলে দিচ্ছে দুয়ারে বসন্ত। কুয়াশার ঘোমটা সরিয়ে, গাছে গাছে বাহারি ফুলের আভাসও জানাচ্ছে বসন্তের বার্তা। ইতোমধ্যে ফ্যাশন হাউসগুলোতে চলে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। কেননা, বাসন্তী রঙে নারী-পুরুষ সবাই সাজবেন।
ফ্যাশনপ্রেমীরা উৎসবের আমেজে উৎসবকেন্দ্রিক পোশাকে নিজেদের রাঙিয়ে তুলতে চান। এই উৎসবে শামিল হতে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোও রং ও নকশায় বিশেষ পোশাক নিয়ে হাজির হয়েছে। এসব পোশাকের রঙে ও নকশায় ফাল্কগ্দুনের প্রকৃতিই ভিন্ন মাত্রায় ধরা দিয়েছে। একই দিনে ভালোবাসা ও পহেলা ফাল্কগ্দুন দুই দিবস হওয়ায় পোশাকেও সেদিক বিবেচনায় বৈচিত্র্যে ভরপুর।
বিশ্বরঙের ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, 'শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, পোশাক বা খাবারের মাধ্যমে যে কোনো জাতির পরিচয় ফুটে ওঠে। এর মধ্যে অন্যতম মাধ্যম পোশাক। সে জন্যই আমরা প্রতি বছর ঋতুরাজ বসন্তের রঙের আদলে পোশাক তৈরি করে থাকি। উজ্জ্বল রং, তবে চোখে দেবে শান্তি- এমন রংকে প্রাধান্য দিয়ে এবারের ফাল্কগ্দুন-ভ্যালেন্টাইনস ডে আয়োজনে পোশাক নিয়ে এসেছি।'
রঙ বাংলাদেশের ডিজাইনার সৌমিক দাস বলেন, 'পোশাক সংস্কৃতির অন্যতম বাহক। সে জন্যই আমরা সবসময় ঋতুভিত্তিক পোশাকে রং ও নকশায় ভিন্নতা নিয়ে আসি। বাহারি নকশার পোশাকে হলুদ ও বসন্তের নানা রঙের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রাধান্য পেয়েছে।'
আর্টের ডিজাইনার হোসাইন ইমন বলেন, 'বসন্তে নাতিশীতোষ্ণ প্রকৃতি বিরাজ করে। বেশি শীতও নয়, গরমও নয়। বসন্তে বাঙালিরা মূলত ফোক ডিজাইন ধারার পোশাক পরতে পছন্দ করেন। পাঞ্জাবি, ফতুয়া, শার্ট, টি-শার্ট তরুণদের তালিকায় থাকে; কারণ বসন্তের মাধ্যমে গ্রীষ্ফ্মের যাত্রা শুরু। পোশাকের কারুকাজেও ফোক ধারার প্রাধান্য থাকে। লাল, ইয়োলো, লেমন, হালকা লেমনসহ বিভিন্ন উজ্জ্বল রং এই সময় তরুণদের বেশি প্রাধান্য দিতে দেখা যাচ্ছে।' 'কাপড় এবং রঙের রুচিভেদে ভিন্নতা রয়েছে। তবে কাপড় হিসেবে সুতি বেশি বাছাই করে'- যোগ করেন হোসাইন ইমন।
সুরঞ্জনার ডিজাইনার ও স্বত্বাধিকারী নূর নাহার তৃপ্তি বলেন, 'বসন্তের রঙিন ফুলের সমারোহে বরাবরই ফুলের মোটিফ নানা রকমে উঠে আসে পোশাকে। গতানুগতিক শাড়ির মোটিফ ফুল থেকে বেরিয়ে এসে সেই ফুল বা রংকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে এখন, যাতে একঘেয়েমি না পেয়ে বসে পোশাকে। গাঁদা ফুল, গোলাপ, সানফ্লাওয়ার নিয়ে এখন বেশি কাজ হচ্ছে। বসন্তের সময়টাতে বেশি ঠান্ডা বা গরম না থাকায় ফেব্রিক হিসেবে সুতির পাশাপাশি যে কোনো মিশ্র সুতার পোশাকও পরা যায় সহজে।'
