- ফিচার
- তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব...
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব...

'আমার পরানে যে গান বাজিছে / তাহার তালটি শিখো-তোমার চরণমঞ্জীরে/ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে/আমার মুখর পাখি-তোমার প্রাসাদপ্রাঙ্গণে'- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এক ফোঁটা ভালোবাসার হাতছানি যে কাউকেই কবি বানিয়ে দিতে পারে। দার্শনিক প্লেটো এমনভাবেই বলে গেছেন ভালোবাসার কথা। আলেকজান্ডার ব্রাকেনের মতে, 'ভালোবাসা দিয়েই কেবল ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করা যায়।' সংগীতশিল্পী রূপম ইসলাম গানের কথায় লিখেছেন, 'ভালোবাসা সময়কে হারাবে/পেলে তোমাকে/শুধু তোমাকে।' রফিক আজাদ তাঁর কবিতায় লিখেছেন, 'যদি ভালোবাসা পাই/পাহাড় ডিঙ্গাবো আর সমুদ্র সাঁতরাবো।' সুতরাং বলাই যায় এক চিলতে ভালোবাসার জন্য মানুষ কল্পনার রাজ্যে অবাধ বিচরণ করতে পারে।
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে প্রিয় বরুণার জন্য ১০৮টি নীল পদ্ম আনতে পারে তার প্রেমিক। আবার নজরুলের মতো প্রেমিকাকে খোঁপায় তারার ফুল পরানোর চেষ্টা করে। রামধনু হতে লাল রং ছিনিয়ে এনে প্রেমিকার পায়ে আলতা পরানোর স্বপ্ন দেখে। ভালোবাসা মানেই এক সমুদ্রসমান আবেগ। মিষ্টি কিছু পাগলামি। কথা দিয়ে কথা রাখার মতো অনুভব। ভালোবাসার মানুষকে না পেলে কিংবা হারিয়ে ফেললে নিজের মহামূল্যবান জীবনকে তুচ্ছ মনে হয়। প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসা, হৃদয়ের টান যেমন সত্য ও গভীর, তেমনি মা-বাবা-ভাই-বোনদের প্রতি হৃদয়ের টানও গভীর। সবার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্যই ভালোবাসা দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে পৃথিবীব্যাপী। এ দিবসটি সর্বজনীন হয়ে ওঠে ৪০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। ভালোবাসা দিবস কীভাবে এলো, তা নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত আছে।
একটি এ রকম- ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি আহত সেনাদের চিকিৎসার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেন খ্রিষ্টানবিরোধী রোমান সম্রাট গথিকাস। মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেন্টাইন তাঁর আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি ছোট্ট চিঠি লেখেন। সেখানে 'ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন' নামে তিনি তাঁর নাম সই করেছিলেন। পরের বছর থেকে বাবার মৃত্যুর দিনটিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসেবে উদযাপন করা শুরু করেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মেয়ে এবং তাঁর প্রেমিক। ধীরে ধীরে দিবসটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ও ভালোবাসা দিবসের সূত্রপাত নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঘটনার প্রচলন রয়েছে। সেদিকে আর না যাই। এখন ভ্যালেন্টাইনস ডে অর্থাৎ ভালোবাসা দিবস উদযাপন হয় নানা রঙে, নানা ঢঙে।
