
দুপুরের আগে সুপ্রকাশের মন খারাপ হলো, কোনো কারণ ছাড়াই। কারণ নাথাকলেও, সুপ্রকাশ কোনো কারণ খুঁজলও না। খোঁজার কথাও না। নিজের মন খারাপের কারণ, অন্তত সরাসরি কিছু নাঘটলে কেউ খোঁজে? সুপ্রকাশও খুঁজল না। প্রায় বিষণ্ণ মুখে দোতলার জানালা থেকে চোখ দুটো বড় করে বাইরে তাকিয়ে থাকল একটানা।
বাইরে অক্টোবরের রোদ ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই রোদে টানা তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করে। সুপ্রকাশের চোখও এতক্ষণ তাকিয়ে থাকায় জ্বালা করে উঠত, কিন্তু সম্প্র্রতি এক পাশ ভেঙে প্রায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া পেয়ারা গাছটার মাথায় অনেকখানি রোদ আটকে পাশের বাড়ির পুব দিকের দেয়ালে পড়েছে। তাতে রোদের তাপ কমে গেছে; ফলে এই একদৃষ্টে থাকায় সুপ্রকাশের চোখ জ্বালা করল না। সুপ্রকাশ মন খারাপ নিয়ে পেয়ারা গাছের মাথায় আটকানো রোদ থেকে চোখ সরিয়ে রাখল পাশের বাড়ির দেয়ালে। এরপর সেখান থেকে সরিয়ে এক সারিতে লাগানো সীমানার বড় বড় কাপিলা গাছের পাতায় চেয়ে থাকল।
এই সময়ে ঝরনা রান্নাঘর থেকে এই দক্ষিণে খোলা ঘরটাতে এসেছিল। হাতে উঁচু কিনারার থালা নিয়ে সে সুপ্রকাশের উপুড় হয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা খাটের মাঝামাঝি দাঁড়ায়। সুপ্রকাশ অবশ্য বুঝেছে, ঝরনা এই রুমে ঢুকেছে, কিন্তু এখন যে সুপ্রকাশের টানা লম্বালম্বি শুয়ে থাকা শরীরে মাঝখান বরাবর ফাঁকা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে তার দৃষ্টির পথ দেখছে, তা সে বুঝে উঠতে পারেনি; এমনকি অনুমানেও আনতে পারেনি; অনুমানে আনতে পারলে নাহয় ওই ঝুঁকে একনজরে তাকানো চোখ দুটোকে তার ঘাড়সহ ডানে ঘুরিয়ে একবার, অন্তত একবারের জন্য ঝরনাকে দেখে নিত। ঝরনা ওই থালা-ধরা-হাতে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর সুপ্রকাশের পিঠের ওপর পর্যন্ত নিজের শরীর টেনে এনে সেখান থেকে সুপ্রকাশের দৃষ্টিপথ বুঝে নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু সেই পথেও যখন কিছুই মিলল না; দেখল, ওই চোখে সুপ্রকাশ বড়জোর পেয়ারা গাছের পাতাগুলোকেই দেখেছে, তখন এমন শুয়ে একটানা বাইরে চেয়েথাকার কোনো কারণ খুঁজে পেল না। তারপর নিজের জন্য ভাবল, একবার জিজ্ঞাসা করে। আবার ভাবল, না, থাকুক ওইভাবে চেয়ে। আবার ভাবল, না, এই রোদে চেয়ে থাকলে চোখ খারাপ হবে। ভাবল, না, সে কথা বলা যাবে না, চেঁচিয়ে উঠতে পারে, সকাল থেকে মনমরা। ইলিশ মাছ আর জলঝাড়া পান্তা যে মানুষটার এত প্রিয়, তাইই খেল গলা দিয়ে প্রায় কোনো স্বর বের নাকরে। আর এখন ডাকলে যদি ... এখন ডাকলে যদি ওই গলায় আটকেথাকা কথাগুলো এক স্বরে বলে ফেলে? সে কথা ঝরনা সামাল দিতে পারবে না। ঝরনা জানে। তবু ওই ভুলটা ঝরনা করল। নিজের চোখ পেয়ারা গাছের পাতা থেকে সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর সুপ্রকাশের মাথার দিকে চাইল। সুপ্রকাশ এখন সম্ভবত চোখ দুটোকে বিছানার সীমানায় শীতলপাটির লাল বর্ডার বাঁধানো কোনায় এনে আটকেছে। সেখানেই তাকিয়ে আছে। চোখ আর বিছানার তফাত মাত্র এক বিঘত। সেখানেই কিছুক্ষণের জন্য আটকেথাকা চোখজোড়া ঝরনা ফিরাল এই বলে-
'চাইয়ে কী দেহো?'
'তোমার মাথা।'
সুপ্রকাশের সরাসরি উত্তর কোনো বাঁধো-ভাব নেই। যেন ঝরনার এই প্রশ্নেরই অপেক্ষায়ই ছিল সে; অথবা, ছিল না। অথচ উত্তরে মনে হলো, ঝরনা যে এইখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তা সে এতক্ষণে টের পেয়েছে। অথবা আরও আগে যখন ঝরনা প্রথম এসে দাঁড়িয়ে ছিল, তখনই। অথবা, উত্তরটা দিল একদমই তাৎক্ষণিক। এই মুহূর্তে, মন খারাপ নিয়ে সুপ্রকাশ এমন উত্তরই দেয়, দিয়েছে, দিয়ে আসছে, গত কিছুদিন। ফলে, সুপ্রকাশের অমন কাঁটা উত্তরের কোনো মানে খুঁজল না ঝরনা। খাটের পাশ থেকে একটু সরে এসে নিজে কিছু বলার বদলে একটুক্ষণ সুপ্রকাশের মাথা দেখল। এই সময়ে সুপ্রকাশ ঘাড় ঘুরিয়ে ঝরনাকে একপলকের জন্য দেখেছে। দেখে নিয়েছে তার এই উত্তরে ঝরনার প্রতিক্রিয়া কী? ঝরনার ফর্সা লম্বাটে মুখখানায় কোনো প্রতিক্রিয়া নেই দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ সামনে আনে। তারপর সেখান থেকে দৃষ্টি ওই পেয়ারা গাছের ডালে রাখে। একটা টুনটুনি পাখি একটু আগে একদম ওপরের দিকে ডালে বসেছিল, তখন সুপ্রকাশ ঘাড় ঘুরিয়ে ঝরনাকে দেখেছে। তারপর এইমাত্র আবার পেয়ারা গাছে তাকিয়ে পাখিটাকে দেখে না। এতে সুপ্রকাশের ওই মন খারাপে আরএকটু প্রলেপ পড়ল (যেন)! তখন সুপ্রকাশ আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে ঝরনার দাঁড়িয়েথাকা দেখে। তাতে ঝরনার মুখটাকে হঠাৎ উসকে দেয়া হলো। ঝরনা সুপ্রকাশের উত্তরের জবাব দিল-
'আমার মাথা বিছানে? না, ওই পেয়ারা গাছে?'
