![শওকত আলী [১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬-২৫ জানুয়ারি ২০১৮]](https://samakal.com/uploads/2023/02/online/photos/Untitled-32-samakal-63e538ce1a84e.jpg)
শওকত আলী [১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬-২৫ জানুয়ারি ২০১৮]
শওকত আলী বাংলা কথাসাহিত্যে শক্তিমান ও বিরলপ্রজ ঔপন্যাসিক। ষাটের দশকে বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে প্রবেশ করে তিনি প্রচলিত সাহিত্যাদর্শের সমান্তরাল ধারায়, বিষয়ে যেমন নিয়ে আসেন অভিনবত্ব, কলাকৌশলে নিয়ে আসেন বৈচিত্র্যময় ধারা। কথাসাহিত্যের বহমান ধারায় অঙ্গীভূত থেকে, অগ্রজদের সাহিত্যকর্মের নির্যাস আহরণ করে, সমকালীনদের মধ্য থেকেও শওকত আলী নির্মাণ করেন আপন শিল্পভুবন। সাতচল্লিশপূর্ব ব্র্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাল, ষাটের দশকের নব্য ঔপনিবেশিকের শোষণ-পীড়ন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালি জীবন, '৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বিশ শতকের প্রযুক্তি যুগসহ দীর্ঘ পাঁচ দশকের বাঙালি জীবন তাঁর উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে স্বতন্ত্র মনন ও মেজাজে। তিনি সূক্ষ্ণভাবে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং আন্তরিক অথচ নির্মোহ দৃষ্টিতে উপন্যাসের মানব-মানবীকে সৃজন করেন।
সময় ও সমাজ বাস্তবতার নিরিখে বাঙালি জীবনের প্রদোষকাল থেকে আধুনিককাল পরিসরের বাঙালির যাপিত জীবন, বেঁচে থাকার লড়াই, রাজপ্রশাসনের শোষণ-পীড়ন, কৃষিজীবী তৃণমূল মানুষের অধিকার, নাগরিক জীবনের বিকলাঙ্গতা এবং গ্রামীণ জীবনের অভাজনের জীবনমথিত কান্না বিশ্বস্ততায় চিত্রিত হয়েছে তাঁর উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাস শিল্পের মধ্যে প্রদোষে প্রাকৃতজন জাতিসত্তার পরিচয় জ্ঞাপক ধ্রুপদি ধারার উপন্যাস। এটি বাংলা ভাষার অনন্য দলিল পরিগণিত। উপন্যাসটিতে প্রদোষকালের ব্রাত্যজীবনের আলেখ্য চিত্রায়ণের সমান্তরালে ঐতিহ্যপ্রীতি সফলভাবে চিত্রিত হয়েছে। এই ঐতিহ্যপ্রীতির চিত্রায়ণ করতে গিয়ে শওকত আলী উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে নির্বাচন করেছেন প্রদোষকালের বাংলায় তুর্কি আক্রমণের প্রাক্কাল।
প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের কাহিনি-কৌশলের দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ দেবিপীঠে ব্রাত্যমূর্তি নির্মাণ করায় গুরু বসুদেবের গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে উজুবটে শুকদেবের বাড়িতে আশ্রয় পায় এবং মায়াবতী ও লীলাবতীর সাক্ষাৎ সূত্রে প্রথম দর্শনেই লীলাবতীর সঙ্গে প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়ে। মায়াবতীর অনুরোধক্রমে বসন্ত দাসকে খোঁজার সূত্রে নবগ্রাম হাটে এলে হলে শ্যামাঙ্গ রাজা হরি সেনের সৈন্যের হাতে সর্বস্ব হারিয়ে কুসুম্বীগ্রামে এক কুম্ভকারের ঘরে আশ্রয় পায়। এদিকে উজুবটে বসন্ত দাস আগমন করে এবং রাজা হরি সেনের প্রজাপীড়ন থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বন্ধু ভিক্ষু মিত্রানন্দের সন্ধান করতে থাকে। অপরদিকে যবনদের আক্রমণ, সামন্ত ও মহাসামন্ত শোষণ ও প্রজাপীড়নের ঘটনা জনৈক যোগীর কাছে শ্যামাঙ্গ জানতে পেরে শুকদেবের বাড়িতে হাজির হয়। ইতোমধ্যে রাজা হরি সেনের সৈন্যরা শুকদেব ও লীলাবতীদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিলে প্রাণ রক্ষার্থে শ্যামাঙ্গ লীলাবতীকে নিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করে। বসন্ত দাস মিত্রানন্দকে পুনর্ভবার পশ্চিমতীরে সন্ধান করতে গিয়ে বিচিত্র পথ মাড়িয়ে ছায়াবতীর মন্দিরে গিয়ে হাজির হয় এবং মিত্রানন্দের সঙ্গে দেখা হলে মিত্রতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর আসন্ন সন্তানের কারণে স্বগৃহে ফিরে আসে। ওদিকে শ্যামাঙ্গ ও লীলাবতী শিলনাথের বাড়ি থেকে মাতুল সিদ্ধপার আদেশে পালাতে থাকলে ডাকাতদের কবলে পড়ে। পরে তাকে যবনকেন্দ্রে আনা হয়। লীলাবতী প্রাণ রক্ষার্থে যবন ধর্ম গ্রহণ করলেও শ্যামাঙ্গ উত্তরাধিকারে পাওয়া রক্তের ঋণ বিস্মৃত হতে পারে না, যবন ধর্ম গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। অবশেষে শ্যামাঙ্গ সামন্ত হরি সেনের সৈন্য অভিমন্যু দাসের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়।
উপন্যাসের এই ঘটনাক্রমের সমান্তরালে জনমানুষের পলায়নপরতা, রাজশোষণ, প্রজাপীড়ন, ব্রাত্যজীবনধারার চালচিত্র প্রভৃতি ঘটনা কাহিনির অনুষঙ্গ হয়েছে। ঔপন্যাসিক প্রদোষকালের মানুষের প্রাণ রক্ষার্থে পলায়নপরতার সঙ্গে সামন্ত-মহাসামন্ত শোষণ, পীড়ন, বিলাস, রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা, শ্রেণিভেদ, ভিক্ষুদের পতিত জীবনযাপন, যবনদের আক্রমণ ও বাণিজ্য, ব্রাত্য-শূদ্রশ্রেণির মূক জীবনযাপন ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ছবি এঁকেছেন।
উপন্যাসের কাহিনি-সূত্র অনুসন্ধান-কৌশলে দেখা যায়, শওকত আলী যখন সাহিত্যাঙ্গনে আবির্ভূত হন, তখন স্বৈরাচার আইয়ুব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। স্বৈরশাসক মানুষের শুধু বাকস্বাধীনতা হরণ করেনি, মানুষের শিল্পচর্চায় বিধিনিষেধও আরোপ করে। ক্রমশ মুক্তিযুদ্ধে উপনীত হয় দেশের মানুষ। যুদ্ধে ঘরছাড়া মানুষসহ যুদ্ধের বিচিত্র ঘটনাবলী লেখকের যাপিত জীবনে রেখাপাত করে। সমকাল দ্বারা শওকত আলী সংক্ষুব্ধ হন। এই সংক্ষুব্ধতা তাঁকে শিল্প নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছে। সমকালের ঘটনার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন দ্বাদশ শতকের বাংলায় রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনামলে। ফলে কাহিনি-কৌশলে সমকাল থেকেই রসদ খুঁজে নিয়েছিলেন।
এ উপন্যাসের কাহিনির উপাদান ইতিহাস থেকে নেওয়া। কিন্তু প্রধান চরিত্রগুলো ঔপন্যাসিকের সৃজিত। রাজা সামন্ত হরি সেন, শক্তিবর্মণ, সোমজিৎ উপধ্যায়গণের ঐতিহাসিক মূল্য থাকলে উপন্যাসে তাদের শারীরিক উপস্থিতি নেই। প্রধান-অপ্রধান মিলে অনেক চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে এ উপন্যাসে। প্রধান চরিত্রের মধ্যে শ্যামাঙ্গ, বসন্ত দাস, মায়াবতী, লীলাবতী আর অপ্রধান চরিত্রের মধ্যে যোগমায়া, দীনদাশ, শুকদেব, ছায়াবতী, সোমজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণা, বিভাবতী, মিত্রানন্দ ও মাধব আচার্য।
