- ফিচার
- নাফাখুম-আমিয়াখুম
নাফাখুম-আমিয়াখুম

কথায় আছে, যে এখনও সাঙ্গু নদী দেখেনি, সে এখনও বান্দরবান দেখেনি আর যে এখনও বান্দরবান দেখেনি, সে যেন বাংলাদেশ দেখেনি। বান্দরবান ভ্রমণ না করলে সেটি উপলব্ধি করা দুরূহ। বান্দরবানের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মন যেন হারাতে চায় বারবার। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের বান্দরবান প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে সব সময়ই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে তালিকার শীর্ষে থাকে। বান্দরবানের ব্র্যান্ডিং স্লোগান- অপরূপা বান্দরবান। নামকরণের সার্থকতা রয়েছে বটে।
আমিয়াখুম-নাফাখুম ভ্রমণের পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে ছিলেন তৌফিক-লুবনা ও রাব্বি-লামিয়া দম্পতি, কাউসার, আপেল, ইতি, সৃষ্টি, কাশফা, জেনি, সহিদ, তাসনিম, সুমন এবং দলছুট ট্রাভেল ফ্রিকের অ্যাডমিন তন্ময় ভাই।
২০ জানুয়ারি সকাল ৬টায় বান্দরবান শহরে পৌঁছে নাশতা সেরে চাঁদের গাড়িতে চেপে বসলাম। সর্পিলাকায় সরু পথে থানচির দিকে চাঁদের গাড়ি ছুটে চলছে। চিম্বুক পর্যটন কেন্দ্র ও ডাবল হ্যান্ড ভিউ পয়েন্টে খানিক বিরতি দিয়ে আবারও ছুটে চলা। ৩ ঘণ্টার বেশি সময় অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম থানচি। থানচি থানায় বেশ কিছু কার্যক্রম সম্পন্ন করে মধ্যাহ্নভোজ সেরে ট্রলারে উঠে বসলাম। সাঙ্গু নদীর সবটুকু সৌন্দর্য ক্যামেরার ল্যান্সে ধরা বেশ কঠিন। তিন্দুর বড় পাথর, রানী পাথর, মন্ত্রী পাথর, রাজা পাথর সাঙ্গুর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
বান্দরবান জেলা শহরও এ নদীতীরে অবস্থিত। এ জেলার জীবন-জীবিকার সঙ্গে সাঙ্গু নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং পাহাড়ি জনপদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ নদী অন্যতম মাধ্যম। পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা সাঙ্গু নদী যেন প্রকৃতি আপন রূপের পসরা সাজিয়ে রেখেছে। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সবুজ অরণ্যে মন হারিয়ে যায় নিজের অজান্তেই। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদী উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। কিন্তু সাঙ্গু নদী বান্দরবানের দক্ষিণাঞ্চলে সৃষ্টি হয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে বাঁক নিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। সাঙ্গু নদী পার হতে হতে অজান্তেই মনে বেজে উঠল- 'ও নদীরে/ একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে/ বলো কোথায় তোমার দেশ/ তোমার নাই কী চলার শেষ/ ও নদীরে ...।'
