যাকে আমরা সরাসরি বাস্তববাদী সাহিত্য বলে থাকি, তার প্রবল প্রতাপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ইউরোপে। শিল্পকলার আরও কোনো কোনো শাখা যেমন চিত্রকলায়ও এ দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তর শিল্পীর চর্চায় প্রাধান্য পেয়েছে। আগের যুগের রোমান্টিক কল্পনাধর্মিতা আর ব্যক্তিগত আবেগের বাড়াবাড়িকে অস্বীকার করতে চাওয়া বা অতিক্রম করতে চাওয়া এর এক কারণ। ফটোগ্রাফির বিকাশও বোধহয় সৃষ্টিশীল চর্চাকে বেশ চাপে ফেলে দিয়েছিল। শিল্পকে বরাবরই জীবনের প্রতিফলন ভাবা হতো। সেদিক থেকে ‘হুবহু’ উপস্থাপনের যে বর্গীয় সুবিধা ফটোগ্রাফির ছিল, ‘জীবনকে প্রতিফলিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত’ অন্য শিল্পীদের পক্ষে তার চাপ এড়ানো সহজ ছিল না। সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রধানত উপন্যাসে বাস্তববাদ সবচেয়ে বেশি জেঁকে বসেছিল। আর অন্তত দু-তিন দশক ধরে বিশদ বাস্তবের নিখুঁত উপস্থাপনার চল সাহিত্যে কর্তৃত্ব করেছিল।
সাহিত্যে বিজ্ঞানবাদ আসর গেড়ে বসার প্রেক্ষাপটে উনিশ শতকের সাতের দশকের মধ্যেই খাঁটি বাস্তববাদী সাহিত্য-তৎপরতা স্তিমিত হয়ে আসে। এ সময় মানুষকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে দেখা এবং পরীক্ষা করার তুমুল উৎসাহ দেখা দিয়েছিল। এর পেছনে ডারউইনবাদের বড় ভূমিকা আছে। ঝোঁকটা ছিল মানুষের গতি ও প্রবণতা নির্ধারণ করে মানুষ সম্পর্কে বিজ্ঞানীর মতো নিশ্চয়জ্ঞান উৎপাদন করা। সাহিত্যের ইতিহাসে এ প্রবণতা চিহ্নিত হয় প্রকৃতিবাদ বা স্বভাববাদ নামে। ইংরেজি নাম ন্যাচারালিজম। প্রকৃতিবাদীরা মনে করতেন, বাইরের দিক থেকে পরিবেশ-পরিস্থিতি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক যেমন ভিতরের দিক থেকে মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয় ক্ষুধা ও যৌনতার মতো প্রবৃত্তির তাড়নায়। এদিক থেকে মানুষকে দেখা হতো নিয়তচালিত জীব হিসেবে। মনে করা হতো, পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে ঠিকমতো স্থাপন করা গেলে মানুষকে ঠিক সে রকম নিশ্চয়তার সাথে উপস্থাপন করা সম্ভব, একজন ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারে যে রকম নিশ্চয়তার সাথে মানুষের অভ্যন্তরস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে কারবার করেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ একটি নভেলার নাম দিয়েছিলেন ‘পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী’। এ লেখার সারবস্তু যা-ই হোক, নামের মধ্যে প্রকৃতিবাদীদের জীবনদৃষ্টির সুন্দর প্রতিফলন ঘটেছে।