এ উপন্যাসের নায়ক চরিত্র সৃজনকৌশলে দেখা যায়, লেখকের সমকালীন অবরুদ্ধ পরিবেশ ও মূক সময়ের চিত্রায়ণ ঘটেছে। স্বৈরাচার আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তথাকথিত 'মৌলিক গণতন্ত্রী' প্রণয়ন করে, বাঙালির সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রতাপ প্রদর্শন করে- রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধসহ 'সাহিত্য সংঘ' গঠন করে প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে দিয়ে ইসলামী ভাবাদর্শ ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার অভিপ্রায়ে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে রক্তাক্ত প্রান্তর নাটক লিখিয়ে নেয়। এই যে শিল্পচর্চায় বাধানিষেধ আরোপ তা মূলত শিল্পীর স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করার শামিল। সামাজিক কমিটমেন্ট নিয়েই শওকত আলীর সাহিত্যাঙ্গনে আবির্ভাব। এ কারণে আইয়ুব সরকারের বাঙালির শিল্পচর্চা ও ঐতিহ্য হরণের একানায়কতান্ত্রিক মানসিকতায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। শিল্পের অপমান লেখকের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। 'কালে কালে শিল্পীরা কি এভাবেই নিগৃহীত, নির্যাতিত হয়?' অতঃপর লেখক শিল্পের শিকড় সন্ধানে প্রলুব্ধ হন এবং সমকাল থেকে আটশত বছর পূর্বে প্রাকৃতজনের প্রদোষকালে ফিরে গিয়ে রাজনৈতিক আবহে শ্যামাঙ্গ নামক মৃৎশিল্পীর জীবনকে নির্বাচন করেন। তাকে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে নিজ শিল্প-অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। শ্যামাঙ্গ শোষিত নির্যাতিত ব্রাত্যজনের প্রতিভূ। কাল থেকে কালান্তরের বোধ ও চেতনা প্রতীক। ঔপন্যাসিক তাকে বোধে ও দ্রোহে প্রকৃত শিল্পীরূপে নির্মাণ করেন। প্রকৃত শিক্ষার প্রশ্নে শ্যামাঙ্গ আপসহীন, এমনকি গুরুকে পরিত্যাগ করতেও তার গ্লানি নেই। তার প্রমাণ পাই, শ্যামাঙ্গ গুরু বসুদেবকে যখন কোনোক্রমেই আর বোঝাতে পারে না, তখন সে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে গুরুকে কটুবাক্য শোনায় :
'গুরুদেব, আপনি যদি সত্যি সত্যিই আমাকে পরিত্যাগ করে থাকেন, তাহলে শুনে রাখুন, আমিও আপনাকে পরিত্যাগ করলাম- শুধু আপনাকে নয়, আপনার প্রদত্ত শিক্ষাকেও' (প্রদোষে প্রাকৃতজন :পৃষ্ঠা ১৫)
সাহিত্যগবেষক অনেকেই মনে করেন প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর ভাষা তুর্কি আগমনের সময়কালের। অবশ্য লেখকের মন্তব্যও তাই। সংস্কৃতবহুল ও সমাসবদ্ধ শব্দ প্রয়োগে এ উপন্যাসের যে বাক্য গঠনপ্রণালি তাতে ভাষা বিদগ্ধ ধ্রুপদি ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রাবন্ধিক মনে হয়। সর্বোজ্ঞ লেখক পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতেই পারেন। তবে এ উপন্যাসের ভাষা লক্ষ্মণ সেনের আমলের বলে অনেক গবেষক মনে করলেও মূলত তা বিদ্যাসাগরীয় যুগের বলে মনে হয়। কেননা, আমরা জানি গদ্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিদ্যাসাগরীয় গদ্যে যে সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতা প্রতিভাত, তাই রূপান্বিত প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর গদ্যে। আবার গদ্যের উৎপত্তির বিকাশ টানলে আমরা দেখতে পাই ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে গদ্যের সূচনা হলেও এর প্রথম সূচনা ধরা হয় ১৫৫৫ সালে কুচবিহারের রাজা নরনারায়ণের চিঠিতে। প্রথম গদ্যের নমুনা পাওয়ার সাল ১৫৫৫ ধরা হলে দ্বাদশ শতকের বাংলায় লিখিত কোনো গদ্য ছিল না। যদি না থাকে তবে প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর গদ্য দ্বাদশ শতকের নয়, অর্থাৎ প্রদোষের কাহিনির সমকালীন নয় বা তা লক্ষ্মণ সেনের আমলের নয়। তখন বাংলা গদ্যের উৎপত্তিই হয়নি। এই উপন্যাসের গদ্য বিদ্যাসাগরীয় রীতির গদ্য। যেমন :
