
মধ্য পৌষের চড়চড়ে রোদে মধ্যবয়স্ক মানুষটা মধ্যম গতিতে হাঁটছেন।
তাঁর সাদা চেকশার্টের পিঠের দিকে হালকা ভেজা ভেজা ছোপ। মাঝেমধ্যে বিড়বিড় করছেন। কেউ যদি তাঁর পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কাছাকাছি চলে আসে, শুনতে পাবে-
'মেয়েমানুষ নিয়া এই সমস্যা। পুরুষ কাউরে বাইরে যাইতে দেখলেই হইসে, কোনো না কোনো কাজ ধরায়াই দেবে। তাও কী কাজ? ডাল ঘুঁটনি।'
অবশ্য স্ত্রীর যুক্তিকে অস্বীকার করার কোনো পাল্টা যুক্তিও কাছে নেই। ডাল ঘুঁটনি কোথায় পাওয়া যায় তিনি জানেন না, তবে খেতে বসলে অবধারিতভাবে সুস্বাদু পাতলা ডাল খুঁজবেন, সেই ডালে কোনো টমেটো থাকবে না, রসুন থাকবে না। শুধু লবণ দেয়া ডাল। অভীকের স্ত্রী আর দুই মেয়ের ডাল না হলেও চলে, তাঁর চলে না। ডাল রান্না করতে হলে ডাল লাগে সত্য। দিন চারেক ডাল ঘুঁটনি আনতে ভুলে যাওয়ার পর একদিন তিনি টের পেলেন ডালের স্বাদ কমে গেছে। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়েই কথা শুনতে হলো-
'ডাল ঘুঁটনির দুইখেন পাখনা ভাঙসে, ঘোঁটা যদি সুবিধার না হয়, ডাল সুবিধার হবে কী কারণে?'
তাঁর মেয়ে দুটো সমানে হাসতে শুরু করল মায়ের কথা শুনে। তিনি জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন যে ডাল ঘুঁটতে ঘুঁটনিই কেন লাগে, তরকারির চামচ দিয়ে চা গোলানোর মতো করে গোলালে হয় না? মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস পেলেন না। রান্নাবান্নার তিনি কাঁচকলাও জানেন না। মূর্খের মতো প্রশ্ন করে হাসির পাত্র হওয়া বোকামি। ডাল সুবিধামতো না পেয়ে তিনি বিমর্ষ হয়ে গেলেন। অল্পতেই আবেগাক্রান্ত হয়ে যাওয়াটা তাঁর একটা সমস্যা। তাঁর এই আবেগী মনই একদিন ডাল কিনতে বলা এই মহিলার মন কেড়েছিল। সময়ের সাথে সাথে তাঁর স্ত্রী এগিয়ে গিয়ে মেয়ে থেকে মহিলা হয়েছে, প্রেমিকা থেকে গৃহিণী হয়েছে, কিন্তু তিনি মানসিকভাবে রয়ে গেছেন তাঁর প্রেমিক বয়সে। ডান হাতটা আপসেই চলে এল পিঠের দিকে, যেখানে চুলকাচ্ছে সেখানে হাতটা পৌঁছুচ্ছে না, অংসফলকের হাড়টার ঠিক চূড়ায়।
আগতপ্রায় মাঘের সাথে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে তাপমাত্রা। কিছুক্ষণ হাঁটলেই ঘাম হয়। পৌষের হিম নেই কিন্তু বাতাস ঠিকই শীতের সাথে শুকিয়ে এসেছে। জলবায়ুর এই দ্বিমুখী আচরণে নাকেমুখে ধুলো ঢুকে সর্দি লাগে। নাহ্, বয়স তো হচ্ছে। কিন্তু মানসিকভাবে তিনি সেটা মানতে পারছেন না। তাঁর কেবলই মনে হয় হাতে বেশি সময় বাকি নেই, তারুণ্য দ্রুত ফুরিয়ে এলো, মৃত্যুও বুঝি মাঘের মতো সমাসন্ন। মেয়ে দুটো বাঁশঝাড়ের মতো কেবল বেড়েই চলেছে। অথচ মানসিকভাবে তিনি সেই ছাব্বিশ বছর বয়সে আটকে আছেন। মনের আবেগ কমছে না, কমা দরকার। নামটাও বুঝি আর বয়সের সাথে খাপ খাচ্ছে না। শুনলেই ছাব্বিশ বছরের এক তরুণ মুখ চোখে ভাসে। উল্টোদিকে সুচরিতা নামটা যেন সব বয়সেই চলে- প্রেমিকা, মা, বুড়ি দাদি, সব।
সমস্যাটা শুরু বড় মেয়েটার জন্মের পর থেকে। তিনি স্ত্রীকে প্রেমিকা ভেবে সেই আগের মতোই দু'জন মিলে বেড়াতে যেতে চাইতেন- ঘোরাঘুরি, আইসক্রিম, পার্ক, চটপটি, ফুচকা। তাঁর স্ত্রী যে যেতেন না তা না, তবু তিনি স্পষ্ট টের পেতেন তাঁর স্ত্রী আর প্রেমিকা নেই। প্রেমিক জীবনটাতে দু'জন বাইরে ঘোরাঘুরি করার সময় মেয়েটা ভুলে যেত দেরিতে ফিরলে তার হিটলার বাপের ডলা খেতে হবে। ঘড়িতে সময় দেখত, যাই যাই করেও বিদায় বেশ দেরিতেই নিত। আর মেয়ের জন্মের পর বেড়াতে বেরোলেই তাঁর মনে হতো, স্ত্রীর গলায় যেন একটা অদৃশ্য শেকল বাঁধা আছে। কেবলই ঘুরেফিরে মেয়ের কথা। হয়তো বসে আছে ঘাসের ওপর, স্ত্রী বলবে-
'মেয়েটা যে কী করতেসে বাসায়! ওর দাদিরও তো বয়স হইসে, ঠিকমতো খাওয়াতে পারবেনে? মেয়েটা না আবার আমারে খোঁজে!'
হয়তো চটপটি খাচ্ছে, বলবে-
'মেয়েটা আরেকটু বড় হলে ওরে নিয়ে আসতে পারব, চটপটি খাওয়া শেখাব। আমার পছন্দের খাবার আর আমার মেয়ে খাবে না!'
ধরা যাক দু'জনে কোনো মেলায় গিয়ে চরকিতে চড়ল-
'মেয়েটাকে এখন চরকিতে ওঠানো ঠিক হবে না। আরেকটু বড় হোক। যেই জোরে ঘোরায়! এখন থাকলে কাইন্দা দিত।'
একদিন ভুল করে অভীক বলে ফেলেছিলেন-
'হ্যাঁ, ওকে না আনাই ঠিক আছে, নইলে এখন চরকি থামানো লাগত।'
বেশ একটা ঝাড়ি খেলেন-
'বাহ, থামানো লাগলে থামাবা না? তোমার মেয়ে ভয়ে কানতেসে আর তুমি আরামে চরকিতে ঘুরতেস, এইটা হয়? কী বললা তুমি এটা?'
