- ফিচার
- কাইয়ুম চৌধুরী দেশের প্রতি পরতে জড়িয়ে আছেন
শ্রদ্ধাঞ্জলি
কাইয়ুম চৌধুরী দেশের প্রতি পরতে জড়িয়ে আছেন

কাইয়ুম চৌধুরী (৯ মার্চ ১৯৩২–৩০ নভেম্বর ২০১৪)
কাইয়ুম চৌধুরী আমার শিক্ষক ছিলেন। একটা ছাত্র-শিক্ষকসুলভ দূরত্ব ছিল আমাদের। তবে তাঁর অশেষ স্নেহ পেয়েছি আমি। তাঁর কাজের অত্যন্ত ভক্ত ছিলাম, এখনও আছি। তিনিও আমার কাজের প্রশংসা করতেন।
বাংলাদেশের শিল্পকলার শুরুটা যাঁদের হাতে, কাইয়ুম চৌধুরী তাঁদের মাঝে আছেন। এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন। এটা সার্বিকভাবে বলা। যদি গ্রাফিক ডিজাইনের কথা বলা হয়, তাহলে তিনি শ্রেষ্ঠতম– এতো দ্বিমত থাকার কোনো কারণ নেই। যদি আন্তর্জাতিক বিচারে বলি, সেক্ষেত্রেও গ্রাফিক ডিজাইনে কাইয়ুম চৌধুরী আধুনিকততম শৈলীর প্রচলন ঘটানো শিল্পীদের অন্যতম। এবং এদিকে তাঁর আন্তর্জাতিক সুনামও রয়েছে।
একটা বিষয় আমরা এরই মাঝে জানি। কাইয়ুম চৌধুরী বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে কাজ করেছিলেন। তাঁর সহপাঠী-সহশিল্পীরা ছিলেন মুর্তজা বশীর, আবদুর রাজ্জাক, আমিনুল ইসলাম, রশীদ চৌধুরী প্রমুখ। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন খ্যাতিমান অথবা পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়েছেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁরা ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং সহিংস পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। পোস্টার লিখতেন, ব্যানার, ফেস্টুন তৈরি করতেন। প্রতিবাদী ছবি এঁকেছেন। ছবিগুলো লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা হতো। কাইয়ুম চৌধুরী শুধুমাত্র একটি দিক নিয়ে কাজ করেননি। শুধুমাত্র পেইন্টিং নিয়ে ছিলেন না। সাধারণত যে যেই কাজে দক্ষ, সেটাই করতে চান। যাঁরা জলরঙে দক্ষ তাঁরা হয়তো শুধু জলরং নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তাঁর ক্ষেত্রে হয়নি এমন। তিনি এক পিঁড়িতে বসে থাকার শিল্পী ছিলেন না। নানান মাধ্যমে কাজ করতেন। স্কেচ করতেন, পেইন্টিং করতেন, লিখতেন, প্রচ্ছদ করতেন। একসময় বাংলাদেশের বইপত্রের বাজারে প্রচ্ছদে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল।
কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ একইসঙ্গে রুচি ও উচ্চমাত্রা স্পর্শ করত। যত্ন করে প্রচ্ছদ করতেন তিনি। নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছেন। একটা সময় ছিল যখন বড় লেখকদের প্রায় প্রত্যেকের প্রচ্ছদ ছিল তাঁর করা। তাঁর আরেকটি দক্ষতার জায়গা ছিল লোগো। লোগো করতে প্রচুর ভাবনাচিন্তা করার প্রয়োজন হয়। এটিও কাইয়ুম চৌধুরীর আগ্রহের জায়গা ছিল। পত্রপত্রিকার লোগো, মাস্টহেড এসবের বেশিরভাগই ছির তাঁর করা। তিনি ভাবতে পারতেন ভালো। কোন প্রতিষ্ঠানের কাজের কেমন ধরন, তার ওপর ভিত্তি করে নকশা করতেন। এসব বিচারে কাইয়ুম চৌধুরীকে সব্যসাচী শিল্পী বলতে পারি।
