
আজ ১৫ ফাল্গুন। কোকিলের একটা ডাকও শুনলাম না। একই দেয়ালের ও-পাশের ফ্ল্যাটে ড্রিলমেশিন চলছে। অন্য যে পাখিগুলো অন্য সময়ে কলরব করত সেগুলোও স্তব্ধ হয়ে গেছে। সামনের নির্মীয়মাণ ভবনে লোহার পাইপ কাটা মেশিনের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। আর আমি লেখার টেবিলে বসে বসন্ত-বিষয়ে ভাবছি। প্রকৃতির একটা পর্যায়কে গুণীজনরা নাম দিয়েছেন বসন্ত। পঞ্জিকাপ্রণেতাগণও তার জন্য দুটো প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন, কিন্তু আমি কী পেলাম?
প্রচণ্ড কাশির কষ্টে গত দিন দশেক ঘুমোতে পারছি না। এর মধ্যেই ঋতুরাজকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। না ভেবে উপায় নেই; কেননা সে রাজা, আর আমি প্রজা। অথচ একটা প্রজাপতিও দেখছি না আমাকে প্রেরণা দেওয়ার জন্য।
২.
বার্ধক্যের সীমান্তে দাঁড়িয়ে
ক্যালেন্ডারের ফুলের ছবিটি ঝাপসা হয়ে গেছে,
অথচ সেই বসন্তভরা তারিখগুলো
রক্তচোষা বাদুড়ের মতো উৎকট লালে ফেটে পড়া।
ঘড়ির নির্বিকার কাঁটারা ফুলের ছবিকে খুঁজছে!
স্মৃতির সরীসৃপটা আমার শিরার নদী বেয়ে
হলুদ গরল মিশিয়ে আমার শোণিতে
রাঙিয়ে তুলছে তোমার মুখশ্রীকে।
দৃশ্যনির্যাতনের থেকে মুক্তি পেতে বন্ধ করি দেহের দু’চোখ,
অথচ মন বন্দি– দু’চোখ খোলা।
যে হৃদ কখনও হতে পারল না নদী
সে হৃদের বুকে জটিল অক্টোপাস।
শুভ্র চুলের আশ্রয় আমি নিয়েছি এখন,
তবুও তোমার কুন্তলকালো বিষণ্ন স্মৃতি
সর্পিণী হয়ে দিনরাত শুধু দংশন করে।
৩.
হাস্যকর শিরোনামের ওই কবিতাটি লিখেছিলাম যখন, তখন আমার বয়স কুড়ির মতো (২৪.০৬.১৯৭০)। তার ওপর, আদিখ্যেতা করে ফুটনোটও দিয়েছি– বার্ধক্যের তীরে উপনীত হয়েছি। তবুও আমার বিগত যৌবনের প্রেমিকার স্মৃতি তোমায় জ্বালাচ্ছে, পোড়াচ্ছে। দ্বিতীয় খাতার প্রথম এই কবিতা মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে। আমি মনে মনে হাসি। সেই হাসি তাচ্ছিল্যের, ব্যঙ্গের হাসি। আর, তিয়াত্তর বছর বয়সে কী ভেবে জানি কবিতাটি হুবহু উদ্ধৃত করলাম। তাচ্ছিল্যের সেই হাসিও নেই, রিক্তদের বোধও নেই। মনে গভীরতা ভর করেছে। ঋতুচক্র নিয়ে অনেক ভাবনা জট পাকাচ্ছে।
আচ্ছা, কোকিল কি ক্যালেন্ডার দেখে ডাকে? কাঞ্চনফুল কি পত্রিকা পড়ে?
‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।’
কথাটা আমি মানি। তারপরও কেন জানি মনে হয়, বসন্তের বোধটুকু অন্তরেই জন্মায়, অন্তরেই ক্রিয়াশীল হয়।
একজন মানুষ যদি একটানা দশ-বারো বছর ধরে মন খারাপের মধ্য দিয়ে তার সময় অতিবাহিত করে, তার আবার কিসের বসন্ত, কিসের হেমন্ত! কেন জানি না, নিজের প্রতিই তাচ্ছিল্যের বোধ জন্মাচ্ছে এখন।
৪.
নিজেকে শান্ত করার জন্য কবিতার খাতা উল্টাচ্ছি। হঠাৎ ২০১৩ সালে লেখা একটা কবিতা চোখে পড়ল। কবিতাটি উদ্ধৃত করে বসন্তের কাছে ক্ষমা চেয়ে বিদায় নেব।
ফাল্গুনীর খোঁজে তাকে দেখি নাই। তবু তাকে দেব বলে কয়েকটি পঙ্ক্তির খোঁজে অন্ধ হয়ে গেছি। বালিশ ঘুমোচ্ছে খাটে নিহত শিমুল ফুল নিয়ে। বৃক্ষের পাড়ায় ঝরাপাতা। খয়েরি মৃত্যুকে পাশ কেটে, ক্ষুধার্ত হলুদ ট্রাক তুলে নিচ্ছে অবলীলাক্রমে বৃক্ষের কঠিন মাংস। আর কত মৃত্যু পাড়ি দেব।
হঠাৎ মাখনরং জিন্সপরা ম্যালালুকা ঢুকে গেল অরণ্যের জটিল মায়ায়। শাদা হাড়গোড় ঢেকে সেফিয়াম ভরে আছে ডালপালা জুড়ে।
এসব দৃশ্যের কাছে পরাজিত হওয়ার সময় আমার তো নেই। ফাল্গুনীকে খুঁজে পাওয়া খুব দরকার। চলে যাক ম্যালালুকা, পড়ে থাক সেফিয়াস ফুল। ভূতের বাসার পাশে নাকফুল পরা ছায়ালতা। আর বেশি দেরি নেই, বাঁশঝাড় হয়ে যাবে সন্ধ্যার আঁচল।
ওই তো পাহাড়ি নদী, বাঁশের সাঁকোর নিচে দ্রুতগামী হরিণের চোখে ফাল্গুনীর পঙ্ক্তিগুলো ছুটে যাচ্ছে ঘন অন্ধকারে। এমন সময় সাঁকোর অপর প্রান্তে লন্ঠন জ্বালিয়ে দিল অন্ধ এক বুড়ি। আমাকে বলল হেসে– ‘তোমাকে অনাদিকাল চিনি। তবু তুমি চিনলে না– পথে পথে সবখানে ছিল ফাল্গুনী।’
মন্তব্য করুন