১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মান্টো লাহোরে মারা যান। তাঁর এই গল্পটি ‘শিকারি আওরতেঁ’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।দুই দশকেরও বেশি সময়ের লেখক জীবনে মান্টো রচনা করেছেন ২২টি গল্পের বই, একটি উপন্যাস, পাঁচটি বেতার নাটকের বই, তিনটি প্রবন্ধ সংকলন, দুটি স্মৃতিকথা আর বেশ কিছু চিত্রনাট্য। কারও চোখে মান্টো ছিলেন প্রগতিশীল আবার কারও চোখে প্রতিক্রিয়াশীল। শেষ জীবনে এসে বরণ করে নিয়েছিলেন প্রচণ্ড দারিদ্র্য আর হতাশা।
উর্দু ভাষা ও ভারতীয় উপমহাদেশের বহুল পঠিত ও বিতর্কিত লেখক সাদত হাসান মান্টোর জন্ম ১৯১২ সালের ১১ মে পাঞ্জাবের সামরালায়। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন কাশ্মীরি। ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হলে প্রগতিশীল লেখক আবদুল বারী আলিগের সান্নিধ্যে আসেন। তাঁর উৎসাহেই লেখালেখিতে প্রবেশ মান্টোর।

লেখক পরিচিতি

সবাই তার পরামর্শ মান্য করে অগ্রসর হলো। আমি যেতে উদ্যত হয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম, যে মানুষটা সব সময় ধোপদুরস্ত পরিচ্ছন্ন কালো আচকান পরত, সে এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সারা আচকান লেপটে আছে কাদায়; কিন্তু পরিষ্কার করার মতো কেউ ছিল না সেখানে।
“নরকে যাক ‘ভদ্রলোকের বুরুশ’। চলো বাড়ি চলো।”
হাফিজ তখন রীতিমতো টলছিল। জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠে বলল–
“এ তো দেখছি সেই ‘ভদ্রলোকের বুরুশ’!”
সে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে গেল। ঘণ্টাখানেক পরে বৃষ্টি থামলে আসর ভঙ্গ হলো। সবাই বাইরে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় পা দিতেই আমরা দেখলাম একটা লোক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ভালো করে দেখার পর আমি চিৎকার করে উঠলাম–
‘হুজুর তুমুল বৃষ্টি, যাবেন কী করে?’
সবার অনুরোধে সে গাইতে শুরু করল– একটা মিয়াঁকি টোরি ছিল সেটা। এমন মিষ্টি সুরে গাইছিল সে সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। গান শেষ করে সে চলে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করল। ততক্ষণে সবাই মদের নেশায় বিভোর। কারও খেয়ালই ছিল না বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ‘ভদ্রলোকের বুরুশ’ দরজা খুললে কোনো একজন বলল–
‘এই সৌভাগ্য আমার নেই।’
মুবারক আসলে তাকে হুইস্কি নিতে অনুরোধ করছিল। কিন্তু ‘ভদ্রলোকের বুরুশ’ খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল–
‘খুবই আনন্দের বিষয়। আপনি আমার পাশে এসে বসুন। আপনি নিজেও একজন বড় গায়ক। কিছু একটা নিন।’
মুবারক বলল–
‘আরে আসুন, আসুন, আসন গ্রহণ করুন।’
‘এখান দিয়ে যাবার পথে কানে ভেসে এলো গানের সুর। মাশাল্লা, যিনি গাইছেন তার গলা খুব ভালো। জানি, আমন্ত্রণ ছাড়া এভাবে ঢুকে পড়াটা খুব ভদ্র রুচির পরিচায়ক নয়। সম্মতি পেলে আপনাদের মধুর সান্নিধ্য খানিকটা উপভোগ করা যায়।’