একটা দিক নিয়ে তাঁর আরও অনেক কাজ করার ইচ্ছে ছিল। তা হলো, বাংলা ক্যালিওগ্রাফি। একইসঙ্গে বাংলা বর্ণমালা কেমন হবে, তা নিয়ে আরও ভাবতে চেয়েছিলেন। কাজটা হয়তো আংশিক হয়েছে। একটি বেসরকারি সংস্থা তাঁর বর্ণের নকশা নিয়ে আংশিক কাজ করেছে। তিনি যা চেয়েছিলেন তা বোধহয় হয়নি। বর্ণমালাকে আরও সুন্দর, উন্নত রূপ দিতে চেয়েছিলেন।
লেখালেখির সর্বদিকেও তাঁর ভালো হাত ছিল। ছড়া, প্রবন্ধ লিখতেন। পুরস্কারও পেয়েছেন প্রচুর। আমি গর্ববোধ করি এই ভেবে যে, এমন একজন শিল্পীর সান্নিধ্য আমি পেয়েছি। শিল্পকলার জগতে একসঙ্গে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে পেরেছি। তবে একটা বিষয় উল্লেখ্য, তা হলো, কাইয়ুম চৌধুরী একটু সিরিয়াস ধরনের মানুষ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছাত্রাবস্থায় যে ছাত্র-শিক্ষক দূরত্ব ছিল, তা বোধহয় পরবর্তী জীবনে একসঙ্গে অনেক কাজ করলেও অনেকখানি বজায় ছিল। একসঙ্গে হাসি-কান্না, মান-অভিমানের মতো সম্পর্ক তৈরি হয়ে ওঠেনি।
তাঁর কাছ থেকে একটা আদর্শ আমি পেয়েছি, যা আমার জীবনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। তিনি শিখিয়েছিলেন ভালো কিছু ভাবতে। শিল্পকলা নিয়ে ভালো কিছু, বড় কিছু ভাবতে বলতেন তিনি। আমরা শিল্পীরা একটা জিনিসের ভীষণ কাঙাল, তা হলো– প্রশংসা। আমরা প্রশংসা চাই। প্রশংসা পেতে হলে ভালো কিছু করতে হয়।
আমি কার্টুনের কাজ করতাম। অনেক শিল্পী এটিকে ভালোভাবে নিতেন না। তাঁরা ভাবতেন, এটা আমাদের কাজ না। কার্টুন না এঁকে শুধু পেইন্টিং নিয়ে থাকলেই আমার ভালো হতো। কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরী আমাকে উৎসাহ দিতেন। জিনিসটা ভালো হচ্ছে, করো। যা কিছুই করো, ভালোভাবে করো। এভাবে তিনি আমাদের উৎসাহ দিতেন। বিশেষ করে আমাকে। আমার গর্ব হয় যে অনেক ভালো কাজে আমি তাঁর সঙ্গে থাকতে পেরেছি।
তাঁর সামগ্রিক জীবন ছিল আমাদের জন্যে শক্তি ও সাহসের উৎস। এতো বড় একজন শিল্পী জীবনে কতটা অবদান রাখেন, তা আসলে একটা-দুটো কথা কিংবা ঘটনা বলে বোঝানো যায় না। তাঁদের সঙ্গে জীবনের দীর্ঘ যাপনে একটা কোনো সার্বিক বোঝাপড়া ওঠে আসে। যেটা মতাদর্শকে প্রভাবিত করে, জীবন বদলে দেয়।
একসঙ্গে আমরা দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করেছি। সেসমস্ত স্থানে তাঁকে সম্মানিত হতে দেখেছি, বক্তব্য রাখতে দেখেছি। দেশের বাইরে বাংলাদেশকে তিনি খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতেন।
এই আমাদের কাইয়ুম চৌধুরী– বাংলাদেশের বিশিষ্ট জন, বিশিষ্ট শিল্পী। দেশের পরতে পরতে তাঁর ভাবনা জড়িয়ে আছে।
বিষয় : শ্রদ্ধাঞ্জলি রফিকুন নবী
মন্তব্য করুন