কাজেই দু'জনে যেখানেই যেতেন, মেয়ে অশরীরী রূপে হলেও তাঁদের সাথেই থাকত। তিনি প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস চেপে ভাবতেন, দু'জন আর দু'জনার নেই। 'দুটি মন আর নেই দুজনার' গানটাকে তাঁর কাছে বিয়োগান্ত মনে হতো। এরপর একটা সময় এলো যখন তাঁর স্ত্রীর বাইরে যাওয়ার আগ্রহ দৃশ্যত কমে আসতে লাগল। সেটা অবশ্য সুচরিতা সরাসরি স্বীকার করতেন না। বলতেন রান্না বাকি, অথবা মেয়েটা যেতে দিচ্ছে না বা ঘরের কাজ ফেলে যাওয়াটা শ্বশুরবাড়িতে ভালো দেখায় না। কয়েকবার অভীক বউ-মেয়ে সহই গেছেন, সন্তান নিয়ে ঘোরাফেরা খারাপ না মোটেই। একটা শিশুকে দেখেশুনে কোথাও নিয়ে যাওয়া, তাকে আনন্দ দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা, তারপর ঢাকা শহরের মহা ঝুঁকিপূর্ণ পথ পেরিয়ে নিরাপদে তাকে বাসায় ফিরিয়ে আনার মধ্যে এক ধরনের আশ্চর্য আনন্দ আছে, একটা বিমূর্ত সফলতার অনুভূতি কাজ করে। তবে সেই অনুভূতির একটা বিনিময় মূল্য আছে। এরপর দ্বিতীয় মেয়ের জন্মের পরেই সুচরিতা পুরোপুরি মা হয়ে গেলেন। তাঁর সকল কথাবার্তা, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন-সাধ হয়ে গেল সন্তানকেন্দ্রিক। আবার একটা পর্যায় এলো যখন অভীক নিজেই আর ঘোরাফেরার সাধ বোধ করলেন না। অফিসে যান, বাসায় আসেন, বাচ্চা পড়ান, বাচ্চা নিয়ে কথা বলেন, বাচ্চার দাদা-দাদি কীভাবে বাচ্চার অভ্যাস খারাপ করছে সেটা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শোনেন। আর এখন চটপটি-ফুচকা পেটে তেমন সয়ও না। তাঁর সবচেয়ে খারাপ লাগত যে ব্যাপারটা- সুচরিতা নানান অজুহাত দিতেন তাঁর সাথে বাইরে না যাওয়ার। সত্যটা বলতেন না যে স্বামীর সাথে একা বাইরে গিয়ে তিনি আর স্বস্তি পান না, সংসার তাঁর পিছু ছাড়ে না। সংসার বুঝি এমনই, ভণ্ডামি ছাড়া টেকে না। এভাবেই আজকের দিনটার জন্ম, যেদিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ডাল কেনা। চুলকানিটা কেবলই বেড়ে যাচ্ছে। কাঁধের ওপর দিয়ে এক হাত আর বগলের তলা দিয়ে আরেক হাত পিঠের দিকে বাড়ালে দেখা যাবে কাঁধের হাড়ের একটা সরু আয়তক্ষেত্র আছে যেখানে ইঞ্চিখানেকের জন্য কোনো হাতের আঙুলই পৌঁছায় না। দশটা আঙুলের মিলনের অভাবে শরীরের সকল অস্বস্তি ওই বিন্দুতে ভর করেছে।
আজ যেন বিষণ্ণতাটা খুব বেশি অনুভূত হচ্ছে। বয়সের কারণে? মিডলাইফ ক্রাইসিস? নাকি এই মাঝ-পৌষেরও কিছু অবদান আছে? তাঁদের প্রেমটা হয়েছিল এ রকম সময়ই। সাতাশ বছর আগের সেই সময়ের কথা মনে পড়লে আজও শীতের গন্ধটা মনে পড়ে তাঁর। সেই কালে শীত আসার আগে আগে হেমন্তের অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত শহরের বাতাসে। আর দু'জনেরই ছিল হেমন্তের প্রভাবে কাত হয়ে যাওয়ার বয়স। কনকনে ঠান্ডার এক বিকেলে মন বিনিময় হয়েছিল গাঁদাফুল ভাসা এক মাঠের কাছে। সেই মাঠ এখন ইটের জঙ্গল। যে ঘাসের ওপর বসা ছিল দৈনন্দিন আনন্দ, সেখানে ঘাস সব উঠে গেছে লক্ষ পায়ের ডলাডলিতে। রিকশায় ঘোরার আনন্দ মরে গেছে এই শহরের নিরেট জ্যামে। যে পুকুরের জলে ইটের টুকরো দিয়ে ব্যাঙ লাফ দিতে দিতে প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করা হতো, সেই পুকুর বিবর্তিত হয়েছে রুফটপ রেস্টুরেন্টে যার সামনে বড় করে লেখা আছে 'ভূমিকম্প প্রতিরোধী', ব্যাঙ লাফ দেয়ার মতো ইটের টুকরোও আর নেই কোথাও। হাত ধরাধরি করে খুব ধীরেসুস্থে হেঁটে যেতে যেতে মন খুলে কথা বলার মতো রাস্তা একটাও অবশিষ্ট নেই বোধহয়- সেসব রাস্তা পাকা থেকে ক্রমান্বয়ে কাঁচা হতে হতে গ্রামের দিকে চলে যেত- সব রাজপথ হয়ে গেছে, চুপি চুপি কথা বলার ব্যক্তিস্বাধীনতা বিলুপ্তপ্রায়, কণ্ঠের ডেসিবেল যথেষ্ট না বাড়ালে চারপাশের হাজার ঘর্ষণের শব্দ ছাড়িয়ে প্রণয়ীর কানে শব্দ পৌঁছে দেয়া যায় না। নাহ, স্ত্রীকে দোষ দেয়া চলে না, ধুত্তোরি, চুলকানিটা কমছেই না। সত্যি, দু'জন দু'জনার বলে কিছু নেই। দু'জনের সাথে আরও বহু কিছু যুক্ত হয়, পরিবেশ-প্রতিবেশ। যারা ছিল তাদের ভালোবাসার সাক্ষী, সব আজ বিবর্তিত- ইটচাপা গাঁদাফুল, ঘাসহীন মাঠ, স্থবির-পেশাদার রিকশা, প্রতিমুহূর্তে বাসচাপার ভয়, মাথার খুলি চেপে ধরা শব্দ, পুকুরের পাকা সমাধি। হেমন্তের গন্ধ, শীতের কামড়, গাঁদাফুল, পুকুর এরা না থাকলে তাঁর প্রেম টিকবে কী করে? এখন সুখী হওয়ার পথ একটাই, ইটে সুখ পাওয়া, রুফটপে পয়সা খসানো, নিরাপত্তা নিয়ে সদা চিন্তিত থাকা, অর্থনৈতিকভাবে অরক্ষিত হবার আতঙ্ক আর সংসারে খরচ জোগানোর বাধকতার টানাপোড়েন। এসবেও মানুষ সুখ পায় নিশ্চয়। ঘোঁটানো ডালের স্বাদের মতোই। শহরটা একটা ডালের পাতিলই মনে হচ্ছে, দানবীয় ডাল দিয়ে ঘোঁটা দিয়ে চলেছে যেন মহাযন্ত্র। ক্রমশ ঘোঁট পাকাচ্ছে সবকিছু- যানবাহন, গাছ, মাছ, পাখি, ফুল, লতাপাতা, মানুষ, মন, জীবন, যৌবন, প্রেম, আবেগ, অতীত, স্মৃতিকাতরতা, কী না?
