- ফিচার
- নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত কৃষিবিজ্ঞানীরা
নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত কৃষিবিজ্ঞানীরা

অর্ধশতাব্দীরও আগে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ, পরিবেশ উপযোগী আধুনিক ধান এবং লাগসই ধান উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। ১১১টি ধানের জাত উদ্ভাবন করে দেশের কৃষিতে অনন্য অবদান রেখেছে ব্রি।
ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। উচ্চফলনশীল ধানের জাত ও আনুষঙ্গিক লাগসই চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষক পর্যায়ে এসব প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে এ অর্জনের পথ সুগম হয়েছে। গত কয়েক দশকে কৃষি খাতে যে রূপান্তর ঘটেছে, তার নেতৃত্বে ছিল ব্রি। তবে এ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁরা পদোন্নতিসহ নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এ প্রতিষ্ঠানের ৫০ বছর পূর্তি ছিল ২০২০ সালের ১ অক্টোবর। তবে মহামারির কারণে তখন অনুষ্ঠান হয়নি। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার গাজীপুরে অবস্থিত ব্রি সদরদপ্তরে প্রতিষ্ঠানটির অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন বঙ্গবন্ধু-পিয়েরে ট্রুডো কৃষিপ্রযুক্তি কেন্দ্র উদ্বোধন করবেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘিরে ব্রিতে সাজসাজ অবস্থা। আবার তাঁর কাছে বেশ কিছু দাবিও আছে কৃষিবিজ্ঞানীদের।
ব্রির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে বর্তমানে ৩০৮ জন বিজ্ঞানী কাজ করছেন। নানা অর্জনের পরও প্রতিষ্ঠানটির সামনের দিনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ১১১টি জাত উদ্ভাবিত হলেও সব মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে পৌঁছায়নি। মাত্র ৮-১০টি জাতই আবাদ হচ্ছে মোট আবাদের ৬০ শতাংশ জমিতে। বীজ বিপণনে বেসরকারি খাতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়েও রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। ফলে উদ্ভাবিত জাতগুলোর সম্প্রসারণ হচ্ছে না বলে
জানান বিজ্ঞানীরা।
এ বিষয়ে ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ভালো জাত উদ্ভাবনে ব্রি নেতৃত্ব দিলেও কৃষকের কাছে ভালো বীজ পৌঁছানোর একটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাঁরা নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় আরও বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হচ্ছে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি বিজ্ঞানীদের নানা দাবি পূরণ করলে প্রতিষ্ঠানটি খাদ্য নিরাপত্তায় আরও অবদান রাখতে সক্ষম হবেন। ব্রির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী সমকালকে জানান, তাঁরা নানা ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেসব সুবিধা পান, তাঁরা তা পান না। দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের পদোন্নতি আটকে আছে।
পদ খালি না হলে পদোন্নতি দেওয়া হয় না। ফলে পদোন্নতি না পেয়েই অবসরে যেতে হচ্ছে অনেককে। এ ছাড়া শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা পিএইডি করলে তিনটি ইনক্রিমেন্ট পান। কিন্তু কৃষি বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে পিএইচডির পর একটি ইনক্রিমেন্টও নেই। সরকারি কর্মকর্তারা গাড়ি ও বাড়ির জন্য স্বল্প সুদে ঋণ পেলেও কৃষি বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে নেই সেই সুবিধা।
দীর্ঘদিনের দাবির পরও কৃষিবিজ্ঞানীদের চাকরির বয়স বাড়ানো হয়নি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁদের চাকরির বয়স সরকারি নিয়মেই। ৫৭ বছর বয়সে একজন বিজ্ঞানী অবসর নিলে অনেক সময় তাঁর গবেষণা অসমাপ্ত থেকে যায়। তাই কৃষিবিজ্ঞানীদের বেলায় চাকরির বয়স ৬৭ করার দাবি তাঁদের।
একজন সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, তিনি ২০ বছর ধরে একই পদে আছেন। যোগ্যতা থাকার পরও যথাসময়ে পদোন্নতি ও নানা সুবিধা না পেয়ে তিনি হতাশ। তিনি জানান, ব্রিতে বিজ্ঞানীদের ৩০৫টি পদ। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা থেকে
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পর্যন্ত চারটি পদ আছে। পদ খালি না হলে এখানে পদোন্নতি পাওয়া যায় না। সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত ব্রি থেকে ১৫২ বিজ্ঞানী চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। প্রতিবছর ৫০-৬০ জন অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
২০২০ সাল থেকে ব্রি বিজ্ঞানীসহ সংশ্নিষ্টরা সরকারি পেনশন সুবিধাভুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তার অনেক আগেই অবসরে যাওয়া প্রখ্যাত অনেক বিজ্ঞানী এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জনপ্রিয় ব্রি ধান-২৮ ও ব্রি ধান-২৯ জাত দুটির উদ্ভাবনে জড়িত বিজ্ঞানী ড. প্রণব কুমার সাহা রায়, ড. তানভীর আহমেদ, ড. খাজা গুলজার হোসেন ও ড. কামরুন্নাহার অবসরে গেছেন পেনশন সুবিধা ছাড়াই।
বাংলাদেশের কৃষির অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বিজ্ঞানীদের নাম উঠলেই প্রথমে আসে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কৃষিবিজ্ঞানী ড. কাজী এম বদরুদ্দোজার নাম। তাঁর নামেই কাজী পেয়ারা। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এই কৃষিবিজ্ঞানী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) চেয়ারম্যান ও মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অথচ তাঁর মতো কৃষির প্রাণপুরুষ পেনশন সুবিধার বাইরেই থেকে গেছেন। বিজ্ঞানীর মধ্যে কেউ কেউ দেশি-বিদেশি সংস্থায় কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করলেও অনেকেরই শেষ জীবনে কষ্টে কাটে।
বিজ্ঞানীদের পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কৃষিবিদদের পদোন্নতির জন্য দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা ও সফলতা দেখাতে হবে। বিজ্ঞানীদের পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবেন।
মন্তব্য করুন