আড়াই ঘণ্টা পর রেমাক্রি ফলসে পৌঁছে নাফাখুমের উদ্দেশে হাঁটা শুরু। রাত ৮টা ৩০ মিনিটে নাফাখুমপাড়ায় পৌঁছে চা-বিরতি নিয়ে জিন্নাপাড়ার উদ্দেশে হাঁটা শুরু। রাতের অন্ধকারে উঁচু-নিচু ও ঝিরিপথ পাড়ি দিয়ে ছুটে চলছি। ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শুনতে শুনতে রাত সাড়ে ১১টার সময় জিন্নাপাড়ায় পৌঁছে সবাই বেশ ক্লান্ত। জুমের চালের ভাত খেয়ে ঘুম। হাড়কাঁপানো শীতের সকালে ঘুম থেকে ওঠে গরম খিচুড়ি ও চা পর্ব শেষে দেবতা পাহাড়ের উদ্দেশে ছুটে চলা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম দেবতা পাহাড়। এ পাহাড়ের পাদদেশেই কাঙ্ক্ষিত আমিয়াখুম-সাতভাইখুম-ভেলাখুম। ওপর থেকে তাকালেই গা শিউরে ওঠার উপক্রম। সোজাসুজি খাড়া ৯০ ডিগ্রি নিচে নামতে লাগলাম।
সময় লাগল প্রায় ৫০ মিনিট। অবশেষে ঝরনার রানী আমিয়াখুমের সৌন্দর্য প্রাণভরে অবলোকন করলাম। আমিয়াখুমের সৌন্দর্য বর্ণনা করা বেশ কঠিন। ক্ষণে ক্ষণে আপনাকে করবে মন্ত্রমুগ্ধ; যার সৌন্দর্য দেখে লিখে ফেলতে পারবেন কবিতা কিংবা ছন্দে ছন্দে গেয়ে উঠতে পারবেন নতুন কোনো গান। আমিয়াখুম জলপ্রপাতের জল সাদা রঙের ফেনা ছড়িয়ে পাথরের গা ঘেঁষে অনবরত পতিত হচ্ছে। আহ্ কী সে অনুভূতি! উপলব্ধি করলাম জীবন আসলেই সুন্দর ও রঙিন। দুর্গম জায়গায় স্বাচ্ছন্দ্যে পৌঁছে যাওয়ার মনোভাব মনে করিয়ে দেয় জীবন একটা দুঃসাহসিক অভিযান। আর তখন জলজঙ্গলের সৌন্দর্যে মন ভালো হয়ে যায় মুহূর্তেই। আমিয়াখুম, সাতভাইখুম ও ভেলাখুমের প্রাকৃতিক দৃশ্য পর্যটকদের ক্ষণে ক্ষণে মোহিত করবে। এমন নান্দনিক দৃশ্য মনের আয়নায় দাগ কেটে থাকবে সারাজীবন। পাহাড় না সমুদ্র সেই বিতর্ক এড়িয়ে যাই বরাবরই। প্রকৃতি সুন্দর সব সময়- হোক সেটা পাহাড় কিংবা সমুদ্র।
অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ দেখতে দেখতে মন যেন হারিয়ে যাচ্ছে; আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা পঙ্ক্তি মনে পড়ে গেল-
'আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই
সেই পাহাড়ের পায়ের কাছে থাকবে গহন অরণ্য
আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব
খুব কাছে আকাশ/ নিচে বিপুলা পৃথিবী
চরাচরে তীব্র নির্জনতা/আমার কণ্ঠস্বর যেখানে কেউ শুনতে পাবে না ...।'
দুপুর ২টায় জিন্নাপাড়ায় ফিরে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে নাফাখুমপাড়ার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম।
অজুহাত ছাড়া বাঁচব, অনুশোচনা ছাড়া ভ্রমণ করব। তাই তো প্রয়োজন নিজেকে জানা-অজানা পথে হারাতে। আমিয়াখুম জলপ্রপাত যতটা দুর্গম তার থেকে বেশি সুন্দর! উঁচু উঁচু সবুজে মোড়ানো প্রতিটি পাহাড় যেন মেঘের কোলে শুয়ে আছে অবলীলায়। পাহাড়ের চূড়া কোথাও কোথাও ঢেকে আছে মেঘের আবরণে।
