
যেন মাথা থেকে আকাশটা সরে গেল, চারপাশে আর কোনো বুনো গন্ধ রইল না। একাকী হয়ে গেলাম শেষমেশ। যেখানটায় এসেছি, প্রকৃতি তার হাড়আত্মা বেহিসাবি বিছিয়ে দিয়েছে।
এই প্রযুক্তির বাড়াবাড়ির যুগে এমন জায়গাও এ দেশে থাকতে পারে, না এলে বিশ্বাস হতো না।
আসতে আসতে বুকে হু হু শূন্যতার ঢেউ খেলে যাচ্ছিল, কিন্তু জায়গাটায় এসে, চারপাশটাসহ নিজের থাকার ছিমছাম জায়গাটা দেখে আত্মায় আনন্দের কলরোল উঠল।
কিছুক্ষণ উচ্চমাত্রায় বেজেই তা নিজ স্বভাবে মিইয়ে এল।
আমার এই এক রোগ।
বেশিরভাগ সময় মুখে নানারকম বিষয় কমবেশি ঝুলিয়ে রেখে ভেতরটা টানা আপসেট থাকে। এর মাঝে সার সার ভাবনা অ্যালোভেরার মতো পিছল চমক জল বেয়ে থিকথিক করে আসতে থাকে, যেতে থাকে, আচমকা আমাকে না জানিয়েই সমস্ত সত্তাকে শিরশিরে বোধ দিয়ে কোনো একটা ভাবনা আমাকে আনন্দিত করে।
তখন অবসাদে নেয়ে থাকা আমার মধ্যে জীবনের রস সঞ্চারিত হয়, আমি পিঠটান দিয়ে দাঁড়াব কি দাঁড়াব না, সেই ভাবনার নেগেটিভ দিক এসে মস্ত কালো ছাতা দিয়ে আমূল আমাকে শুইয়ে ঢেকে দেয়।
এই যে আমার হাতে লাগামহীন এই ভালোমন্দ থাকার চক্কর, আমি আর পারি না। আমার হাঁপ ধরে যায়।
তুমি তাহলে যাবেই ঠিক করেছ?
সেতুর কণ্ঠে কী বোঝা যায় না, ভদ্রতা করছে আমার সঙ্গে? আমি তো স্পষ্ট জানিই আমার যাওয়া-আসায় ওর কিচ্ছু যায় আসে না। তবুও আমার প্রাণের কাঠামো কেন এক্কেবারে ওত পেতে এখনও ওর মনের মধ্যে এক সময়কার তরঙ্গ রস খোঁজে?
কথা বলছ না কেন?
আমার কণ্ঠ কেন এমন শুকিয়ে আসছে? কেন তুমুল চাইছে স্পৃহা, ও এমন একটা কিছু বলুক যাতে আমাকে কোথাও যেতে না হয়।
কী শুনতে চাইছ তুমি? গুছিয়ে রাখা ব্যাগ নাড়াচাড়া করি, জানই তো যাচ্ছি, বিশ্বাস তো কেউ করছিল না, এবার তো রীতিমতো মাইক ঘোষণায় সবাইকে জানিয়েছি, তারপরও প্রশ্ন কেন?
আমার প্রাণহীন অবয়ব কোন দূর সীমানায় ইথারে ইথারে ভেসে যেতে থাকে বুঝি না।
কী সব উল্টি খায়, কীসব পাল্টি বুঝি না।
অথচ একসময় কত তর্কই না করেছি বন্ধুদের সঙ্গে, পুণ্যির সঙ্গেও। বলেছি, কারও মন যদি অন্যদিকে চলে যায়, তাকে পেতে কী করে আরেকজন মরিয়া হতে পারে?
কত দেখছি চারপাশে, পুরুষ-নারী ভেদে, কী কাঙাল হয়েই না মনছুট মানুষটাকে পেতে মরিয়া হয়। কেউ কেউ পায়ও।
তারপর কীভাবে একসঙ্গে তারা জীবন কাটায়?
এ আমার কল্পনার বাইরে।
ছি পর্যন্তও উচ্চারণ করেছি।
অথচ এখন আমি কী করছি?
চারপাশের ঘন প্রকৃতি আমূল ডুবিয়ে চুবিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।
আমার অন্যমনস্ক চোখের কোনো খিড়কির কোণ দিয়ে বৃষ্টির ফলা ভেদ করে কী দেখে কী ভাবনায় যে নিমগ্ন, এখন আমি তার আগামাথা পাই না। পলায়নপর বাতাসের ধাই ধাই নৃত্য, চারপাশে বজ্রপাত শব্দের কুণ্ডলী, যাযাবর পাখিদের আত্মগোপন জলছিটার উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বাসে আমাকে জাগ্রত করতে একসময় পারেও।
যেন সংবিৎ ফিরে আমার, মা আমূল ভিজে গেছি যে!