সমস্যাটা কি শার্টে? কিছু কি লেগে ছিল? কেন এত চুলকাচ্ছে? আর শালা ওখানেই চুলকাচ্ছে, যেখানে হাত পৌঁছতে গেলে পেশিতে টান লাগে, ঘাড় ব্যথা করে, আঙুল কুঁকড়ে আসে। সেই সাথে পৌষ মাসের ঘাম গড়িয়ে গড়িয়ে যেন ঠিক ওখানটাতেই লাগছে, ঘামের লবণে বাড়ছে চুলকানি। বিয়ের প্রথমদিকে স্ত্রী তাঁর পিঠ চুলকে দিত অনেকক্ষণ ধরে। এমন অভ্যাস হয়েছিল ওই হাতের মিষ্টি চুলকানিতে, ওটা ছাড়া তাঁর ঘুমাতে দেরি হতো। এখনও দেয়, তবে না চাইলে দেয় না। দিলেও আগের সেই যত্ন আর বোধ হয় না। তিনি নিজেও হয়তো মিইয়ে গেছেন। নেই, কিছুই আগের মতো নেই। থাকার কথা? পরিবর্তনই কি একমাত্র অপরিবর্তনীয় জিনিস না? সত্য, তবে পরিবর্তনের স্মৃতিটাও যে মুছে যেতে বসেছে! মরিচার মরীচিকা ধরেছে সব স্মৃতিস্মারকে। পিঠটা চুলকাবে কে? কোনো সেলুনে ঢুকে পড়লে কেমন হয়? চুল কাটানোর অজুহাতে বলতে হবে-
'চুল একেবারে ছোট করে দ্যাও। মেলা গরম। আচ্ছা, আমার পিঠের এইদিকে চুলকাচ্ছে, একটু ঘসে দ্যাও তো। চুল কিন্তু ভালো করে কাইটো।'
নাহ, দৃশ্যটা হাস্যকর হবে। সপ্তাহ দেড়েক হলো তিনি চুল কাটিয়েছেন। নাপিত দেখলেই বুঝে ফেলবে চুল কাটার মতো বড় হয়নি। পিঠ চুলকানো কি আসলে এত বড় ঘটনা যে তাঁকে পয়সা খরচ করতে হবে? ছোটবেলায় গরুকে দেখেছেন গাছের সাথে গা ঘষে ঘষে পিঠ চুলকে নিতে। একটা ছাগল আরেকটা ছাগলের পিঠ জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে চুলকে দেয়। কোনো গাছের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ঘষা দিয়ে পিঠ চুলকে নেয়া যায় কি? সেও কি সুবিধার হবে? এখন কেউ তাঁর দিকে তাকাচ্ছে না, তবে পিঠ ঘষা শুরু করলে নির্ঘাত তাকাবে। তার ঘষাঘষি দেখে জনতারও শৈশবে দেখা গরুর পিঠ চুলকানো মনে পড়ে যেতে পারে। কোনো বাবা হয়তো সন্তানকে বলবে-
'তোকে বলেছিলাম না আমাদের পোষা গরুটা কীভাবে গাছের সাথে পিঠ চুলকাত? ওই দ্যাখ ওইভাবে।'
দৃষ্টিসীমায় চুলকানোর মতো গাছ নেইও। রাস্তার বিভাজকে অনিয়মিত বিরতিতে কিছু ম্যাড়মেড়ে গাছ দাঁড়িয়ে আছে, পাতায় ধুলোর আস্তরণ, একেকটা ভারী যানবাহন সাঁ করে যাওয়ার সাথে সাথে ওরা কেঁপে উঠছে, টালমাটাল হতে হতে আবার সামলে নিচ্ছে শিকড়ের জোরে। জ্যামে রাস্তা স্থবির হলে বরং ওরা কিছুটা স্থিতি লাভ করে।
খানিক সামনে ধুলো যেন বাতাসে ঝুলে আছে। কয়েক পা এগিয়ে বোঝা গেল নির্মাণকাজ চলছে। পায়ের নিচে হালকা কম্পন টের পেলেন অভীক। পাইলিং চলছে। চারপাশে পাকা রাস্তার মাঝে একখণ্ড কাঁচা মাটি পাইলিং মেশিনের দণ্ডাকৃতির ওঠানামায় ধর্ষিতার মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে যন্ত্রণায়। মেশিনটার দিকে ম্যামথের শুঁড়ের মতো দানবীয় থাবা আকাশের দিকে তুলে ধরে বেশ গৌরবময় গতিতে শুয়োপোকার মতোই ধীরলয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটা ক্যাটারপিলার। থাবার খাঁজকাটা ধাতব পাতগুলো দেখে তাঁর পিঠের চুলকানি আবার বেড়ে গেল। ইচ্ছে করল যন্ত্রটাকে হাত তুলে থামিয়ে চালককে অনুরোধ করে ওই থাবা দিয়ে তাঁর পিঠটা যেন বেশ ভালো করে আঁচড়ে আঁচড়ে দেয়। ডাল পাওয়া গেছে। ক্যাটারপিলারটাকে আধা কিলোমিটারের মতো পেছনে ফেলে এসে একটা ছিরিছাঁদহীন পার্কের পাশে ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন গেরস্তালি জিনিস- ডাল, চিরুনি, ঢাকনা, চামচ, অ্যাশট্রে, ছাঁকনি- এবং পিঠ চুলকানি। ডাল ছাড়া সবই প্লাস্টিক আর অ্যালুমিনিয়ামের। পায়ের গতি বাড়িয়ে তৃষ্ণার্তের মতো সেদিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। ডাল পরে কেনা যাবে। সবার আগে তাঁর দরকার একটা রুক্ষ চুলকানি, যা তাঁর পিঠের অনধিগম্য জায়গায় অনায়াস আক্রমণে আরাম দেবে। পিঠ চুলকানিগুলো মানুষের হাতের অনুকৃতি, কঙ্কালের হাড়ের চেয়ে সরু, নবজাতকের আঙুলের মতো ছোট পাঁচটা প্লাস্টিকের আঙুল যেন ওই ক্যাটারপিলারের দানবীয় থাবার ক্ষুদ্ররূপ। গেরস্থালি পণ্য নিয়ে যে মেয়েটা বসে আছে, তার বয়স চব্বিশের বেশি হবে না। নারী বিক্রেতার কাছ থেকে সাধারণত তিনি কিছু কেনেন না। নারীদের সাথে তিনি দর কষাকষি করতে পারেন না, এটাই হয়তো কারণ। ফুটপাতের অ্যাশট্রের দিকে নজর রেখে তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে পার্কের লোহার গেটে পিঠটা আলতো করে ছুঁইয়ে দাঁড়ালেন, চুলকানিটা সহনীয় করার জন্য। তীব্র ইচ্ছে করছে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে পিঠটা ঘষে নিতে। আচ্ছা, তাঁর কেন মনে হচ্ছে মেয়েটার বয়স চব্বিশ? মানুষ যখন কারও বয়স আন্দাজ করে, তখন পঁচিশ, তিরিশ, পঁয়ত্রিশ, চল্লিশ এভাবে চিন্তা করে। তিনি চব্বিশই কেন ভাবলেন? মেয়েটা এক হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে বসে আছে, হয়তো ক্রেতা নেই বলে হতাশ, কিংবা ভাবছে প্রেমিকের কথা, অপেক্ষা করছে কখন কিছু বিক্রিবাট্টা হবে আর সে প্রেমিকের সাথে দেখা করবে। তিন কোনা-তীক্ষ্ণ একটা মুখ। দুই চোখ সরু তবে কোনার দিকে বেশ টানা টানা। চুল পেছন দিকে টেনে খোঁপা করা। একটা হালকা রঙের ছাপা শাড়ি পরে আছে, রংকানা হওয়ায় তিনি শাড়ির রং বলতে পারবেন না। শ্যামলা বরণ মেয়ে, ছিপছিপে। এক ফাঁকে মেয়েটাও নিজের মাথাটা চুলকে নিল, তার নরম হাত ক্যাটারপিলারের মতো রুক্ষ, ওই হাতটা যদি একটু চুলকে দিত তাঁকে তাহলে পার্কের বেঞ্চেই তিনি জীবনের সেরা ঘুমটা দিতেন। সিগারেট ফেলে দিয়ে অভীক এগিয়ে গেলেন, মেয়েটাকে আপাত-উপেক্ষা করে অতি মনোযোগ সহকারে গেরস্থালি জিনিস দেখতে লাগলেন। মেয়েটা চোখ তুলে হাঁটু নামালে দেখা গেল তার কপালে একটা তিন কোনা টিপ, রং দিয়ে আঁকা, দুই হাত জোড়া মেহেদি, ময়ূরের পেখমের মতো।
'কী লাগবো লন।'
রিনরিনে আগ্রহী কণ্ঠে বলল সে।
অভীকের ইচ্ছে হলো মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করতে, তবে সেটা অভব্যতা হবে-
'পিঠ চুলকানি কত করে?'