প্রকৃতিবাদীদের সাথে বাস্তববাদীদের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য বিরাট। একদিকে মানুষকে বা মানবজীবনকে বিশেষ জীবনদৃষ্টির অনুকূলে আবিষ্কার করা, অন্যদিকে জীবন যে রকম সেভাবে উপস্থাপন। এ পার্থক্য সত্ত্বেও বাস্তববাদী সাহিত্যের কলাকৌশল প্রকৃতিবাদী সাহিত্যিক চর্চায়ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। যদি মানুষকে যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে স্থাপন করতে হয়, তাহলে চাই বাস্তবের নিখুঁত উপস্থাপন। বাস্তবের প্রতীতি তৈরি হওয়া ছাড়া তো নিখুঁত পরিপ্রেক্ষিতের আন্দাজ পাওয়া সম্ভব নয়। প্রকৃতিবাদী চর্চায় তাই বাস্তববাদের চর্চাও পরোক্ষে অঙ্গীভূত ছিল। এ কারণেই জোলা বা বালজাকের মতো প্রকৃতিবাদী ঘরানার বড় লেখকেরা বাস্তববাদেরও বড় লেখক।
প্রকৃতিবাদীদের সাথে বাস্তববাদীদের যে ঝগড়া, তা আসলে আর্টের চিরন্তন বিতর্কেরই এক নতুন প্রকাশ। শিল্প প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটলের সাথে প্লেটোর প্রধান মতপার্থক্যের মধ্যে আমরা ওই বিতর্কের পুরোনো ছায়া দেখি। গ্রিক মতানুযায়ী প্লেটো সাব্যস্ত করেছিলেন, শিল্পমাত্রই অনুকরণ। জীবনের অনুকরণ। কাজেই একদিক থেকে তা বাস্তবেরই অনুকরণ। অন্যদিকে অ্যারিস্টটলের ধ্রুপদি সিদ্ধান্ত ছিল, শিল্পী অনুকরণ করেন বটে; তবে তা বাস্তবের অনুকরণ নয়, তৈরি-করা বাস্তবের অনুকরণ। আধুনিক অর্থে বাস্তব কথাটা গ্রিক শিল্পকলার চর্চায় প্রযোজ্য নয় নিশ্চয়ই; কিন্তু গুরু-শিষ্যের এই মতপার্থক্যের মধ্যে শিল্প সম্পর্কে যেসব গোড়ার অনুমানের প্রকাশ ঘটেছে, তার সাথে বাস্তববাদী-প্রকৃতিবাদী দ্বৈরথ বেশ মিলিয়ে পড়া যায়।
যা আছে, তার প্রতিফলন কুশলতা হিসেবে অবশ্যই প্রশংসনীয়; কিন্তু আবিষ্কারের ও নতুনত্বের যে মহিমা শিল্পকলার প্রাণ, বাস্তবের হুবহু প্রতিফলনের মধ্যে তার নিবৃত্তি হওয়ার কথা নয়। প্রকৃতিবাদীরা যেভাবে মানুষকে নির্ধারণবাদী ও একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখত, পরবর্তীকালে তার ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু এটা তো খুব সহজে বোঝা যায়, অন্তর্নিহিত সত্য আবিষ্কারের গুরুতর প্রকল্প প্রকৃতিবাদের অন্তরঙ্গ উপাদান। কাজেই শিল্পকলার অন্তর্গত স্বভাবের সাথে তার যোগটাও অনেক নিগূঢ়। এর অভাবের কারণে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি খুব বেশিদিন সাহিত্যের অভিজাত কেতায় কল্কে পায়নি।
কিন্তু বাস্তববাদী সাহিত্যিক তৎপরতার দুটি তাৎপর্য খুব গুরুত্বের সাথে উল্লেখ থাকা উচিত। একটি সামনে এনেছেন রোমান ইয়াকবসন। তাঁর মতে, রোমান্টিক সাহিত্য যে রূপকধর্মী সে কথাটা খুব প্রচারিত হলেও বাস্তববাদী সাহিত্যের লক্ষণাধর্মের কথাটা খুব একটা উচ্চারিত হয়নি। ব্যাপারটা মোটেই এমন নয় যে, কোনো বাস্তব চিহ্নিত-আবিষ্কৃত হয়ে সাহিত্যিকের চোখের সামনে হাজির থাকে। বরং একে আবিষ্কার করতে হয়, নির্বাচন করতে হয়, কাটছাঁট করতে হয়; আর সবশেষে রূপায়িত করতে হয়। এর মধ্য দিয়ে বাস্তববাদী শিল্পকর্মে যা পাওয়া যায়, তা বৃহত্তর বাস্তবের লক্ষণাধর্মী বা মেটোনিমিক্যাল প্রকাশ। কাজেই নন্দনতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে একে অবহেলা করা চলে না। দ্বিতীয় তাৎপর্যের ব্যাপারে শরণ নিতে চাই উপন্যাসতাত্ত্বিক মিখাইল বাখতিনের। বাখতিন উপন্যাসের আলোচনায় উল্লেখ করেছেন, বর্তমানকে