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। হলেও সে উত্তর জানাও নেই সুপ্রকাশের। তাছাড়া, যে ঝাঁজে তার কাছে নিজের মাথার খোঁজ জানতে চাইল, সেই ঝাঁজের তালে তাল রেখে এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতন উত্তর জানাও নেই সুপ্রকাশের। ফলে, সুপ্রকাশের উত্তর দেয়া হলো না। সে চুপ করে গেল। চোখ দুটো আবার সামনের পেয়ারা গাছে রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকল কিছুক্ষণ; যদিও কান খাড়াই রেখেছিল, ঝরনা কখন সরে রান্নাঘরে যায় তা বুঝে নিতে চাইছিল। অথচ ঝরনা বেশ খানিকক্ষণ সরল না। একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু এই দাঁড়িয়ে থাকায়ও যখন সুপ্রকাশের গলা দিয়ে স্বর বের হলো না, তখন যেন অনেককিছু তার খোয়া গেল ভিতরে গুমরানো এমন গজরানিতে একটু রাগ হয়ে সুপ্রকাশকে শুনিয়ে আনমনে বলতে বলতে চলে গেল-
'খালি ফাও কতা! তোমার মাথা মনে হয় ঠিক নেই। ডাক্তার দেহাও, আর নয় এইরম করলি আমি পাগল হইয়ে যাব ...'
'তুমি পাগল হবা, না?'
সুপ্রকাশ ঝরনার চলে যাওয়া শরীরের পেছনকে শোনাল-
'তুমি পাগল হবা না ... তোমার মতন মানুষ পাগল হ'লি বাকি মানুষ কী কইরে বাঁইচে থাকপে। আর হ'লি তো-'
'আর হ'লি?'
'হ'লি পাবনা থুইয়ে আসপো। এহোন পাবনায় ডাইরেক্ট বাস যায়।'
'এহোনই থুইয়ে আসো। পাগল আর হওয়া লাগবে না। আমিও বাঁইচে যাই। তোমার মতন মানষির সাতে সংসার করার চাইয়ে পাবনায় পাগলের সাতে থাহা অনেক ভালো-'
'তা'লি যাও- আমার থুইয়ে আসার দরকার কী?'
'একলা গেলি মানষি কবে চইলে গেইচে। তুমি থুইয়ে আসলি তো তা ক'তি পারবে না-'
'ওঃ, তা'লি মানষির কতার ভয় পাও। সে ভয় তোমার আছে?'
এই বলে সুপ্রকাশ বুঝল, একটু বেফাঁস কথাই বলা হয়ে গেছে। এখনই প্রতিক্রিয়া মিলবে। কলেজে নুরুল ইসলাম স্যার নিউটনের গতিতত্ত্ব পড়ানোর সময় কথাটা খুব বলতেন, প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। দেয়ালে বল মারো, ফিরে আসবে। কিন্তু বল ফিরল না। নিউটন ভুল প্রমাণিত হলো। মুহূর্তেই। তাহলে নিম্নচাপ। কিছুক্ষণের ভিতরেই প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে। সুপ্রকাশ সেই অপেক্ষায়ই থাকল। কিন্তু অপেক্ষা জল হলো, ঝরনা এলো না। রান্নাঘর থেকে প্রায় কোনো শব্দই ভেসে এলো না আর।
তবে, সুপ্রকাশ আর ঝরনার এই কথা কাটাকাটিতে সুপ্রকাশের লাভ হলো। তার মন ভালো হয়ে গেল। যেন ঝরনাকে এই কথাগুলো বলতে নাপারায় তার মন এতক্ষণ খারাপ ছিল। যেন সেখান থেকে এতক্ষণে বোঝা নেমে গেছে। আর যেন সে, সেই জন্য উঠে বসে হিসাব করতে পারছে কেন তার মন খারপ ছিল। এ সময়ে বসা থেকে একপলকে বাইরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে পেয়ারা গাছে তাকাল সে। এখন টুনটুনি পাখিটা আবার পেয়ারা গাছে এসে বসেছে। লাফাতে লাফাতে মগডালে পৌঁছেছে। আরএকটা ছোট্ট লাফ দিলেই পাখিটা সেখান থেকে নিচে পড়ে যাবে। সুপ্রকাশ পাখিটার নিচে পড়া দেখার অপেক্ষায় গাছের মগডালে চোখ দিয়ে থাকল। কিন্তু পাখিটা আর লাফ দিল না, সেখানেই স্থির। তারপরই সুপ্রকাশের মনে হলো, পাখিটা ওইখানে আর একটা কেন, দশটা লাফ দিলেইবা কী? পাখি কি কখনও গাছ থেকে পড়ে?
আচ্ছা, পাখি কখনও গাছ থেকে পড়ে?
না। পড়ে না।
আচ্ছা, পাখির কখনও মন খারাপ হয়?
না। হয় না।
আচ্ছা, পাখির যদি কখনও মন খারাপ হয়?
হয় না।
যদি হয়?
কেন হবে?
হয় না। পাখির কখনও মন খারাপ হয় না।
তাহলে?
পাখির মন নেই।
টুনটুনিটা পেয়ারা গাছ থেকে উড়ে কাপিলা গাছে গিয়ে বসল। বসে থাকল, স্থির আর অনড়। সাধারণত যা ঘটে না। সুপ্রকাশের আবার মন খারাপ হলো।
২
এইবারের মন খারাপের হিসাব সুপ্রকাশ মিলিয়ে ফেলল। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে, একবার চোখ বড় করে রান্নাঘরের দিকে চেয়ে ঝরনাকে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু সেখানেও খুন্তি-চামচের নাড়ানাড়ি নেই, এতে ওই হিসাব মিলিয়ে নেয়া তার জন্য সোজাই হলো। এখন হিসাব কাউকে বললে, সে যাই বলুক অথবা যাই বলত- সেই বলার সঙ্গে সুপ্রকাশের হিসাব এদিক-ওদিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুপ্রকাশ তা যাচাই করত, নিজের হিসাবের সঙ্গে যুক্তি দিয়ে তর্ক করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করত। শুধু ঝরনাকে কথাটা বললে সে বলবে-
এ আর নতুন কী? এত জানাই ছিল।
বাইরের রোদে চোখ আসলেই একটু জ্বলছে। ভাদ্রআশ্বিনের রোদে একটানা চেয়ে থাকলে চোখ জ্বলে। কে বলেছিল? মনে নেই। বৈশাখের রোদে চেয়ে থাকলে, চোখে তাপ লাগে। এপ্রিলমেতে কলেজে যেত গগলস্ পরে। এখন সেই কলেজেপরা গগলস্ খুঁজে দেখবে নাকি কোথায় আছে। তাহলে টুনটুনির দিকে একটানা তাকিয়ে থাকা যেত। চোখ জ্বলত না। তারপর ওই গগলস্পরা চোখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে ঝরনার উদ্দেশ্যে বলা যেত-
'আমার মন কেন খারাপ, তুমি জানো?'
