বসন্তের বাতাস নিজে কি জানে, তাকে নিয়ে কত যে মন্ত্রণা কবিদের গানে! সেসব গানের ফাঁদে পড়ে একদিন আমাকেও লিখতে হয়েছিল: ‘ইরেজার হাতে নিয়ে তুমি হে বসন্ত, মুছে দিয়ে চলে যাও মনের হসন্ত...’

ফাল্গুন নামে একটা বাস চলে এই ঢাকা শহরে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হঠাৎ তাকে দেখলে মনে হয়, যাত্রীরা-সব বাসটিতে চড়ে ছুটে যাচ্ছে চির-বসন্তের দেশে, পথচারীদের পিছে ফেলে। কেমন সে দেশ? তাও কল্পনা করে ফেলি। স্পষ্ট দেখতে পাই, ছিপছিপে একটা নদী। ডাবের পানির মতো ঘোলাটে তার জল। কেননা সাদা মেঘের প্রতিবিম্ব তাতে ভেসে যায়। তারই পাশ দিয়ে চলে গেছে কালো পাথরের রাস্তা। কোথায় যে কে জানে। সে পথের ধারে সারি সারি লালচে পাতার বাদাম গাছ।

এইটুকু কল্পনার মানে আমি বুঝতে পারি, যখন দেখি হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি ক্রিসেন্ট লেক, চন্দ্রিমা উদ্যান। বসে পড়েছি একটা বাদাম গাছের নিচে। বাদাম খেতে নয়, সিগারেট ধরাতে। এই জায়গাটাতেই দেখা হতো আমাদের। ও আসত হলিক্রস থেকে, আমি রেসিডেন্সিয়াল মডেল থেকে। সে কী উত্তেজনা, কী যে লুকোচুরি, আর কতই না বাহাদুরি! কলেজ-লাইফ এনজয় করতে হলে কলজে লাগে– কে যেন বলেছিল কথাটা, কোন বদমাশ। বসন্ত-বাতাসে এইসব বুজরুকি বেশ ছড়ায়।
কিন্তু বসন্তেরও মন পাল্টায়। যেমন, ও এখন আসতে পারে নর্থ-সাউথ থেকে। আর আমিও ইউল্যাব থেকে। কিন্তু আসা হয় না।

অথচ এখানে এখনও ফাল্গুন-হাওয়া বয়। এখনও স্খলিত চুম্বনের শব্দে পাতা ঝরে পড়ে। এখনও এখানে হিজড়েদের আনাগোনা। কিছুক্ষণ বসলেই এসে হাত পাতে, ‘বোনটারে কিছু দে।’ আমি দিই। আর বোনটার মুখের দিকে তাকাই। বলি, ‘বাড়ি কোথায়?’ ‘বাড়ি নাই’ বলতে বলতে সে চলে যায়। এইসবে সেই হলিক্রস খুব বিরক্ত হতো। খেপে গিয়ে বলত, ‘ওর সঙ্গে যাবে নাকি, ওদের বাড়ি?’

তখন সত্যিই একটা বাড়ি ভেসে উঠত চোখের সামনে। ফুপুদের বাড়ি। ফটিকজানি নদী পার হয়ে যেতে হয় সেখানে। ছোট্ট সেই নদী, চির-বসন্তের দেশে যেমনটা শোভা পায়। কোশা-নৌকায় চলে পারাপার। মাত্র কয়েক মিনিট লাগে নদীটা পেরুতে। নৌকা থেকে নেমে তরমুজ-খেতের আল ধরে তারপর ভুট্টাপাতা পায়ে মাড়িয়ে উঁচু মাটির রাস্তায় গিয়ে ওঠা। চাপা উদ্বেগ আর উৎসাহ তখন আমাদের তিন ভাইবোনের মনে। আরেকটু এগোলেই গম-ভাঙানোর কল। কলঘরের পাশে দুটি কাঁঠাল গাছ।গাছের ডালের নিচ দিয়ে দেখা যায় একটা গেরুয়া রঙের মসজিদ। তার উল্টোদিকের রাস্তা ধরে এগোলেই ফুপুদের বাড়ি।

দূর থেকে দেখতে পেতাম রেণু দাঁড়িয়ে আছে বরই গাছের তলায়। চারদিকে বসন্ত-বাতাস। আমাদের দেখে ওর সে কী হৈচৈ! তা শুনে বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েরা এসে জুটত। আর ফুপুও বেরিয়ে আসতেন ভেতর থেকে। ততক্ষণে আমিও লাগাতাম ভোঁ-দৌড়। কত কথা কত অনুযোগ শুরু হতো মায়েদের। আমাদের সারাদিন শুধু হাসি আর খেলা। খেলতে খেলতে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া, হাসতে হাসতে জলে ডুবে যাওয়া। অকারণে বড়দের বকা খাওয়া।