আবিষ্কার করতে পারা আর যথাযথ মূল্যমানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারা একটা আধুনিক ঘটনা; আর উপন্যাসের অসামান্যতার একটা বড় কারণ এই বর্তমানময়তার শিল্পরূপ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারা। কোনো সন্দেহ নেই, বাস্তববাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার আগেও বহু তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস রচিত হয়েছে। বাখতিন নিজেই আধুনিক যুগের সূচনালগ্নের মহান ঔপন্যাসিক র‌্যাবেলাইসের রচনা নিয়ে বিশাল গবেষণা করেছেন। কিন্তু জীবনকে উপস্থাপনার বাস্তববাদী কেতা সাহিত্যে বর্তমানময়তার প্রতিষ্ঠায় যে বিশেষ মুহূর্ত হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
বাংলা সাহিত্যের উদাহরণ দিলে কথাটা আরও ভালো বোঝা যাবে। দেবেশ রায় তাঁর বিখ্যাত ‘উপন্যাস নিয়ে’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, উনিশ শতকের মাঝামাঝি ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা আর টেকচাঁদ ঠাকুরের উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সমকালীন বাস্তবতাকে উপস্থাপনের যে কেতা তৈরি হয়েছিল, মধুসূদন ও বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব তাকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দেয়। সেকালের অন্য প্রায় সব লেখক (প্রহসনধর্মী নাট্যাঙ্গিকের কিছু লেখা বাদ দিয়ে) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মিলে বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হাই আর্টের খুব জবরদস্ত ধারা, যেখানে কল্পনা, রোমান্স, রোমান্টিকতা, মিথ আর ইতিহাস-কল্পইতিহাসের প্রবলতায় বর্তমানময়তা এবং বাস্তব প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্বাসিত হয়েছিল। কল্লোলীয় সাহিত্যের প্রতিষ্ঠাকে এদিক থেকে পরোক্ষতার বিপরীতে প্রত্যক্ষতার প্রতিষ্ঠা হিসেবে দেখা চলে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এ যুগটিকে ‘রবীন্দ্র-বিরোধী’ হিসেবে উপস্থাপনার প্রবণতা এতই প্রবল যে, যথেষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সত্ত্বেও কল্লোলীয়দের বাস্তববাদিতার কথাটা খুব বেশি চাউর হয়নি। শুধু রবীন্দ্রনাথকে হিসাবে না রেখে মধুসূদন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বর্ণাঢ্য সাহিত্যচর্চার ধারাটিকে বিবেচনায় রাখলে বর্তমানময়তা আর বাস্তবের প্রত্যক্ষতাকেই এ যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে।
অবশ্য বাস্তববাদী কলাকৌশলের ব্যাপক সংস্থান সত্ত্বেও কল্লোলীয় সাহিত্যধারার প্রধান লেখকদের রচনায় প্রকৃতিবাদী ধ্যান-ধারণার প্রকোপই ছিল বেশি। যথার্থ কল্লোলীয় লেখকেরা– জগদীশ গুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র কিংবা প্রথম পর্বের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়– প্রবৃত্তি ও নিয়তির যৌথ লীলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন নিখুঁত পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে স্থাপিত মানুষের চালচিত্রে। তাতে বাস্তববাদ আর প্রকৃতিবাদ একাকার হয়ে নতুন নান্দনিক প্রেরণায় বাংলা সাহিত্যের যুগান্তর ঘটিয়েছিল।