ত্রস্ত হাতে জানালা বন্ধ করায় তৎপর হই।
সব বিন্যস্ত করে সালোয়ার-কামিজ বদলাতে গিয়ে খামোখাই নিজের মধ্যে মৌজ তৈরির চেষ্টায় দাঁতে দাঁতে টক্কর দিই।
পরক্ষণে বিষণ্ণতার বিকট হাঙ্গর আমার কলজে সাপটে ধরে।
আজ গেছিলাম কলেজে, ক্লাসে।
ছাত্র, সহকর্মীদের মধ্যে ঢুকে ভিন্ন এক আবহ পেয়েছি, এ ভেবে কী মজাই না নিজের মধ্যে তৈরি করে ছুটেছি। তক্কে তক্কে থেকেছি, বৈরী বাতাস যেন ব্যাপারটা উল্টে না দেয়।
সব বদলে জবুথবু কুনো ব্যাঙ হয়ে বসে থাকি, নিজের পুরো ভার নিজের ওপর দিয়ে।
এই এত্ত অবাধ সুন্দর প্রকৃতি, অপরিচিত মানুষ, আমি একাকী কী করে কাটাব প্রহর এইখানে?
আমার তো মিনিটই কাটে না,
ঘণ্টা-দিন মাসের বেশি ভাবতে গেলেই আত্মার ঢেঁকিতে কষে পা দেয় কেউ।
মানুষ পালায়, জায়গা ছেড়ে দেশ ছেড়ে।
এ তো কমন কথাই নিজেকে নিয়েই তো পালায়, একি পালানো হয়? বরং যা থেকে পালানো, একা পেয়ে তা মস্ত করে হূৎপিণ্ডের ওপর চেপে বসে। নিজে যখন একাকী, সেই স্মৃতি সেই ছবি চারপাশ মুখর করে উড়তে থাকে, কঠিন কোরাসে সমস্ত অবয়বকে চুবিয়ে নাজেহাল করতে থাকে। তক্ষুনি বুকের ভয়টা ডিগবাজি খেয়ে আমার আত্মা কামড়ে বসে রইল।
এখানে একদিন সবাই আপন হবে, সময়, অপেক্ষা করো। সময়ের চাইতে ভালো বন্ধু কেউ নেই, সে-ই সব ঠিক করে দেবে।
মাথার চন্দ্রবিন্দুতে স্টম্ফটিকবিন্দু ঝোলে।
ওপরদিকে চোখ তুলে প্রাণান্ত চেষ্টায়ও তাকে দেখতে পাই না। আমি সময়ের এই শক্তির সত্য ব্যাপারটা জানি। কিন্তু সে যে এখন আমার কাছে রংধনুর মতো। আমি তার দেখা, নাগাল, হদিস কিচ্ছু পাই না।
কে পার করিয়ে দেবে এই সময়টাকে?
কী তুমুল প্রেমই না ছিল সেতুর সঙ্গে। দিন-রাত দু'জন মোবাইল চ্যাটিং ... দেখা সান্নিধ্য শরীর পর্যন্ত যাওয়া হয়েছে।
আমরা দু'জন কেউই পুরোপরি শরীরটা চাইনি। কিন্তু ওর বন্ধুর ফ্ল্যাটটায় একদিন বাঁধ ভেঙে গেল। পিঠেপিঠি ছোটবোন সহোদরা পুণ্যির কাছে এসব নুন জলভাত। তার টাইট পোশাক, উপচানো স্তন প্রগাঢ় করার অ্যাটিচুট- এর কিছু আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্তের সঙ্গে যায় না।
বলতও সেতু, মেয়েদের জিন্সের টাইট প্যান্ট তক্ষুনি পরা উচিত, যখন গাড়ি থাকে।
রিকশায় এসব দুর ছাই লাগে।
আমার সঙ্গে সেতুর পুরোটা হয়ে গেলে আমি যখন তুমুল জলস্রোতা, গ্লানি আক্রান্ত, পুণ্যিকে শেয়ার না করে পারলাম না একটা অশরীরী ভয় থেকে, যদি পেটে এসে যায়, কী ব্যবস্থা নিতে পারি ...।
প্রান্তর কাঁপিয়ে হেসেছিল পুণ্যি। তোমরা দু'জন একা একটি ফ্ল্যাট শেয়ার করছ, কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে, আম্মু, দাদির যুগে পড়ে আছ দেখছি?
এরপর এমন গম্ভীর আর অচেনা হয়ে গেল, সহসা আমি দিকভ্রান্তহীন হয়ে পড়লাম।
দীর্ঘলয়ে নিশ্চুপ থাকে।
আমি অস্থির কাতর হয়ে ঝাঁকাতে থাকি তাকে, আমার ব্যাপারটা মানতে পারছিস না? অথচ তুই ...।
অথচ তুই মানে? ফণা তোলে পুণ্যি, তোমার তোমাদের আমাকে নিয়ে এই ভাবনাটাই গা জ্বালিয়ে দেয়। কিছু আধুনিক পোশাক পরি বলে তোমরা ধরেই নাও, আমরা ছেলেদের সঙ্গে বেডে জলভাত? আশ্চর্য!
