নাম, ফোন নম্বর, জায়গার নাম মনে রাখতে অনেকেরই সমস্যা হয়। এ জন্য কিছু বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয়। আবার বলা হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তি তৈরির ক্ষমতা, দ্রুত জবাব তৈরির মতো মানসিক ক্ষমতা কমতে থাকে; কিন্তু সহজ কিছু নিয়ম আপনার মস্তিস্কের শক্তি যেমন বাড়াবে, তেমনি ভাবনার গতিকে করবে তীক্ষষ্ট। লিখেছেন জেবা ফারিহা
মানব মস্তিস্ক স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্রীয় অঙ্গ। এটি আমাদের দেহের বেশিরভাগ ক্রিয়াকলাপ পরিচালনা করে এবং আমাদের আবেগ, হাসি, কষ্ট, দুঃখ, হিংসা, রাগ, চিন্তাভাবনা এবং জ্ঞানীয় ক্ষমতাগুলো পরিচালনা করে। শরীরচর্চা শুধু দেহের পেশির বিকাশই করে না; এর ফলে মস্তিস্কের আকারও বৃদ্ধি পায়। ব্যায়াম করলে মস্তিস্কের সিন্যাপসের সংখ্যা বাড়ে। এর ফলে মস্তিস্কে নতুন কোষ তৈরি হয়। কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়ামের ফলে মস্তিস্কে বেশি হারে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ সরবরাহ হয়। আর আপনি যদি খোলা জায়গায় রোদের মধ্যে ব্যায়াম করেন, তাহলে বাড়তি পাওনা হলো ভিটামিন ডি। তবে শরীরের অন্যান্য অংশের মতো মস্তিস্কেরও প্রতিদিন বিশেষ ব্যায়াম দরকার। এর মাধ্যমে তার কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে চিন্তার শক্তি উদ্দীপিত করা যায়। এর বিপরীতে মস্তিস্কের স্বাস্থ্যকে অবহেলা করলে আলঝেইমার বা ডিমেনশিয়ার মতো রোগের কবলে পড়তে পারেন। ৮১ বছর বয়সী স্নায়ুবিজ্ঞানী ডা. রিচার্ড রেস্টাক ভাবনার গতি বাড়াতে মস্তিস্কের ব্যায়াম নিয়ে বেশ কিছু কথা তুলে ধরেছেন। তিনি মস্তিস্কবর্ধক অভ্যাস এবং স্মৃতিশক্তির সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের ব্যায়ামের মাধ্যমে অনুশীলন করান, যার মধ্যে অনেক নিয়ম তিনিও অনুশীলন করেন। মস্তিস্ক এবং স্মৃতিশক্তিকে তীক্ষষ্ট রাখার সাতটি নিয়ম নিচে দেওয়া হলো-
১. উপন্যাস বা কল্পকাহিনি
নন-ফিকশন কাজগুলো থেকে অনেক কিছু জানা যায়, শেখা যায়। তবে এখানে কিছু বিষয় থাকে। যেমন ব্যক্তিগত আগ্রহ বা পরিচিত বিষয়, যা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এর ফলে নতুন বিষয় জানলেও পরিচিত গণ্ডির বাইরে যাওয়া হয় না। এতে মস্তিস্ক কাজ করলেও নতুন চিন্তার খোরাক পাচ্ছে না। অন্যদিকে ফিকশন পড়ার সময় বিভিন্ন চরিত্র, প্লট এবং বিবরণ আমাদের মনে রাখতে হয়। প্রত্যেকের মধ্যকার মিথস্ট্ক্রিয়া এবং ঘটনাপ্রবাহ আমাদের মস্তিস্কে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। স্মৃতি ধরে রাখার অনুশীলন করতে হলে উপন্যাস বা ফিকশন পড়ার অভ্যাস করা দরকার। ডা. রিচার্ড লক্ষ্য করেছেন, ডিমনেশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রাথমিক লক্ষণগুলোর একটি হলো উপন্যাস পড়া বন্ধ করে দেওয়া।
২. শিল্প জাদুঘর মানেই স্মৃতি পরীক্ষা
ডা. রিচার্ডের প্রিয় পেইন্টিং হলো এডওয়ার্ড হপারের 'ওয়েস্টার্ন মোটেল', যেখানে একজন নারী মোটেলের কক্ষে বসে আছেন, তাঁর ওপর সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে। যতক্ষণ না এই শিল্পকর্মটি আপনি নিজের মনের চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন বা বিশদভাবে বর্ণনা করতে পারছেন ততক্ষণ আপনি ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকুন আর কল্পনা করুন। আপনি কি ছবিতে থাকা ওই নারীর পাশের ছোট ঘড়িটা দেখেছেন? আপনি কি ঘরের অন্দরসজ্জা মনে করতে পারছেন? এভাবে অন্যান্য চিত্রকর্মের ক্ষেত্রেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করুন। এটি আপনার স্মৃতিশক্তিকে বাড়াতে সাহায্য করবে এবং কল্পনাশক্তিকে তুখোড় করে তুলবে।
