- ফিচার
- কেনাকাটায় স্বস্তি এনেছে সুপারশপ
কেনাকাটায় স্বস্তি এনেছে সুপারশপ

স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন প্রত্যেক মানুষের চাওয়া। উচ্চবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত তো বটেই, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য থেকেও যতটা সম্ভব স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে ফেরেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। যেমন- কেনাকাটার কথাই ধরা যাক। প্রাত্যহিক জীবনের এই ক্ষেত্রে গ্রাম বা শহর সব জায়গার মানুষকেই কম-বেশি গলদঘর্ম হতে হয়। বাজার মানেই যেন অপরিচ্ছন্ন আর ভিড়ে ঠাসা অস্বস্তিকর পরিবেশ। আবার দরদাম করতে গিয়ে মেজাজ ঠিক রাখাও দায় হয়ে পড়ে অনেকের। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার বিপরীতে শহুরে মধ্যবিত্তের জীবনে খানিকটা স্বস্তি এনেছে সুপারশপ সংস্কৃতি।
আশির দশক পর্যন্ত পোশাকসহ গৃহস্থালি সব পণ্যের কেনাকাটায় রাজধানী বা জেলা শহরে কিছু বিপণি কেন্দ্র ছাড়া কাঁচাবাজারের বিকল্প তেমন ছিল না। নব্বইয়ের দশক থেকে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাত ধরে এর বিকল্প হয়ে আসে বাণিজ্যিক মল এবং সুপারমার্কেট। কিন্তু রান্নার সব সামগ্রীর জন্য তখনও এলাকার কাঁচাবাজারই ছিল ধনী-গরিব সবার বড় ভরসা। দিন বদলেছে। উচ্চবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্তের বাড়বাড়ন্ত চাহিদা মেটাতে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সুপারশপ।
বাংলাদেশে সুপারশপের যাত্রা শুরু মাত্র দুই দশক আগে, ২০০১ সালে আগোরার হাত ধরে। রাজধানীর তৎকালীন রাইফেলস স্কয়ারে (বর্তমানে সীমান্ত স্কয়ার) ধানমন্ডি ও জিগাতলাবাসীর জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি। তবে এরও দুই বছর আগে ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডে স্টপ অ্যান্ড শপ নামে একটি সুপারশপ চালু হয়েছিল বলে জানা যায়। যদিও ওই প্রতিষ্ঠানটি এখন টিকে নেই। তবে তার দেখানো পথে দুই দশক পর আজ বিভিন্ন এলাকায় নানা নামে সুপারশপের দেখা মেলে। বড় সুপারশপ চেইন রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরে তাদের আউটলেটগুলোর মাধ্যমে ক্রেতাদের স্বাচ্ছন্দ্যময় কেনাকাটার সুযোগ করে দিচ্ছে।
কেনাকাটায় কোনো সুপারশপ মানেই এক ছাদের নিচে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের সমাহার। প্রচলিত বাজারের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ বা বিক্রেতার হাঁকডাকের বিপরীতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিপাটি সজ্জার বিশাল বাজার সম্ভার। মিলছে সবই– হোক তা রন্ধনশালার মাছ, মাংস বা সবজি। হাঁড়ি বা বঁটি থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক বা বাচ্চার খেলনা সবই মেলে সুপারশপে। শৌখিন সজ্জাসামগ্রী বা জীবন রক্ষাকারী ওষুধও বাদ নেই। দেশি পণ্যের সঙ্গে আমদানি করা বিদেশি পণ্যও মিলছে সহজে। নিজেই নিজের পছন্দসই পণ্য বাছাই করে ঝুড়ি ভরার সুযোগ শুধু উচ্চ আয়ের মানুষকেই সুপারশপে টানছে না, নিম্ন-মধ্যবিত্তও সুযোগ পেলে ঢুঁ মারার চেষ্টা করছেন সুপারশপে।
এক সময় বাসার কাজের লোক দিয়ে বাজার সদাইয়ের কাজ সারত যে উচ্চবিত্ত পরিবার, সময়-সুযোগ পেলে সেই পরিবারের সদস্যরা পছন্দমতো বাজার করতে এখন নিজেরাই ছুটছেন সুপারশপে। ব্যবসায়ী এবং করপোরেট হাউসের উচ্চ বা মধ্যম আয়ের চাকুরেদের অনেকেই এখন আর বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করতে চান না। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে, ক্রেতার আগ্রহের কারণে সুপারশপের আদলে পাড়ায় পাড়ায় মিনি সুপারশপ নামে অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন।