আমার যেন তুমুল একটা জীবনের শিক্ষা হয়। আত্মার চরকায় বিশুদ্ধতা ঢেলে ঢেলে ওর কাছে ক্ষমা চাই। আমাকে গাইয়া বলে যে মেয়েটার ভ্রুকুটি ছিল আমার দিকে, নতজানু হয়ে বসি তার নিচে, এই মেয়েটি বিয়েবহির্ভূত কোনো কাণ্ড করেনি।
কিন্তু পুণ্যি তর্ক করার সময় যে মেয়েদের সতীত্ব নিয়ে যে ন্যাকামির তার চৌদ্দটা বাজিয়ে দেয়?
মানুষ সত্যিই রহস্যময়।
সেই পুরোনো ছবিতে যা দেখায়, আধুনিক মা-চাচিরা যা শেয়ার করে, বিয়ের আগে একবার শরীরে গেলে, যতই ছেলেটি বলুক দু'দিন পর আমরা স্বামী-স্ত্রী হচ্ছিই, তার পরেও কোথায় যেন দাগ লেগে যায়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছেলেরা ক'দিন পর এসব মেয়েকে মানতে পারে না। সরে যায়।
আগের কথাটি সত্যি, কোথাও যেন একটা জট লেগে যায় আমার মধ্যে কিন্তু এ কারণে সেতু সরে যাবে, বা অন্য কেউ সরতে পারে, সে অবস্থাটা অনেকটা পাল্টেছে। এ ক্ষেত্রে দু'জনের সমঝোতাটাই ব্যাপক এক অর্থ ধারণ করে।
সেতু তো এরপর আরও বেশি রোমান্টিক হয়ে গেল, আরও বেশি ভালোবাসতে থাকল আমাকে। কিন্তু মুশকিল একটাই, ওই ফ্ল্যাটে যেতে তুমুল পীড়াপীড়ি করে।
মাংসের ঘ্রাণ পেয়ে গেছে নাকি?
অন্তরাত্মায় এ বাক্য লাফ দিতেই আমি মুখ চেপে ধরি, অবুঝ অজস্র ধারাস্রোতে নিজেকে চাইলেও ভাসিয়ে দিই না।
তবে একবার বাঁধ ভেঙে গেলে ...।
যতটা বাধা ছিল শরীর সম্পর্ক একেবারেই না হওয়ার আগে, পরে তার আঁকশি ঢিলা হয়ে যায়।
রাতে বিছানায় একাকী ছটফট করি।
ওই নিয়ন্ত্রণহীনতাটাই আমার ভুল ছিল।
কোনো আমল বদলায়নি, শুধু ওই কারণে সেতু আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
অবুঝের মতো কাঁদতে থাকি।
এ কোথায় এলাম? সেখানে তার স্মৃতি, তার পরিবেশ সব দেখে আমার কষ্ট হবে ভেবে কাঁধে করে সেতু নামের মস্ত এক হাতি দেখি অস্তিত্বে নিয়ে এসেছি। এর ভারে না পারি চলতে, না ক্লাস করতে না ঘুমাতে। আমি আমাকে নিয়ে কোথায় যাব?
বিছানা থেকে উঠে রাতের জানালা খুলে দিই।
অদ্ভুত একটা ফাল্কগ্দুন মাস চলছে, পুরো যেন শীতকাল। চারপাশ আঁধারে তলিয়ে ধৈর্যহীন আষাঢ় ছুটে এসে ফাল্কগ্দুনের গলা জড়িয়ে কী কান্নাটাই না কাঁদছে! তার এ চোখের জলে আমাদের হিম কাঁপিয়ে জল স্থল অন্তরীক্ষ কী সীমাহীনতার মধ্য দিয়েই না ভেসে যাচ্ছে। এখানে নয়, নগরেও এমন চলছে।
কম্বলটা ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে আঁধার প্রকৃতির মিশমিশে কালোর রহস্য দেখি।
যেন তিতিরের কুহু ...
কানের মধ্যে সাঁই করে কে যেন গেয়ে উঠল আর কারণ ছাড়া আমার সত্তায় এমন এক মধুরিমার স্রোত বয়ে গেল ... আমূল জড়িয়ে ধরতাম যখন সেতুকে, আমার কানে ঠোঁট নিয়ে গাইলে এমন সুর হতো।
আমি জানি এই ধ্বংসের দায় ভাগে আমরা দু'জন সমান অংশীদার। অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে। আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার।
সব সফেদ স্টম্ফুলিঙ্গের মতো উড়ে উড়ে আসছে ... আমার এই নির্জন কক্ষটি হয়ে গেছে সেই ফ্ল্যাট আমাদের দু'জনের শরীর শীৎকারে ভূস্বর্গ নেমেছে। কী পেখনাটাই করেছে সেতু, এই মেয়ে হলে কী নাম রাখবে? যেন ফুলশয্যা, হানিমুন ... যেন ... সেই কঠিন বরফ বিষাদটা আমার কলজে কবজা করে করে বেদনার জলস্রোত তৈরি করে।
পরদিন ভিজে মফস্বলের শহরতলির পথ ধরে হেঁটে হেঁটে রাস্তা পার হতে গিয়ে শান্তনু সাহেবকে দেখি, বলেন-
আরে! রাজধানী থেকে এসে দেখি গরুর গাড়ির নিচে পড়বেন?