'পনেরো টাকা।'
কী বলা যায় ভেবে পেলেন না তিনি।
'দশ টাকা দিয়েন। লন।'
'ভালো?'
'আবার কয়। প্লাস্টিক পচে না জানেন না? ভালো না হইয়া যাইব কই? কোনডা দিমু কন।'
"রং পছন্দ করে নিই। আসলে আমার মেয়ে পিঠ চুলকানি দিয়ে খেলতে পছন্দ করে। 'হাত-হাত' খ্যালে। তোমার হাতের মেন্দির রংটা কী?"
'কী আর, মেন্দি রং!'
'মেন্দি রঙের চুলকানি আছে?'
'মেন্দি রঙের তো নাই। তয় এইডা লন, মেন্দির মতোন।'
অভীক পনেরো টাকা দিয়ে পিঠ চুলকানিটা নিয়ে পার্কে ঢুকে গেলেন। কোথাও বসে বিলাস করে চুলকাতে হবে। অনেকক্ষণ ধরে জ্বালাচ্ছে শালা। পার্কের বেঞ্চগুলো মারাত্মক নোংরা। এত ছিরিহীন পার্ক কখনও দেখেছেন বলে তাঁর মনে পড়ল না। এমাথা-ওমাথা চোখ দিয়েই মেপে নেয়া যায়। এর চেয়ে রাস্তার ওপাশের করপোরেট দালানটা বেশি আকর্ষণীয়। ঘনবদ্ধ গাছ এখানে নেই, ছাড়া ছাড়া-দূরে দূরে অনাত্মীয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে, প্রতিটার গোড়ায় জমাট বর্জ্য। এক জায়গায় আবর্জনায় কারা যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, গলগলিয়ে ধোঁয়া আর প্লাস্টিকের বোতল পোড়ার তীব্র কটু গন্ধ। দক্ষিণ কোনায় বসে কয়েকজন পথশিশু পলিথিনে করে ড্যান্ডি টানছে। ছন্নছাড়া ধরনের ছাতাপড়া পোশাক পরে বিভিন্ন বয়সের কিছু মানুষ অবস্থান করছে পার্কে- কেউ বসে ঝিমোচ্ছে, কেউ উদ্দেশ্যহীন এলোমেলো পায়ে হাঁটছে, একজন আবার মনোযোগ দিয়ে নিজের পায়ের লম্বা নখ পর্যবেক্ষণ করছে। অভীকের খানিকটা ভয় করল। পকেটে পয়সা বিশেষ নেই অবশ্য, মোবাইল ফোনটা আছে। এত ভেবে লাভ নেই, নোংরা একটা বেঞ্চে বসে জামার কলারের ফাঁক দিয়ে পিঠ চুলকানিটা ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। আহা, এত আরাম বহুদিন পাননি। মনে হচ্ছে বহুকাল আগের স্ত্রীর সেই হাতের চেয়েও যেন ভালো এই প্লাস্টিকের চুলকানি। স্বস্তি মিলল আর এই পার্কটা কেমন চেনা মনে হলো। বিয়ের প্রথমদিকে এই পার্কেই একবার আসা হয়েছিল দু'জনে? আরে হ্যাঁ, তাই তো! তখন এই পার্কটা কেবল হয়েছে। গাছগুলো তখন আরও কাছাকাছি ছিল। নাহ, গাছ কাছাকাছি থাকবে কী করে? আসলে গাছের সংখ্যা বেশি ছিল। বেঞ্চগুলো বোধহয় সেই সময় থেকে আর কেউ মোছেনি। এত ঠিকানাহীন মানুষও তখন ছিল না। কেবল বিয়ে হয়েছে, স্ত্রীর বয়স তখন চব্বিশ, তাঁর ঊনত্রিশ। সেদিন কেউ আবর্জনা জড়ো করে আগুন দেয়নি, নববিবাহিত স্ত্রী তাঁকে মৃদুস্বরে একটা গানও শুনিয়েছিল। হঠাৎ চুলকানিটা কেমন ফিরে এলো দ্বিগুণ স্রোতে। পিঠ চুলকানির ব্যর্থ সদ্ব্যবহার করলেন। ঘষতে ঘষতে চামড়া তুলে ফেললেও বুঝি চুলকানি কমবে না। অস্বস্তিটা চামড়ার নিচে চালান হয়ে গেছে। যন্ত্রণায় চোখ কুঁচকে গেল। কেউ যেন এক খাবলা চোৎরা পাতা ঘষে দিয়েছে ওই অগম্য জায়গায়। চাপ দিয়ে চুলকাতে গিয়ে চুলকানির আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে আসছে। ছন্নছাড়াদের একজন, বস্তাপরা, তার দিকে চোখের কোণ দিয়ে তাকিয়ে আছে, সেই চোখ ভাবলেশহীন।
ও হো, ডালই তো কেনা হয়নি, আসল জিনিস। তড়াক করে উঠে পড়লেন তিনি। দৌড়ে গিয়ে মেয়েটার দিকে মমতামাখা চোখে তাকিয়ে বললেন-
'একটা ডাল দাও তো, তোমার পছন্দের রং দেখে দাও, ডালটা যেন খুব শক্ত হয়। টিকবে তো?'
