
বিকেলগুলোয় ঢাকার ধানমন্ডির ‘বেঙ্গল শিল্পায়ন’ মুখর হয়ে থাকে নানা আয়োজনে। চতুর্থ তলায় সেমিনার হলে প্রায়ই তিল ধারণের জায়গা থাকছে না। ২৯ জানুয়ারি অনেকে আলোচনা শুনতে এসে জায়গা না পেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
সেদিন বক্তব্য রাখছিলেন প্রদর্শনীর উদ্বোধক বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক অধ্যাপক রওনক জাহান। আরও ছিলেন দৈনিক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কবি সাজ্জাদ শরিফ। উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের ও মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। মধ্যমণি ছিলেন শিল্পী ঢালী আল মামুন। ‘অসম্মতির মানচিত্র’ প্রদর্শনীটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আসার জন্য আমার মতো আরও অনেকেই অপেক্ষা করেছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। দেখা পেলাম অনেক গুণীজন, শিল্পী, শিল্পযোদ্ধা, শিক্ষার্থীসহ নানা বয়সী দর্শকের। আরও ভালো লাগল গ্যালারিতে উপচে পড়া ভিড়ে নতুন প্রজন্মের ছবির দর্শকদের দেখে। নানা উপাদানে নানা মাধ্যমে করা বৈচিত্র্যময় কাজগুলো তারা উপভোগ করছিল বটে।
১৯৮০-এর দশকের ‘সময়’ দলটির নেতৃস্থানীয় শিল্পী ঢালী আল মামুন। যে সময়ের দেশের চারুশিল্পের স্বনামধন্য, সৃজনশীল শিল্পীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সমাজ-বাস্তবতা ও পরিবর্তনের পক্ষে নিয়োজিত থেকে তিনি সৃষ্টিশীলতাকে নিরন্তর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এবারের বিষয়টি তাঁর মতে ‘ঔপনিবেশিকতার মধ্যে নিজের অবস্থান অনুসন্ধান’। শিল্প ভাষা-কাঠামো পরিবর্তনে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন মাধ্যম ও উপকরণ।
ইতিহাস ও সমাজ-রাজনীতি নিয়ে শিল্পী ঢালী আল মামুন কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর শিল্প শিক্ষাপদ্ধতির মধ্য দিয়ে গৃহীত জ্ঞান এবং সেসবের নির্মাণশৈলীতে আমাদের ইতিহাস ও সামাজিক পরিমণ্ডলের সম্পর্ক আছে কিনা, এর মধ্য দিয়ে নতুন কোনো ভাষা নির্মাণ করা যায় কিনা, সেটা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। বস্তুত তিনি দেশীয় আঙ্গিকে আর উচ্চ আধুনিক সমাজ রাজনীতির সফল ফিউশন ঘটিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিতে। তালপাতার সেপাই-এর বিবর্তিত রূপ ‘কাঠের হাতি’ (ড়িড়ফবহ ষড়ৎফ)। এর সাথে আরেকটি তল যুক্ত হয়েছে– তা হলো ‘শব্দ’, যার মাধ্যমে শিল্পী দর্শকের উপলব্ধির জগৎ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। আবার ‘শতাব্দীর আখ্যান’ শিরোনামের কাজটিতে বাংলার চিরায়ত নকশিকাঁথা তৈরির প্রক্রিয়াকে রেফারেন্স হিসেবে ধরে ‘পেল’ কাঠামোর ওপর পেইন্টিংগুলো করেছেন।
প্রতিনিধিত্বশীল প্রতীকীতে ঔপনিবেশিক সংকেত আর দেশীয় সংস্কৃতির মিশেল পাওয়া যায় শিল্পকর্মে। অতীত ঔপনিবেশিক প্রভাব ঝেড়ে ফেলে দেশজ ঐতিহ্য, নিজস্ব জ্ঞান, ঐতিহাসিক চেতনা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজেকে গড়ে নিতে চান। এ অঞ্চলের শিল্পকলায় দেখা যায় রোমান্টিকতা বা আধ্যাত্মিকভাবে আধিপত্য। কিন্তু শিল্পী ঢালী তাঁর শিল্পকর্মের ফর্মে দেশীয় উপাদান ব্যবহার করলেও বিষয়বস্তুর মেটাফোরিক আবেদন ও সমাজ রাজনীতির মাত্রা যুক্ত করেছেন। শিল্পে নতুন ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে এটা কি তবে উত্তর আধুনিকতার উপস্থাপন নাকি উত্তর আধুনিক উপস্থাপন– শিল্পী সেই রহস্যের জালে আটকেছেন তাঁর দর্শককে।