এর কয়েক রাত পরে ধুম বৃষ্টির মধ্যে আমরা হাফিজ পেইন্টারের দোকানে গানের আসর বসিয়েছিলাম। হুইস্কি খেতে খেতে আমরা ফটোগ্রাফার মাসুক আলির গাওয়া গান উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ দরজা খুলে গেল আর ঘরে ঢুকল ভদ্রলোকদের বুরুশ। আমাদের সবাইকে উদ্দেশ করে সে বলল–
একটুখানি সাহস সঞ্চয় করে সংকোচের সঙ্গে সে ডেপুটি কমিশনার সাহেবের পাজামায় লেগে থাকা ময়লা সাফ করে দিল। ইংরেজ ডিসি তার অন্তরের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন তাকে।
কিছুক্ষণ পর আমার বন্ধু চলে গেল জরুরি কিছু কাজ আছে বলে, নাহলে লোকটা সম্পর্কে আরও তথ্য জানতে পারতাম। এর কিছুক্ষণ পরেই একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলাম দুলাভাইয়ের সঙ্গে (সে ছিল অমৃতসরের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট, আল্লাহতালা জানেন আর কী করে সে); বিস্তারিত মনে নেই আমার, মনে হয় নতুন ডেপুটি কমিশনার মহোদয়ের সম্মানে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ওখানেই সেই কালো লোকটার দেখা পেয়েছিলাম। শহরের ধনী ও গণ্যমান্য লোকজনের আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছিল। বিশ্বাস করুন, বাড়িয়ে বলছি না। আধা ঘণ্টার মধ্যেই সে ওই অনুষ্ঠান থেকে নামকরা সব মানুষ খুঁজে বের করেছিল আর তার নাজুক আঙুল ও বুরুশ দিয়ে তাদের কোট সাফ করছিল। সে তাদের কোটের কলার ও পেছন দিকে লেগে থাকা ধুলো ময়লা রুমাল দিয়ে সুচারুরূপে পরিষ্কার করছিল আর তার বিনিময়ে লাভ করছিল তাদের ধন্যবাদ।
আমরা যখন গভীর আলাপে ডুবে আছি আবলুশ কাঠের মতো লোকটা দু’জন ভদ্রলোকের কোট সাফ করতে করতে বাজারের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে।
‘না। তবে লোকজনকে পাগলের মতো তার বিষয়ে আলোচনা করতে শুনেছি।’
‘তার গান শুনেছ কখনও?’
‘বললাম না তোমাকে, সে তাদের কোট সাফ করে, তাছাড়া খুব ভালো গান গায়।’
‘তার খাওয়া-পরার সংস্থান হয় কীভাবে?’
সে তাদের কোট সাফ করার কাজ করে।’
‘সে কিছু ধনী মানুষের সান্নিধ্য লাভে সমর্থ হয়েছে।
‘কী করে?’
‘সে আসলে রাবাবিস সম্প্রদায়ের মানুষ, যাদের কাজ হচ্ছে দরবার সাহিব, অর্থাৎ স্বর্ণমন্দিরে বাজনা বাজানো। কিন্তু সে ওখানে যায় না।’
বন্ধুটি হাসল–
‘সে আসলে কী করে? মানে তার পেশা কী?’
‘তাহলে এখন বলো আর কী জানতে চাও?’
‘তা-ই অনুমান করতে পারছি এখন।’
“আরে তাকে চেনো না? তার নাম ‘ভদ্রলোকের বুরুশ’।”
আমার বন্ধু হো হো করে হেসে বলল–
‘আরে না। আবলুশ কাঠের রং খুব কালো। দেখো না তার পরনে কুচকুচে কালো আচকান। আল্লাহর মেহেরবানিতে সে নিজেও খুব কালো। আর এ জন্য তাকে আবলুশ ডাকছি।’
‘তার মানে আমাদের আগে-আগে এক টুকরো কাঠ হেঁটে যাচ্ছে?’
‘আরে দেখো না, আমাদের সামনে দিয়ে যে লোকটা দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। তুমি দেখছি একটা আস্তো পাঁঠা। তুমি কি জানো না আবলুশ কাঠের নাম?’
