শিশু ওয়ার্ডে সেদিন ১০ বছরের অচেতন একটি ছেলেকে নিয়ে আসা হলো। ঠিক আগের দিনও সম্পূর্ণ সুস্থ ছেলেটি এক দিনের জ্বর আর মাথাব্যথা থেকে খিঁচুনি হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি আমরা সাধারণ কিছু রোগের ইতিহাস নিলাম। সারা বছরে হওয়া বিভিন্ন ভাইরাস দিয়ে মস্তিস্কে সংক্রমণ (এনকেফালাইটিস), ব্যাকটেরিয়া দিয়ে মস্তিস্কের আবরণীতে সংক্রমণ (মেনিনজাইটিস), ম্যালেরিয়া, করোনা, উচ্চ রক্তচাপ, মাথায় আঘাত এমনকি কোনো বিষাক্ত খাবার বা পানীয় গ্রহণ করেছে কিনা জানার এবং শারীরিক পরীক্ষা করার চেষ্টা করলাম সঙ্গে সঙ্গে। তখন জানতে পারলাম ছেলেটির গ্রামে প্রচুর খেজুর গাছ আছে আর সে প্রায়ই খেজুরের কাঁচা রস পান করত। আমরা ধারণা করলাম, অসুখটি নিপাহ ভাইরাস দিয়ে ঘটা মস্তিস্কের সংক্রমণ বা এনকেফালাইটিস।

আমাদের দেশে প্রথম 'নিপাহ' সংক্রমণ হয় ২০০১ সালে মেহেরপুরে। এর পর থেকে কমবেশি প্রতিবছর নিপাহ এনকেফালাইটিস রোগী শনাক্ত হচ্ছে। ডিসেম্বর থেকে মে মাসে সমস্যাগুলো বেশি দেখা যায়। চলতি বছর এর প্রাদুর্ভাব এখন পর্যন্ত বেড়েই চলছে। 'নিপাহ' একটি আরএনএ ভাইরাস, যা ফল আহারী বাদুড় দিয়ে বাহিত হয়। এ ধরনের বাদুড় নিজে আক্রান্ত না হয়েও লালা, মলমূত্রের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়াতে থাকে। এভাবে ওর মুখ দেওয়া খেজুরের কাঁচা রস, কামড় দেওয়া ফলের (বরই, কামরাঙা, জামরুল, শরিফা, পেয়ারা ইত্যাদি) উচ্ছিষ্ট থেকে মানুষ এমনকি গবাদি পশু সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি বা পশুও তখন জীবাণুর উৎস হয়ে যায়। এ রকম সন্দেহজনক রোগীর নাকের পানি, হাঁচি, কাশি, শ্নেষ্ফ্মা, থুথু এবং শরীরের অন্যান্য নিঃসরণ থেকে জীবাণু ছড়াতে পারে।

ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের ৪-১৪ দিন পর রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। অধিকাংশের ৩-১৪ দিনব্যাপী জ্বর, মাথাব্যথা, অবসাদ, মাংসপেশিতে ব্যথা, গলায় ঘা, বমি, ঝিমুনিভাব, প্রলাপবকা এমনকি মানসিক অসংলগ্নতা দেখা দেয়। কারও কারও শ্বাসকষ্ট থাকতে পারে। সবচেয়ে বিপজ্জনক ক্ষেত্রে এক-দু'দিনের মধ্যে রোগী খিঁচুনিসহ বা ছাড়া জ্ঞান হারিয়ে কোমায় চলে যেতে পারে। ৪০-৭৫ শতাংশ আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু রেকর্ড করা গেছে। যারা বেঁচে যায় তাদের অনেকের দীর্ঘমেয়াদে খিঁচুনি এবং ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন দেখা গেছে।

এখন পর্যন্ত নিপাহ এনকেফালাইটিস রোগের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা এমনকি প্রতিরোধী টিকাও আবিস্কার হয়নি। আমরা মূলত রোগীর সহায়ক চিকিৎসা করি। যেমন শরীরের পানি, লবণ ঠিক রাখা, জ্বর কমানো, শ্বাসকষ্টের সময় অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখা, খিঁচুনি হলে তার চিকিৎসা প্রভৃতি। চিকিৎসা চলাকালে যকৃৎ, বৃক্ক, হূৎপিণ্ড এবং মস্তিস্কের ক্ষতি প্রতিরোধে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির আইসোলেশন, অর্থাৎ তার থেকে অন্য কেউ এমনকি চিকিৎসাকর্মী যাতে সংক্রমিত না হন, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা খুবই জরুরি। গবেষণামূলক আরটিপিসিআর এবং এলিজা পরীক্ষা করে ভাইরাস নির্ধারণ করা যায়। তবে আমাদের সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে ভাইরাস ছড়ানো প্রতিরোধে। সচেতনতামূলক কিছু তথ্য উল্লেখ করছি।

১. খেজুরের কাঁচা রস, পাখির মুখ দেওয়া ফল, গাছের তলায় পড়ে থাকা ফল পান বা খাওয়া যাবে না। বিশেষ করে গ্রামের শিশুদের ফলের উচ্ছিষ্ট মুখে দেওয়ার প্রবণতা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
২. অক্ষত ফলও ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।
৩. হাত ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে। বিশেষ করে সন্দেহজনক রোগীর সংস্পর্শে যাঁরা থাকেন, তাঁরা বারবার পরিস্কার পানি, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেবেন।
৪. সব সময়ই বাদুড়ের লালা, মলমূত্র থেকে দূরে থাকতে হবে।
৫. ৭০ শতাংশের সেলসিয়াসের অধিক তাপে ভাইরাসটি নষ্ট হয়ে যায়। তাই গুড়, রান্না করা খাবার, পিঠা খেতে বাধা নেই। ভাইরাস আক্রান্ত পশুর মাংস ঠিকমতো সিদ্ধ না করলে রোগ ছড়াতে পারে। অর্ধসিদ্ধ, কাঁচা মাংস খাওয়া পরিহার করুন।
৬. সন্দেহজনক রোগীকে দ্রুত সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।
[রেজিস্ট্রার (শিশু বিভাগ), আইসিএমএইচ, ঢাকা]