আমার কলেজের লেকচারার।
সেও বদলি হয়ে এসেছে। দেখতে ভালোই, স্মার্ট কিন্তু আমার সত্তার কোনো তন্ত্রীতেই এর এক কণা স্পর্শ লাগে না। আমার কেবলই মনে হয় জীবনের কোনো সময়ই আমার অস্তিত্বের কোনো কণা থেকে সেতুর এক বিন্দুও মুছতে দেবে না।
শান্তনু সাহেবের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে ক্যাম্পাসে ঢুকতে গিয়ে জানা হয় তিনিও বিয়ে করেননি এখনও। তার মানে সব দিক থেকেই আমার জন্য জুতসই।
কিচ্ছু স্পর্শ করে না।
এত সুন্দর গান সেতুর, এত সুন্দর আবৃত্তি ... পৃথিবীর আর কেউ এমন অবয়ব কীভাবে ধারণ করে? কলজের মধ্যে যেন কোনো কারণ ছাড়াই আচমকা স্মৃতির অগ্নিশলাকা ঢুকে যায়, চোখে ভাসে দৃশ্য, সেই ফ্ল্যাট থেকে পুণ্যির গলায় হাত রেখে সেতু বেরিয়ে এসেছিল উন্মত্তভাবে হাসতে হাসতে।
আমি এই জীবনে সেতুর এমন নিজেকে ছেড়ে দেওয়া উড়ালিয়া রূপ আর দেখিনি।
এরপর পুণ্যির স্থিত অটুট বাক্য, তারা দু'জনই দু'জনকে ভালোবাসে। কারও মন কাউকে ছেড়ে অন্যদিকে ধাবিত হলে এতে দোষের কিছু দেখে না তারা।
মনের ওপর মানুষের কোনো হাত থাকে নাকি? আমি আছড়ে পড়ি, তাই বলে বিশ্বাস কমিটমেন্ট এসব কিচ্ছু না?
এসব জাগতিক বিষয়কে কেন্দ্র করে হয়।
এইসব কথার সাতপাকে বিবশ বোধ করি, আরও অতলের আড্ডায় পড়তে থাকি, শুনি তারা আমাকে 'মান্দাতা' 'খ্যাত' আখ্যায়িত করছে।
মূক-বধিরের ন্যায় নিজেকে হেঁচড়ে চলতে থাকি। আমি আর মনুষ্য পর্যায়ে নেই, পথ দিয়ে আমি নই একটা আস্ত বিষাদ চলে ফিরে, বিছানায় এক স্তব্ধ রাত এমনই চেতনার ঘুলঘুলিতে যখন প্রখর বিষণ্ণ প্রস্তর গড়াচ্ছিল, আমি অনুভব করি, যেন ধোঁয়া উড়ছে।
প্রায়ই ধোঁয়াটা ওড়ে। হৃদয় কষটে কচলে, হাতড়ে হাতড়ে আবিস্কার করি, আমি আসলে পুণ্যির কাছে পরাজয়টা মানতে পারছি না। আর সেতু পুণ্যির প্রতি নাকউঁচা ভাব দেখিয়ে এখন সম্পর্ক এমন জায়গায় গেছে যে দু'জন বিয়ে পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পেরেছে।
মানা যায় না।
তারপরও আমি কুঁকড়ে উঠি, কেন আমার আত্মা বারবার ভিখিরির মতো চায় পুণ্যিকে ছুড়ে ফেলে সেতু যদি আমার কাছে ফিরে আসত?
ছি নিজের ব্যক্তিত্বের এই নিম্নদশাকে ধিক্কার দিই। বিবশতার বেড়াজাল সরিয়ে নিজেকে দাঁড় করানোর আপ্রাণ চেষ্টায় বারবারই অধ্যবসায়ী মাকড়সার মতো আছড়ে পড়ি। এইভাবে ছায়াচ্ছন্ন প্রকৃতিতে, উদাস বাতাস বৃক্ষদের বল্ক্কল আর পত্রসম্ভারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুনো ঘ্রাণ টেনে আচমকা আত্মাটা শান্তনু সম্বন্ধে দাঁড়াতে চায়, আমার প্রতি আকৃষ্ট শান্তনু সাহেবের দিকে হাতটা দিই না বাড়িয়ে, সেতু দেখুক, আমি পারি ...
