
পৃথিবীতে ছাপার হরফেই সংবাদপত্রের হাত ধরে সংবাদমাধ্যমের সূচনা হয়েছিল। তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার প্রথম মাধ্যমই ছিল কলম ও কাগজ। প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানীরা ট্রান্সমিশন ও শব্দতরঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। যার ফসল জনপ্রিয় সম্প্রচার মাধ্যম বেতার।
২০ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ্বে বেতার সম্প্রচার শুরু হয় শব্দতরঙ্গ ও সংকেতের সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট ব্যান্ডউইথের মাধ্যমে। তবে তা সংবাদমাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিল। যাঁরা বিজ্ঞাপন ও সংবাদপত্র পড়তে পারতেন না, তাঁরা রেডিওর উদ্ভাবনের পরে বিভিন্ন তথ্য এবং সংবাদ ভালোভাবে শুনতে ও বুঝতে পারতেন। এই সংবাদমাধ্যমের জনপ্রিয়তাকে বাঁচিয়ে রাখতে ও এর ব্যবহারের বিস্তারে প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী বিশ্ব বেতার দিবস উদযাপিত হয়। এবারের প্রতিপাদ্য 'রেডিও এবং শান্তি'।
দিনটি উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য হলো শ্রবণের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের সংবাদ, বিনোদন, বিতর্ক সবকিছুর সঙ্গে মানুষকে তাল মিলিয়ে চলতে উৎসাহিত করা। টেলিভিশনের জনপ্রিয়তার এত বছর পরও রেডিও গানের বিশ্বস্ত মাধ্যম, ভ্রমণের সঙ্গী; সর্বোপরি কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বর বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছে বেতার।
অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এখনও দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় সংবাদপত্র পৌঁছে না। কোথাও কোথাও টেলিভিশনও সহজলভ্য নয়। চরাঞ্চল কিংবা এ রকম প্রত্যন্ত এলাকায় ইদানীং ব্যাটারি বা সৌরশক্তি দিয়ে টেলিভিশন চালানোর একটা সংস্কৃতি চালু হলেও তার সংখ্যা নিতান্তই কম। আবার স্যাটেলাইট সংযোগ না থাকায় অনেক দর্শকের র্নিভরশীল হতে হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের ওপর। সে ক্ষেত্রে রেডিও অনেক সহজে এবং দ্রুত পৌঁছে গেছে প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায়। মানুষকে এখন আলাদা করে রেডিও সেট কিনতেও হচ্ছে না। বরং হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন।
অধিকাংশ মোবাইল ফোনেই রেডিও শোনার ব্যবস্থা আছে। ফলে মানুষ মোবাইল ফোনে রেডিও শুনছে; আবার মোবাইল ফোনে কল করে অথবা এসএমএস দিয়ে রেডিও অনুষ্ঠান সম্পর্কে তাদের মতামত জানাচ্ছে। অনেক সময় অনুষ্ঠানেও অংশ নিচ্ছে। এভাবে মোবাইল ফোনের কল্যাণে রেডিও এখন খুবই জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমে পরিণত হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে রেডিও কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও মোবাইল ফোনে এটি সংযোজিত হওয়ায় আবার তা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
তথ্যপ্রাপ্তিতে শহর ও গ্রামের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। ফলে মৌলিক বিষয় ক্রমাগত চলে যাচ্ছে দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে। তারা প্রত্যেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে এবং তাদের চিন্তাভাবনাও পরস্পর-বিচ্ছিন্ন বলে তারা উন্নয়নে তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না। তাই কমিউনিটির ভেতরকার সার্বিক পরিস্থিতি, তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ এবং উন্নতির জন্য সম্ভাব্য কার্যক্রম সংক্রান্ত আলোচনা কমিউনিটির লোকজনের ভেতর থেকেই আসতে হয়। আর এভাবেই কমিউনিটির উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন ও মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নতুন বিশ্বে বাংলাদেশ বেতার ও কমিউনিটি রেডিও বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন রোধ; সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ-প্রতিরোধ; ডেঙ্গু ও করোনা মহামারির সচেতনতা ও দুর্যোগ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য, সংবাদ, অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষি উন্নয়ন, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, শিক্ষার মানোন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুহার হ্রাসসহ সার্বিক উন্নয়নে বেতারের ভূমিকা অনবদ্য।
বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিওর সাফল্যও অনেক। দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিওবিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৮টি কমিউনিটি রেডিও এবং দুটি কমিউনিটি ভিজুয়াল রেডিও প্রতিদিন সর্বমোট ১৭৫ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। এক হাজার তরুণের অংশগ্রহণে নতুন ধারার এ সংবাদমাধ্যমটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বেতার যেন ইথারে ছড়িয়ে দিচ্ছে জীবনের আহ্বান।
বশির আহমেদ: সংবাদকর্মী
boshir.radiochilmari@gmail.com
মন্তব্য করুন