'হ টিকব। তয় পিঠ চুলকানির মতো টিকব না। ডাইল তো গাছ দিয়া বানায়, কাঠ পইচা যায়।'
ঘুঁটনি নিয়ে পার্কে আবার ঢুকলেন। পিঠ চুলকানিটা ফেলে দিলেন আবর্জনার আগুনে। আগের বেঞ্চে বসে অনতিবিলম্বে ডাল ঘুঁটনির কর্কশ-গোলকার-চার আঙুলওয়ালা প্রান্তটা কলারের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘুঁটতে শুরু করলেন এবং নিশ্চিত হলেন, প্লাস্টিকের চুলকানি তার পিঠকে শুরুতে যে স্বস্তি দিয়েছিল, সেটা ডাল ঘুঁটনির পচনশীল কাঠের দেয়া শান্তির কাছে কিছু না।
তাঁর সাদা চেকশার্টের পিঠের দিকে হালকা ভেজা ভেজা ছোপ। মাঝেমধ্যে বিড়বিড় করছেন। কেউ যদি তাঁর পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কাছাকাছি চলে আসে, শুনতে পাবে-
'মেয়েমানুষ নিয়া এই সমস্যা। পুরুষ কাউরে বাইরে যাইতে দেখলেই হইসে, কোনো না কোনো কাজ ধরায়াই দেবে। তাও কী কাজ? ডাল ঘুঁটনি।'
অবশ্য স্ত্রীর যুক্তিকে অস্বীকার করার কোনো পাল্টা যুক্তিও কাছে নেই। ডাল ঘুঁটনি কোথায় পাওয়া যায় তিনি জানেন না, তবে খেতে বসলে অবধারিতভাবে সুস্বাদু পাতলা ডাল খুঁজবেন, সেই ডালে কোনো টমেটো থাকবে না, রসুন থাকবে না। শুধু লবণ দেয়া ডাল। অভীকের স্ত্রী আর দুই মেয়ের ডাল না হলেও চলে, তাঁর চলে না। ডাল রান্না করতে হলে ডাল লাগে সত্য। দিন চারেক ডাল ঘুঁটনি আনতে ভুলে যাওয়ার পর একদিন তিনি টের পেলেন ডালের স্বাদ কমে গেছে। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়েই কথা শুনতে হলো-
'ডাল ঘুঁটনির দুইখেন পাখনা ভাঙসে, ঘোঁটা যদি সুবিধার না হয়, ডাল সুবিধার হবে কী কারণে?'
তাঁর মেয়ে দুটো সমানে হাসতে শুরু করল মায়ের কথা শুনে। তিনি জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন যে ডাল ঘুঁটতে ঘুঁটনিই কেন লাগে, তরকারির চামচ দিয়ে চা গোলানোর মতো করে গোলালে হয় না? মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস পেলেন না। রান্নাবান্নার তিনি কাঁচকলাও জানেন না। মূর্খের মতো প্রশ্ন করে হাসির পাত্র হওয়া বোকামি। ডাল সুবিধামতো না পেয়ে তিনি বিমর্ষ হয়ে গেলেন। অল্পতেই আবেগাক্রান্ত হয়ে যাওয়াটা তাঁর একটা সমস্যা। তাঁর এই আবেগী মনই একদিন ডাল কিনতে বলা এই মহিলার মন কেড়েছিল। সময়ের সাথে সাথে তাঁর স্ত্রী এগিয়ে গিয়ে মেয়ে থেকে মহিলা হয়েছে, প্রেমিকা থেকে গৃহিণী হয়েছে, কিন্তু তিনি মানসিকভাবে রয়ে গেছেন তাঁর প্রেমিক বয়সে। ডান হাতটা আপসেই চলে এল পিঠের দিকে, যেখানে চুলকাচ্ছে সেখানে হাতটা পৌঁছুচ্ছে না, অংসফলকের হাড়টার ঠিক চূড়ায়।
আগতপ্রায় মাঘের সাথে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে তাপমাত্রা। কিছুক্ষণ হাঁটলেই ঘাম হয়। পৌষের হিম নেই কিন্তু বাতাস ঠিকই শীতের সাথে শুকিয়ে এসেছে। জলবায়ুর এই দ্বিমুখী আচরণে নাকেমুখে ধুলো ঢুকে সর্দি লাগে। নাহ্, বয়স তো হচ্ছে। কিন্তু মানসিকভাবে তিনি সেটা মানতে পারছেন না। তাঁর কেবলই মনে হয় হাতে বেশি সময় বাকি নেই, তারুণ্য দ্রুত ফুরিয়ে এলো, মৃত্যুও বুঝি মাঘের মতো সমাসন্ন। মেয়ে দুটো বাঁশঝাড়ের মতো কেবল বেড়েই চলেছে। অথচ মানসিকভাবে তিনি সেই ছাব্বিশ বছর বয়সে আটকে আছেন। মনের আবেগ কমছে না, কমা দরকার। নামটাও বুঝি আর বয়সের সাথে খাপ খাচ্ছে না। শুনলেই ছাব্বিশ বছরের এক তরুণ মুখ চোখে ভাসে। উল্টোদিকে সুচরিতা নামটা যেন সব বয়সেই চলে- প্রেমিকা, মা, বুড়ি দাদি, সব।
সমস্যাটা শুরু বড় মেয়েটার জন্মের পর থেকে। তিনি স্ত্রীকে প্রেমিকা ভেবে সেই আগের মতোই দু'জন মিলে বেড়াতে যেতে চাইতেন- ঘোরাঘুরি, আইসক্রিম, পার্ক, চটপটি, ফুচকা। তাঁর স্ত্রী যে যেতেন না তা না, তবু তিনি স্পষ্ট টের পেতেন তাঁর স্ত্রী আর প্রেমিকা নেই। প্রেমিক জীবনটাতে দু'জন বাইরে ঘোরাঘুরি করার সময় মেয়েটা ভুলে যেত দেরিতে ফিরলে তার হিটলার বাপের ডলা খেতে হবে। ঘড়িতে সময় দেখত, যাই যাই করেও বিদায় বেশ দেরিতেই নিত। আর মেয়ের জন্মের পর বেড়াতে বেরোলেই তাঁর মনে হতো, স্ত্রীর গলায় যেন একটা অদৃশ্য শেকল বাঁধা আছে। কেবলই ঘুরেফিরে মেয়ের কথা। হয়তো বসে আছে ঘাসের ওপর, স্ত্রী বলবে-
'মেয়েটা যে কী করতেসে বাসায়! ওর দাদিরও তো বয়স হইসে, ঠিকমতো খাওয়াতে পারবেনে? মেয়েটা না আবার আমারে খোঁজে!'
হয়তো চটপটি খাচ্ছে, বলবে-
'মেয়েটা আরেকটু বড় হলে ওরে নিয়ে আসতে পারব, চটপটি খাওয়া শেখাব। আমার পছন্দের খাবার আর আমার মেয়ে খাবে না!'
ধরা যাক দু'জনে কোনো মেলায় গিয়ে চরকিতে চড়ল-
'মেয়েটাকে এখন চরকিতে ওঠানো ঠিক হবে না। আরেকটু বড় হোক। যেই জোরে ঘোরায়! এখন থাকলে কাইন্দা দিত।'
একদিন ভুল করে অভীক বলে ফেলেছিলেন-
'হ্যাঁ, ওকে না আনাই ঠিক আছে, নইলে এখন চরকি থামানো লাগত।'
বেশ একটা ঝাড়ি খেলেন-
'বাহ, থামানো লাগলে থামাবা না? তোমার মেয়ে ভয়ে কানতেসে আর তুমি আরামে চরকিতে ঘুরতেস, এইটা হয়? কী বললা তুমি এটা?'