সাহিত্যিক বাস্তববাদের হিসাবটা খানিকটা মুলতবি রেখে যদি সাহিত্যে প্রতিফলিত বাস্তবের নিরিখে পুরো ব্যাপারটাকে দেখি, তাহলে অবশ্য মানচিত্রটাই আমূল বদলে যাবে। দেখা যাবে, বাস্তব সম্পর্কে মানুষের ধারণাগুলো বদলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটেই আসলে সাহিত্যে বড় ধরনের বদলগুলো ঘটেছিল। সাহিত্য বা আর্টের নিজস্ব কারিগরি বা কলাকুশলতার একটা বড় ভূমিকা নিশ্চয়ই ছিল; কিন্তু তারচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে যাপিত জীবনের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিগত বদল।
পুরোনো দুনিয়া– গ্রিক বা ভারতীয় সাহিত্যে যার সর্বোত্তম নমুনা ধরা আছে– ছিল মুখ্যত মিথের জগৎ। তার সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, নীতিবিদ্যা ইত্যাদির মতো সাহিত্যও তাই প্রায় সম্পূর্ণরূপে মিথশাসিত। মধ্যযুগে দুনিয়াজুড়ে বাস্তবের সাথে মানুষের মোকাবিলার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। কিন্তু ধর্ম-নির্ভর ভাষার মোড়ক থেকে সে নিজেকে তখনও পুরোপুরি আলাদা করে নিতে পারেনি। স্থান ও কালের ফারাক অনুযায়ী নানা ভিন্নতা দৃষ্টিগ্রাহ্য হলেও ধর্মীয় অনুষঙ্গের বরাতে জীবন-বাস্তবতা উপস্থাপন মধ্যযুগের প্রায় সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সাহিত্যও সর্বত্র সেই বাস্তবতার অনুগামী। ইউরোপের আধুনিক যুগের প্রথম পর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অভিজাত জীবনের ন্যায়-নীতি অনুযায়ী স্থিরীকৃত নির্দিষ্ট রীতি-রেওয়াজ। গ্রেকো-রোমান আদর্শের ছাঁচে গড়া সে রীতির আনুগত্য দেখা যায় নিও-ক্লাসিক যুগের সাহিত্যকর্মে। বিজ্ঞান-দর্শনের নির্দিষ্টতাবাদ সাহিত্যকেও নির্দিষ্ট ও আদর্শ বাস্তবের অনুকরণে বাধ্য করেছে।
এদিক থেকে বিচার করলে রোমান্টিক আন্দোলনকে বাস্তব-বিরোধী মনে না হয়ে নতুনতর বাস্তবের চেতন-অচেতন প্রকল্প বলেই ব্যাখ্যা করা যাবে। টেরি ইগলটন উল্লেখ করেছেন, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রোমান্টিক কবিদের পাঁচজনই প্রত্যক্ষভাবে সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। ব্যক্তিগত ভাবাবেগ আর সুদূরের কল্পনা রোমান্টিকদের প্রধান কুলক্ষণ হিসেবে সর্বত্র বর্ণিত হলেও, আর নান্দনিকতার বিচারে সে কথা সত্য হলেও, যদি আঠারো শতকের জার্মান আর ফরাসি দর্শনে উদ্ভাসিত মানবকেন্দ্রিক দর্শনের কথা মনে রাখি, যদি মার্কিন বা ফরাসি-বিপ্লব উদ্ভূত মানুষের নতুন সম্ভাবনার বাস্তবের কথা মাথায় রাখি, তাহলে রোমান্টিক কবিতাকে সেই বাস্তবের উত্তুঙ্গ প্রকাশ হিসেবে পড়তে খুব একটা বেগ পেতে হয় না।