তক্ষুনি মোবাইলে ফোন, যেন তিতিরের শিস, সেতুকে লাত্থি দিয়ে পুণ্যি অন্য ছেলের ঘাড়ে হাত রেখেছে।
মুহূর্তে আমার সমস্ত অস্তিত্বের আগুন নিভে যায়। দেহ ভারী করে রাখা মস্ত হাতিটা মুহূর্তে খুদে এক ছারপোকা হয়ে আমার অগ্রাহ্যময় চক্ষুযুগলের ওপর ফরফর করতে থাকে। আর আমি নিজের প্রেমেই নিজে পড়ে মাতালের মতো ভাসতে থাকি।
এই প্রযুক্তির বাড়াবাড়ির যুগে এমন জায়গাও এ দেশে থাকতে পারে, না এলে বিশ্বাস হতো না।
আসতে আসতে বুকে হু হু শূন্যতার ঢেউ খেলে যাচ্ছিল, কিন্তু জায়গাটায় এসে, চারপাশটাসহ নিজের থাকার ছিমছাম জায়গাটা দেখে আত্মায় আনন্দের কলরোল উঠল।
কিছুক্ষণ উচ্চমাত্রায় বেজেই তা নিজ স্বভাবে মিইয়ে এল।
আমার এই এক রোগ।
বেশিরভাগ সময় মুখে নানারকম বিষয় কমবেশি ঝুলিয়ে রেখে ভেতরটা টানা আপসেট থাকে। এর মাঝে সার সার ভাবনা অ্যালোভেরার মতো পিছল চমক জল বেয়ে থিকথিক করে আসতে থাকে, যেতে থাকে, আচমকা আমাকে না জানিয়েই সমস্ত সত্তাকে শিরশিরে বোধ দিয়ে কোনো একটা ভাবনা আমাকে আনন্দিত করে।
তখন অবসাদে নেয়ে থাকা আমার মধ্যে জীবনের রস সঞ্চারিত হয়, আমি পিঠটান দিয়ে দাঁড়াব কি দাঁড়াব না, সেই ভাবনার নেগেটিভ দিক এসে মস্ত কালো ছাতা দিয়ে আমূল আমাকে শুইয়ে ঢেকে দেয়।
এই যে আমার হাতে লাগামহীন এই ভালোমন্দ থাকার চক্কর, আমি আর পারি না। আমার হাঁপ ধরে যায়।
তুমি তাহলে যাবেই ঠিক করেছ?
সেতুর কণ্ঠে কী বোঝা যায় না, ভদ্রতা করছে আমার সঙ্গে? আমি তো স্পষ্ট জানিই আমার যাওয়া-আসায় ওর কিচ্ছু যায় আসে না। তবুও আমার প্রাণের কাঠামো কেন এক্কেবারে ওত পেতে এখনও ওর মনের মধ্যে এক সময়কার তরঙ্গ রস খোঁজে?
কথা বলছ না কেন?
আমার কণ্ঠ কেন এমন শুকিয়ে আসছে? কেন তুমুল চাইছে স্পৃহা, ও এমন একটা কিছু বলুক যাতে আমাকে কোথাও যেতে না হয়।
কী শুনতে চাইছ তুমি? গুছিয়ে রাখা ব্যাগ নাড়াচাড়া করি, জানই তো যাচ্ছি, বিশ্বাস তো কেউ করছিল না, এবার তো রীতিমতো মাইক ঘোষণায় সবাইকে জানিয়েছি, তারপরও প্রশ্ন কেন?
আমার প্রাণহীন অবয়ব কোন দূর সীমানায় ইথারে ইথারে ভেসে যেতে থাকে বুঝি না।
কী সব উল্টি খায়, কীসব পাল্টি বুঝি না।
অথচ একসময় কত তর্কই না করেছি বন্ধুদের সঙ্গে, পুণ্যির সঙ্গেও। বলেছি, কারও মন যদি অন্যদিকে চলে যায়, তাকে পেতে কী করে আরেকজন মরিয়া হতে পারে?
কত দেখছি চারপাশে, পুরুষ-নারী ভেদে, কী কাঙাল হয়েই না মনছুট মানুষটাকে পেতে মরিয়া হয়। কেউ কেউ পায়ও।
তারপর কীভাবে একসঙ্গে তারা জীবন কাটায়?
এ আমার কল্পনার বাইরে।
ছি পর্যন্তও উচ্চারণ করেছি।
অথচ এখন আমি কী করছি?
চারপাশের ঘন প্রকৃতি আমূল ডুবিয়ে চুবিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।
আমার অন্যমনস্ক চোখের কোনো খিড়কির কোণ দিয়ে বৃষ্টির ফলা ভেদ করে কী দেখে কী ভাবনায় যে নিমগ্ন, এখন আমি তার আগামাথা পাই না। পলায়নপর বাতাসের ধাই ধাই নৃত্য, চারপাশে বজ্রপাত শব্দের কুণ্ডলী, যাযাবর পাখিদের আত্মগোপন জলছিটার উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বাসে আমাকে জাগ্রত করতে একসময় পারেও।
যেন সংবিৎ ফিরে আমার, মা আমূল ভিজে গেছি যে!