আলুলায়িত কেশভার, বিস্র্রস্তবাস আর ঐ প্রকার অবরুদ্ধ হাহাকার। শ্যামাঙ্গ লীলাকে বক্ষলগ্ন করে। পৃষ্ঠে হাত রাখে, সীমান্তে চুম্বন করে। যতবার করে, ততবার হাহাকার উদ্বেল হয়, রোদন উচ্ছ্বসিত হয়, ক্ষোভ তীব্রতর হয়। এবং ঐ তীব্র, ক্ষুব্ধ এবং হাহাকারময় আবেগের মধ্যেই, অত্যন্ত গভীর তলদেশে, ছিল ভিন্ন, অনির্বচনীয়, একটি আনন্দ স্রোতের প্রবাহ। (প্রদোষে প্রাকৃতজন :পৃষ্ঠা ১৫৮)
ভাষা ব্যবহারে কিছু অসংগতি নজরে আসে। আমরা জানি মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ গুরু বসুদেবের গৃহে মূর্তি নির্মাণ ব্যতীত অন্য কোনো বিদ্যাভ্যাস করেনি এবং তার শিক্ষা লাভের কোনো বার্তা ঔপন্যাসিক আমাদের জানান না। আমরা দেখেছি ঔপন্যাসিক এ উপন্যাসে প্রদোষকালের প্রাকৃতজনের জীবন ও তাদের সংগ্রামকে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। প্রাকৃতজনরা মূলত বাঙালির প্রদোষকালের কথা বলে। প্রাকৃতজন বা ব্রাত্য জনগোষ্ঠী একান্তই নিম্ন শ্রেণি-উদ্ভূত। তাদের ভাষাও হওয়ার কথা আঞ্চলিক। বিশেষ করে তাদের মুখে নিঃসৃত কথামালা। কিন্তু ঔপন্যাসিক তাদের মুখে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা মান বা প্রমিত ভাষায় রূপান্তরিত। আমরা জানি বাংলা ভাষা তখন পর্যন্ত পরিপুষ্টতা পায়নি। তাহলে ব্রাত্য মানুষরা কীভাবে এই রকম ধ্রুপদি ভাষায় কথা বলে? বলা যায়, ভাষা ব্যবহারে শওকত আলী এ উপন্যাসে অগাধ পাণ্ডিত্য প্রদর্শনে সক্ষম হলেও নিম্নবর্গের ভাষা বলে তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তথাপি সংস্কৃত ও সমাসবদ্ধ শব্দের বহুল ব্যবহার প্রদোষের ভাষাকে করেছে দ্যুতিময়।
প্রদোষে প্রাকৃতজন-কে কেউ বলেন ঐতিহাসিক উপন্যাস। কেউ বলেন ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস। আবার কেউ বলেন ঐতিহ্য ও মিথপ্রধান উপন্যাস। গবেষক ও সমালোচকের অভিমত কোনোটাই খণ্ডন ভিত্তিহীন নয়। এসবের সংজ্ঞায়নের বাইরে এটাকে নিম্নবর্গের জীবনচেতনাভিত্তিক উপন্যাসও বলা যায়। কেননা, আমরা দেখেছি লেখক মূলত এ উপন্যাসে নিম্নবর্গের জীবনকেই উপন্যাসের বিষয় করেছেন। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা, পার্শ্বচরিত্রগুলো মৃৎশিল্পী, কুম্ভকার, ক্ষেত্রকর, ডোম, কর্মকার, তন্তুবায়, চণ্ডাল প্রভৃতি। এইসব মানুষ নিম্নবিত্তের পর্যায়ভুক্ত। এইসব মানুষের জীবনধারা ও বেঁচে থাকার সংগ্রামকেই লেখক উপন্যাসের উপজীব্য করেছেন। উচ্চবিত্তের রাজা সামন্ত হরি সেন, শক্তিবর্মণ, সোমজিৎ উপধ্যায়গণ উপন্যাসে বিচরণ করলেও নিম্নবর্গ ও শূদ্র শ্রেণির ওপর তাদের শোষণ-পীড়ন অঙ্কিত। এইসব কারণে আমরা এ উপন্যাসটিকে নিম্নবিত্তের জীবনচেতনাভিত্তিক উপন্যাস বলতে পারি।
কিন্তু নিম্নবিত্তের জীবনচেতনাই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় আবহ হয়নি। তৎকালীন সময়ের মানুষের গার্হস্থ্য জীবনধারা, শিল্প নির্মাণ, বিভিন্ন আচার, অনুষ্ঠান, পেশা, সাংস্কৃতিক চিত্র প্রভৃতি বিষয়ও নিপুণভাবে লেখক পরিবেশন করেছেন। ইতিহাসের যে ঘটনা তা চরিত্রের ব্যক্তিজীবনে সন্নিহিত করে লেখক একটা সময়কে ধারণ করার কৌশল গ্রহণ করেছেন। এই যে পূর্বপুরুষের জীবনধারা, লোকাচার, কিংবদন্তি, স্মৃতি-কল্পনা- এই বিষয়গুলো কোনো জাতির ঐতিহ্যকে ইঙ্গিত করে। এদিক থেকে এই উপন্যাসটিকে ঐতিহ্যপ্রধান উপন্যাসও বলা যায়। আবার ইতিহাসের ঘটনা থাকলেও চরিত্রগুলো লেখকসৃষ্ট। ফলত, ইতিহাসের ছাপচিত্র নিয়ে লেখা উপন্যাসকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। আবার নিম্নবিত্তের জীবনাঙ্কনই লেখকের মূল লক্ষ্য বলে মনে হয় না।