কাজেই দু'জনে যেখানেই যেতেন, মেয়ে অশরীরী রূপে হলেও তাঁদের সাথেই থাকত। তিনি প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস চেপে ভাবতেন, দু'জন আর দু'জনার নেই। 'দুটি মন আর নেই দুজনার' গানটাকে তাঁর কাছে বিয়োগান্ত মনে হতো। এরপর একটা সময় এলো যখন তাঁর স্ত্রীর বাইরে যাওয়ার আগ্রহ দৃশ্যত কমে আসতে লাগল। সেটা অবশ্য সুচরিতা সরাসরি স্বীকার করতেন না। বলতেন রান্না বাকি, অথবা মেয়েটা যেতে দিচ্ছে না বা ঘরের কাজ ফেলে যাওয়াটা শ্বশুরবাড়িতে ভালো দেখায় না। কয়েকবার অভীক বউ-মেয়ে সহই গেছেন, সন্তান নিয়ে ঘোরাফেরা খারাপ না মোটেই। একটা শিশুকে দেখেশুনে কোথাও নিয়ে যাওয়া, তাকে আনন্দ দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা, তারপর ঢাকা শহরের মহা ঝুঁকিপূর্ণ পথ পেরিয়ে নিরাপদে তাকে বাসায় ফিরিয়ে আনার মধ্যে এক ধরনের আশ্চর্য আনন্দ আছে, একটা বিমূর্ত সফলতার অনুভূতি কাজ করে। তবে সেই অনুভূতির একটা বিনিময় মূল্য আছে। এরপর দ্বিতীয় মেয়ের জন্মের পরেই সুচরিতা পুরোপুরি মা হয়ে গেলেন। তাঁর সকল কথাবার্তা, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন-সাধ হয়ে গেল সন্তানকেন্দ্রিক। আবার একটা পর্যায় এলো যখন অভীক নিজেই আর ঘোরাফেরার সাধ বোধ করলেন না। অফিসে যান, বাসায় আসেন, বাচ্চা পড়ান, বাচ্চা নিয়ে কথা বলেন, বাচ্চার দাদা-দাদি কীভাবে বাচ্চার অভ্যাস খারাপ করছে সেটা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শোনেন। আর এখন চটপটি-ফুচকা পেটে তেমন সয়ও না। তাঁর সবচেয়ে খারাপ লাগত যে ব্যাপারটা- সুচরিতা নানান অজুহাত দিতেন তাঁর সাথে বাইরে না যাওয়ার। সত্যটা বলতেন না যে স্বামীর সাথে একা বাইরে গিয়ে তিনি আর স্বস্তি পান না, সংসার তাঁর পিছু ছাড়ে না। সংসার বুঝি এমনই, ভণ্ডামি ছাড়া টেকে না। এভাবেই আজকের দিনটার জন্ম, যেদিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ডাল কেনা। চুলকানিটা কেবলই বেড়ে যাচ্ছে। কাঁধের ওপর দিয়ে এক হাত আর বগলের তলা দিয়ে আরেক হাত পিঠের দিকে বাড়ালে দেখা যাবে কাঁধের হাড়ের একটা সরু আয়তক্ষেত্র আছে যেখানে ইঞ্চিখানেকের জন্য কোনো হাতের আঙুলই পৌঁছায় না। দশটা আঙুলের মিলনের অভাবে শরীরের সকল অস্বস্তি ওই বিন্দুতে ভর করেছে।
আজ যেন বিষণ্ণতাটা খুব বেশি অনুভূত হচ্ছে। বয়সের কারণে? মিডলাইফ ক্রাইসিস? নাকি এই মাঝ-পৌষেরও কিছু অবদান আছে? তাঁদের প্রেমটা হয়েছিল এ রকম সময়ই। সাতাশ বছর আগের সেই সময়ের কথা মনে পড়লে আজও শীতের গন্ধটা মনে পড়ে তাঁর। সেই কালে শীত আসার আগে আগে হেমন্তের অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত শহরের বাতাসে। আর দু'জনেরই ছিল হেমন্তের প্রভাবে কাত হয়ে যাওয়ার বয়স। কনকনে ঠান্ডার এক বিকেলে মন বিনিময় হয়েছিল গাঁদাফুল ভাসা এক মাঠের কাছে। সেই মাঠ এখন ইটের জঙ্গল। যে ঘাসের ওপর বসা ছিল দৈনন্দিন আনন্দ, সেখানে ঘাস সব উঠে গেছে লক্ষ পায়ের ডলাডলিতে। রিকশায় ঘোরার আনন্দ মরে গেছে এই শহরের নিরেট জ্যামে। যে পুকুরের জলে ইটের টুকরো দিয়ে ব্যাঙ লাফ দিতে দিতে প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করা হতো, সেই পুকুর বিবর্তিত হয়েছে রুফটপ রেস্টুরেন্টে যার সামনে বড় করে লেখা আছে 'ভূমিকম্প প্রতিরোধী', ব্যাঙ লাফ দেয়ার মতো ইটের টুকরোও আর নেই কোথাও। হাত ধরাধরি করে খুব ধীরেসুস্থে হেঁটে যেতে যেতে মন খুলে কথা বলার মতো রাস্তা একটাও অবশিষ্ট নেই বোধহয়- সেসব রাস্তা পাকা থেকে ক্রমান্বয়ে কাঁচা হতে হতে গ্রামের দিকে চলে যেত- সব রাজপথ হয়ে গেছে, চুপি চুপি কথা বলার ব্যক্তিস্বাধীনতা বিলুপ্তপ্রায়, কণ্ঠের ডেসিবেল যথেষ্ট না বাড়ালে চারপাশের হাজার ঘর্ষণের শব্দ ছাড়িয়ে প্রণয়ীর কানে শব্দ পৌঁছে দেয়া যায় না। নাহ, স্ত্রীকে দোষ দেয়া চলে না, ধুত্তোরি, চুলকানিটা কমছেই না। সত্যি, দু'জন দু'জনার বলে কিছু নেই। দু'জনের সাথে আরও বহু কিছু যুক্ত হয়, পরিবেশ-প্রতিবেশ। যারা ছিল তাদের ভালোবাসার সাক্ষী, সব আজ বিবর্তিত- ইটচাপা গাঁদাফুল, ঘাসহীন মাঠ, স্থবির-পেশাদার রিকশা, প্রতিমুহূর্তে বাসচাপার ভয়, মাথার খুলি চেপে ধরা শব্দ, পুকুরের পাকা সমাধি। হেমন্তের গন্ধ, শীতের কামড়, গাঁদাফুল, পুকুর এরা না থাকলে তাঁর প্রেম টিকবে কী করে? এখন সুখী হওয়ার পথ একটাই, ইটে সুখ পাওয়া, রুফটপে পয়সা খসানো, নিরাপত্তা নিয়ে সদা চিন্তিত থাকা, অর্থনৈতিকভাবে অরক্ষিত হবার আতঙ্ক আর সংসারে খরচ জোগানোর বাধকতার টানাপোড়েন। এসবেও মানুষ সুখ পায় নিশ্চয়। ঘোঁটানো ডালের স্বাদের মতোই। শহরটা একটা ডালের পাতিলই মনে হচ্ছে, দানবীয় ডাল দিয়ে ঘোঁটা দিয়ে চলেছে যেন মহাযন্ত্র। ক্রমশ ঘোঁট পাকাচ্ছে সবকিছু- যানবাহন, গাছ, মাছ, পাখি, ফুল, লতাপাতা, মানুষ, মন, জীবন, যৌবন, প্রেম, আবেগ, অতীত, স্মৃতিকাতরতা, কী না?