আমি তীক্ষ্ণ স্বরে বললাম–
‘আবলুশ কাঠের মতো মানুষ’ বলতে কী বোঝাতে চাও তুমি? বানরের মতো মানুষের কথা অবশ্য আমি শুনেছি। আবলুশ কাঠের মতো মানুষের স্বপ্ন কোথায় দেখলে তুমি?’
সে অবাক হয়ে বলল–
‘আবলুশ কাঠের মতো ওই লোকটা কে?’
আমি বাজারের এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস  করলাম–
পরের দিন আবার আমি কালো লোকটাকে দেখলাম। তার সঙ্গে ছিল দু’জন লোক। খুব কষ্ট করে সে তাদের পরিচ্ছন্ন কোট থেকে ধুলোবালি সাফ করছিল। সেদিনও তার পরনে ছিল কালো আচকান। কালো কাপড় সব সময়ই ময়লা আর ধুলোবালি টেনে নেয়। আমি খুব সতর্কতার সঙ্গে তাকিয়ে দেখলাম কোটে ধুলোবালির কণামাত্র নেই। তখন আমার মনে হলো, সে শুধু অন্যের কোটের বুরুশই নয়, তার নিজের কোটের বুরুশও বটে।
এ কথা বলে তিনি কোম্পানিবাগের দিকে হাঁটা দিলেন। রাস্তায় একটা ইলেকট্রিকের খাম্বা পড়লে তিনি তাতে গোটা দুই বাড়ি মারলেন।
‘কাল সকালে আমার বাড়িতে এসো।’
শেখ সাহেব তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন–
‘কিছু চুল আর ময়লা লেগেছিল হুজুর, সাফ করে দিলাম।’
খানিকটা মিনমিন করে আবলুশ কাঠের মতো লোকটা বলল–
‘এসব কী হচ্ছে?’
তাদের একজন হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ, রোগাই বলা যায় তাকে; তবে তার শরীরের গঠন বেশ পোক্ত। শেখ সাহেব হাঁটতে শুরু করলে আবলুশ কাঠের ওই মাংস খুব পরিপাটি করে তার কোট সাফ করতে লাগল একটা বুরুশ দিয়ে। শেখ একটুখানি রেগে জিজ্ঞেস করল–
যে দু’জন লোক শেখ সাহেবের সঙ্গে কথা বলছিলেন তাদের গায়ের রং খুবই কালো। তাদের পরনের আচকানের রং তার চেয়েও কালো।
‘আপনার দোয়ায় ভালোই জনাব।’
‘কী হে সাদত, দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’
আমি ওষুধ কিনে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই বিখ্যাত ধনাঢ্য ব্যক্তি শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু’জন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাঁকে সালাম জানালাম। অভ্যাসবশত তিনি বৈদ্যুতিক খাম্বার গায়ে দুটো বাড়ি মারলেন ঠাস-ঠাস করে। তারপর বললেন–
‘ঠিক আছে এখন যাও তাহলে। কাজটা আজই শেষ করতে হবে।’
হাফিজ কানে গোঁজা তুলিটা হাতে নিয়ে সাইনবোর্ডে লিখতে লিখতে বলল–
‘ঠিক আছে, ওইসব ভাঁড়ামিও উপভোগ করা যাবে। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত– কোনো মশা যদি তিনি মারতে না পারেন তাহলে জ্যান্ত ছাড়া হবে না তাঁকে।’
বললাম–
‘কী যে বলো তুমি। না না। এই লোকটার একটা অদ্ভুত অভ্যাস আছে– চড়া স্বর থেকে যখন তিনি নিচে নামেন হাঁটুর ওপর জোরে জোরে থাবড়া মারেন। মনে হয় তিনি গাইছেন না, রক্তখেকো মশা বিনাশ করছেন। লোকে এ জন্যই বোধ হয় তাকে মাখসার গান বলে।’
অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে হাফিজ পেইন্টার বলল–
‘আসব নিশ্চয়ই। এই মাখসার খান লোকটা কে? তাঁকে কি মশারির নিচে নিয়ে বসাবেন? হা হা হা ...।’
তার কথা শুনে ভালো লাগল আমার। বললাম–
‘তাঁর কথা অবশ্য আমি কখনও শুনিনি, তবে এই প্রজন্মের ছেলেপেলে সত্যিই তাঁকে পছন্দ করে। সে নিজেও একজন যুবক। তারা আমাকে বলেছে– খান সাহেব খুব আবেগ দিয়ে গান করেন, কখনও কাউকে হতাশ করবেন না।’
‘আজ এখানে পুরোনো দিনের গান হবে। মাখসার খান গাইবেন আর বাঁশি খান হাজির থাকবেন। অন্য আরও কিছু আছে, ছটার মধ্যে চলে এসো। বন্ধুবান্ধবকে জানিয়ে দিয়েছি।’
ব্রাশটা আবার কানের ওপরে গুঁজে সে বলল–
‘কী ব্যাপার হাফিজ সাহেব?’