স্বাচ্ছন্দ্যের পাশাপাশি কিছুটা সাশ্রয়: সুপারশপে পণ্যের দাম প্রচলিত বাজারের থেকে বেশি বলে অনেকের ধারণা। তবে ব্যবসায় প্রতিযোগিতা বাড়ায় বিভিন্ন সুপারশপ অনেক পণ্যের দামে ছাড় দিয়ে থাকে। নিয়মিত ক্রেতাদের ডিসকাউন্ট কার্ডও দেয় তারা। ফলে সব পণ্যে না হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে ভালো ছাড় পাওয়া যায়। তাছাড়া প্রচলিত বাজারের কেনাবেচার তুলনায় সময় বাচে অনেকটা। ধকলও পোহাতে হয় কম। প্রচলিত বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি হওয়া পণ্যের কোনটি আসল আর কোনটি নকল, তা বুঝে ওঠা দুষ্কর। এ ক্ষেত্রে সুনাম নষ্ট, জরিমানা এড়ানো ছাড়াও ক্রেতা হারানোর ভয়ে সুপারশপগুলো নিজেরাও ভেজাল পণ্য বিক্রির বিষয়ে সতর্ক থাকে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজার তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার নিয়মিত নজরদারিও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।
ক্রেতাদের অভিযোগও আছে: অন্যান্য দেশে প্রচলিত বাজারের তুলনায় কম দামে পণ্য মেলে সুপারশপে। এর কারণও আছে। বিভিন্ন উৎপাদক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি পণ্য কেনে সুপারশপ। ফলে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে খুচরা মূল্যের তুলনায় কম মূল্যে পণ্য বিক্রির সুযোগ আছে। অন্যদিকে সাধারণ পণ্য বিপণন ব্যবস্থায় মধ্যস্বস্তভোগীর কয়েক হাত ঘুরে খুচরা দোকানে পণ্য বিক্রি হয়। তাই সুপারশপগুলো চাইলে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের তুলনায় কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারে।
ভোক্তাদের অভিযোগ, অধিকাংশ পণ্যে এমন ছাড় তারা দেয় না দেশের সুপারশপগুলো। মাঝেমধ্যে কিছু পণ্যে ছাড় দিলেও বেশিরভাগ পণ্যে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যেই পণ্য বিক্রি করছে তারা। সবজি, মাছ ও মাংসে অনেক বেশি দাম রাখা হচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগালের বাইরেও চলে যাচ্ছে অনেক পণ্যের দাম। বেশি মুনাফার লোভে তারা বেশি দাম রাখে বলে অভিযোগ করেন অনেকে।
তবে সুপারশপের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি সুপারশপ বিশাল পরিমাণ ফ্লোর স্পেস নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে। প্রতিটি পর্যায়ে বহু সংখ্যক দক্ষ কর্মী নিয়োগ করতে হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসহ লাইটিংয়ের জন্য বিপুল অঙ্কের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য দোকানের তুলনায় ৫-১০ শতাংশ পর্যন্ত খরচ বেশি হয়। তার ওপর সরকারকে কর দিতে হয়। মান নিশ্চিতের জন্য অনেক অবচয়ও হয়। এসব বিবেচনায় অনেক মুনাফা হয়, তা নয়। বরং নানা খরচ মিটিয়ে টিকতে না পেরে কিছু সুপারশপের ব্যবসা বন্ধও হয়ে গেছে।
ভ্যাট নিয়ে অস্বস্তি: প্রচলিত বাজারে প্যাকেটজাত পণ্য কিনতে কোনো ভ্যাট দিতে হয় না। কিন্তু সব সুপারশপে পণ্য ক্রয়ে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। প্যাকেটজাত পণ্য উৎপাদক ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সব ভ্যাট পরিশোধ করে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে পণ্য বিক্রির পরও এভাবে ভ্যাট আরোপের ফলে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। এ ব্যবস্থাকে এক দেশে দুই নিয়ম বলে সমালোচনা করছে সুপারশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।
সুপারশপ মালিকদের সংগঠনটির সভাপতি ও মীনা বাজারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী ইনাম আহমেদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, এখন সুপারশপে নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষও কেনাকাটা করেন। কিন্তু ভ্যাটের মাধ্যমে তাঁদের ওপর বাড়তি খরচ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকার যে অনেক বড় অঙ্কের রাজস্ব পাচ্ছে, তাও নয়। এই একটি কারণে অনেক ক্রেতা সুপারশপে আসতে চান না। অথচ সুপারশপে মানুষ বেশি এলে সরকারের রাজস্ব বাড়ে। প্রচলিত বাজারের পণ্য কেনাবেচায় দোকানি যে মুনাফা করেন, তার থেকে সরকার কর পায় না। কিন্তু সুপারশপকে আয়-ব্যয়ের অডিট করে পাই পাই করে করপোরেট কর দিতে হয়।