সমস্যাটা কি শার্টে? কিছু কি লেগে ছিল? কেন এত চুলকাচ্ছে? আর শালা ওখানেই চুলকাচ্ছে, যেখানে হাত পৌঁছতে গেলে পেশিতে টান লাগে, ঘাড় ব্যথা করে, আঙুল কুঁকড়ে আসে। সেই সাথে পৌষ মাসের ঘাম গড়িয়ে গড়িয়ে যেন ঠিক ওখানটাতেই লাগছে, ঘামের লবণে বাড়ছে চুলকানি। বিয়ের প্রথমদিকে স্ত্রী তাঁর পিঠ চুলকে দিত অনেকক্ষণ ধরে। এমন অভ্যাস হয়েছিল ওই হাতের মিষ্টি চুলকানিতে, ওটা ছাড়া তাঁর ঘুমাতে দেরি হতো। এখনও দেয়, তবে না চাইলে দেয় না। দিলেও আগের সেই যত্ন আর বোধ হয় না। তিনি নিজেও হয়তো মিইয়ে গেছেন। নেই, কিছুই আগের মতো নেই। থাকার কথা? পরিবর্তনই কি একমাত্র অপরিবর্তনীয় জিনিস না? সত্য, তবে পরিবর্তনের স্মৃতিটাও যে মুছে যেতে বসেছে! মরিচার মরীচিকা ধরেছে সব স্মৃতিস্মারকে। পিঠটা চুলকাবে কে? কোনো সেলুনে ঢুকে পড়লে কেমন হয়? চুল কাটানোর অজুহাতে বলতে হবে-
'চুল একেবারে ছোট করে দ্যাও। মেলা গরম। আচ্ছা, আমার পিঠের এইদিকে চুলকাচ্ছে, একটু ঘসে দ্যাও তো। চুল কিন্তু ভালো করে কাইটো।'
নাহ, দৃশ্যটা হাস্যকর হবে। সপ্তাহ দেড়েক হলো তিনি চুল কাটিয়েছেন। নাপিত দেখলেই বুঝে ফেলবে চুল কাটার মতো বড় হয়নি। পিঠ চুলকানো কি আসলে এত বড় ঘটনা যে তাঁকে পয়সা খরচ করতে হবে? ছোটবেলায় গরুকে দেখেছেন গাছের সাথে গা ঘষে ঘষে পিঠ চুলকে নিতে। একটা ছাগল আরেকটা ছাগলের পিঠ জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে চুলকে দেয়। কোনো গাছের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ঘষা দিয়ে পিঠ চুলকে নেয়া যায় কি? সেও কি সুবিধার হবে? এখন কেউ তাঁর দিকে তাকাচ্ছে না, তবে পিঠ ঘষা শুরু করলে নির্ঘাত তাকাবে। তার ঘষাঘষি দেখে জনতারও শৈশবে দেখা গরুর পিঠ চুলকানো মনে পড়ে যেতে পারে। কোনো বাবা হয়তো সন্তানকে বলবে-
'তোকে বলেছিলাম না আমাদের পোষা গরুটা কীভাবে গাছের সাথে পিঠ চুলকাত? ওই দ্যাখ ওইভাবে।'
দৃষ্টিসীমায় চুলকানোর মতো গাছ নেইও। রাস্তার বিভাজকে অনিয়মিত বিরতিতে কিছু ম্যাড়মেড়ে গাছ দাঁড়িয়ে আছে, পাতায় ধুলোর আস্তরণ, একেকটা ভারী যানবাহন সাঁ করে যাওয়ার সাথে সাথে ওরা কেঁপে উঠছে, টালমাটাল হতে হতে আবার সামলে নিচ্ছে শিকড়ের জোরে। জ্যামে রাস্তা স্থবির হলে বরং ওরা কিছুটা স্থিতি লাভ করে।
খানিক সামনে ধুলো যেন বাতাসে ঝুলে আছে। কয়েক পা এগিয়ে বোঝা গেল নির্মাণকাজ চলছে। পায়ের নিচে হালকা কম্পন টের পেলেন অভীক। পাইলিং চলছে। চারপাশে পাকা রাস্তার মাঝে একখণ্ড কাঁচা মাটি পাইলিং মেশিনের দণ্ডাকৃতির ওঠানামায় ধর্ষিতার মতো কেঁপে কেঁপে উঠছে যন্ত্রণায়। মেশিনটার দিকে ম্যামথের শুঁড়ের মতো দানবীয় থাবা আকাশের দিকে তুলে ধরে বেশ গৌরবময় গতিতে শুয়োপোকার মতোই ধীরলয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটা ক্যাটারপিলার। থাবার খাঁজকাটা ধাতব পাতগুলো দেখে তাঁর পিঠের চুলকানি আবার বেড়ে গেল। ইচ্ছে করল যন্ত্রটাকে হাত তুলে থামিয়ে চালককে অনুরোধ করে ওই থাবা দিয়ে তাঁর পিঠটা যেন বেশ ভালো করে আঁচড়ে আঁচড়ে দেয়। ডাল পাওয়া গেছে। ক্যাটারপিলারটাকে আধা কিলোমিটারের মতো পেছনে ফেলে এসে একটা ছিরিছাঁদহীন পার্কের পাশে ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন গেরস্তালি জিনিস- ডাল, চিরুনি, ঢাকনা, চামচ, অ্যাশট্রে, ছাঁকনি- এবং পিঠ চুলকানি। ডাল ছাড়া সবই প্লাস্টিক আর অ্যালুমিনিয়ামের। পায়ের গতি বাড়িয়ে তৃষ্ণার্তের মতো সেদিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। ডাল পরে কেনা যাবে। সবার আগে তাঁর দরকার একটা রুক্ষ চুলকানি, যা তাঁর পিঠের অনধিগম্য জায়গায় অনায়াস আক্রমণে আরাম দেবে। পিঠ চুলকানিগুলো মানুষের হাতের অনুকৃতি, কঙ্কালের হাড়ের চেয়ে সরু, নবজাতকের আঙুলের মতো ছোট পাঁচটা প্লাস্টিকের আঙুল যেন ওই ক্যাটারপিলারের দানবীয় থাবার ক্ষুদ্ররূপ। গেরস্থালি পণ্য নিয়ে যে মেয়েটা বসে আছে, তার বয়স চব্বিশের বেশি হবে না। নারী বিক্রেতার কাছ থেকে সাধারণত তিনি কিছু কেনেন না। নারীদের সাথে তিনি দর কষাকষি করতে পারেন না, এটাই হয়তো কারণ। ফুটপাতের অ্যাশট্রের দিকে নজর রেখে তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে পার্কের লোহার গেটে পিঠটা আলতো করে ছুঁইয়ে দাঁড়ালেন, চুলকানিটা সহনীয় করার জন্য। তীব্র ইচ্ছে করছে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে পিঠটা ঘষে নিতে। আচ্ছা, তাঁর কেন মনে হচ্ছে মেয়েটার বয়স চব্বিশ? মানুষ যখন কারও বয়স আন্দাজ করে, তখন পঁচিশ, তিরিশ, পঁয়ত্রিশ, চল্লিশ এভাবে চিন্তা করে। তিনি চব্বিশই কেন ভাবলেন? মেয়েটা এক হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে বসে আছে, হয়তো ক্রেতা নেই বলে হতাশ, কিংবা ভাবছে প্রেমিকের কথা, অপেক্ষা করছে কখন কিছু বিক্রিবাট্টা হবে আর সে প্রেমিকের সাথে দেখা করবে। তিন কোনা-তীক্ষ্ণ একটা মুখ। দুই চোখ সরু তবে কোনার দিকে বেশ টানা টানা। চুল পেছন দিকে টেনে খোঁপা করা। একটা হালকা রঙের ছাপা শাড়ি পরে আছে, রংকানা হওয়ায় তিনি শাড়ির রং বলতে পারবেন না। শ্যামলা বরণ মেয়ে, ছিপছিপে। এক ফাঁকে মেয়েটাও নিজের মাথাটা চুলকে নিল, তার নরম হাত ক্যাটারপিলারের মতো রুক্ষ, ওই হাতটা যদি একটু চুলকে দিত তাঁকে তাহলে পার্কের বেঞ্চেই তিনি জীবনের সেরা ঘুমটা দিতেন। সিগারেট ফেলে দিয়ে অভীক এগিয়ে গেলেন, মেয়েটাকে আপাত-উপেক্ষা করে অতি মনোযোগ সহকারে গেরস্থালি জিনিস দেখতে লাগলেন। মেয়েটা চোখ তুলে হাঁটু নামালে দেখা গেল তার কপালে একটা তিন কোনা টিপ, রং দিয়ে আঁকা, দুই হাত জোড়া মেহেদি, ময়ূরের পেখমের মতো।
'কী লাগবো লন।'
রিনরিনে আগ্রহী কণ্ঠে বলল সে।
অভীকের ইচ্ছে হলো মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করতে, তবে সেটা অভব্যতা হবে-
'পিঠ চুলকানি কত করে?'