ইতিহাস, সমাজ, শিল্প, সংস্কৃতি, লোকাচার, পেশা, সব মিলেমিশে একটি জাতিসত্তার আত্মমুকুর হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসটি। ফলে সকল তর্ক ঝেড়ে ফেলে বলতে চাই প্রদোষে প্রাকৃতজন 'বাঙালি জাতিসত্তাভিত্তিক উপন্যাস'। বাংলা ভাষা ও বাঙালির জাতিসত্তার পরিচয় উদ্ঘাটনে বাংলা উপন্যাস শিল্পে যে ক'টি উপন্যাস প্রতিনিধিত্ব করবে তন্মধ্যে প্রদোষে প্রাকৃতজন অনন্য। ঔপন্যাসিকের শিল্পমেধার কারণে এটি বাংলা ভাষার স্মরণীয় শিল্প হয়ে উঠেছে।
সময় ও সমাজ বাস্তবতার নিরিখে বাঙালি জীবনের প্রদোষকাল থেকে আধুনিককাল পরিসরের বাঙালির যাপিত জীবন, বেঁচে থাকার লড়াই, রাজপ্রশাসনের শোষণ-পীড়ন, কৃষিজীবী তৃণমূল মানুষের অধিকার, নাগরিক জীবনের বিকলাঙ্গতা এবং গ্রামীণ জীবনের অভাজনের জীবনমথিত কান্না বিশ্বস্ততায় চিত্রিত হয়েছে তাঁর উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাস শিল্পের মধ্যে প্রদোষে প্রাকৃতজন জাতিসত্তার পরিচয় জ্ঞাপক ধ্রুপদি ধারার উপন্যাস। এটি বাংলা ভাষার অনন্য দলিল পরিগণিত। উপন্যাসটিতে প্রদোষকালের ব্রাত্যজীবনের আলেখ্য চিত্রায়ণের সমান্তরালে ঐতিহ্যপ্রীতি সফলভাবে চিত্রিত হয়েছে। এই ঐতিহ্যপ্রীতির চিত্রায়ণ করতে গিয়ে শওকত আলী উপন্যাসের পটভূমি হিসেবে নির্বাচন করেছেন প্রদোষকালের বাংলায় তুর্কি আক্রমণের প্রাক্কাল।
প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের কাহিনি-কৌশলের দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ দেবিপীঠে ব্রাত্যমূর্তি নির্মাণ করায় গুরু বসুদেবের গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়ে উজুবটে শুকদেবের বাড়িতে আশ্রয় পায় এবং মায়াবতী ও লীলাবতীর সাক্ষাৎ সূত্রে প্রথম দর্শনেই লীলাবতীর সঙ্গে প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়ে। মায়াবতীর অনুরোধক্রমে বসন্ত দাসকে খোঁজার সূত্রে নবগ্রাম হাটে এলে হলে শ্যামাঙ্গ রাজা হরি সেনের সৈন্যের হাতে সর্বস্ব হারিয়ে কুসুম্বীগ্রামে এক কুম্ভকারের ঘরে আশ্রয় পায়। এদিকে উজুবটে বসন্ত দাস আগমন করে এবং রাজা হরি সেনের প্রজাপীড়ন থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বন্ধু ভিক্ষু মিত্রানন্দের সন্ধান করতে থাকে। অপরদিকে যবনদের আক্রমণ, সামন্ত ও মহাসামন্ত শোষণ ও প্রজাপীড়নের ঘটনা জনৈক যোগীর কাছে শ্যামাঙ্গ জানতে পেরে শুকদেবের বাড়িতে হাজির হয়। ইতোমধ্যে রাজা হরি সেনের সৈন্যরা শুকদেব ও লীলাবতীদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিলে প্রাণ রক্ষার্থে শ্যামাঙ্গ লীলাবতীকে নিয়ে আত্মগোপনের চেষ্টা করে। বসন্ত দাস মিত্রানন্দকে পুনর্ভবার পশ্চিমতীরে সন্ধান করতে গিয়ে বিচিত্র পথ মাড়িয়ে ছায়াবতীর মন্দিরে গিয়ে হাজির হয় এবং মিত্রানন্দের সঙ্গে দেখা হলে মিত্রতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর আসন্ন সন্তানের কারণে স্বগৃহে ফিরে আসে। ওদিকে শ্যামাঙ্গ ও লীলাবতী শিলনাথের বাড়ি থেকে মাতুল সিদ্ধপার আদেশে পালাতে থাকলে ডাকাতদের কবলে পড়ে। পরে তাকে যবনকেন্দ্রে আনা হয়। লীলাবতী প্রাণ রক্ষার্থে যবন ধর্ম গ্রহণ করলেও শ্যামাঙ্গ উত্তরাধিকারে পাওয়া রক্তের ঋণ বিস্মৃত হতে পারে না, যবন ধর্ম গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। অবশেষে শ্যামাঙ্গ সামন্ত হরি সেনের সৈন্য অভিমন্যু দাসের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়।