বটতলার ডিজাইনার মাহমুদা রশীদ লতা বলেন, 'হালকা রোদের সঙ্গে বসন্তের বাতাসে মনটা যেমন ফুরফুরে হয়ে ওঠে, তেমনি এ সময় পোশাকটাও চাই হালকা। কিছুটা উজ্জ্বল রং আর আরামদায়ক সুতি কাপড়গুলোর চাহিদা থাকে এ সময়ে। এ সময় মেয়েদের জন্য শাড়ি, কুর্তি, ফতুয়া, ঢোলা পায়জামা আর ছেলেদের জন্য ফতুয়া, পাঞ্জাবি বেশ আরামদায়ক পোশাক হতে পারে। পোশাকের তন্তু সুতি এবং উজ্জ্বল রঙের হলে পরিবেশ থেকে কম তাপমাত্রা শোষণ করে বিধায় পরিধানকারী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।'
এবারের ফাল্কগ্দুন উপলক্ষে শাড়ি, থ্রিপিস, সিঙ্গেল কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, শার্টসহ বিভিন্ন পোশাকে বিশ্বরঙ তুলে ধরেছে প্রকৃতি থেকে নেওয়া হলুদ বর্ণের অনুপ্রেরণায় ফ্লোরাল মোটিফ, হলুদ সাদা রঙের বিভিন্ন গ্রাফিক্যাল জ্যামিতিক ফর্ম। বসন্তের কথা মাথায় রেখে কাপড় হিসেবে আরামদায়ক সুতি, লিনেন, ভয়েল প্রাধান্য পেয়েছে। পোশাকগুলোতে হলুদের পাশাপাশি প্রাকৃতিক রঙের অনন্য ব্যবহার দেখা গেছে। কাজের মাধ্যম হিসেবে টাইডাই, ব্লক, বাটিক, অ্যাপ্লিক, স্ট্ক্রিনপ্রিন্ট এবং ডিজিটাল প্রিন্ট প্রাধান্য পেয়েছে।
শীত যেহেতু একেবারে প্রকৃতি থেকে বিদায় নেয়নি, সেই দিক বিবেচনায় সুতি কাপড় বেশি মানানসই ও আরামদায়ক হবে বলে ডিজাইনাররা জানান। কটনের পাশাপাশি খাদি, ভয়েল, লিনেন আর তাঁতের কাপড়ও মানিয়ে যাবে। সাদা, হলুদ, গোল্ডেন হলুদ, ম্যাজেন্টা, লাল, ব্রাউন, ক্রিম, নীল ও মেরুনের সঙ্গে সহকারী রং হিসেবে কমলা, অ্যাশ, অলিভ, পেস্ট, কালো, গাজর কমলা, টিয়া, সবুজ, নেভি ব্লু, ফিরোজা এবং নীল রং ফাল্কগ্দুনের পোশাকে ব্যবহার করা হয়েছে। সূর্যমুখী, টিউলিপ, চেরি, পপির পাশাপাশি ইস্টার্ন বোটানিক, ফ্লোরাল টাইডাই ফর্ম, ফোক ফ্লোরাল এবং সবুজ পাতা পোশাকের ডিজাইনে প্রাধান্য দিয়েছেন ডিজাইনাররা।
আর্টের হোসাইন ইমন বলেন, 'ট্র্যাডিশনাল পোশাকের পাশাপাশি ওয়েস্টার্ন পোশাকও বসন্তের আয়োজনে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।' ফ্যাশন হাউসগুলো বাহারি পোশাকের পাশাপাশি একই রং ও নকশার পোশাক এনেছে কাপলদের জন্য। আবার কাপলদের সঙ্গে মিল রেখে পরিবারের সবার জন্য এনেছে ম্যাচিং পোশাক।
শিশুদের বসন্ত :বসন্ত বড়দের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদেরও উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই দিনে বাসন্তী রঙের শাড়ি, হাতভর্তি কাচের চুড়ি আর মাথায় ফুলের মুকুট বর্ণিল করে তোলে শিশুদেরও। প্রতি বছরই শিশুদের মা-বাবার পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে পোশাক তৈরি হয়ে থাকে। বেশিরভাগ পোশাক তৈরি করা হয়েছে আরামদায়ক সুতির ওপর, যা শিশুরা পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। পাঞ্জাবির সঙ্গে সন্তানকে পরিয়ে দিতে পারেন খাদি, তসর কিংবা ফেব্রিকের কটি। শিশুকে আকর্ষণীয় লাগবে বর্ণিল চেক, প্রকৃতি, প্রজাপতিসহ নানা রকম জীবজন্তু নকশার শার্ট ও টি-শার্টেও। নজর কাড়বে বর্ণিল বাটিকের ফতুয়াতেও।