ঝরনা পয়লা হয়তো শুনতই না, আরও বার দুয়েক বললে তারপর বলত-
'না, জানি না।'
তখন সুপ্রকাশ বাইরে তাকিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে যেন এক আসন্ন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তৈরি এমন গলায়, ধীর ধীরে জানাত-
'তুমি।'
এইটুকু বলতে এতক্ষণের প্রস্তুতি। আর বলার পরে যেন চারধার সুনসান, টুনটুনিটা আসন্ন যুদ্ধের দর্শকের প্রস্তুতি নিয়ে ওই দক্ষিণে খোলা বারান্দার সবচেয়ে কাছের কাপিলা গাছটায় এসে বসেছে। অথচ, এই যুদ্ধ হলো না। ঝরনা দ্রুতই, গলার স্বর নিচের খাদে রেখে জানাল-
'এ তো জানাই ছিল।'
তাহলে ঝরনার জানা ছিল, সুপ্রকাশই জানত না। তাহলে আর জেনে লাভ নেই। সুপ্রকাশ ঝরনাকে কিছু বলল না। একটানা বাইরে তাকিয়ে থাকল, আগের মতো। যদিও তখন তার কানে ওই যুদ্ধের প্রস্তুতিতে শোনা ঝরনার কথা। যেন ঝরনা তার পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাধানোর জন্য বলেই চলেছে যে- মানুষের কোনো কাজ নেই, বাপের গোলার ধান ভাঙায় আর খায়, টাউনে বাপের দালানে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুইলে বইসে বঙ্গোপসাগরের বাতাস খায়, সের তো মন খারাপের কারণ বাইর করা লাগে ... আর কোনো তা না পা'লি শেষে কবে বউর জন্যি মোন খারাপ। অকম্মা মানষির মোন খারাপ হ'তি কারণ লাগে? ...
ঝরনার কথা আরও দীর্ঘ হয়ে কানে বাজতে থাকে একটানা। কিন্তু এই সবই তো অনুমান। ঝরনা তো মুখে কিছু বলছে না। বলুক, আজকে ছাড়ব না।
ঝরনা কিছু বলল না।
তবে ঝরনার ওই নাবলা, অথচ সুপ্রকাশের কানে বাজতে থাকা কথাগুলোই একটানা বাইরে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করল। তার হাতে কোনো কাজ নেই, সত্যি। কোনো চেষ্টাও কোনোদিন করেনি সে, সত্যি। আশপাশের কত মানুষ কতভাবে দাঁড়িয়ে গেল, সে কিছুই করতে পারল না। গতবার, বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এসে ঝরনা বলেছিল, বড় সম্বন্ধীর সঙ্গে ঘের করতে। সুপ্রকাশ কানে তোলেনি। শ্বশুরবাড়ির মানুষের সঙ্গে আর যা-ই হোক, ব্যবসা হয় না। তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে উপদেশ দিত বাবা। বাবা নিজেও কোনো কালে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। তারা কেউ মামাবাড়ি যেতে চাইলে মায়ের সঙ্গে পাঠিয়ে দিত। নিজে যায়নি। সেই বাপের ছেলে হয়ে সে করবে বড় সম্বন্ধীর সঙ্গে ব্যবসা। অসম্ভব। একে বউর বড় ভাই, সবকিছুতে ছড়ি ঘোরাত; তার ওপরে সুপ্রকাশ ঘেরের 'ঘ'ও বোঝে না। সুপ্রকাশ ঝরনাকে সরাসরি না করে দেয়। ততদিনে গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের বাড়িতে এসে উঠেছে। দোতলায় নিজের ভাগের অংশে এমন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে থাকতে, হাতে-পায়ে খিলধরার সঙ্গে আজকাল তার মনও কেমন মরা হয়ে থাকে। এটা সাধারণত সন্ধ্যার আগে আগে ঘটত। এখন দুপুরেও ঘটতে শুরু করেছে। ফলে, সেই মার্চ থেকে এই অক্টোবরনভেম্বরের দুপুরের আগের সকাল, সকালেই যখন রোদ লাফিয়ে লাফিয়ে চেতে ওঠে- সেই থেকেই আজকাল সুপ্রকাশের মন খারাপ হয়। প্রথম প্রথম ঝরনা বুঝত না। সুপ্রকাশকে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে বলত, মটকা মাইরে পইড়ে রইচো কী জন্যি! পরে যখন দেখা গেল, এই সবই সুপ্রকাশের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, তখন তাও বলা বাদ দিল। তারপর একদিন ঝরনা নিজেই আবিস্কার করল, মানুষ তাকেই দোষ দেবে। এই যেমন, সুপ্রকাশ নিজেতে আবিস্কার করেছে, তার মন খারাপের কারণ ঝরনা! সে কথা ঝরনাকে বললে যদি কোনো প্রতিক্রিয়াই না-হয় তাহলে, বলেইবা লাভ কী?
সুপ্রকাশের ভাইয়েরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করে। কেউ মাস্টারি, কেউ বিমা কোম্পানিতে, কেউ ব্যবসা। বড় সম্বন্ধীর সঙ্গে ঘের করতে সুপ্রকাশ রাজি না জেনে ঝরনা বলেছে, সুপ্রকাশের ছোট ভাই সুবিনয়ের সঙ্গে ঘের করতে। তখন সুবিনয় ফতেপুরে এক দাগে একটা বড় জমি পেয়েছিল ঘের করার। সুপ্রকাশ রাজি হলেই সে শুরু করতে পারত। সুপ্রকাশ রাজি হয়নি। আচ্ছা, তা নয় গেল, দোকান দেয়ার কথা উঠল যখন। সে কথাও আমলে আনেনি সুপ্রকাশ। তারপর, এই সেদিনও সুপ্রকাশের জ্ঞাতি দাদা শিবেন সাধনার মোড়ে ফোনফ্যাক্সের দোকান দেয়ার কথা বলল, সুপ্রকাশ তাও করল না। আর যা-ই করুক, ফোন-ফ্যাক্সের দোকান দেবে না সুপ্রকাশ। অথচ কিছুই করল না। তার গুমোট হয়ে বসে থাকা বাড়ল। বাড়তে বাড়তে এই দুপুরের আগে মন খারাপ হওয়ায় এসে ঠেকেছে। এইখানে একটানা বসে থাকলে কার মন ভালো থাকে। আগে টিভি দেখত। রিমোট কন্ট্রোলারে চ্যানেল ঘোরত। এখন তাও বাদ। টিভির চেয়ে বাড়ির দোতলার এই দক্ষিণের দিকটা অনেক ভালো। সময় ভালো কাটে। শুধু ঝরনা নামের ওই উৎপাতটা না থাকলেই ভালো ছিল।
সুপ্রকাশ টুনটুনি পাখিটাকে খুঁজল। আশ্চর্য! পাখিটা যেন সুপ্রকাশকে বুঝতে পারছে। এই যে, একটু আগে আসন্ন যুদ্ধ দর্শনের প্রস্তুতি নিয়ে পাখিটা পেয়ারা গাছের ডাল থেকে উড়ে এসে রান্নাঘরের কোনায় কাপিলা গাছে এসে বসেছিল। কিছুক্ষণ অনড় বসে থেকে যখন যুদ্ধের কোনো আলামত দেখল না, তখন উড়ে গেল। আবার এই মাত্র যেই পাখিটাকে খুঁজল সুপ্রকাশ, তখনই উড়ে এসে ওই পেয়ারা গাছের একদম মগডালে বসল। এই যে এইমাত্র বসেছে। একদম মগডালে, এখনই পড়বে পাখিটা। ধুস্, পাখি কখনও গাছ থেকে পড়ে। মানুষ পড়ে। মানুষ এমনি এমনিও পড়ে। মানুষের গাছে ওঠা লাগে না। কারণ, মানুষের মন আছে ...