ত্রস্ত হাতে জানালা বন্ধ করায় তৎপর হই।
সব বিন্যস্ত করে সালোয়ার-কামিজ বদলাতে গিয়ে খামোখাই নিজের মধ্যে মৌজ তৈরির চেষ্টায় দাঁতে দাঁতে টক্কর দিই।
পরক্ষণে বিষণ্ণতার বিকট হাঙ্গর আমার কলজে সাপটে ধরে।
আজ গেছিলাম কলেজে, ক্লাসে।
ছাত্র, সহকর্মীদের মধ্যে ঢুকে ভিন্ন এক আবহ পেয়েছি, এ ভেবে কী মজাই না নিজের মধ্যে তৈরি করে ছুটেছি। তক্কে তক্কে থেকেছি, বৈরী বাতাস যেন ব্যাপারটা উল্টে না দেয়।
সব বদলে জবুথবু কুনো ব্যাঙ হয়ে বসে থাকি, নিজের পুরো ভার নিজের ওপর দিয়ে।
এই এত্ত অবাধ সুন্দর প্রকৃতি, অপরিচিত মানুষ, আমি একাকী কী করে কাটাব প্রহর এইখানে?
আমার তো মিনিটই কাটে না,
ঘণ্টা-দিন মাসের বেশি ভাবতে গেলেই আত্মার ঢেঁকিতে কষে পা দেয় কেউ।
মানুষ পালায়, জায়গা ছেড়ে দেশ ছেড়ে।
এ তো কমন কথাই নিজেকে নিয়েই তো পালায়, একি পালানো হয়? বরং যা থেকে পালানো, একা পেয়ে তা মস্ত করে হূৎপিণ্ডের ওপর চেপে বসে। নিজে যখন একাকী, সেই স্মৃতি সেই ছবি চারপাশ মুখর করে উড়তে থাকে, কঠিন কোরাসে সমস্ত অবয়বকে চুবিয়ে নাজেহাল করতে থাকে। তক্ষুনি বুকের ভয়টা ডিগবাজি খেয়ে আমার আত্মা কামড়ে বসে রইল।
এখানে একদিন সবাই আপন হবে, সময়, অপেক্ষা করো। সময়ের চাইতে ভালো বন্ধু কেউ নেই, সে-ই সব ঠিক করে দেবে।
মাথার চন্দ্রবিন্দুতে স্টম্ফটিকবিন্দু ঝোলে।
ওপরদিকে চোখ তুলে প্রাণান্ত চেষ্টায়ও তাকে দেখতে পাই না। আমি সময়ের এই শক্তির সত্য ব্যাপারটা জানি। কিন্তু সে যে এখন আমার কাছে রংধনুর মতো। আমি তার দেখা, নাগাল, হদিস কিচ্ছু পাই না।
কে পার করিয়ে দেবে এই সময়টাকে?
কী তুমুল প্রেমই না ছিল সেতুর সঙ্গে। দিন-রাত দু'জন মোবাইল চ্যাটিং ... দেখা সান্নিধ্য শরীর পর্যন্ত যাওয়া হয়েছে।
আমরা দু'জন কেউই পুরোপরি শরীরটা চাইনি। কিন্তু ওর বন্ধুর ফ্ল্যাটটায় একদিন বাঁধ ভেঙে গেল। পিঠেপিঠি ছোটবোন সহোদরা পুণ্যির কাছে এসব নুন জলভাত। তার টাইট পোশাক, উপচানো স্তন প্রগাঢ় করার অ্যাটিচুট- এর কিছু আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্তের সঙ্গে যায় না।
বলতও সেতু, মেয়েদের জিন্সের টাইট প্যান্ট তক্ষুনি পরা উচিত, যখন গাড়ি থাকে।
রিকশায় এসব দুর ছাই লাগে।
আমার সঙ্গে সেতুর পুরোটা হয়ে গেলে আমি যখন তুমুল জলস্রোতা, গ্লানি আক্রান্ত, পুণ্যিকে শেয়ার না করে পারলাম না একটা অশরীরী ভয় থেকে, যদি পেটে এসে যায়, কী ব্যবস্থা নিতে পারি ...।
প্রান্তর কাঁপিয়ে হেসেছিল পুণ্যি। তোমরা দু'জন একা একটি ফ্ল্যাট শেয়ার করছ, কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে, আম্মু, দাদির যুগে পড়ে আছ দেখছি?
এরপর এমন গম্ভীর আর অচেনা হয়ে গেল, সহসা আমি দিকভ্রান্তহীন হয়ে পড়লাম।
দীর্ঘলয়ে নিশ্চুপ থাকে।
আমি অস্থির কাতর হয়ে ঝাঁকাতে থাকি তাকে, আমার ব্যাপারটা মানতে পারছিস না? অথচ তুই ...।
অথচ তুই মানে? ফণা তোলে পুণ্যি, তোমার তোমাদের আমাকে নিয়ে এই ভাবনাটাই গা জ্বালিয়ে দেয়। কিছু আধুনিক পোশাক পরি বলে তোমরা ধরেই নাও, আমরা ছেলেদের সঙ্গে বেডে জলভাত? আশ্চর্য!