উপন্যাসের এই ঘটনাক্রমের সমান্তরালে জনমানুষের পলায়নপরতা, রাজশোষণ, প্রজাপীড়ন, ব্রাত্যজীবনধারার চালচিত্র প্রভৃতি ঘটনা কাহিনির অনুষঙ্গ হয়েছে। ঔপন্যাসিক প্রদোষকালের মানুষের প্রাণ রক্ষার্থে পলায়নপরতার সঙ্গে সামন্ত-মহাসামন্ত শোষণ, পীড়ন, বিলাস, রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা, শ্রেণিভেদ, ভিক্ষুদের পতিত জীবনযাপন, যবনদের আক্রমণ ও বাণিজ্য, ব্রাত্য-শূদ্রশ্রেণির মূক জীবনযাপন ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ছবি এঁকেছেন।
উপন্যাসের কাহিনি-সূত্র অনুসন্ধান-কৌশলে দেখা যায়, শওকত আলী যখন সাহিত্যাঙ্গনে আবির্ভূত হন, তখন স্বৈরাচার আইয়ুব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। স্বৈরশাসক মানুষের শুধু বাকস্বাধীনতা হরণ করেনি, মানুষের শিল্পচর্চায় বিধিনিষেধও আরোপ করে। ক্রমশ মুক্তিযুদ্ধে উপনীত হয় দেশের মানুষ। যুদ্ধে ঘরছাড়া মানুষসহ যুদ্ধের বিচিত্র ঘটনাবলী লেখকের যাপিত জীবনে রেখাপাত করে। সমকাল দ্বারা শওকত আলী সংক্ষুব্ধ হন। এই সংক্ষুব্ধতা তাঁকে শিল্প নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছে। সমকালের ঘটনার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন দ্বাদশ শতকের বাংলায় রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনামলে। ফলে কাহিনি-কৌশলে সমকাল থেকেই রসদ খুঁজে নিয়েছিলেন।
এ উপন্যাসের কাহিনির উপাদান ইতিহাস থেকে নেওয়া। কিন্তু প্রধান চরিত্রগুলো ঔপন্যাসিকের সৃজিত। রাজা সামন্ত হরি সেন, শক্তিবর্মণ, সোমজিৎ উপধ্যায়গণের ঐতিহাসিক মূল্য থাকলে উপন্যাসে তাদের শারীরিক উপস্থিতি নেই। প্রধান-অপ্রধান মিলে অনেক চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে এ উপন্যাসে। প্রধান চরিত্রের মধ্যে শ্যামাঙ্গ, বসন্ত দাস, মায়াবতী, লীলাবতী আর অপ্রধান চরিত্রের মধ্যে যোগমায়া, দীনদাশ, শুকদেব, ছায়াবতী, সোমজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণা, বিভাবতী, মিত্রানন্দ ও মাধব আচার্য।
এ উপন্যাসের নায়ক চরিত্র সৃজনকৌশলে দেখা যায়, লেখকের সমকালীন অবরুদ্ধ পরিবেশ ও মূক সময়ের চিত্রায়ণ ঘটেছে। স্বৈরাচার আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তথাকথিত 'মৌলিক গণতন্ত্রী' প্রণয়ন করে, বাঙালির সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রতাপ প্রদর্শন করে- রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধসহ 'সাহিত্য সংঘ' গঠন করে প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে দিয়ে ইসলামী ভাবাদর্শ ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার অভিপ্রায়ে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে রক্তাক্ত প্রান্তর নাটক লিখিয়ে নেয়। এই যে শিল্পচর্চায় বাধানিষেধ আরোপ তা মূলত শিল্পীর স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করার শামিল। সামাজিক কমিটমেন্ট নিয়েই শওকত আলীর সাহিত্যাঙ্গনে আবির্ভাব। এ কারণে আইয়ুব সরকারের বাঙালির শিল্পচর্চা ও ঐতিহ্য হরণের একানায়কতান্ত্রিক মানসিকতায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। শিল্পের অপমান লেখকের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। 