'পনেরো টাকা।'
কী বলা যায় ভেবে পেলেন না তিনি।
'দশ টাকা দিয়েন। লন।'
'ভালো?'
'আবার কয়। প্লাস্টিক পচে না জানেন না? ভালো না হইয়া যাইব কই? কোনডা দিমু কন।'
"রং পছন্দ করে নিই। আসলে আমার মেয়ে পিঠ চুলকানি দিয়ে খেলতে পছন্দ করে। 'হাত-হাত' খ্যালে। তোমার হাতের মেন্দির রংটা কী?"
'কী আর, মেন্দি রং!'
'মেন্দি রঙের চুলকানি আছে?'
'মেন্দি রঙের তো নাই। তয় এইডা লন, মেন্দির মতোন।'
অভীক পনেরো টাকা দিয়ে পিঠ চুলকানিটা নিয়ে পার্কে ঢুকে গেলেন। কোথাও বসে বিলাস করে চুলকাতে হবে। অনেকক্ষণ ধরে জ্বালাচ্ছে শালা। পার্কের বেঞ্চগুলো মারাত্মক নোংরা। এত ছিরিহীন পার্ক কখনও দেখেছেন বলে তাঁর মনে পড়ল না। এমাথা-ওমাথা চোখ দিয়েই মেপে নেয়া যায়। এর চেয়ে রাস্তার ওপাশের করপোরেট দালানটা বেশি আকর্ষণীয়। ঘনবদ্ধ গাছ এখানে নেই, ছাড়া ছাড়া-দূরে দূরে অনাত্মীয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে, প্রতিটার গোড়ায় জমাট বর্জ্য। এক জায়গায় আবর্জনায় কারা যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, গলগলিয়ে ধোঁয়া আর প্লাস্টিকের বোতল পোড়ার তীব্র কটু গন্ধ। দক্ষিণ কোনায় বসে কয়েকজন পথশিশু পলিথিনে করে ড্যান্ডি টানছে। ছন্নছাড়া ধরনের ছাতাপড়া পোশাক পরে বিভিন্ন বয়সের কিছু মানুষ অবস্থান করছে পার্কে- কেউ বসে ঝিমোচ্ছে, কেউ উদ্দেশ্যহীন এলোমেলো পায়ে হাঁটছে, একজন আবার মনোযোগ দিয়ে নিজের পায়ের লম্বা নখ পর্যবেক্ষণ করছে। অভীকের খানিকটা ভয় করল। পকেটে পয়সা বিশেষ নেই অবশ্য, মোবাইল ফোনটা আছে। এত ভেবে লাভ নেই, নোংরা একটা বেঞ্চে বসে জামার কলারের ফাঁক দিয়ে পিঠ চুলকানিটা ঢুকিয়ে দিলেন তিনি। আহা, এত আরাম বহুদিন পাননি। মনে হচ্ছে বহুকাল আগের স্ত্রীর সেই হাতের চেয়েও যেন ভালো এই প্লাস্টিকের চুলকানি। স্বস্তি মিলল আর এই পার্কটা কেমন চেনা মনে হলো। বিয়ের প্রথমদিকে এই পার্কেই একবার আসা হয়েছিল দু'জনে? আরে হ্যাঁ, তাই তো! তখন এই পার্কটা কেবল হয়েছে। গাছগুলো তখন আরও কাছাকাছি ছিল। নাহ, গাছ কাছাকাছি থাকবে কী করে? আসলে গাছের সংখ্যা বেশি ছিল। বেঞ্চগুলো বোধহয় সেই সময় থেকে আর কেউ মোছেনি। এত ঠিকানাহীন মানুষও তখন ছিল না। কেবল বিয়ে হয়েছে, স্ত্রীর বয়স তখন চব্বিশ, তাঁর ঊনত্রিশ। সেদিন কেউ আবর্জনা জড়ো করে আগুন দেয়নি, নববিবাহিত স্ত্রী তাঁকে মৃদুস্বরে একটা গানও শুনিয়েছিল। হঠাৎ চুলকানিটা কেমন ফিরে এলো দ্বিগুণ স্রোতে। পিঠ চুলকানির ব্যর্থ সদ্ব্যবহার করলেন। ঘষতে ঘষতে চামড়া তুলে ফেললেও বুঝি চুলকানি কমবে না। অস্বস্তিটা চামড়ার নিচে চালান হয়ে গেছে। যন্ত্রণায় চোখ কুঁচকে গেল। কেউ যেন এক খাবলা চোৎরা পাতা ঘষে দিয়েছে ওই অগম্য জায়গায়। চাপ দিয়ে চুলকাতে গিয়ে চুলকানির আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে আসছে। ছন্নছাড়াদের একজন, বস্তাপরা, তার দিকে চোখের কোণ দিয়ে তাকিয়ে আছে, সেই চোখ ভাবলেশহীন।
ও হো, ডালই তো কেনা হয়নি, আসল জিনিস। তড়াক করে উঠে পড়লেন তিনি। দৌড়ে গিয়ে মেয়েটার দিকে মমতামাখা চোখে তাকিয়ে বললেন-
'একটা ডাল দাও তো, তোমার পছন্দের রং দেখে দাও, ডালটা যেন খুব শক্ত হয়। টিকবে তো?'
'হ টিকব। তয় পিঠ চুলকানির মতো টিকব না। ডাইল তো গাছ দিয়া বানায়, কাঠ পইচা যায়।'
ঘুঁটনি নিয়ে পার্কে আবার ঢুকলেন। পিঠ চুলকানিটা ফেলে দিলেন আবর্জনার আগুনে। আগের বেঞ্চে বসে অনতিবিলম্বে ডাল ঘুঁটনির কর্কশ-গোলকার-চার আঙুলওয়ালা প্রান্তটা কলারের ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘুঁটতে শুরু করলেন এবং নিশ্চিত হলেন, প্লাস্টিকের চুলকানি তার পিঠকে শুরুতে যে স্বস্তি দিয়েছিল, সেটা ডাল ঘুঁটনির পচনশীল কাঠের দেয়া শান্তির কাছে কিছু না।
মন্তব্য করুন