মানুষের মন আছে বলেই মানুষ ভাবতে পারে। মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলে ভাবা যায়। যেমন সুপ্রকাশ ভাবল, আসলে ঝরনাকে বিয়ে করাই ভুল হয়েছে। সেই থেকে সে অকম্মা! কী হয়েছে ঝরনাকে বিয়ে করে? কোনো লাভ হয়নি। আগেও দিন যেভাবে যেত, এখনও তাই যায়। খালি কাজের ভিতরে কাজ একটা বেড়েছে। পকেটে পয়সা থাকলে ওই কাজেরও মানুষ জুটে যায়। শুধু আগে দিন যেমন যেত, এখন তেমন যায় না। আগে কখনও মন খারাপ হতো না, এখন হয়। কত আশা ছিল, শুধু ঝরনাকে বিয়ে করে সব আশার গুড়ে বালি।
নিজের সেই সব আশা আর ইচ্ছা নিয়ে ভাবল সুপ্রকাশ। দু-চোখ যেদিকে যায় ... ইন্ডিয়া ... পুরি, তাজমহল, বারাণসী, দার্জিলিং, বোম্বে, মাদ্রাজ, দিল্লি, কাশ্মীর থেকে মুহূর্তে রাঙামাটি, কক্সবাজার ... কোনটা কোথায় সেই ভূগোলের দরকার নেই। দু-চোখ যেদিকে যায় চলে যেত। একাএকা। দেখো, তার কিছুই ঘটল না। কিছুই না। কোথায় কোথায় থাকত। একদিন বাড়ি ফিরে আসত। ছোট্দার ঘরে উঠত। বউদি কি ভাত দিত না। তারপর একদিন আবার বের হয়ে যেত ... দু-চোখ যেদিকে যায় ... অথচ ঝরনাকে বিয়ে করে ...।
'বোঝলা?'
টুনটুনিটার দিক চেয়ে থেকে সুপ্রকাশ বলল বেশ প্রসন্ন গলায়-
'তোমারে বিয়ে কইরে আমার জীবনডা শেষ হইয়ে গেল!'
এই কথা ঝরনার কানে গেল। তবে, সুপ্রকাশের গলার মতন সে গলায় কোনো প্রসন্নতা নেই। সুপ্রকাশের গলায় স্পষ্ট ব্যঙ্গও ছিল, ঝরনা সে গলায় উত্তর দিল না। একই সঙ্গে নিজস্ব তেজ আর হতাশা মিলিয়ে সে বলল-
'ছাইড়ে দেও, চইলে যাই-'
বলেই ঝরনা ভাবল, কী বলল সে। নিজের হাতের শাঁখার দিকে তাকাল।
ওদিকে সুপ্রকাশ কথার বেশ সূত্র পেয়েছে-
'চইলে যাও- আটকাইয়ে রাহিছে কেডা?'
ঝরনা নিরুত্তর। বাইরের বাড়ন্ত আঁচ সামনের খোলা জায়গা দিয়ে ঘরে ঢুকল। টুনটুনিটা পেয়ারা গাছের মগডাল থেকে কাপিলা গাছে এসে বসল। ঝরনা রান্নাঘর থেকে এই ঘরে। অথচ সুপ্রকাশ তা বুঝেও একটুক্ষণ কিছু বলল না। তারপর গলায় আগের মতোই ওই একই ব্যঙ্গ রেখে বলল-
'যাও, চাইলে যাও- তুমি গেলি আমিও যা'তি পারি-'
'কোতায়?'
'দুই চোখ যেদিক যায়। চইলে যাব।
'খালি সিনেমা!'
ঝরনা আবার রান্নাঘরে চলে গেল। সে এসেছিল সুপ্রকাশকে দেখতে। সুপ্রকাশের বলা কথার ওজন বুঝতে। কিন্তু যখন সুপ্রকাশের গলায় ব্যঙ্গ আর কথাগুলোর গুরুত্বহীনতা বুঝতে পারল, তখন ওই এক মুহূর্তেই সুপ্রকাশের কর্মহীনতার কষ্ট আর মনমরা ভাবটা বুঝতে পেরে ঝরনা নিজের কষ্ট আর বাড়াল না। বাইরে চোখ দেয়া সুপ্রকাশ এখন তার দিকে মুখটা নাফেরানোই ভালো। সুপ্রকাশের ওই মুখ দেখতে চায় না। অথচ সুপ্রকাশ বাইরে চোখ রেখে টুনটুনিটা খুঁজল। ঝরনা চলে যেতে টুনটুনিটা আবার কাপিলা গাছ থেকে পেয়ারা গাছের মগডালে গিয়ে বসল। পড়ে যাবে তো। না, পড়বে না। পাখি পড়ে না। সুপ্রকাশ বাইরে থেকে ঘরে তাকাল। ঝরনা নেই। রান্নাঘরে চলে গেছে। অথচ, সুপ্রকাশের কথা তো শেষ হয়নি। এবার সুপ্রকাশ ব্যঙ্গের জায়গায় হতাশা যোগ করল-
'সিনেমা না। সিনেমা না। বাস্তব। আমি চইলে গেলি তোমারও লাভ আমারও লাভ। দুই জনেরই মুক্তি ... যদি যা'তি পারতাম ... দুই চোখ যেদিক যায় ...'
ঝরনা রান্নাঘর থেকে এই ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। সুপ্রকাশ দেখল, ঝরনার চোখে জল। সেই জলে সুপ্রকাশের সেই অনিশ্চিত যাত্রার অনুমোদন। সুপ্রকাশ বুঝল। কিন্তু তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখের জলে হয় না কোনো রং, কিন্তু এর শক্তি সীমাহীন। তাকানো যায় না। সুপ্রকাশ বাইরে তাকাল। সরাসরি, পেয়ারা গাছের মগডালে।
টুনটুনি পাখিটা উড়ে গেছে। ...