এটা ঠিক, রোমান্টিক কল্পনাপ্রবণতা সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতায় জীবনযাপনের দৈনন্দিনকে প্রায়শই লঙ্ঘন করছিল। আর উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যায়ে বাস্তববাদের প্রতাপশালী হয়ে ওঠার পেছনে ওই স্বেচ্ছাচারিতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতার ভূমিকাও ছিল। কিন্তু একই সাথে এটাও ভুললে চলবে না, গ্রামীণ জনপদ, সাধারণ মানুষ আর সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের ভাষা রোমান্টিক সাহিত্যকর্মেই প্রথমবারের মতো নান্দনিক গুরুত্বে মূর্ত হয়েছিল। কাজেই বাস্তববাদী সাহিত্যকর্মের সাথে রোমান্টিক সাহিত্যাদর্শের বিরোধের কথা যেমন সত্য, তেমনি নানামাত্রিক মিলঝিলের এবং ধারাবাহিকতার বয়ানও মিথ্যা নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কল্লোলীয়দের সাথে তাঁর বিখ্যাত ঝগড়ায় এ দিকটাই বারবার তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। অসুন্দরকে উপস্থাপন করাই বাস্তবতার পরাকাষ্ঠা– কল্লোলীয়দের এ রেওয়াজ তিনি কিছুতেই মানতে পারেননি। ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ বইয়ের প্রবন্ধগুচ্ছে বারবার বলতে চেয়েছেন, বাস্তব বাইরের কুৎসিতে থাকে না, থাকে অন্তর্গত সত্য আবিষ্কারের সামর্থ্যে।
অবশ্য রবীন্দ্রনাথের দাবি রোমান্টিক সাহিত্যতত্ত্বের শক্তিমত্তা বুঝতে আমাদের যত সাহায্য করে, বাস্তববাদের শক্তি ও নতুনত্ব বোঝার ক্ষেত্রে ততটাই অপারগ প্রমাণিত হয়। আদতে বাস্তববাদীদের ‘অন্তর্নিহিত সত্য’ প্রকাশের দায়ের তুলনায় আরও বড় এবং গুরুতর প্রকল্প ছিল। সমাজতত্ত্ব, নৃবিদ্যা, মনস্তত্ত্ব, সর্বোপরি ‘আধুনিক’ জীবনের বিচিত্র নতুন অভিজ্ঞতা ধারণ করার জন্য পরের জমানার সাহিত্যিকরা যেসব নতুন নান্দনিকতার অন্বেষণ করতে বাধ্য হচ্ছিলেন, ভিক্টোরীয় লিবারেল হিউম্যানিস্ট ঘরানার চিন্তায় সেগুলোকে মোটেই ধারণ করা যাচ্ছিল না। যেমন ধারণ করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথও। বাস্তবের সাথে সাহিত্যের কার্যকর মোকাবিলার সেই বড় প্রস্তুতিপর্বের চিহ্নায়নযোগ্য মুহূর্ত বলতে পারি সাহিত্যের বাস্তববাদী আন্দোলনকে।
কথাটা অন্যভাবে বুঝিয়ে বলা যাক। মিথের জগৎ থেকে, কিংবা ধর্মতত্ত্বীয় আবরণের জগৎ থেকে, বা ধ্রুপদি যুগের ‘আদর্শের জগৎ’ থেকে বেরিয়ে বর্তমানময় বাস্তবকে সম্বোধন করার একটা প্রক্রিয়া মানব-ইতিহাসে শনাক্ত করা সম্ভব। এ বস্তুকে শিথিল অর্থে ‘আধুনিকতা’ নামেও চেনা চলে। এ প্রসঙ্গে বাংলা ভাষার বড় কবি ভারতচন্দ্রের উদাহরণ দেওয়া যাক। আমরা জানি, আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিকশিত নতুন নাগরিকতা এবং বর্তমানময়তার প্রবল ছাপ পড়েছিল ভারতচন্দ্রের রচনায়। উনিশ শতকের নবজাগরণ-নির্ভর সাহিত্যের ইতিহাস ওই বস্তুকে যতই অবক্ষয় আর অন্ধকার হিসেবে চিনতে চাক না কেন, ধর্মগাথার আড়ালে ভারতচন্দ্র যে ইতিহাসের চরিত্র আর নাগরিক বর্তমানের বাকচালিয়াতিকে কাব্যরূপ দিয়েছিলেন, সে কথাও গোপন থাকেনি। এই যে নিজেকে অনুধ্যানের ক্ষেত্রে মানুষের ‘প্রগতি’, ইউরোপীয় বাস্তববাদী আন্দোলনকে তার একটা উত্তুঙ্গ মুহূর্ত হিসেবে ভাবা চলে। মানুষ যে বাস্তবতায় জীবনযাপন করে, তা-ই তার অস্তিত্ব– এ ধরনের একটা দার্শনিক সিদ্ধান্ত ওই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে উচ্চকিত হয়েছিল।
