যুগটা প্রযুক্তির। প্রযুক্তি মানুষের সেবায় কতটা কাজে আসছে, সেটিই আধুনিক উন্নয়ন আলোচনার আলোকপাত। প্রযুক্তিতে পিছিয়ে আছেন মানে যুগের ডাকে আপনি পিছিয়ে আছেন। ডিজিটাল জেন্ডার গ্যাপ বা ডিজিটাল লিঙ্গ ব্যবধান বলে একটি কথা রয়েছে। এখান থেকেই আসে ডিজিটাল বিভাজনের প্রশ্নটি। ডিজিটাল বিভাজন বা প্রযুক্তিগত ব্যবধান হলো, প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের সেবা নেওয়ার সক্ষমতা যাঁদের রয়েছে এবং নেই, তাঁদের মধ্যে পার্থক্য। প্রায়ই প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটে পুরুষের তুলনায় নারীর প্রবেশগম্যতা কম থাকে। এ ব্যবধান বাংলাদেশের মতো দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বেশি হবে, সেটিই স্বাভাবিকভাবে অনুমেয়। কারণ এখানে নারীর সম্পদের ওপরে অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ দুটিই পুরুষের তুলনায় অনেক কম।

ইন্টারনেটসহ স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীর ভাগ বিশ্বব্যাপী কম। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নারীদের তুলনায় পুরুষের অনলাইনে থাকার সম্ভাবনা ২১ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ ব্যবধান ৫২ শতাংশের বেশি।

আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) বলছে, বিশ্বের ৫০ শতাংশের বেশি নারী থাকছেন অফলাইনে। অন্য এক পরিসংখ্যান বলছে, উন্নয়নশীল দেশে ৯৯৩ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর কোনো নিজস্ব মোবাইল ফোন নেই। মোবাইল মালিকানায় লিঙ্গ ব্যবধান দক্ষিণ এশিয়ায় ২৩ শতাংশ, সাব-সাহারান আফ্রিকায় ১৩ শতাংশ। এসব এলাকায় নারীরা সাধারণত পুরুষদের কাছ থেকে ধার করে মোবাইল ব্যবহার করেন। প্রায়ই একটি পরিবারে একটি ফোন থাকলে তার মালিকানা থাকে পরিবারের পুরুষ সদস্যটির কাছে। নারীদের স্মার্টফোনের মালিক হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষের তুলনায় ২০ শতাংশ কম।

ডিজিটাল লিঙ্গ বিভাজনকে তিনটি ভাগে দেখা যেতে পারে– ১) ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অ্যাকসেস বা প্রবেশগম্যতা, ব্যবহার এবং ইন্টারনেট সেবা প্রাপ্তি, ২) ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার বিকাশ এবং ৩) দৃশ্যমান নেতৃত্বে নারীদের অগ্রগতি ও ডিজিটাল সেক্টরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভূমিকা।

যেখানে পুরুষতন্ত্র বেপরোয়া, সেখানে দৈনন্দিন জীবনের প্রযুক্তিগত দিকগুলোর সঙ্গে পুরুষ বেশি সম্পৃক্ত থাকেন। অন্যদিকে সামাজিকভাবে প্রচলিত জেন্ডার নর্ম নারীকে অপ্রযুক্তিগত গৃহস্থালি ভূমিকায় নিযুক্ত রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য পায়। ব্যয়বহুল হ্যান্ডসেট ও ডাটা শুল্ক, সামাজিক নিয়ম এবং সর্বোপরি ডিজিটাল নিরাপত্তাহীনতা নারী ও মেয়েদের অনলাইন সেবা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করে।

আমরা সবাই যেহেতু জানি, অনলাইনে যুক্ত থাকা, ইন্টারনেট সুবিধা থাকা ইত্যাদি বর্তমান সময়ে, বিশেষ করে কভিড-পরবর্তীকালে শিক্ষা, ব্যবসা, চাকরি ও কমিউনিটি মোবিলাইজেশনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় এবং সংগত কারণেই নারীরা পিছিয়ে যাচ্ছেন পুরুষের তুলনায় এবং অপচয় হচ্ছে নারীর সব সম্ভাবনার। অন্যদিকে নারী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বা বাড়ির বাইরে চাকরি বজায় রাখতে পারলেই কেবল তাঁর জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার শিথিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেখানেও নারী পুরুষের চেয়ে অনগ্রসর।

এ বছর অন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য– ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দিকে দ্রুত ধাবমান ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য নারী দিবসের এই প্রতিপাদ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাইবার হয়রানি ডিজিটাল স্পেসে জেন্ডার গ্যাপকে উৎসাহিত করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে।

ডিএমপি সাইবার অপরাধ শাখার তথ্যমতে, দেশের ৮০ শতাংশ সাইবার হয়রানির শিকার নারী। সাইবার হয়রানি কমাতে না পারলে ডিজিটাল লিঙ্গ ব্যবধান কমানো যাবে না। ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নতুন ধাপে বাংলাদেশ প্রবেশ করবে অর্ধেক জনশক্তি নিয়ে। সুতরাং সাইবার হয়রানি বন্ধ করা ও ডিজিটাল জেন্ডার গ্যাপ কমিয়ে আনা সরকারের শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি হওয়া উচিত। যদি ডিজিটাল লিঙ্গ ব্যবধান কমানো না যায়, তবে প্রযুক্তি সাফল্যের পরিবর্তে সামাজিক ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।

সমতার পৃথিবী বিনির্মাণ করবে প্রযুক্তি– এটিই প্রযুক্তির কাছে মানবসভ্যতার কামনা। জেন্ডার সমতার জন্য সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হোক সর্বোত্তম উপায়ে। অন্য সব ক্ষেত্রের মতো প্রযুক্তির প্রাপ্তিতে এবং ব্যবহারে নারী নিজেকে প্রমাণ করেই এগিয়ে যাবেন।

লেখক: উন্নয়নকর্মী ও ডেমোগ্রাফার
প্রোগ্রাম হেড, জেন্ডার জাস্টিস ও ডাইভারসিটি বিভাগ, ব্র্যাক


বিষয় : লিঙ্গবৈষম্য ডিজিটাল বিভাজন

মন্তব্য করুন