বাইরে অক্টোবরের রোদ ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই রোদে টানা তাকিয়ে থাকলে চোখ জ্বালা করে। সুপ্রকাশের চোখও এতক্ষণ তাকিয়ে থাকায় জ্বালা করে উঠত, কিন্তু সম্প্র্রতি এক পাশ ভেঙে প্রায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া পেয়ারা গাছটার মাথায় অনেকখানি রোদ আটকে পাশের বাড়ির পুব দিকের দেয়ালে পড়েছে। তাতে রোদের তাপ কমে গেছে; ফলে এই একদৃষ্টে থাকায় সুপ্রকাশের চোখ জ্বালা করল না। সুপ্রকাশ মন খারাপ নিয়ে পেয়ারা গাছের মাথায় আটকানো রোদ থেকে চোখ সরিয়ে রাখল পাশের বাড়ির দেয়ালে। এরপর সেখান থেকে সরিয়ে এক সারিতে লাগানো সীমানার বড় বড় কাপিলা গাছের পাতায় চেয়ে থাকল।
এই সময়ে ঝরনা রান্নাঘর থেকে এই দক্ষিণে খোলা ঘরটাতে এসেছিল। হাতে উঁচু কিনারার থালা নিয়ে সে সুপ্রকাশের উপুড় হয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা খাটের মাঝামাঝি দাঁড়ায়। সুপ্রকাশ অবশ্য বুঝেছে, ঝরনা এই রুমে ঢুকেছে, কিন্তু এখন যে সুপ্রকাশের টানা লম্বালম্বি শুয়ে থাকা শরীরে মাঝখান বরাবর ফাঁকা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে তার দৃষ্টির পথ দেখছে, তা সে বুঝে উঠতে পারেনি; এমনকি অনুমানেও আনতে পারেনি; অনুমানে আনতে পারলে নাহয় ওই ঝুঁকে একনজরে তাকানো চোখ দুটোকে তার ঘাড়সহ ডানে ঘুরিয়ে একবার, অন্তত একবারের জন্য ঝরনাকে দেখে নিত। ঝরনা ওই থালা-ধরা-হাতে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর সুপ্রকাশের পিঠের ওপর পর্যন্ত নিজের শরীর টেনে এনে সেখান থেকে সুপ্রকাশের দৃষ্টিপথ বুঝে নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু সেই পথেও যখন কিছুই মিলল না; দেখল, ওই চোখে সুপ্রকাশ বড়জোর পেয়ারা গাছের পাতাগুলোকেই দেখেছে, তখন এমন শুয়ে একটানা বাইরে চেয়েথাকার কোনো কারণ খুঁজে পেল না। তারপর নিজের জন্য ভাবল, একবার জিজ্ঞাসা করে। আবার ভাবল, না, থাকুক ওইভাবে চেয়ে। আবার ভাবল, না, এই রোদে চেয়ে থাকলে চোখ খারাপ হবে। ভাবল, না, সে কথা বলা যাবে না, চেঁচিয়ে উঠতে পারে, সকাল থেকে মনমরা। ইলিশ মাছ আর জলঝাড়া পান্তা যে মানুষটার এত প্রিয়, তাইই খেল গলা দিয়ে প্রায় কোনো স্বর বের নাকরে। আর এখন ডাকলে যদি ... এখন ডাকলে যদি ওই গলায় আটকেথাকা কথাগুলো এক স্বরে বলে ফেলে? সে কথা ঝরনা সামাল দিতে পারবে না। ঝরনা জানে। তবু ওই ভুলটা ঝরনা করল। নিজের চোখ পেয়ারা গাছের পাতা থেকে সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর সুপ্রকাশের মাথার দিকে চাইল। সুপ্রকাশ এখন সম্ভবত চোখ দুটোকে বিছানার সীমানায় শীতলপাটির লাল বর্ডার বাঁধানো কোনায় এনে আটকেছে। সেখানেই তাকিয়ে আছে। চোখ আর বিছানার তফাত মাত্র এক বিঘত। সেখানেই কিছুক্ষণের জন্য আটকেথাকা চোখজোড়া ঝরনা ফিরাল এই বলে-
'চাইয়ে কী দেহো?'
'তোমার মাথা।'
সুপ্রকাশের সরাসরি উত্তর কোনো বাঁধো-ভাব নেই। যেন ঝরনার এই প্রশ্নেরই অপেক্ষায়ই ছিল সে; অথবা, ছিল না। অথচ উত্তরে মনে হলো, ঝরনা যে এইখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তা সে এতক্ষণে টের পেয়েছে। অথবা আরও আগে যখন ঝরনা প্রথম এসে দাঁড়িয়ে ছিল, তখনই। অথবা, উত্তরটা দিল একদমই তাৎক্ষণিক। এই মুহূর্তে, মন খারাপ নিয়ে সুপ্রকাশ এমন উত্তরই দেয়, দিয়েছে, দিয়ে আসছে, গত কিছুদিন। ফলে, সুপ্রকাশের অমন কাঁটা উত্তরের কোনো মানে খুঁজল না ঝরনা। খাটের পাশ থেকে একটু সরে এসে নিজে কিছু বলার বদলে একটুক্ষণ সুপ্রকাশের মাথা দেখল। এই সময়ে সুপ্রকাশ ঘাড় ঘুরিয়ে ঝরনাকে একপলকের জন্য দেখেছে। দেখে নিয়েছে তার এই উত্তরে ঝরনার প্রতিক্রিয়া কী? ঝরনার ফর্সা লম্বাটে মুখখানায় কোনো প্রতিক্রিয়া নেই দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ সামনে আনে। তারপর সেখান থেকে দৃষ্টি ওই পেয়ারা গাছের ডালে রাখে। একটা টুনটুনি পাখি একটু আগে একদম ওপরের দিকে ডালে বসেছিল, তখন সুপ্রকাশ ঘাড় ঘুরিয়ে ঝরনাকে দেখেছে। তারপর এইমাত্র আবার পেয়ারা গাছে তাকিয়ে পাখিটাকে দেখে না। এতে সুপ্রকাশের ওই মন খারাপে আরএকটু প্রলেপ পড়ল (যেন)! তখন সুপ্রকাশ আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে ঝরনার দাঁড়িয়েথাকা দেখে। তাতে ঝরনার মুখটাকে হঠাৎ উসকে দেয়া হলো। ঝরনা সুপ্রকাশের উত্তরের জবাব দিল-
'আমার মাথা বিছানে? না, ওই পেয়ারা গাছে?'