এই বহিঃবাস্তবই পরের দশকগুলোতে স্থান-কাল ভেদে নতুন নতুন অন্তর্বাস্তব আবিষ্কারের দাবি হিসেবে সাহিত্যধারায় ঘোষিত হয়েছিল।
প্রকৃতিবাদীদের দাবির কথা আগেই বলেছি। এখন অন্য প্রসঙ্গে আরেকবার উল্লেখ করা যাক। মার্কসবাদী ঘরানার বাস্তববাদে গরিব মানুষের জীবন উপস্থাপনার একটা প্রবণতা দেখা গেছে সারা দুনিয়াতেই। গরিবি জীবনের বাস্তবতা উন্মোচন প্রকৃতিবাদীদেরও গোড়ার লক্ষ্য। তবে মার্কসীয় বাস্তববাদের তুলনায় তাদের দাবিটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। প্রকৃতিবাদীরা মনে করত, শিক্ষিত ভদ্রলোকরা নিজেদের চারপাশে এত বেশি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ আড়াল তৈরি করে যে, প্রবৃত্তি ও নিয়তিচালিত মানুষ চেনার জন্য তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গরিব মানুষের যাপন ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই মানুষের পাশবিক রূপটা প্রকটভাবে মূর্ত হতে পারে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে এ দৃষ্টিভঙ্গির আক্ষরিক অনুরণন দেখতে পাই। বিপরীতে মার্কসীয় বাস্তববাদে প্রাধান্য পায় মানুষের দুর্দশা, তার সংগ্রাম-সংক্ষোভ এবং প্রলেতারিয়েত হিসেবে বিপ্লবী তৎপরতায় যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা। বাংলা সাহিত্য এ দুই ধরনের গরিব মানুষেই ভর্তি। গত কয়েক দশকে কথাসাহিত্যে আরেক ধরনের গরিবির প্রকাশ ঘটেছে– প্রধানত বাংলাদেশে। উন্নয়ন ডিসকোর্সের অনুষঙ্গী হয়ে অনেক লেখক গ্রামীণ ও নাগরিক গরিবির উন্মোচন ঘটিয়েছেন কথাসাহিত্যে।
মনঃসমীক্ষণবিদ্যা বিশেষত ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণের প্রভাবে অব্যবহিত ও গভীরতর বাস্তব সম্পর্কে মানুষের ধ্যান-ধারণায় বৈপ্লবিক বদল ঘটেছিল। অন্তর্বাস্তবের বৃহদংশের ওপর মানুষের কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নাই– এ সংবাদ বাস্তব সম্পর্কে সার্বিক সিদ্ধান্তগুলোতে বড় ধরনের রদবদল ঘটিয়েছিল। এর প্রতিফলন দেখি চেতনাপ্রবাহ রীতির বিপুল ব্যবহারে, আর শিল্পকলার নানা প্রাঙ্গণে প্রতাপশালী হয়ে ওঠা পরাবাস্তববাদী রূপ-রীতিতে। দক্ষিণ আমেরিকায় বিকশিত জাদুবাস্তবতার উল্লেখ করে এ তালিকা শেষ করব। মার্কেজের নোবেল বক্তৃতার দাবিটি মনে রাখলে জাদুবাস্তবতাকে বাস্তবতার অন্যতর প্রকাশ হিসেবে পড়তে আমাদের সুবিধা হবে। মার্কেজ বলেছিলেন, তিনি জাদু-টাদু করেন নাই, নিখাদ বাস্তবতারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সে বাস্তবতা পশ্চিমের অপারগ চোখে যদি জাদুবাস্তবতা হিসেবে ধরা পড়ে, তাহলে তার দায় লেখকের নয়। এ কথার অসংখ্য ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু একটা ব্যাখ্যা তো নিশ্চয়ই এ রকম: যে বাস্তবে তাঁর পাত্রপাত্রীরা জীবনযাপন করে, সেটাকে সামগ্রিকভাবে বা তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছেন তিনি–নিছক সাহিত্যশৈলী হিসেবে নতুনত্ব তৈরি তাঁর লক্ষ্য নয়। সেভাবে পড়লে তাঁর মূল লক্ষ্যই হারিয়ে যাবে। মার্কেজ আদতে এক গভীর ও সামগ্রিক বাস্তবকে সাহিত্যে সম্ভবপর করার সাফল্যের কথাই বলেছেন তাঁর নোবেল বক্তৃতায়।
