- ফিচার
- 'অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলতে হয়'
'অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলতে হয়'

প্রতিকৃতি :তন্ময় শেখ
গ্রামের বাড়ি বরিশাল। নাম সবুর আলী। দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে ঢাকায় থাকেন। ফার্মগেট এলাকায় কলা-রুটি বিক্রি করে সংসার চালান। তাঁর সঙ্গে কথা বলে লিখছেন ফরিদুল ইসলাম নির্জন
কীভাবে কলা-রুটি বিক্রি শুরু করেন?
গ্রামে কৃষিকাজ ও দিনমজুরি করতাম। কিন্তু অভাব লেগেই থাকত। অভাব যেন আমাদের পিছু ছাড়ত না। পরে ভাবলাম শহরে গেলে যদি কিছু আয় করতে পারি। ঢাকা শহরে কত ধরনের মানুষই তো আসেন। ভালো আয় করতেও পারি। পরিবার রেখে চলে আসি ঢাকায়। কী করব তা বুঝতে পারি না। প্রথম সিদ্ধান্ত নিলাম কাঁচামালের ব্যবসা করলে মন্দ হয় না। রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় শাক বিক্রি শুরু করি। কিন্তু ঠিকঠাক বিক্রি না হলে ক্ষতি হয়। আয়ও কম হয়। পরে কলা-রুটি বিক্রি শুরু করি ইস্পাহানি চক্ষু হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে। প্রথম প্রথম বিক্রি কম হলেও পরে বেড়ে যায় বিক্রি।
ফুটপাতে বসতে প্রথম প্রথম ভয় হয়নি?
ভয় হয়েছিল। প্রথম ভেবেছিলাম যদি এখানে না বসতে পারি, তাহলে ফুটপাতে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করব। কোনো উপায় নেই। সংসারে তো টাকা দিতেই হবে। নিজের পেটের জন্য কিছু আয় করতে হবে। বলতে পারেন, পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে এখানে বসতে। আমাকে সাহসী করেছে। তবে এখানে বসে কোনো সমস্যা হয়নি।
আপনার পরিবারের সদস্য কয়জন?
আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা এখন দু'জন। আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। আমার এক ছেলে ও আমার স্ত্রী মারা গেছে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন ঢাকায় এক ছেলে ও আমি একসঙ্গে থাকি।
সংসার চালাতে পারেন ঠিকমতো?
এই বয়সে এসে একটু খারাপ লাগে। ছেলের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। এখনও অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলতে হয়। আমার স্ত্রীর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে পারিনি। টাকার অভাবে সে মারা যায়। আসলে অভাবের জন্য ঢাকায় এলাম। কিন্তু অভাবই যেন পিছু ছাড়ল না। ছেলেটাকে টাকার অভাবে পড়াশোনা করাতে পারলাম না। সে এখন বাসের হেলপার। ছেলেটাকে বিয়ে করাতে পারলে আমার দায়িত্ব শেষ।
কলা-রুটি বিক্রি করেন দিনের কোন সময় থেকে?
এই হাসপাতাল চালু হয় সকাল সাড়ে ৭টা। আমি তার আগে থেকেই এখানে আসি। বলা চলে সাড়ে ৬টার আগেই চলে আসি। কারণ বিভিন্ন জেলার মানুষ ভোরেই চলে আসেন এখানে। শনিবার একটু বেশি বিক্রি হয়। সরকারি ছুটির দিন। তাই শনিবার ভিড় বেশি হয়। আমিও সকাল সকাল চলে আসি।
ক্রেতাদের সঙ্গে কোনো স্মরণীয় বা মজার ঘটনা আছে?
এখানে বেশিরভাগ কাস্টমার আসেন ভ্রাম্যমাণ। বলতে পারেন একবার এলে তাদের সঙ্গে আর দেখা হয় না। অনেক স্মৃতির কথাই মনে পড়ে। অনেক ঘটনাই ঘটে। অনেকদিন আগের কথা। একজন ৮০ টাকার কলা-রুটি নিলেন। ১ হাজার টাকার নোট দিলেন। কিন্তু আমার কাছে ভাংতি ছিল না। সকালে এত টাকা ভাঙানোর উপায় নেই। তাই বললাম, আপনি ডাক্তার দেখাইয়া যাওয়ার আগে টাকা দিয়েন। পরে মানুষটি হয়তো ভুলে টাকা না দিয়ে চলে যান। আমি অপেক্ষা করি। ভেতরে গিয়ে খুঁজি। কিন্তু লোকটিকে আর পাইনি। মনে মনে বেশ রাগ হয়। ৮০ টাকা আমার জন্য অনেক টাকা। পরেরদিন সকালে লোকটি এসে হাজির। আমাকে বলছেন, আপনাকে গতকাল টাকা না দিয়ে চলে গেছি। আসলে ভুলে গেছিলাম। এখন এসেছি টাকা দিতে। লোকটির কথা শুনে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। আসলে তিনি ডাক্তার দেখিয়ে চলে যান। বাড়িতে গিয়ে মনে হওয়ায় পরদিন ৮০ টাকা দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে চলে আসেন।
সবশেষে যা বলতে চান-
আসলে আমার কাছে জীবনটা পুরো সংগ্রামের। এখনও শেষ বয়সে এসে সংগ্রামের সঙ্গেই পার করছি। জানি না আমার সন্তান এই সংগ্রাম থেকে কবে মুক্তি পাবে। আসলে মানুষের সঞ্চয় জিনিসটা খুব জরুরি। কিন্তু জীবনে কোনো সঞ্চয় করিনি। যার খেসারত এখন পোহাতে হয়েছে। সবাই যা আয় করবেন, তার থেকে কিছু সঞ্চয় করবেন। একজন ফুটপাতের কলা-রুটি বিক্রেতার কথাটি ভেবে দেখবেন।
মন্তব্য করুন