কবরে সদ্য শায়িত মৃতের প্রতি প্রশ্নে মানবজীবন-সমাজ বাস্তবতা নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে ‘আদম সুরত’ নাটকে। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন বাকার বকুল। তাড়ুয়া প্রযোজিত নাটকটি গভীর বাস্তবতার বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার সমষ্টি, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবুল। এ নাটকে হিসাবুল অপেক্ষা করে মাটির তলদেশে মুনকার-নকীবের তিন সওয়ালের। একে একে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। আত্মজিজ্ঞাসাই সামাজিক জিজ্ঞাসায় রূপান্তরিত হয়। সামাজিক দোলাচল ও রাজনৈতিক নিষ্পেষণের বিকলাঙ্গ এক রূপরেখায় যেন বিধ্বস্ত মানবতা। অশিক্ষা-কুশিক্ষা মগজে যেন যাপিত জীবনের যন্ত্রণারই লীলাক্ষেত্র, আবার মুক্তি-অন্বেষী মানুষও নিস্পৃহ কিংবা আক্রমণের শিকার– এমনই এক জনপদের ক্ষয়িষ্ণু প্রতিচ্ছবি এ নাটক।

নাটকের কাহিনি গল্পের অন্ত্যভাগ থেকে শুরু। কবরে শায়িত হাসিবুল সম্মুখীন হচ্ছে মুনকার-নকীরের প্রশ্নের। গল্পকথন সরলরৈখিক হলেও নানা লেয়ার আছে। হাসিবুল ফিরে যায় শৈশবে। স্মৃতিচারণে ফুটে উঠতে থাকে গণহত্যার নামে বিধ্বস্ত বাস্তবতা। ফুটে উঠতে থাকে সে সমাজের লাঞ্ছিত শিক্ষকের মুখ। বাল্যবন্ধু বাকিবিল্লাহর উদ্ভট মানসিকতা কিংবা নিজের ব্যর্থ জীবনের যন্ত্রণা। পাটকলে কাটা যাওয়া হাত, কসাইয়ের মাংসে মানুষের বৃদ্ধাঙ্গুল, নপুংসক হয়ে যাওয়া মৈজুদ্দির টঙ্গীর ইজতেমায় গমন। ভীতু সোনামুখীর হারিকেন জ্বালিয়ে বসে থাকা। ফেরেশতাদের প্রশ্নে সে গ্রামের ইহকাল-পরকালের হিসাব যেন উঠে আসে দৃশ্য নির্মাণের ভাষায়।

নির্দেশক সমাজ বাস্তবতার ছোট ছোট স্কেচ নির্মাণ করেছেন। কোরিওগ্রাফি, অভিনয়, আলো ও সংগীতের নিনাদে চলনশীল বাস্তবতার প্রতীকী রূপ সাজাতে সচেষ্ট ছিলেন। অত্যন্ত ক্রিয়ানির্ভর নাটক– দর্শকের চোখ যেন কোনো মুহূর্তে সরে না যায়। বিরতি দিয়ে দীর্ঘ সময়ের ব্যাপ্তি এ নাটকে। ঢাকার নাট্যদর্শকরা সাধারণত এত দীর্ঘ সময়ে ক্লান্তিকর অস্বস্তি অনুভব করতে পারেন। এত বেশি চরিত্র ও এত বেশি মুহূর্তের সমাগম ঘটেছে যে কখনও কখনও মূল গল্পের প্রবহমানতার চেয়েও বিন্যাসগুলোই বড় হয়ে ওঠে। নাটকটির শুরু কোরআন পাঠের মধ্য দিয়ে। নাট্যবিষয়ী জনসম্প্রদায় মুসলিম। সে হিসাবে এটি স্বাভাবিক হলেও পরবর্তী ঘটনায় ধর্মবিশ্বাসের অতটা প্রাধান্য ছিল না।

এ সময়ে নাট্যচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে এর উপস্থাপন রীতি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে প্রত্যুজ্জ্বল। প্রচলিত মঞ্চ বিন্যাসকে ভেঙে তিন দিকে দর্শক বসার স্থান দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের মঞ্চ বিন্যাসে সাধারণত কোনো সেট ব্যবহার করতে দেখা যায় না। কিন্তু এ নাটকে সেট ব্যবহার হয়েছে। মঞ্চের মধ্যে একটি কবরের সাজেশন। তিন দিকে দরজার সাজেশন। দরজার নিচেই কসাইয়ের দোকানের প্রতীকী রূপ নির্মাণ করেছেন। অভিনেতার মঞ্চে প্রবেশের পথও বৈচিত্র্যময়। কোরিওগ্রাফি ও প্রপসের বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহারের নানা মুহূর্ত অনবদ্য। অভিনেতার সংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিনয়-সংলাপে সুনির্দিষ্টকরণ হওয়া আরও জরুরি ছিল। অভিনয়-আলো ও মিউজিকে সৃষ্ট দৃশ্য ইমেজে আবেগী দ্যোতনা তৈরি করেছে। পোশাকগুলো গ্রামীণ ও কালারফুল– মঞ্চের উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে চরিত্রের পোশাক যেন নিষ্প্রভ মনে না হয়। নানাভাবে দৃশ্যাংকার তৈরি হয়েছে দৃশ্যের পরতে। কখনও কোরিওগ্রাফি, কখনও ভাষা, কখনও চরিত্রের সঙ্গে আলো-সংগীতের মায়াজালের দৃশ্যকল্প তৈরি। শারীরিক নানা ভাষা তৈরি হয়েছে। বাংলা নাট্য বৈশিষ্ট্যের বর্ণনাত্মক রীতিতে উপস্থাপিত এ নাটক মানবীয় সুরে দর্শকের আবেগকে স্পর্শ করে।

বিষয় : আদম সুরত বাকার বকুল

মন্তব্য করুন