পোশাক, খাওয়া-দাওয়া, ঘোরাফেরা সবকিছুতেই থাকে উৎসবের আমেজ। এই দিনকে কেন্দ্র করে ফ্যাশন হাউসগুলো প্রতি বছর নিয়ে আসে নতুন পোশাক। ডিজাইন, নকশা, প্যাটার্ন ও মোটিফে থাকে বৈচিত্র্য। মূল রং লাল, খয়েরি হলেও এর পাশাপাশি কমলা, সাদা, বেগুনি রঙের পোশাকও প্রাধান্য পায় এখন। যেহেতু ভালোবাসা দিবস ও পহেলা ফাল্কগ্দুন একই দিনে; এখন এই দিনে হলুদ ও বাসন্তী রঙের সমাহার বেশি দেখা যায়। এদিন অনেকেই ফাল্কগ্দুনের কমলা-বাসন্তী রঙে নিজেকে রাঙান, আবার লাল রঙের পোশাকে ভালোবাসার অনুভূতি ফিরে পান।
যুগ যুগ ধরে লালকেই বলা হচ্ছে ভালোবাসার রং। এর পেছনের কারণ কী? ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মধ্যযুগে ভালোবাসার আদান-প্রদানে লাল রঙের ব্যবহার করা হতো। রোমান চার্চের ধর্মযাজকরা লাল রংকে ত্যাগের প্রতীক মনে করতেন। যিশু খ্রিষ্ট ও অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁরা লাল রঙের পোশাক পরতেন। শুধু তাই নয়, ওই যুগে যুদ্ধের বার্তা বা বিপদের প্রতীক হিসেবেও লাল রংকে ব্যবহার করা হতো। এক গ্রিক কবি তাঁর কবিতায় লালকে ভালোবাসার রং হিসেবে তুলে ধরেন।
সেই থেকে লাল রংই ভালোবাসার রং হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এখন ফ্যাশন ডিজাইনাররা ভালোবাসা দিবসের পোশাকে লাল ও মেরুন রঙের ব্যবহার বেশি করেন। আর্টের ডিজাইনার নাদিম বলেন, 'শক্তি এবং উত্তেজনা দুইয়ের সমন্বয়ে উদ্ভাসিত লাল রং। ভালোবাসা, প্রেমের বন্ধন যেন জোরালো তথা শক্তিময় থাকে এবং দুজনের পার করা প্রতিটি মুহূর্ত যেন উত্তেজনায় একে অপরের যুগলবন্দি হয়- তাই পোশাকেও লালের প্রাধান্য থাকে। এ ছাড়া তরুণ-তরুণীদের জন্য ভালোবাসা দিবসও এখন এক ধরনের উৎসব। লাল যেন উৎসব ভিন্নমাত্রা এনে দেয়, রাঙিয়ে দেয় প্রতিটি সময়।'
সারা লাইফস্টাইলের হেড অব ডিজাইন শামীম রহমান বলেন, 'লাল ভালোবাসার প্রতীক। লাল মানে শক্তি এবং সুখ। অন্যদিকে লাল রং আসে গোলাপ থেকে। গোলাপ ভালোবাসা ও শক্তির আরেকটি প্রতীক। রাজকীয় লোকজন তাঁদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বেশিরভাগ লাল রং ব্যবহার করতেন। এ কারণেই আমরা আমাদের ভ্যালেন্টাইন পণ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লাল রং ব্যবহার করি।'
এবার 'রঙ বাংলাদেশ'-এর ভালোবাসা দিবসের পোশাকে পাখির রংকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর পেছনের কারণ হিসেবে ব্র্যান্ডটির স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার সৌমিক দাস জানান, পাখি প্রকৃতির অনিন্দ্য উপহার। রঙের বৈচিত্র্য আর বাহারে চোখ জুড়ায়। রংধনুর প্রতিটি রংই আছে পাখিদের শরীরে। কখনও একরঙা, কখনও একই রঙের নানা শেড, আবার কখনও বহু বর্ণে নান্দনিক শেড ব্যবহার করা হয়েছে।
তাই কাপড় ক্যানভাস হয়ে উঠেছে বর্ণময়। মোটিফরা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন। পাখিদের রং অসংখ্য। এর মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে বিন্যাস ঘটানো হয়েছে চমৎকারভাবে। ফলে প্রতিটি পোশাক হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয় ও উৎসবমুখী।