শিল্পে ব্যবহৃত উপাদান বা মেটেরিয়াল শিল্পের ভাষা বদলে দেয়। প্রযুক্তির ব্যবহার, শিল্প শিক্ষার পুরোনো ভাষা নতুনভাবে রূপান্তর করেছে। দ্বিমাত্রিক তলে গতিময়তা এনেছেন। এখানে ‘সময়’ নামক আরেকটি তলের সন্ধান দিয়েছেন। শিল্পী ঢালী তাই অতি চর্চার শৈলী গাঙে এক উজান বাওয়া মাঝি।
রেখে চলা ঢেকে চলা ঢালী ঔপনিবেশিকতার ইংরেজ শাসনামল, ৪৭-এর দেশভাগ, পলাশী ও বপারের যুদ্ধ, পরিবর্তিত মানচিত্রের ক্ষত বহন করে সেই ঔপনিবেশিক ইতিহাসকে নানা দিক থেকে পাঠ করতে চেয়েছেন। যেখানে নিশ্চিতভাবে কিছু প্রমাণের লক্ষণ দেখাতে চাননি। বোদ্ধা দর্শকের অতৃপ্ত মন খুঁজে ফিরছে অনেক অজানা ইতিহাস ও সৃষ্টিশীল বক্তব্য। শিল্পীর যে লক্ষ্য, সেটাই হয়তো বাস্তবায়ন করেছেন সবটুকু দিয়ে। আমার বিশ্বাস, শিল্পী তাঁর কাজের একটি বিন্দুও অবচেতনে দেবেন না, পরবর্তী সময়ে হয়তো জানাবেন আগ্রহী দর্শকদের।
ঢালী আল মামুনের সংক্ষিপ্ত জীবনী
চিত্রশিল্পী ও অধ্যাপক। জন্ম ১৯৫৮ সালে চাঁদপুর জেলায়। ১৯৮২ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ১৯৯৩ সালে জার্মান সরকারের বৃত্তি নিয়ে চারুশিল্পে দুই বছরের উচ্চতর ডিএএডি কোর্স সম্পন্ন করেন।
১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের একটি শিল্পী দল প্রাচীন পথ থেকে দূরে সরে এক নতুন পথে হাঁটতে শুরু করেছিল। ওই দলটির নাম ছিল ‘সময়’। এই ‘সময়’ দলটির অন্যতম নেতৃস্থানীয় একজন হলেন শিল্পী ঢালী আল মামুন। আরও ছিলেন– নিসার হোসেন, আজিজ শরাফী, ওয়াকিলুর রহমান, দিলারা বেগম জলি, হাবিবুর রহমান, শিশির ভট্টাচার্য্যের মতো শিল্পীরা। যাঁরা বিমূর্ত চিত্ররীতির জেঁকে বসা আধিপত্যের ওপর বীতস্পৃহ হয়ে পড়েছিলেন। প্রথম প্রদর্শনী ১৯৮৮ সাল থেকে দেখা যায় প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলনের বাইরে তাঁর কাজের উপাদানে পরিবর্তন। শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেন শিল্পী ঢালী আল মামুন। দেশে-বিদেশে অসংখ্য একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য– ডিএএস, ঢাকা আর্ট সামিট [২০২০]; মাঝি ইন্টারন্যাশনাল আর্ট রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম, ভেনিস, ইতালি [২০১৯]; ঢাকার মোহাম্মদপুর কলা কেন্দ্রে, শিরোনাম : ড্রইং অ্যান্ড থিঙ্কিং, থিঙ্কিং অ্যান্ড ড্রইং-১ [২০১৮]; বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে শিরোনাম :টাইম, কো-ইন্সিডেন্স অ্যান্ড হিস্টরি [২০১৬]; ঢাকার গুলশান বেঙ্গল গ্যালারিতে, শিরোনাম : অপনয়ন [২০১২]; ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে, শিরোনাম : কাগজের ছায়া [শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের সঙ্গে যৌথ, ২০০৯]; আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে, শিরোনাম : ওয়াটার ইজ ইনোসেন্ট [২০০৪]।
২০০০ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রধান স্বীকৃতিসমূহের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পদক পান। ২০০৬ সালে ঢাকায় আয়োজিত দ্বাদশ এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে গ্র্যান্ড পুরস্কার পান। ২০১৩ সালে ইতালির ভেনিসে আয়োজিত ৫৫তম বিয়েনালে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
মন্তব্য করুন