আমি তার দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম–
এক সকালে কানের ওষুধ কেনার জন্য হাফিজের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ১০টার মতো বাজছিল, হাফিজ উচ্চ স্বরে ডাকছিল আমাকে। তাকাতেই চোখে পড়ল ওর কানে একটা ছোট তুলি গোঁজা। কান থেকে তুলি নামিয়ে রেখে ওর কথা শোনার জন্য কাছে যেতে ইঙ্গিত করল।
প্রায় সব গায়ক-গায়িকাই এখানে নিজেদের প্রতিভা দেখাতে এসেছে। হোক তারা বেশ ঝকমকে আর উচ্ছল কিংবা মাঝারি গোছের শিল্পী। এর কারণ ওখানে জমায়েত হতো সব তরুণ-তরুণী আর প্রাণবন্ত সব মানুষ। ভালো রকমের মজা হতো, ফলে খ্যাপানো বা ঠাট্টা-মশকরা কেউ গায়ে মাখত না।
ওখানে ভাং চলত, চলত গঞ্জিকা, চলত পেগের পর পেগ মদ। কারণ, খুব সহজ-স্বাভাবিক সময় ছিল তখন। মাত্র সাড়ে আট টাকায় কেনা যেত ভালো জাতের এক বোতল স্কচ হুইস্কি। হাফিজ তার দোকানে ঝাঁপ বন্ধ করে আমাদের সঙ্গে বসে যেত উন্মাতাল মদের আড্ডায়। মাঝরাত পর্যন্ত তা গড়াত। ততক্ষণে অন্য সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত– শুরু হতো গানের আসর।
হাফিজ পেইন্টারের দোকান সারাক্ষণ মুখর থাকত রাজনৈতিক আলাপ, আর্থসামাজিক কথাবার্তা আর সারাক্ষণ গল্পগাছায়। তবে এ কথা সত্যি যে; এরা সবাই আসলে ছিল শিল্পী, তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সংগীত। কেউ হাতে তুলে নিত সেতার, কেউ বাজাতে শুরু করত সারেঙ্গি, অন্য একজন তানপুরায় হাত ছোঁয়াত আর গাইতে শুরু করত মিয়াঁকি টোরি, মালকোশ, বাগেশ্রী বা অন্য কোনো রাগ।
মানব জীবনের নানান স্রোতধারা বয়ে চলত অবিরাম। রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠত, আবার মিলিয়েও যেত। গ্যাংস্টাররা একে অপরকে খুন করত। মুসলমান-কাদিয়ানি বিতর্ক তীব্র হয়ে উঠত, খ্যাতনামা পণ্ডিত আর যাজক-পাদ্রিরা তাতে যোগ দিতেন। জালিয়ানওয়ালাবাগে সংঘটিত হয়েছিল ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ। অনেক মুসলমান, শিখ আর হিন্দু নৃশংসভাবে খুন হয়েছিল। কিন্তু অমৃতসর যেমন ছিল তেমনি আছে।
অমৃতসর অদ্ভুত এক শহর। সেই সময় নানা ধরনের ঘটনা ঘটত ওই শহরে– সুইপার রমণীদের মধ্যে চুলোচুলি থেকে শুরু করে সরকারের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ। সব ধরনের মানুষের বসবাস ছিল ওই শহরে। কিছু শয়তান লোক ছিল, যারা কারণে-অকারণে পটকা আর বাজি ফোটাত– ভয় দেখানোর জন্য কিংবা লোকজনকে যমের দুয়ারে পাঠাতে। কিছু লোক মানুষকে সন্ত্রস্ত করতে পছন্দ করত, কিছু লোক ছিল শান্তিপ্রিয়। ধর্মপ্রাণ আর দয়ালু মানুষ যেমন ছিল, তেমনি আবার ছিল শয়তান-বদমাশ। ছিল মসজিদ আর মন্দির। এগুলোর ভেতরে ভালো কাজ যেমন হতো আবার পাপাচারও চলত।