ভালোবাসা দিবসের পোশাকে কোন রংকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে- এই প্রশ্নের জবাবে সৌমিক দাস বলেন, 'এবারের পোশাকের মূল রং লাল ও মেরুন। সহকারী হিসেবে গোল্ডেন, ব্রাউন ব্যবহার করা হয়েছে। পেপার সিল্ক্ক, কটন, লিনেন ও টাফেটা সিল্ক্ক কাপড়ে পোশাকের নকশাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা ভ্যালু অ্যাডেড মিডিয়ার ব্যবহারে। এর মধ্যে রয়েছে স্ট্ক্রিন প্রিন্ট ও হাতের কাজ।'
রঙ বাংলাদেশের সংগ্রহে ট্র্যাডিশনাল পোশাকের পাশাপাশি ওয়েস্টার্ন পোশাকও রয়েছে। রয়েছে কাপল শাড়ি, পাঞ্জাবি, সিঙ্গেল কামিজ, টি-শার্ট, থ্রিপিস, টপস, রেডি ব্লাউজ, সিঙ্গেল ওড়না, আনস্টিচড থ্রিপিস, টিউনিক ও স্কার্ট। আরও রয়েছে মগ, জুয়েলারি ও বিভিন্ন উপহার সামগ্রী।
ব্র্যান্ড 'সারা' নিয়ে এসেছে ফুলেল নকশার পোশাক। রঙিন সংগ্রহ ও ট্রেন্ডি প্যাটার্নের পোশাক আছে ব্র্যান্ডটিতে। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, কুর্তি, টি-শার্টের পাশাপাশি সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ফ্যামিলি ও ম্যাচিং পোশাক। আছে বাবা-ছেলের মিনিমি পাঞ্জাবি কালেকশন। ভালোবাসা দিবসের জন্য ক্যাপসুল কালেকশন নিয়ে এসেছে। বসন্ত ও ভালোবাসার পোশাকে উজ্জ্বল হলুদ, কমলা, নীল, লাল, গোলাপির সঙ্গে প্যাস্টেল, পাউডার ও নিউট্রাল শেডের সংমিশ্রণ রেখেছে লা রিভ। প্যাটার্ন বোর্ডে পাওয়ার স্লিভস, স্টেটমেন্ট কলার, বাবল হেমলাইন, কাটওয়ার্ক ও ইউটিলিটি ফিচার এবং ক্রাফটেড প্যাচওয়ার্ক প্রিন্টকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অঞ্জন'স, বিশ্বরঙ, কে কদ্ধ্যাফট, নাগরদোলা, দেশালসহ সব ব্র্যান্ড নিয়ে এসেছে নতুন পোশাক। মোটামুটি লাল ও খয়েরি রংকে প্রাধান্য দিয়েই আনা হয়েছে। প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার জন্য কিনতে পারেন সেসব পোশাক।
সাজ :ভালোবাসা দিবসে নারীরা হালকা সাজ দিতে পারেন। দিনের বেলা শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, কুর্তি কিংবা পশ্চিমা পোশাকের সঙ্গে হালকা বেইজের মেকআপ করুন। ফাউন্ডেশনের হালকা বেইজ করে কমপ্যাক্ট পাউডার নিতে পারেন। যাঁরা আরও ন্যাচারাল থাকতে চান, তাঁরা বিবি ক্রিম দিয়ে বেইজ করতে পারেন। তার ওপর পাউডার এবং গালে হালকা ব্লাশন লাগান। চোখে হালকা রঙের শ্যাডো লাগিয়ে আইলাইনার দিন। ঠোঁটে লাল, গোলাপি বা বাদামি লিপস্টিক দিন।
সবশেষে নাকে নথ পরতে পারেন। শাড়ি-কুর্তি কিংবা পশ্চিমা পোশাকের সঙ্গে নথ, নাকছাবি ভালো মানায়। তবে রাতে যদি ডিনার পার্টি থাকে তাহলে ভারী পোশাকের সঙ্গে ভারী সাজ দিন। চুল কার্ল করতে পারেন। পার্টি জুতা ও ক্লাচ ব্যাগ সাজে পূর্ণতা দেবে। পুরুষরা পাঞ্জাবি, টি-শার্ট কিংবা ফতুয়া পরে নিতে পারেন। পার্টিতে যাওয়ার জন্য শার্ট কিংবা টি-শার্টের সঙ্গে ব্লেজার ও সুট বেছে নিতে পারেন। হালকা সুগন্ধি অবশ্যই। মোট কথা, সময় ও পরিবেশের ওপর নির্ভর করে নিজেকে সাজিয়ে তুলুন।
মন্তব্য করুন