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। হলেও সে উত্তর জানাও নেই সুপ্রকাশের। তাছাড়া, যে ঝাঁজে তার কাছে নিজের মাথার খোঁজ জানতে চাইল, সেই ঝাঁজের তালে তাল রেখে এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতন উত্তর জানাও নেই সুপ্রকাশের। ফলে, সুপ্রকাশের উত্তর দেয়া হলো না। সে চুপ করে গেল। চোখ দুটো আবার সামনের পেয়ারা গাছে রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকল কিছুক্ষণ; যদিও কান খাড়াই রেখেছিল, ঝরনা কখন সরে রান্নাঘরে যায় তা বুঝে নিতে চাইছিল। অথচ ঝরনা বেশ খানিকক্ষণ সরল না। একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু এই দাঁড়িয়ে থাকায়ও যখন সুপ্রকাশের গলা দিয়ে স্বর বের হলো না, তখন যেন অনেককিছু তার খোয়া গেল ভিতরে গুমরানো এমন গজরানিতে একটু রাগ হয়ে সুপ্রকাশকে শুনিয়ে আনমনে বলতে বলতে চলে গেল-
'খালি ফাও কতা! তোমার মাথা মনে হয় ঠিক নেই। ডাক্তার দেহাও, আর নয় এইরম করলি আমি পাগল হইয়ে যাব ...'
'তুমি পাগল হবা, না?'
সুপ্রকাশ ঝরনার চলে যাওয়া শরীরের পেছনকে শোনাল-
'তুমি পাগল হবা না ... তোমার মতন মানুষ পাগল হ'লি বাকি মানুষ কী কইরে বাঁইচে থাকপে। আর হ'লি তো-'
'আর হ'লি?'
'হ'লি পাবনা থুইয়ে আসপো। এহোন পাবনায় ডাইরেক্ট বাস যায়।'
'এহোনই থুইয়ে আসো। পাগল আর হওয়া লাগবে না। আমিও বাঁইচে যাই। তোমার মতন মানষির সাতে সংসার করার চাইয়ে পাবনায় পাগলের সাতে থাহা অনেক ভালো-'
'তা'লি যাও- আমার থুইয়ে আসার দরকার কী?'
'একলা গেলি মানষি কবে চইলে গেইচে। তুমি থুইয়ে আসলি তো তা ক'তি পারবে না-'
'ওঃ, তা'লি মানষির কতার ভয় পাও। সে ভয় তোমার আছে?'
এই বলে সুপ্রকাশ বুঝল, একটু বেফাঁস কথাই বলা হয়ে গেছে। এখনই প্রতিক্রিয়া মিলবে। কলেজে নুরুল ইসলাম স্যার নিউটনের গতিতত্ত্ব পড়ানোর সময় কথাটা খুব বলতেন, প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। দেয়ালে বল মারো, ফিরে আসবে। কিন্তু বল ফিরল না। নিউটন ভুল প্রমাণিত হলো। মুহূর্তেই। তাহলে নিম্নচাপ। কিছুক্ষণের ভিতরেই প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে। সুপ্রকাশ সেই অপেক্ষায়ই থাকল। কিন্তু অপেক্ষা জল হলো, ঝরনা এলো না। রান্নাঘর থেকে প্রায় কোনো শব্দই ভেসে এলো না আর।
তবে, সুপ্রকাশ আর ঝরনার এই কথা কাটাকাটিতে সুপ্রকাশের লাভ হলো। তার মন ভালো হয়ে গেল। যেন ঝরনাকে এই কথাগুলো বলতে নাপারায় তার মন এতক্ষণ খারাপ ছিল। যেন সেখান থেকে এতক্ষণে বোঝা নেমে গেছে। আর যেন সে, সেই জন্য উঠে বসে হিসাব করতে পারছে কেন তার মন খারপ ছিল। এ সময়ে বসা থেকে একপলকে বাইরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে পেয়ারা গাছে তাকাল সে। এখন টুনটুনি পাখিটা আবার পেয়ারা গাছে এসে বসেছে। লাফাতে লাফাতে মগডালে পৌঁছেছে। আরএকটা ছোট্ট লাফ দিলেই পাখিটা সেখান থেকে নিচে পড়ে যাবে। সুপ্রকাশ পাখিটার নিচে পড়া দেখার অপেক্ষায় গাছের মগডালে চোখ দিয়ে থাকল। কিন্তু পাখিটা আর লাফ দিল না, সেখানেই স্থির। তারপরই সুপ্রকাশের মনে হলো, পাখিটা ওইখানে আর একটা কেন, দশটা লাফ দিলেইবা কী? পাখি কি কখনও গাছ থেকে পড়ে?
আচ্ছা, পাখি কখনও গাছ থেকে পড়ে?
না। পড়ে না।
আচ্ছা, পাখির কখনও মন খারাপ হয়?
না। হয় না।
আচ্ছা, পাখির যদি কখনও মন খারাপ হয়?
হয় না।
যদি হয়?
কেন হবে?
হয় না। পাখির কখনও মন খারাপ হয় না।
তাহলে?
পাখির মন নেই।
টুনটুনিটা পেয়ারা গাছ থেকে উড়ে কাপিলা গাছে গিয়ে বসল। বসে থাকল, স্থির আর অনড়। সাধারণত যা ঘটে না। সুপ্রকাশের আবার মন খারাপ হলো।
২
এইবারের মন খারাপের হিসাব সুপ্রকাশ মিলিয়ে ফেলল। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে, একবার চোখ বড় করে রান্নাঘরের দিকে চেয়ে ঝরনাকে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু সেখানেও খুন্তি-চামচের নাড়ানাড়ি নেই, এতে ওই হিসাব মিলিয়ে নেয়া তার জন্য সোজাই হলো। এখন হিসাব কাউকে বললে, সে যাই বলুক অথবা যাই বলত- সেই বলার সঙ্গে সুপ্রকাশের হিসাব এদিক-ওদিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুপ্রকাশ তা যাচাই করত, নিজের হিসাবের সঙ্গে যুক্তি দিয়ে তর্ক করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করত। শুধু ঝরনাকে কথাটা বললে সে বলবে-
এ আর নতুন কী? এত জানাই ছিল।
বাইরের রোদে চোখ আসলেই একটু জ্বলছে। ভাদ্রআশ্বিনের রোদে একটানা চেয়ে থাকলে চোখ জ্বলে। কে বলেছিল? মনে নেই। বৈশাখের রোদে চেয়ে থাকলে, চোখে তাপ লাগে। এপ্রিলমেতে কলেজে যেত গগলস্ পরে। এখন সেই কলেজেপরা গগলস্ খুঁজে দেখবে নাকি কোথায় আছে। তাহলে টুনটুনির দিকে একটানা তাকিয়ে থাকা যেত। চোখ জ্বলত না। তারপর ওই গগলস্পরা চোখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে ঝরনার উদ্দেশ্যে বলা যেত-
'আমার মন কেন খারাপ, তুমি জানো?'