'কালে কালে শিল্পীরা কি এভাবেই নিগৃহীত, নির্যাতিত হয়?' অতঃপর লেখক শিল্পের শিকড় সন্ধানে প্রলুব্ধ হন এবং সমকাল থেকে আটশত বছর পূর্বে প্রাকৃতজনের প্রদোষকালে ফিরে গিয়ে রাজনৈতিক আবহে শ্যামাঙ্গ নামক মৃৎশিল্পীর জীবনকে নির্বাচন করেন। তাকে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে নিজ শিল্প-অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। শ্যামাঙ্গ শোষিত নির্যাতিত ব্রাত্যজনের প্রতিভূ। কাল থেকে কালান্তরের বোধ ও চেতনা প্রতীক। ঔপন্যাসিক তাকে বোধে ও দ্রোহে প্রকৃত শিল্পীরূপে নির্মাণ করেন। প্রকৃত শিক্ষার প্রশ্নে শ্যামাঙ্গ আপসহীন, এমনকি গুরুকে পরিত্যাগ করতেও তার গ্লানি নেই। তার প্রমাণ পাই, শ্যামাঙ্গ গুরু বসুদেবকে যখন কোনোক্রমেই আর বোঝাতে পারে না, তখন সে যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করে গুরুকে কটুবাক্য শোনায় :
'গুরুদেব, আপনি যদি সত্যি সত্যিই আমাকে পরিত্যাগ করে থাকেন, তাহলে শুনে রাখুন, আমিও আপনাকে পরিত্যাগ করলাম- শুধু আপনাকে নয়, আপনার প্রদত্ত শিক্ষাকেও' (প্রদোষে প্রাকৃতজন :পৃষ্ঠা ১৫)
সাহিত্যগবেষক অনেকেই মনে করেন প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর ভাষা তুর্কি আগমনের সময়কালের। অবশ্য লেখকের মন্তব্যও তাই। সংস্কৃতবহুল ও সমাসবদ্ধ শব্দ প্রয়োগে এ উপন্যাসের যে বাক্য গঠনপ্রণালি তাতে ভাষা বিদগ্ধ ধ্রুপদি ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রাবন্ধিক মনে হয়। সর্বোজ্ঞ লেখক পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করতেই পারেন। তবে এ উপন্যাসের ভাষা লক্ষ্মণ সেনের আমলের বলে অনেক গবেষক মনে করলেও মূলত তা বিদ্যাসাগরীয় যুগের বলে মনে হয়। কেননা, আমরা জানি গদ্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিদ্যাসাগরীয় গদ্যে যে সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতা প্রতিভাত, তাই রূপান্বিত প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর গদ্যে। আবার গদ্যের উৎপত্তির বিকাশ টানলে আমরা দেখতে পাই ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে গদ্যের সূচনা হলেও এর প্রথম সূচনা ধরা হয় ১৫৫৫ সালে কুচবিহারের রাজা নরনারায়ণের চিঠিতে। প্রথম গদ্যের নমুনা পাওয়ার সাল ১৫৫৫ ধরা হলে দ্বাদশ শতকের বাংলায় লিখিত কোনো গদ্য ছিল না। যদি না থাকে তবে প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর গদ্য দ্বাদশ শতকের নয়, অর্থাৎ প্রদোষের কাহিনির সমকালীন নয় বা তা লক্ষ্মণ সেনের আমলের নয়। তখন বাংলা গদ্যের উৎপত্তিই হয়নি। এই উপন্যাসের গদ্য বিদ্যাসাগরীয় রীতির গদ্য। যেমন :
আলুলায়িত কেশভার, বিস্র্রস্তবাস আর ঐ প্রকার অবরুদ্ধ হাহাকার। শ্যামাঙ্গ লীলাকে বক্ষলগ্ন করে। পৃষ্ঠে হাত রাখে, সীমান্তে চুম্বন করে। যতবার করে, ততবার হাহাকার উদ্বেল হয়, রোদন উচ্ছ্বসিত হয়, ক্ষোভ তীব্রতর হয়। এবং ঐ তীব্র, ক্ষুব্ধ এবং হাহাকারময় আবেগের মধ্যেই, অত্যন্ত গভীর তলদেশে, ছিল ভিন্ন, অনির্বচনীয়, একটি আনন্দ স্রোতের প্রবাহ। (প্রদোষে প্রাকৃতজন :পৃষ্ঠা ১৫৮)