আমার যেন তুমুল একটা জীবনের শিক্ষা হয়। আত্মার চরকায় বিশুদ্ধতা ঢেলে ঢেলে ওর কাছে ক্ষমা চাই। আমাকে গাইয়া বলে যে মেয়েটার ভ্রুকুটি ছিল আমার দিকে, নতজানু হয়ে বসি তার নিচে, এই মেয়েটি বিয়েবহির্ভূত কোনো কাণ্ড করেনি।
কিন্তু পুণ্যি তর্ক করার সময় যে মেয়েদের সতীত্ব নিয়ে যে ন্যাকামির তার চৌদ্দটা বাজিয়ে দেয়?
মানুষ সত্যিই রহস্যময়।
সেই পুরোনো ছবিতে যা দেখায়, আধুনিক মা-চাচিরা যা শেয়ার করে, বিয়ের আগে একবার শরীরে গেলে, যতই ছেলেটি বলুক দু'দিন পর আমরা স্বামী-স্ত্রী হচ্ছিই, তার পরেও কোথায় যেন দাগ লেগে যায়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছেলেরা ক'দিন পর এসব মেয়েকে মানতে পারে না। সরে যায়।
আগের কথাটি সত্যি, কোথাও যেন একটা জট লেগে যায় আমার মধ্যে কিন্তু এ কারণে সেতু সরে যাবে, বা অন্য কেউ সরতে পারে, সে অবস্থাটা অনেকটা পাল্টেছে। এ ক্ষেত্রে দু'জনের সমঝোতাটাই ব্যাপক এক অর্থ ধারণ করে।
সেতু তো এরপর আরও বেশি রোমান্টিক হয়ে গেল, আরও বেশি ভালোবাসতে থাকল আমাকে। কিন্তু মুশকিল একটাই, ওই ফ্ল্যাটে যেতে তুমুল পীড়াপীড়ি করে।
মাংসের ঘ্রাণ পেয়ে গেছে নাকি?
অন্তরাত্মায় এ বাক্য লাফ দিতেই আমি মুখ চেপে ধরি, অবুঝ অজস্র ধারাস্রোতে নিজেকে চাইলেও ভাসিয়ে দিই না।
তবে একবার বাঁধ ভেঙে গেলে ...।
যতটা বাধা ছিল শরীর সম্পর্ক একেবারেই না হওয়ার আগে, পরে তার আঁকশি ঢিলা হয়ে যায়।
রাতে বিছানায় একাকী ছটফট করি।
ওই নিয়ন্ত্রণহীনতাটাই আমার ভুল ছিল।
কোনো আমল বদলায়নি, শুধু ওই কারণে সেতু আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
অবুঝের মতো কাঁদতে থাকি।
এ কোথায় এলাম? সেখানে তার স্মৃতি, তার পরিবেশ সব দেখে আমার কষ্ট হবে ভেবে কাঁধে করে সেতু নামের মস্ত এক হাতি দেখি অস্তিত্বে নিয়ে এসেছি। এর ভারে না পারি চলতে, না ক্লাস করতে না ঘুমাতে। আমি আমাকে নিয়ে কোথায় যাব?
বিছানা থেকে উঠে রাতের জানালা খুলে দিই।
অদ্ভুত একটা ফাল্কগ্দুন মাস চলছে, পুরো যেন শীতকাল। চারপাশ আঁধারে তলিয়ে ধৈর্যহীন আষাঢ় ছুটে এসে ফাল্কগ্দুনের গলা জড়িয়ে কী কান্নাটাই না কাঁদছে! তার এ চোখের জলে আমাদের হিম কাঁপিয়ে জল স্থল অন্তরীক্ষ কী সীমাহীনতার মধ্য দিয়েই না ভেসে যাচ্ছে। এখানে নয়, নগরেও এমন চলছে।
কম্বলটা ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে আঁধার প্রকৃতির মিশমিশে কালোর রহস্য দেখি।
যেন তিতিরের কুহু ...
কানের মধ্যে সাঁই করে কে যেন গেয়ে উঠল আর কারণ ছাড়া আমার সত্তায় এমন এক মধুরিমার স্রোত বয়ে গেল ... আমূল জড়িয়ে ধরতাম যখন সেতুকে, আমার কানে ঠোঁট নিয়ে গাইলে এমন সুর হতো।
আমি জানি এই ধ্বংসের দায় ভাগে আমরা দু'জন সমান অংশীদার। অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে। আমাদের পরে দেনা শোধবার ভার।
সব সফেদ স্টম্ফুলিঙ্গের মতো উড়ে উড়ে আসছে ... আমার এই নির্জন কক্ষটি হয়ে গেছে সেই ফ্ল্যাট আমাদের দু'জনের শরীর শীৎকারে ভূস্বর্গ নেমেছে। কী পেখনাটাই করেছে সেতু, এই মেয়ে হলে কী নাম রাখবে? যেন ফুলশয্যা, হানিমুন ... যেন ... সেই কঠিন বরফ বিষাদটা আমার কলজে কবজা করে করে বেদনার জলস্রোত তৈরি করে।
পরদিন ভিজে মফস্বলের শহরতলির পথ ধরে হেঁটে হেঁটে রাস্তা পার হতে গিয়ে শান্তনু সাহেবকে দেখি, বলেন-
আরে! রাজধানী থেকে এসে দেখি গরুর গাড়ির নিচে পড়বেন?