ঝরনা পয়লা হয়তো শুনতই না, আরও বার দুয়েক বললে তারপর বলত-
'না, জানি না।'
তখন সুপ্রকাশ বাইরে তাকিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস টেনে যেন এক আসন্ন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তৈরি এমন গলায়, ধীর ধীরে জানাত-
'তুমি।'
এইটুকু বলতে এতক্ষণের প্রস্তুতি। আর বলার পরে যেন চারধার সুনসান, টুনটুনিটা আসন্ন যুদ্ধের দর্শকের প্রস্তুতি নিয়ে ওই দক্ষিণে খোলা বারান্দার সবচেয়ে কাছের কাপিলা গাছটায় এসে বসেছে। অথচ, এই যুদ্ধ হলো না। ঝরনা দ্রুতই, গলার স্বর নিচের খাদে রেখে জানাল-
'এ তো জানাই ছিল।'
তাহলে ঝরনার জানা ছিল, সুপ্রকাশই জানত না। তাহলে আর জেনে লাভ নেই। সুপ্রকাশ ঝরনাকে কিছু বলল না। একটানা বাইরে তাকিয়ে থাকল, আগের মতো। যদিও তখন তার কানে ওই যুদ্ধের প্রস্তুতিতে শোনা ঝরনার কথা। যেন ঝরনা তার পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া বাধানোর জন্য বলেই চলেছে যে- মানুষের কোনো কাজ নেই, বাপের গোলার ধান ভাঙায় আর খায়, টাউনে বাপের দালানে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুইলে বইসে বঙ্গোপসাগরের বাতাস খায়, সের তো মন খারাপের কারণ বাইর করা লাগে ... আর কোনো তা না পা'লি শেষে কবে বউর জন্যি মোন খারাপ। অকম্মা মানষির মোন খারাপ হ'তি কারণ লাগে? ...
ঝরনার কথা আরও দীর্ঘ হয়ে কানে বাজতে থাকে একটানা। কিন্তু এই সবই তো অনুমান। ঝরনা তো মুখে কিছু বলছে না। বলুক, আজকে ছাড়ব না।
ঝরনা কিছু বলল না।
তবে ঝরনার ওই নাবলা, অথচ সুপ্রকাশের কানে বাজতে থাকা কথাগুলোই একটানা বাইরে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করল। তার হাতে কোনো কাজ নেই, সত্যি। কোনো চেষ্টাও কোনোদিন করেনি সে, সত্যি। আশপাশের কত মানুষ কতভাবে দাঁড়িয়ে গেল, সে কিছুই করতে পারল না। গতবার, বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এসে ঝরনা বলেছিল, বড় সম্বন্ধীর সঙ্গে ঘের করতে। সুপ্রকাশ কানে তোলেনি। শ্বশুরবাড়ির মানুষের সঙ্গে আর যা-ই হোক, ব্যবসা হয় না। তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে উপদেশ দিত বাবা। বাবা নিজেও কোনো কালে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। তারা কেউ মামাবাড়ি যেতে চাইলে মায়ের সঙ্গে পাঠিয়ে দিত। নিজে যায়নি। সেই বাপের ছেলে হয়ে সে করবে বড় সম্বন্ধীর সঙ্গে ব্যবসা। অসম্ভব। একে বউর বড় ভাই, সবকিছুতে ছড়ি ঘোরাত; তার ওপরে সুপ্রকাশ ঘেরের 'ঘ'ও বোঝে না। সুপ্রকাশ ঝরনাকে সরাসরি না করে দেয়। ততদিনে গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের বাড়িতে এসে উঠেছে। দোতলায় নিজের ভাগের অংশে এমন হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে থাকতে, হাতে-পায়ে খিলধরার সঙ্গে আজকাল তার মনও কেমন মরা হয়ে থাকে। এটা সাধারণত সন্ধ্যার আগে আগে ঘটত। এখন দুপুরেও ঘটতে শুরু করেছে। ফলে, সেই মার্চ থেকে এই অক্টোবরনভেম্বরের দুপুরের আগের সকাল, সকালেই যখন রোদ লাফিয়ে লাফিয়ে চেতে ওঠে- সেই থেকেই আজকাল সুপ্রকাশের মন খারাপ হয়। প্রথম প্রথম ঝরনা বুঝত না। সুপ্রকাশকে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে বলত, মটকা মাইরে পইড়ে রইচো কী জন্যি! পরে যখন দেখা গেল, এই সবই সুপ্রকাশের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, তখন তাও বলা বাদ দিল। তারপর একদিন ঝরনা নিজেই আবিস্কার করল, মানুষ তাকেই দোষ দেবে। এই যেমন, সুপ্রকাশ নিজেতে আবিস্কার করেছে, তার মন খারাপের কারণ ঝরনা! সে কথা ঝরনাকে বললে যদি কোনো প্রতিক্রিয়াই না-হয় তাহলে, বলেইবা লাভ কী?
সুপ্রকাশের ভাইয়েরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু করে। কেউ মাস্টারি, কেউ বিমা কোম্পানিতে, কেউ ব্যবসা। বড় সম্বন্ধীর সঙ্গে ঘের করতে সুপ্রকাশ রাজি না জেনে ঝরনা বলেছে, সুপ্রকাশের ছোট ভাই সুবিনয়ের সঙ্গে ঘের করতে। তখন সুবিনয় ফতেপুরে এক দাগে একটা বড় জমি পেয়েছিল ঘের করার। সুপ্রকাশ রাজি হলেই সে শুরু করতে পারত। সুপ্রকাশ রাজি হয়নি। আচ্ছা, তা নয় গেল, দোকান দেয়ার কথা উঠল যখন। সে কথাও আমলে আনেনি সুপ্রকাশ। তারপর, এই সেদিনও সুপ্রকাশের জ্ঞাতি দাদা শিবেন সাধনার মোড়ে ফোনফ্যাক্সের দোকান দেয়ার কথা বলল, সুপ্রকাশ তাও করল না। আর যা-ই করুক, ফোন-ফ্যাক্সের দোকান দেবে না সুপ্রকাশ। অথচ কিছুই করল না। তার গুমোট হয়ে বসে থাকা বাড়ল। বাড়তে বাড়তে এই দুপুরের আগে মন খারাপ হওয়ায় এসে ঠেকেছে। এইখানে একটানা বসে থাকলে কার মন ভালো থাকে। আগে টিভি দেখত। রিমোট কন্ট্রোলারে চ্যানেল ঘোরত। এখন তাও বাদ। টিভির চেয়ে বাড়ির দোতলার এই দক্ষিণের দিকটা অনেক ভালো। সময় ভালো কাটে। শুধু ঝরনা নামের ওই উৎপাতটা না থাকলেই ভালো ছিল।
সুপ্রকাশ টুনটুনি পাখিটাকে খুঁজল। আশ্চর্য! পাখিটা যেন সুপ্রকাশকে বুঝতে পারছে। এই যে, একটু আগে আসন্ন যুদ্ধ দর্শনের প্রস্তুতি নিয়ে পাখিটা পেয়ারা গাছের ডাল থেকে উড়ে এসে রান্নাঘরের কোনায় কাপিলা গাছে এসে বসেছিল। কিছুক্ষণ অনড় বসে থেকে যখন যুদ্ধের কোনো আলামত দেখল না, তখন উড়ে গেল। আবার এই মাত্র যেই পাখিটাকে খুঁজল সুপ্রকাশ, তখনই উড়ে এসে ওই পেয়ারা গাছের একদম মগডালে বসল। এই যে এইমাত্র বসেছে। একদম মগডালে, এখনই পড়বে পাখিটা। ধুস্, পাখি কখনও গাছ থেকে পড়ে। মানুষ পড়ে। মানুষ এমনি এমনিও পড়ে। মানুষের গাছে ওঠা লাগে না। কারণ, মানুষের মন আছে ...