সে বার এক ভয়ংকর কাণ্ড হলো। বাড়ির পেছনে বাঁশবন পেরিয়ে একটা বড় খালে দল বেঁধে মাছ ধরতে গিয়ে বড়শি বিঁধে গেল আমার মাথায়। রেণুর ভাইয়ের হ্যাঁচকা টানে মাছ তো উঠলই না, তার ছিপের বড়শি এসে গেঁথে গেল একেবারে চান্দিতে। রেণুর সে কী কান্নাকাটি! আমিও দিশাহারা। তার ভাই পলাতক। সন্ধ্যাবেলায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সদর হাসপাতালে। ফিরে এলাম রাত্রিতে। উৎকণ্ঠিত রেণু তখনও ছিল জেগে।

মনে হয় কতদিন আগেকার কথা! কোন জন্মে ঘটেছিল এইসব! কতটা ছোট ছিলাম আমরা তখন! মনে সেই প্রশ্ন জাগে এই ফাগুনবেলায়। আহা রেণু! সেই রেণু আজ কোথায় গেল? কিভাবে ধীরে ধীরে দূরে সরে পড়ল সে! ঠিক যেন টেরও পাইনি আমরা। বুঝতেই পারিনি, হাসিখুশি সেই মেয়ে কবে কখন কেন এতটা গম্ভীর হয়ে পড়ল।

একদিন আমরা জানতে পারলাম রেণু ঠিক সুস্থ নয়। কী অসুখ তার? তা আমাদের বলা হয়নি। আমরাও খুঁজে বার করতে চাইনি সেসব। আলগোছে শুধু এড়িয়ে গেছি তাকে। যেন আমাদের কেউ বলে দিয়েছিল, ওর সঙ্গে মেশা বারণ। এরপর আমাদের হাসি-উল্লাসে সে যোগ দিত সামান্যই। তার সাথে কথা হতো খুবই কম। যতটা না হলেই নয়। আমাদের এই কাছে এসেও দূরে থাকা, ভিড়ের আড়ালে নীরব উপেক্ষা– চুপচাপ মান্য করে গেছে সে। অনুযোগহীন, চিরবিষণ্ন উদাসীনতায়।

গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে উত্তীর্ণ কৈশোরে একদিন বুঝতে পারলাম, রেণু আসলে আমাদের মতো নয়। মেয়েও নয় সে, ছেলেও নয়। এই তার অসুখ। এই তার দুঃখ। এই দুঃখে সে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হলো অবশেষে। কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। কোনোদিনই আর ফিরল না সে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, কেউই তেমন খোঁজ করল না তার। এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্যও শোনা গেল না কারও মুখে।

এখন হয়তো জনে জনে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, তোমরা কি সেদিন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলে? তার নাই হয়ে যাওয়াই আকাঙ্ক্ষিত ছিল তবে? কিন্তু কেন? পথের সেই শিমুল গাছটিকেও জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। ফুল কুড়াতে আসা ছোট্ট সেই মানুষটিকে নিয়ে তুমি কী ভেবেছিলে? বসন্ত-বাতাসে কোনোদিন তোমার ওই ভাবনা কি মুদ্রিত হবে?

অপরাধ আমিও করেছি বটে। আমার মাথায় সেই গেঁথে যাওয়া বড়শি। ছিপ ধরে আজও কেউ টান দেয়। স্থির হয়ে তাই বসতে পারি না যেন। টালমাটাল নিখিল ভুবন। এ ভুবনে ফাল্গুন নামের বাস ছুটে চলে সাঁই সাঁই। অথচ আমার কোনো গন্তব্যই নাই।

শেষবার যখন ফুপুর বাড়ি যাই, তার মৃত্যুর পর, মনে পড়ে ফেরার পথে ফটিকজানি নদীপাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল রেণু। একটি কথা শুধু বলেছিল, ‘আবার আইসো।’ এত মৃদু শব্দে যে, না বললেই হতো। সেদিনও বসন্ত ছিল। চৈত্রের দিনান্তবেলা। নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম, হুহু বাতাসে এলোমেলো চুলগুলো তার উড়ছে। রোদের বিপরীতে মুখে জমে উঠেছে কী বিষণ্ন ছায়া!

ওই ছায়াটুকুর মধ্যেই যেন লুকানো পৃথিবীর সব আর্তি, আর্তনাদ। অচরিতার্থতার গান।

সেই তার সঙ্গে শেষ দেখা। শেষ দৃশ্যপট– সেই চৈত্রের গোধূলি। যতবার মনে পড়ে, আমি লিখে চলি মেঘে মেঘে: ‘ইরেজার হাতে নিয়ে তুমি হে বসন্ত, মুছে দিয়ে চলে যাও মনের হসন্ত...’

আর তখনই দেখতে পাই, ছোট্ট রেণু দাঁড়িয়ে আছে বরই গাছের তলায়। চারদিকে উথালপাথাল হাওয়া।