উনিশ-বিশ শতকের খুব বড় বড় কয়েকটি সাহিত্যধারাকে আমরা এখানে বাস্তববাদের সাথে মিলিয়ে পড়লাম। বাস্তবের অনুকরণমূলক সাহিত্যকে যদি বাস্তবের সাহিত্য নাম দিই, তাহলে অন্যগুলোকে বলতে পারি সাহিত্যের বাস্তব। তার মানেই হলো, আবিষ্কৃত বা অনুভূত বাস্তবকে সাহিত্যে বা সাহিত্যিক কৌশলে সম্ভবপর করা। বড় লেখকদের মধ্যে এ দুই ধরনের রীতি-রেওয়াজ দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছকে বলতে পারি ‘সাহিত্যের বাস্তব’ ক্যাটাগরির এক ধ্রুপদি নমুনা। একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যাবে, ‘গল্পগুচ্ছে’ প্রতিফলিত বাস্তব আদতে জীবনযাপনের প্রত্যক্ষ বাস্তব হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। বরং সাহিত্যিক প্রকল্পের সাপেক্ষে তৈরি করে নেওয়া জুতসই বাস্তব হিসেবে পড়লেই এর প্রতি প্রাথমিক সুবিচার হয়। রবীন্দ্র-সাহিত্যের এই তৈরি করা বাস্তবও আদর্শ বাস্তবের প্রতিরূপ মাত্র– নিখাদ বাস্তব নয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তুলনা করলে পার্থক্যটা ভালো বোঝা যাবে। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের কপিলা বা হোসেন মিয়া স্পষ্টতই প্রকল্পের সাপেক্ষে তৈরি করে নেওয়া বাস্তব। কিন্তু মানিকের প্রকল্পিক বাস্তব বাস্তব জীবনের মর্ম ছেনে তৈরি করা। তাই একে বাস্তববাদী সাহিত্য বলেই ভুল হয়। বেশিরভাগ পাঠক আসলে মানিকের প্রথম পর্বের প্রকল্প-শাসিত উপন্যাসগুলোকে বাস্তববাদী রচনা হিসেবেই পড়েন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এদিক থেকে পড়বেন মানিকের কাতারে, যদিও মানিকের মতো বাস্তবের প্রতিরূপ গড়ার প্রবণতা তাঁর মধ্যে নেই। তাই তাঁর বাস্তবকে খুঁজে-পেতে আবিষ্কার করতে হয়। প্রবলভাবে মানিকীয় লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথাসাহিত্য সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে গড়া। ইলিয়াসের কথাসাহিত্য বাস্তবের ফটোগ্রাফিক রিপ্রেজেন্টেশন– বিমূর্ত ভাবগুলোও ইলিয়াসে মূর্ত ছবির আকার ধারণ করে। ইলিয়াস কাজ করেন বাস্তববাদীর মেজাজে, কিন্তু উপস্থাপন করেন এমন বাস্তবতা, যা রাজনৈতিক প্রকল্পের আদল রক্ষা করে, সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের যে কোনো লেখকের চেয়ে বেশি। মানিকে বাস্তবতার প্রগাঢ় সুরত তৈরি হয় প্রকল্পের অধীনে; আর ইলিয়াসের রচনায় বাস্তবের প্রগাঢ়তর প্রতীতি প্রকল্পে পৌঁছায়। তাতেই ভাবগতভাবে পরস্পর সম্পর্কিত এ দুই লেখক উপনীত হন সাহিত্যের নান্দনিকতার প্রায় বিপরীত কোটিতে।
বাস্তব ও বাস্তবতার প্রতীতি সাহিত্যপাঠের খুব কার্যকর নিশানা হয়ে উঠতে পারে।