মানুষের মন আছে বলেই মানুষ ভাবতে পারে। মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলে ভাবা যায়। যেমন সুপ্রকাশ ভাবল, আসলে ঝরনাকে বিয়ে করাই ভুল হয়েছে। সেই থেকে সে অকম্মা! কী হয়েছে ঝরনাকে বিয়ে করে? কোনো লাভ হয়নি। আগেও দিন যেভাবে যেত, এখনও তাই যায়। খালি কাজের ভিতরে কাজ একটা বেড়েছে। পকেটে পয়সা থাকলে ওই কাজেরও মানুষ জুটে যায়। শুধু আগে দিন যেমন যেত, এখন তেমন যায় না। আগে কখনও মন খারাপ হতো না, এখন হয়। কত আশা ছিল, শুধু ঝরনাকে বিয়ে করে সব আশার গুড়ে বালি।
নিজের সেই সব আশা আর ইচ্ছা নিয়ে ভাবল সুপ্রকাশ। দু-চোখ যেদিকে যায় ... ইন্ডিয়া ... পুরি, তাজমহল, বারাণসী, দার্জিলিং, বোম্বে, মাদ্রাজ, দিল্লি, কাশ্মীর থেকে মুহূর্তে রাঙামাটি, কক্সবাজার ... কোনটা কোথায় সেই ভূগোলের দরকার নেই। দু-চোখ যেদিকে যায় চলে যেত। একাএকা। দেখো, তার কিছুই ঘটল না। কিছুই না। কোথায় কোথায় থাকত। একদিন বাড়ি ফিরে আসত। ছোট্দার ঘরে উঠত। বউদি কি ভাত দিত না। তারপর একদিন আবার বের হয়ে যেত ... দু-চোখ যেদিকে যায় ... অথচ ঝরনাকে বিয়ে করে ...।
'বোঝলা?'
টুনটুনিটার দিক চেয়ে থেকে সুপ্রকাশ বলল বেশ প্রসন্ন গলায়-
'তোমারে বিয়ে কইরে আমার জীবনডা শেষ হইয়ে গেল!'
এই কথা ঝরনার কানে গেল। তবে, সুপ্রকাশের গলার মতন সে গলায় কোনো প্রসন্নতা নেই। সুপ্রকাশের গলায় স্পষ্ট ব্যঙ্গও ছিল, ঝরনা সে গলায় উত্তর দিল না। একই সঙ্গে নিজস্ব তেজ আর হতাশা মিলিয়ে সে বলল-
'ছাইড়ে দেও, চইলে যাই-'
বলেই ঝরনা ভাবল, কী বলল সে। নিজের হাতের শাঁখার দিকে তাকাল।
ওদিকে সুপ্রকাশ কথার বেশ সূত্র পেয়েছে-
'চইলে যাও- আটকাইয়ে রাহিছে কেডা?'
ঝরনা নিরুত্তর। বাইরের বাড়ন্ত আঁচ সামনের খোলা জায়গা দিয়ে ঘরে ঢুকল। টুনটুনিটা পেয়ারা গাছের মগডাল থেকে কাপিলা গাছে এসে বসল। ঝরনা রান্নাঘর থেকে এই ঘরে। অথচ সুপ্রকাশ তা বুঝেও একটুক্ষণ কিছু বলল না। তারপর গলায় আগের মতোই ওই একই ব্যঙ্গ রেখে বলল-
'যাও, চাইলে যাও- তুমি গেলি আমিও যা'তি পারি-'
'কোতায়?'
'দুই চোখ যেদিক যায়। চইলে যাব।
'খালি সিনেমা!'
ঝরনা আবার রান্নাঘরে চলে গেল। সে এসেছিল সুপ্রকাশকে দেখতে। সুপ্রকাশের বলা কথার ওজন বুঝতে। কিন্তু যখন সুপ্রকাশের গলায় ব্যঙ্গ আর কথাগুলোর গুরুত্বহীনতা বুঝতে পারল, তখন ওই এক মুহূর্তেই সুপ্রকাশের কর্মহীনতার কষ্ট আর মনমরা ভাবটা বুঝতে পেরে ঝরনা নিজের কষ্ট আর বাড়াল না। বাইরে চোখ দেয়া সুপ্রকাশ এখন তার দিকে মুখটা নাফেরানোই ভালো। সুপ্রকাশের ওই মুখ দেখতে চায় না। অথচ সুপ্রকাশ বাইরে চোখ রেখে টুনটুনিটা খুঁজল। ঝরনা চলে যেতে টুনটুনিটা আবার কাপিলা গাছ থেকে পেয়ারা গাছের মগডালে গিয়ে বসল। পড়ে যাবে তো। না, পড়বে না। পাখি পড়ে না। সুপ্রকাশ বাইরে থেকে ঘরে তাকাল। ঝরনা নেই। রান্নাঘরে চলে গেছে। অথচ, সুপ্রকাশের কথা তো শেষ হয়নি। এবার সুপ্রকাশ ব্যঙ্গের জায়গায় হতাশা যোগ করল-
'সিনেমা না। সিনেমা না। বাস্তব। আমি চইলে গেলি তোমারও লাভ আমারও লাভ। দুই জনেরই মুক্তি ... যদি যা'তি পারতাম ... দুই চোখ যেদিক যায় ...'
ঝরনা রান্নাঘর থেকে এই ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। সুপ্রকাশ দেখল, ঝরনার চোখে জল। সেই জলে সুপ্রকাশের সেই অনিশ্চিত যাত্রার অনুমোদন। সুপ্রকাশ বুঝল। কিন্তু তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখের জলে হয় না কোনো রং, কিন্তু এর শক্তি সীমাহীন। তাকানো যায় না। সুপ্রকাশ বাইরে তাকাল। সরাসরি, পেয়ারা গাছের মগডালে।
টুনটুনি পাখিটা উড়ে গেছে। ...
মন্তব্য করুন