মুসলমান আর মুসলমান, মুসলমান আর হিন্দুদের মধ্যে সংঘাত বাধে তাদের ভেতরকার দলগত বৈরিতার কারণে। গুন্ডা-বদমাশদের মধ্যে বালকপ্রেমী গ্যাংস্টার আর বেশ্যাদের নিয়ে কামড়াকামড়ি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। এসব নিয়ে মারামারি-কাটাকাটি চলতেই থাকত, আবার কদিন পরে তার অবসান ঘটত; ঠিক গ্রীষ্মকালে পোকামাকড়ের মতো যারা মাকড়সার জালের মতো নিজেদের চারপাশে প্রতারণার জাল বিস্তার করে আবার ফিরে আসে লাশের মতো। কিন্তু এসব আপনার গোচরীভূত হওয়ার আগেই পরিবেশ অনুকূলে চলে আসে, তারাও আবার তাদের নিত্যদিনের কাজেকর্মে মনোযোগ দেয় আর লোকজনকে উত্ত্যক্ত করতে থাকে।
হাফিজ পেইন্টারের দোকানে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মারতাম। হালবাজারের বিজলি চকের পাশেই ছিল দোকানটা। বেশ আগেই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। মুবারকও কোনো একটা এস্টেটে অবস্থিত তার কর্মস্থল থেকে অব্যাহতি নিয়ে অমৃতসরে ফিরে এসেছিল। বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে হাফিজ পেইন্টার বড় একটা দোকান ভাড়া নিয়েছিল। তার আগে এক শিখ কমিউনিস্ট ওই দোকানে গ্রামোফোন রেকর্ড বিক্রি করত। দোকানটা ছিল খায়েরদিন মসজিদ সংলগ্ন হালবাজার এলাকায়। খুব ভালো জায়গা। ঠিক বাজারের মাঝখানে। মসজিদের ছায়া এসে পড়ত দোকানটাতে। অধার্মিককে সব সময় পবিত্রদের অধীনে থাকতে হয়। আর এ জন্যই হাফিজ জায়গাটা খুব পছন্দ করত। একদিকে মসজিদ থেকে আজান ভেসে আসবে, অন্যদিক থেকে ভেসে আসবে গ্রামোফোন রেকর্ডে বাজতে থাকা গানের সুর। কিন্তু এসব কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণ হবে না। যদিও অতি ক্ষুদ্র কোনো বিষয় খুনের মতো ভয়াবহ ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
এই ঘটনা কম করে হলেও বিশ বছর আগের। আমার বয়স তখন প্রায় বাইশ। দু-এক বছর এদিক-ওদিক হতে পারে। তারিখ ও বছরের প্রশ্ন উঠলে আমি নাচার। সেই সময় আমার বন্ধুরাও ছিল তরতাজা যুবক। বয়সে তারা ছিল আমার চেয়ে বেশ বড়।


বিষয় : অনুবাদ গল্প

মন্তব্য করুন