আমার কলেজের লেকচারার।
সেও বদলি হয়ে এসেছে। দেখতে ভালোই, স্মার্ট কিন্তু আমার সত্তার কোনো তন্ত্রীতেই এর এক কণা স্পর্শ লাগে না। আমার কেবলই মনে হয় জীবনের কোনো সময়ই আমার অস্তিত্বের কোনো কণা থেকে সেতুর এক বিন্দুও মুছতে দেবে না।
শান্তনু সাহেবের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে ক্যাম্পাসে ঢুকতে গিয়ে জানা হয় তিনিও বিয়ে করেননি এখনও। তার মানে সব দিক থেকেই আমার জন্য জুতসই।
কিচ্ছু স্পর্শ করে না।
এত সুন্দর গান সেতুর, এত সুন্দর আবৃত্তি ... পৃথিবীর আর কেউ এমন অবয়ব কীভাবে ধারণ করে? কলজের মধ্যে যেন কোনো কারণ ছাড়াই আচমকা স্মৃতির অগ্নিশলাকা ঢুকে যায়, চোখে ভাসে দৃশ্য, সেই ফ্ল্যাট থেকে পুণ্যির গলায় হাত রেখে সেতু বেরিয়ে এসেছিল উন্মত্তভাবে হাসতে হাসতে।
আমি এই জীবনে সেতুর এমন নিজেকে ছেড়ে দেওয়া উড়ালিয়া রূপ আর দেখিনি।
এরপর পুণ্যির স্থিত অটুট বাক্য, তারা দু'জনই দু'জনকে ভালোবাসে। কারও মন কাউকে ছেড়ে অন্যদিকে ধাবিত হলে এতে দোষের কিছু দেখে না তারা।
মনের ওপর মানুষের কোনো হাত থাকে নাকি? আমি আছড়ে পড়ি, তাই বলে বিশ্বাস কমিটমেন্ট এসব কিচ্ছু না?
এসব জাগতিক বিষয়কে কেন্দ্র করে হয়।
এইসব কথার সাতপাকে বিবশ বোধ করি, আরও অতলের আড্ডায় পড়তে থাকি, শুনি তারা আমাকে 'মান্দাতা' 'খ্যাত' আখ্যায়িত করছে।
মূক-বধিরের ন্যায় নিজেকে হেঁচড়ে চলতে থাকি। আমি আর মনুষ্য পর্যায়ে নেই, পথ দিয়ে আমি নই একটা আস্ত বিষাদ চলে ফিরে, বিছানায় এক স্তব্ধ রাত এমনই চেতনার ঘুলঘুলিতে যখন প্রখর বিষণ্ণ প্রস্তর গড়াচ্ছিল, আমি অনুভব করি, যেন ধোঁয়া উড়ছে।
প্রায়ই ধোঁয়াটা ওড়ে। হৃদয় কষটে কচলে, হাতড়ে হাতড়ে আবিস্কার করি, আমি আসলে পুণ্যির কাছে পরাজয়টা মানতে পারছি না। আর সেতু পুণ্যির প্রতি নাকউঁচা ভাব দেখিয়ে এখন সম্পর্ক এমন জায়গায় গেছে যে দু'জন বিয়ে পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পেরেছে।
মানা যায় না।
তারপরও আমি কুঁকড়ে উঠি, কেন আমার আত্মা বারবার ভিখিরির মতো চায় পুণ্যিকে ছুড়ে ফেলে সেতু যদি আমার কাছে ফিরে আসত?
ছি নিজের ব্যক্তিত্বের এই নিম্নদশাকে ধিক্কার দিই। বিবশতার বেড়াজাল সরিয়ে নিজেকে দাঁড় করানোর আপ্রাণ চেষ্টায় বারবারই অধ্যবসায়ী মাকড়সার মতো আছড়ে পড়ি। এইভাবে ছায়াচ্ছন্ন প্রকৃতিতে, উদাস বাতাস বৃক্ষদের বল্ক্কল আর পত্রসম্ভারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুনো ঘ্রাণ টেনে আচমকা আত্মাটা শান্তনু সম্বন্ধে দাঁড়াতে চায়, আমার প্রতি আকৃষ্ট শান্তনু সাহেবের দিকে হাতটা দিই না বাড়িয়ে, সেতু দেখুক, আমি পারি ...
তক্ষুনি মোবাইলে ফোন, যেন তিতিরের শিস, সেতুকে লাত্থি দিয়ে পুণ্যি অন্য ছেলের ঘাড়ে হাত রেখেছে।
মুহূর্তে আমার সমস্ত অস্তিত্বের আগুন নিভে যায়। দেহ ভারী করে রাখা মস্ত হাতিটা মুহূর্তে খুদে এক ছারপোকা হয়ে আমার অগ্রাহ্যময় চক্ষুযুগলের ওপর ফরফর করতে থাকে। আর আমি নিজের প্রেমেই নিজে পড়ে মাতালের মতো ভাসতে থাকি।
মন্তব্য করুন