৩. ৯০ মিনিটের কম সময় ঘুমান
দুপুর ১টা থেকে ৪টার মধ্যে ৩০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত ঘুমাতে পারেন। অল্প সময়ের ঘুম মস্তিস্ককে সতেজ রাখে। রাতে অল্প ঘুমের জন্য অনেক সময় ক্ষতি হতে পারে। আপনি যদি ইনসোমনিয়া বা অনিদ্রাজনিত রোগে ভোগেন, তাহলে মধ্যাহ্নের ঘুম স্মৃতিশক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। ডা. রিচার্ড বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে দুপুরে আধা ঘণ্টা করে ঘুমিয়ে আসছি। তবে আমি দেখেছি, মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য ঘুমিয়েও অনেকে সতেজ ও পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন।
৪. মস্তিস্কের খেলা
দাবা খেলা স্মৃতিশক্তি অনুশীলনের জন্য একটি দুর্দান্ত খেলা। আবার ধরা যাক, একটি অনুষ্ঠানে ২০ জনের একটি গ্রুপ করা হয়েছে। সেখানে একজন ব্যক্তি একটি প্রশ্ন করবেন তারপর কিছু সূত্র দেবেন। সেই সূত্র ধরে সঠিক উত্তর দিতে হবে। এতেও স্মৃতিশক্তির ব্যাপক অনুশীলন হয়। এ জন্য যিনি প্রশ্ন করছেন, তাঁকে প্রশ্নের বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। এ ছাড়াও রয়েছে টিক-টেক-টো : সার্কেল অথবা স্কয়ার; খেলাটার বাংলা নাম 'কাটা-কুটি'।
৫. মগজের খাবার
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের একজন পুষ্টি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. উমা নাইডু মস্তিস্কের খাবার বা ব্রেইন ফুডসের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দিয়েছেন। এ তালিকায় তিনি রেখেছেন- বেরি, মটরশুঁটি, বিভিন্ন রঙের ফলমূল ও সবজি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, চর্বিহীন প্রোটিন এবং উদ্ভিজ্য প্রোটিন, বাদাম, ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার, তেল, ওমেগাসমৃদ্ধ খাবার, দুধ, মসলা ইত্যাদি।
যেসব খাবার আপনার খুব পছন্দ, সেগুলো খেলে আপনার মস্তিস্কের 'রিওয়ার্ড এরিয়ায়' ডোপামিন রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আপনার মনে খুশি খুশি ভাব হয়। মস্তিস্কের কোষ ফ্যাট অর্থাৎ স্নেহ পদার্থ দিয়ে তৈরি। তাই খাবার থেকে তেল-চর্বি একেবারে বিদায় না করাই ভালো। ২০২০ সালে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ডার্ক চকলেটের উপাদান কোকো ফ্ল্যাভোনয়েড সুস্থ তরুণ ও প্রাপ্তবয়স্কদের এপিসোডিক স্মৃতিশক্তি বাড়াতে পারে।
৬. মনে রাখার জন্য ছবি ব্যবহার
ডা. রিচার্ড বলেন, তাঁর স্ত্রী বাড়িতে কোন প্রজাতির কুকুর পুষতেন, তা তিনি মনে রাখার জন্য ছবি এঁকে রাখতেন। অর্থাৎ মনে রাখা কঠিন এমন কিছুর নাম স্মৃতিতে ধরে রাখতে উদ্ভট বা মনোযোগ আকর্ষণকারী কিছু দিয়ে ছবি আকারে তা প্রকাশ করার অভ্যাস করতে হবে। এতে করে স্মৃতিশক্তি বাড়ে।
৭. সারাদিন সোফায় বসে থাকবেন না
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের প্রায় ৮৩ হাজার মানুষের ওপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০ থেকে ৬৯ বছর বয়সী নিষ্ফ্ক্রিয় প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায়; ৮০ বছর বা তার বেশি বয়সী, যাঁরা মাঝারি থেকে উচ্চ স্তরের শরীরচর্চায় যুক্ত, তাঁদের ডিমেনশিয়া হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। সারাদিন শুয়ে বা বসে থাকা ব্যক্তিদের থেকে যাঁরা খুব বেশি পরিশ্রমী না হলেও ঘরের কাজ বা সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামায় সক্রিয় তাঁদের মধ্যে পরিবর্তনটা খুবই লক্ষণীয়। বয়স্কদের মধ্যে যাঁরা অল্প পরিশ্রমও করেন, তাঁদের মধ্যে উচ্চ মনোযোগ, ভালো স্মৃতিশক্তি ও জ্ঞানীয় ক্ষমতা দেখা যায়।

বিষয় : ভাবনার গতি স্নায়ুতন্ত্র মস্তিস্কের শক্তি

মন্তব্য করুন