অনুষঙ্গ :আর্টের ডিজাইনার হোসাইন ইমন বলেন, 'নিজেকে ফুটিয়ে তোলার সুন্দর একটা সময় বসন্ত। অনুষঙ্গ হিসেবে কামিজ, ওয়ান পিস, শাড়ির সঙ্গে টিপ, ফুল, চুড়িসহ বিভিন্ন ধরনের অনুষঙ্গ পরতে পারেন মেয়েরা। ছেলেরা সানগ্লাস, হাতঘড়ি, ব্রেসলেট পরতে পারেন। এই সময়ে পাঞ্জাবির সঙ্গে মানানসই মাফলার বেছে নিতে পারেন।'
বটতলার ডিজাইনার মাহমুদা রশীদ লতা বলেন, 'প্রকৃতিতে যেহেতু এ সময় হরেক রকম ফুল পাওয়া যায়, তাই চুলে কিছু ফুল গুঁজে নিলে দারুণভাবে মানিয়ে যাবে। এ ছাড়া কাঠ, পুঁতি, মাটির তৈরি বিভিন্ন গহনা অনুষঙ্গ হিসেবে বেছে নিতে পারেন। এ সময় রোদ থেকে বাঁচতে ক্যাপ, হ্যাট হতে পারে সহজে বহনযোগ্য, স্মার্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।' পরতে পারেন কাঠের কারুকার্য খচিত গহনাও। এ ছাড়া যাদের দেশীয় অনুষঙ্গ পছন্দ, তারা গামছা কাপড়ের গহনা, মেটালের গহনার পাশাপাশি শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং করে কাচের চুড়ি পরতে পারেন।'
বাসন্তী সাজ :তরুণ-তরুণীর রঙিন সাজে বসন্তের আভাস পাওয়া যায়। মেকআপের ক্ষেত্রে এদিনের আবহাওয়ার দিকে খেয়াল রেখে হালকা মেকআপ করুন। মুখে ম্যাট ফাউন্ডেশন লাগাতে পারেন। এর ওপর হালকা ফেস পাউডার বুলিয়ে নিন। শেড পছন্দ করুন নিজের ত্বকের সঙ্গে মিল রেখে। চোখে হলদে, কমলা ভাব কিংবা পিচ কালারের আইশ্যাডো ব্যবহার করতে পারেন। আইশ্যাডোর পর গাঢ় করে কাজল, আইলাইনার ও মাশকারা লাগাতে পারেন। এমন দিনে খোলা চুল ভালো লাগবে। যদি চুল খোলা রাখতে না চান, তাহলে হালকা করে চুলটা বেঁধে নিতে পারেন। পশ্চিমা পোশাক বেছে নিলে সামনের চুলে মেসি ভাব রাখুন।
আর পেছনের চুলগুলো হালকা কার্ল করে ছেড়ে দিন। চুল যদি কার্ল করে ছেড়ে দিতে চান তাহলে চুলের মধ্যে ছোট ছোট ফুল এলোমেলো করে গুঁজে নিতে পারেন। চুল যদি বেশ বড় হয় তাহলে চাইলে বেণি করে নিতে পারেন। কপালে পরুন বড় একটি লাল টিপ বা বিভিন্ন ডিজাইনের ফাল্কগ্দুনের টিপ। সাজে স্নিগ্ধতা আনতে ঠোঁটের জন্য বাছাই করুন হালকা রঙের লিপস্টিক। সাজে সজীবতা ধরে রাখতে ব্যবহার করুন হালকা সুগন্ধি।
মডেল :মৌ, জেরিন রহমান, জলি, জেরিন জারা, নাসিফ ও রিমন; পোশাক :বিশ্বরঙ; মেকওভার :রিজভী হোসাইন;
নির্দেশনা :বিপ্লব সাহা; ছবি :জি এম সুজন
মন্তব্য করুন