সন্ধ্যায় নাফাখুমপাড়ায় পৌঁছে জমপেশ এক আড্ডায় মেতে উঠলাম সবাই। খুব ভোরে নাফাখুমের প্রবল বেগে নেমে আসা জলধারা দেখতে সবাই বেরিয়ে পড়লাম। সাদা রঙের জলকণা নিমেষেই ভিজিয়ে দিছে চারপাশ, সঙ্গে অবিরাম চলছে জলধারার পতন আর প্রবাহের শব্দতরঙ্গ। লোকালয় ছেড়ে গহিন পাহাড়ে এমন দৃশ্য না দেখলে মিস করতাম অনেক কিছু। কষ্ট ভয় পেয়ে হয়তো অনেকেই ভ্রমণে অনাগ্রহ দেখাবেন, তাঁদের জানা উচিত, কষ্টসহিষ্ণু জীবন গড়ে তোলার মাঝেই জীবনের সৌন্দর্য। প্রকৃতির অপরূপ মায়ার কাছে দৈহিক কষ্ট নিতান্তই সামান্য।
পরিযায়ী পাখির ডানায় চেপে শীত আসে আমাদের দেশে। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। শীত যেন আমাদের দেশে উৎসবের উপলক্ষ নিয়ে আসে। ঘরে ঘরে পিঠাপুলির আয়োজন চলে। সেই সঙ্গে ধুম পড়ে ঘোরাঘুরির। ভ্রমণের জন্য আমরা শীতকালকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। গাইড জর্জ ত্রিপুরা দাদার বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসায় আমরা সবাই মুগ্ধ। তমা তুঙ্গী থেকে কেওক্রাডং, ডিম পাহাড় ও তা জিং ডং দেখার মাধ্যমে এবারের ভ্রমণের ইতি টানলাম।
ভৌগোলিকভাবে নানা সম্ভাবনাময় হলেও পর্যটন উন্নয়ন সূচকে অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে দুর্বল অবকাঠামো নিয়েও অনেক দেশ পর্যটন সূচকে এগিয়ে। আমাদের দেশে পর্যটনে জিডিপিতে অবদান মাত্র ২.২ শতাংশ, যেখানে নেপালে প্রায় ৯ শতাংশ। সুতরাং পর্যটন বিকাশে আরও বহুমুখী উদ্যোগ নেওয়া, অবকাঠামো সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণ ইত্যাদি।
ভ্রমণের টুকিটাকি
যেভাবে যাবেন
হানিফ, শ্যামলী, শান্তি পরিবহন, দেশ ট্রাভেলস, সৌদিয়া কোস সার্ভিস, সেন্টমার্টিন পরিবহন এবং রবি এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন বাসে ঢাকা থেকে বান্দরবান শহরে পৌঁছে তার পর চাঁদের গাড়িতে থানচি যেতে হবে। তবে কেউ চাইলে লোকাল বাসেও থানচি পর্যন্ত যাওয়া যায়, ভাড়া ২৮০ টাকা। থানচি থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে চেপে যেতে হবে রেমাক্রি। রেমাক্রি থেকে ট্র্যাকিং করে যেতে হবে নাফাখুমপাড়া তার পর জিন্নাপাড়া। জিন্নাপাড়া তিন্দু ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত। জিন্নাপাড়া থেকে দেবতা পাহাড়, সব শেষে আমিয়াখুম, সাতভাইখুম ও ভেলাখুম।
যেখানে থাকবেন
স্বল্পমূল্যে আদিবাসীদের ঘরে থাকার সুব্যবস্থা আছে, যা প্রতি রাতের জন্য জনপতি ভাড়া ১৫০ টাকা। খাবারের জন্য আগে অর্ডার করতে হবে। সকালে জুমের চালে ডিম খিচুড়ি ও দুপুর-রাতের জন্য আলু ভর্তা, ডাল ও মুরগির মাংস। নাফাখুমপাড়া, জিন্নাপাড়া ও থুইসাপাড়ায় রাত্রিযাপন করা যাবে। থাকা-খাওয়াসহ অন্যান্য বিষয়ে গাইড আপনাকে সাহায্য করে থাকবেন।
লক্ষ্য রাখুন
জাতীয় পরিচয়পত্রের চার-পাঁচটি ফটোকপি ও প্রাথমিক চিকিৎসা বাক্স সঙ্গে রাখা, বহনকৃত ব্যাগের ওজন যত কম রাখা যায়, দৈনিক ৬ ঘণ্টার ট্র্যাকিং করার শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে।
মন্তব্য করুন