ভাষা ব্যবহারে কিছু অসংগতি নজরে আসে। আমরা জানি মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গ গুরু বসুদেবের গৃহে মূর্তি নির্মাণ ব্যতীত অন্য কোনো বিদ্যাভ্যাস করেনি এবং তার শিক্ষা লাভের কোনো বার্তা ঔপন্যাসিক আমাদের জানান না। আমরা দেখেছি ঔপন্যাসিক এ উপন্যাসে প্রদোষকালের প্রাকৃতজনের জীবন ও তাদের সংগ্রামকে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। প্রাকৃতজনরা মূলত বাঙালির প্রদোষকালের কথা বলে। প্রাকৃতজন বা ব্রাত্য জনগোষ্ঠী একান্তই নিম্ন শ্রেণি-উদ্ভূত। তাদের ভাষাও হওয়ার কথা আঞ্চলিক। বিশেষ করে তাদের মুখে নিঃসৃত কথামালা। কিন্তু ঔপন্যাসিক তাদের মুখে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা মান বা প্রমিত ভাষায় রূপান্তরিত। আমরা জানি বাংলা ভাষা তখন পর্যন্ত পরিপুষ্টতা পায়নি। তাহলে ব্রাত্য মানুষরা কীভাবে এই রকম ধ্রুপদি ভাষায় কথা বলে? বলা যায়, ভাষা ব্যবহারে শওকত আলী এ উপন্যাসে অগাধ পাণ্ডিত্য প্রদর্শনে সক্ষম হলেও নিম্নবর্গের ভাষা বলে তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তথাপি সংস্কৃত ও সমাসবদ্ধ শব্দের বহুল ব্যবহার প্রদোষের ভাষাকে করেছে দ্যুতিময়।
প্রদোষে প্রাকৃতজন-কে কেউ বলেন ঐতিহাসিক উপন্যাস। কেউ বলেন ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস। আবার কেউ বলেন ঐতিহ্য ও মিথপ্রধান উপন্যাস। গবেষক ও সমালোচকের অভিমত কোনোটাই খণ্ডন ভিত্তিহীন নয়। এসবের সংজ্ঞায়নের বাইরে এটাকে নিম্নবর্গের জীবনচেতনাভিত্তিক উপন্যাসও বলা যায়। কেননা, আমরা দেখেছি লেখক মূলত এ উপন্যাসে নিম্নবর্গের জীবনকেই উপন্যাসের বিষয় করেছেন। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা, পার্শ্বচরিত্রগুলো মৃৎশিল্পী, কুম্ভকার, ক্ষেত্রকর, ডোম, কর্মকার, তন্তুবায়, চণ্ডাল প্রভৃতি। এইসব মানুষ নিম্নবিত্তের পর্যায়ভুক্ত। এইসব মানুষের জীবনধারা ও বেঁচে থাকার সংগ্রামকেই লেখক উপন্যাসের উপজীব্য করেছেন। উচ্চবিত্তের রাজা সামন্ত হরি সেন, শক্তিবর্মণ, সোমজিৎ উপধ্যায়গণ উপন্যাসে বিচরণ করলেও নিম্নবর্গ ও শূদ্র শ্রেণির ওপর তাদের শোষণ-পীড়ন অঙ্কিত। এইসব কারণে আমরা এ উপন্যাসটিকে নিম্নবিত্তের জীবনচেতনাভিত্তিক উপন্যাস বলতে পারি।
কিন্তু নিম্নবিত্তের জীবনচেতনাই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় আবহ হয়নি। তৎকালীন সময়ের মানুষের গার্হস্থ্য জীবনধারা, শিল্প নির্মাণ, বিভিন্ন আচার, অনুষ্ঠান, পেশা, সাংস্কৃতিক চিত্র প্রভৃতি বিষয়ও নিপুণভাবে লেখক পরিবেশন করেছেন। ইতিহাসের যে ঘটনা তা চরিত্রের ব্যক্তিজীবনে সন্নিহিত করে লেখক একটা সময়কে ধারণ করার কৌশল গ্রহণ করেছেন। এই যে পূর্বপুরুষের জীবনধারা, লোকাচার, কিংবদন্তি, স্মৃতি-কল্পনা- এই বিষয়গুলো কোনো জাতির ঐতিহ্যকে ইঙ্গিত করে। এদিক থেকে এই উপন্যাসটিকে ঐতিহ্যপ্রধান উপন্যাসও বলা যায়। আবার ইতিহাসের ঘটনা থাকলেও চরিত্রগুলো লেখকসৃষ্ট। ফলত, ইতিহাসের ছাপচিত্র নিয়ে লেখা উপন্যাসকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না। আবার নিম্নবিত্তের জীবনাঙ্কনই লেখকের মূল লক্ষ্য বলে মনে হয় না।
ইতিহাস, সমাজ, শিল্প, সংস্কৃতি, লোকাচার, পেশা, সব মিলেমিশে একটি জাতিসত্তার আত্মমুকুর হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসটি। ফলে সকল তর্ক ঝেড়ে ফেলে বলতে চাই প্রদোষে প্রাকৃতজন 'বাঙালি জাতিসত্তাভিত্তিক উপন্যাস'। বাংলা ভাষা ও বাঙালির জাতিসত্তার পরিচয় উদ্ঘাটনে বাংলা উপন্যাস শিল্পে যে ক'টি উপন্যাস প্রতিনিধিত্ব করবে তন্মধ্যে প্রদোষে প্রাকৃতজন অনন্য। ঔপন্যাসিকের শিল্পমেধার কারণে এটি বাংলা ভাষার স্মরণীয় শিল্প হয়ে উঠেছে।
মন্তব্য করুন