উৎপাদনেও যাচ্ছে সুপারশপ: মানসম্পন্ন ও নির্ভেজাল পণ্য হাতে তুলে দিয়ে ক্রেতা সন্তুষ্টি বাড়াতে কিছু সুপারশপ নিজেরা বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করছে। চুক্তিভিত্তিতে কৃষক পর্যায়ে সবজি, মাছ উৎপাদন করছে। পোলট্রি ও ডেইরি খামারও করছে।
সুপারশপের বাজার: দেশে ছোট-বড় প্রায় দুই লাখ দোকান ও বিপণিবিতানে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার বিক্রি হয়। সুপারশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, এর মাত্র দুই শতাংশ কেনাবেচা হয় সুপারশপে। ২০১৪ সালে সুপারশপগুলোর বার্ষিক টার্নওভার ছিল ১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে ২ হাজার ১৮০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। গত বছর তা ৩ হাজার ছয়শ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রতি বছর সুপারশপে বিক্রি ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। তবে প্রতিবেশী ভারতে খুচরা বাজারে সুপারশপের অংশ ৯ শতাংশের বেশি। শ্রীলঙ্কার মতো দেশে এ হার ৪৩ শতাংশ। ভিয়েতনামে ৫০ শতাংশের বেশি।
দেশের মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে মানসম্পন্ন পণ্য কেনার আগ্রহও বাড়ছে। ফলে সুপারশপ ব্যবসায় প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য সরকারের নীতিসহায়তা চান উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, সুপারশপে কেনাবেচায় আরোপিত পাঁচ শতাংশ অতিরিক্ত ভ্যাট প্রত্যাহার করা দরকার। নজরদারির জন্য বিশেষ একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া বা একটি আলাদা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা প্রয়োজন।
বড় সুপারশপ: রাজধানীসহ বড় শহরে অন্তত দশটি বড় সুপারশপ ব্যবসা পরিচালনা করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চেইন সুপারশপ হয়ে উঠেছে স্বপ্ন। ২০০৮ সালের অক্টোবরে ঢাকার পোস্তগোলায় প্রথম আউটলেট স্থাপন করে এর যাত্রা শুরু। বর্তমানে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে স্বপ্নের তিনশর বেশি আউটলেট রয়েছে। নিজেরা সরাসরি পরিচালনার বাইরে ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে আউটলেট পরিচালনা করছে। দেশের সুপারশপ ব্যবসার প্রায় ৪৫ শতাংশ এ ব্র্যান্ডের দখলে।
রহিমআফরোজ ২০০১ সালে দেশে প্রথম সুপারশপের ধারণা নিয়ে আসে আগোরাকে দিয়ে। অবশ্য সম্প্রতি এর মালিকানায় এসেছে শ্রীলঙ্কার একটি কোম্পানি। বর্তমানে ঢাকায় ১৪টি, চট্টগ্রামে একটি এবং সিলেটে দুটি আউটলেট নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে আগোরা। সুপারশপ ব্যবসার ২২ শতাংশ মার্কেট শেয়ার এ ব্র্যান্ডের।
আন্তর্জাতিকমানের প্রথম সুপারশপ চালু করে মীনা বাজার। জেমকন নামের ব্যবসায়িক গ্রুপের হাত ধরে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু ২০০২ সালে। ঢাকায় এর ১৮টি আউটলেট রয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম ও খুলনায়ও আউটলেট রয়েছে। আর বাংলাদেশে সুপারশপ সেবাকে ‘সুপার’ পর্যায়ে নিয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের ইউনিমার্ট। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে উচ্চবিত্তদের এলাকা গুলশানে এর যাত্রা শুরু। প্রথমে উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং বিদেশিদের চাহিদা বিবেচনায় রেখে কার্যক্রম চলেছে। এটি পরিচিতি পায় অভিজাতদের সুপারশপ হিসেবে। তবে এখন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। বর্তমানে পাঁচটি আউটলেট রয়েছে এ সুপারশপের। ঢাকার বাইরে সিলেটে নতুন আউটলেট চালু করতে যাচ্ছে। এর বাইরে আলমাস সুপারশপ, ডেইলি শপিং, প্রিন্স বাজার, পিক অ্যান্ড পে, সাদ মুসা সিটি সেন্টার, খুলসি মার্টসহ বেশ কিছু সুপারশপ ব্যবসা করছে।
মন্তব্য করুন