- ফিচার
- পলিহাউসে নিরাপদ কৃষি
পলিহাউসে নিরাপদ কৃষি

যে কোনো ফসল চাষে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার পাশাপাশি রোগবালাইয়ের আক্রমণ অনেক বড় একটি সমস্যা। বিরূপ আবহাওয়া ফসলের জন্য যতটা ক্ষতিকর, রোগবালাইয়ের জন্য ততটাই উপযোগী। এ রোগবালাই দমনের জন্য কৃষক থেকে কৃষি উদ্যোক্তা সবাই শরণাপন্ন হন নানা ধরনের কীটনাশক-বালাইনাশকের। জৈব কীটনাশকে রোগবালাই দমন মন্থরগতিতে হওয়ায়, রাসায়নিক কীটনাশকই বেশি প্রয়োগ করা হয়। একদিকে পরিবেশের প্রতিকূলতা, অন্যদিকে রাসায়নিক বালাইনাশকের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগে চাষাবাদ দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। সব মিলিয়ে খোলা মাঠে ফসল চাষ দিন দিন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। এ সমস্যার সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হলো পলিহাউসে চাষাবাদ।
পলিহাউসে পরিবেশের প্রতিকূলতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এটি ইনসেক্ট নেট দিয়ে আবদ্ধ থাকায় বাইরের কীটপতঙ্গ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না, যার ফলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বালাইনাশকগুলোর প্রয়োগমাত্রা অনেক কমে যায়। এদিক থেকে খোলা মাঠে চাষাবাদের তুলনায় পলিহাউসে চাষাবাদ অনেক বেশি সুবিধাজনক।
পলিহাউসের এসব উপকারিতার কথা জানান তরুণ উদ্যোক্তা সামিউল ইসলাম। তিনি ব্যাচেলর অব এগ্রিকালচার শেষ করেছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কৃষিভিত্তিক কয়েকটি কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। কাজের সুবাদে গেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। কৃষকের সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনছেন। সামিউলের মতে, এটিই তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি। এ কৃষি উদ্যোক্তা যখন চাকরি ছেড়ে দেন তাঁর হাতে তখন মাত্র ১৫ হাজার টাকা। তবে কৃষি খাতে চাকরি ও পড়াশোনার অভিজ্ঞতা নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার লড়াইয়ে নেমে পড়েন। মাত্র ২০ শতাংশ জমিতে শুরু করা তাঁর উদ্যোগ এখন ৬০ বিঘায় বিস্তৃত হয়েছে। গড়ে উঠেছে 'এগ্রো ওয়ান' নামে একটি প্রতিষ্ঠান।বগুড়ার বাঘোপাড়া, মহিষবাথানে এগ্রো ওয়ানের কার্যালয়।
বগুড়ার পাশাপাশি মেহেরপুরেও প্রতিষ্ঠানটির একটি শাখা আছে। সাভারেও শুরু হয়েছে কার্যক্রম। তবে নতুন শিক্ষিত কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে বগুড়া ও মেহেরপুরে। মূলত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক কৃষিতে শিক্ষিত তরুণদের টানতে চান সামিউল। এটি যেমন এ খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সামিউলের মধ্য দিয়ে তাঁর বাজার সম্প্রসারণ করছেন। এ নতুন উদ্যোক্তারাই মূলত সামিউলের বীজ, চারা, সার, কীটনাশকের মূল ক্রেতা। এ উদ্যোক্তারা কখন কী চারা লাগবে, তার আগাম অর্ডার দিয়ে রাখেন। সে অনুযায়ী চারা তৈরি করে সামিউল উদ্যোক্তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন। তাঁর কাছে কোনো অবিক্রীত চারা থাকে না। ১৩টি পলিহাউসে বছরে প্রায় দুই কোটির মতো চারা উৎপাদন করে এগ্রো ওয়ান। প্রতি মাসে আনুমানিক ৬ থেকে ৮ লাখ টাকার চারা বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ১৮টি উচ্চমূল্য ফসলের ৩৮টি জাত বিক্রি করছে। পাশাপাশি উচ্চমূল্য সবজি ও ফল-ফসলের চারা, মালচিং ফিল্ম, সিডলিং ট্রে, ইউভি পলি, শেড নেট, কোকো পিট, ট্রাইকো ডার্মা, ট্রাইকো কম্পোস্ট, ভার্মি কম্পোস্ট ইত্যাদি কৃষি উদ্যোক্তাদের সরবরাহ করে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৬০ জন কর্মী রয়েছেন।
গত দুই বছরে সামিউল প্রায় পাঁচ হাজার কৃষি উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মাঠের কাজে বিশ্বাসী সামিউল উদ্যোক্তাদের কৃষির নানা দিক শেখান হাতে-কলমে। কখন, কোন কৃষি কীভাবে করলে কৃষক লাভবান হবেন, সে পরিকল্পনাটাই বুঝিয়ে দেন উদ্যোক্তাদের। প্রশিক্ষণের উপকরণ, থাকা-খাওয়ার সুবিধা দেন। যে কেউ সামিউলের এই এক দিনের প্রশিক্ষণে আসতে পারেন। সে ক্ষেত্রে এক হাজার টাকা দিয়ে আগে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
স্মার্ট কৃষিকে আধুনিক পদ্ধতির পাশাপাশি সঠিক পরিকল্পনা থাকবে- যেমন কোন সময় কোন ফসল চাষ করলে বাজারে ভালো দাম পাবেন, সে অনুযায়ী ফসল নির্বাচন করা। সেই ফসল কীভাবে চাষ করলে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যাবে, তা তুলে ধরা। সহজ কথায় এটিই হলো স্মার্ট কৃষি।
সামিউল আরও জানান, উন্নত দেশে এক বিঘা জমিতে পলিহাউস করতে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ পড়ে। তিনি দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করায় এ খরচ সাত লাখ টাকায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে পলিহাউসেও রোগবালাই হতে পারে।
এ সম্পর্কে সামিউল জানান, পলিহাউসে বীজবাহিত কারণ বা অন্য কোনোভাবে রোগবালাইয়ের আক্রমণ ঘটলে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করা হয়ে থাকে। সাধারণত বেশিরভাগ বালাইনাশক প্রয়োগ করার পর, বালাইনাশকভেদে তার কার্যকারিতা ৩, ৭ বা ১৫ দিন পর্যন্ত থাকে। বালাইনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন পড়লেও এমনভাবে প্রয়োগ করা হয় যেন এর কার্যকারিতা শেষ হওয়ার পরপরই ফসল বাজারজাতকরণ করা যায়।অর্থাৎ ফল বা ফসল পরিপকস্ফ হওয়ার একটা নির্দিষ্ট দিন আগে থেকে সব ধরনের রাসায়নিক বালাইনাশক প্রয়োগ বন্ধ করতে হয়, যার ফলে উৎপাদিত ফসলে মানুষের জন্য ক্ষতিকর অথবা মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটাতে পারে, এমন রাসায়নিক থাকার আশঙ্কাও থাকে না।
সামিউল আরও বলেন, 'পলিহাউসে চাষাবাদ নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বাড়ায় এবং রাসায়নিক বালাইনাশকের প্রয়োগ হার অনেক কমিয়ে আনে।'
সামিউল ইসলামের সফলতার গল্প জানিয়েছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান।
মন্তব্য করুন