
সেদিন টাকা তুলতে ব্যাংকে যাচ্ছি। প্রাইম রোডের কাছে আসতেই এক বুড়ো বয়সের ভিক্ষুক থমকে এসে সামনে দাঁড়িয়ে টাকা ভিক্ষা চাইলেন। দেখতে অনেকটা রোগা টাইপের। দেখে মায়া হলো। পকেট থেকে মানিব্যাগটা খুলে ১০০ টাকার নোটটি বের করে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করি। কারণ, আমি জানি নোটটি জাল। গত মাসে অনেক কেনাকাটা হয়েছে; কে যে কখন টাকাটা ফেরত দিতে এই ১০০ টাকার জাল নোটটি হাতে ধরিয়ে দিয়েছে, জানা নেই। টাকাটা নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছি। যাক বাবা, আজ সেটা এই ভিক্ষুককে দান করে বিদায় করেছি। বেচারা বড় খুশি হয়েছে।
আমি দ্রুত হেঁটে যেতেই ভিক্ষুকটি আমাকে পেছন থেকে ডাকলেন– ‘এই যে বাবা শোন!’ পেছনে তাকিয়ে দেখি তিনি আমাকে ডাকছেন। টাকাটা যে জাল, নিশ্চয়ই ভিক্ষুকটি নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে এখন আমাকে ডাকছেন। এই ফকিরগুলোকে নিয়ে আর পারা যায় না। যখন-তখন টাকার জন্য সামনে এসে পড়ে।
এই ভিক্ষুক এখন যে লোকারণ্যে আমাকে ১০০ টাকার জাল নোটটি ফেরত দেবেন, সেটা লোকজন দেখলে আমার ইজ্জত থাকবে না। এমনটি ধারণা করে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। তবুও তিনি পেছন থেকে ডাকছেন, ‘বাবা, কথা শোন আমার।’ মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। না, থামা যাবে না। এগিয়ে চলছি সামনের দিকে। পেছন থেকে আবার ডাকলেন, ‘বাবা, তোমাকে ডাকছি তো।’ এবার রাগে স্তম্ভিত হয়ে তেজি কণ্ঠে বলি, ‘কী সমস্যা আপনার! বারবার ডাকছেন কেন?’ জবাবে ভিক্ষুকটি যা বললেন, তা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কাছে আসতে আসতে তিনি বললেন, ‘তুমি আমাকে টাকা দিতে গিয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ খোলার সময় ব্যাংকের এই চেকটি মাটিতে পড়ে গেছে। খেয়াল করোনি। এই নাও তোমার ব্যাংকের চেক।’ আমি অবাক হলাম। আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। আমি কী ধারণা করেছি আর ঘটেছে কী! এমন উদার ভিক্ষুক তাহলে দেশে এখনও আছে! নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হলো। চেকটি হারালে আজ কী যে বিপদ হতো।
ভিক্ষুকটিকে পুরস্কার হিসেবে ৫০০ টাকার একটি নতুন নোট দিয়ে বললাম, ‘এই নিন, এটা আপনার। ধন্যবাদ চেকটি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।’ মুখে মরা হাসি দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমাকে আমার সততার পুরস্কার দিচ্ছ? লাগবে না বাবা। দেশ স্বাধীন করেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করতে না পারায় সমাজ আমাকে কোনো পুরস্কার দেয়নি। দিয়েছে ভিক্ষার এই থলে।’ আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি, ‘আপনি মুক্তিযোদ্ধা?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা নয়– এখন আমার পরিচয় আমি ভিক্ষুক-ফকির।’
হতভম্ভ হলাম। সেই মুহূর্তে আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। আমার দেওয়া ৫০০ টাকাটি না নিয়ে তিনি চলে গেলেন। আমি অপরাধ বোধ নিয়ে ভাবতে থাকি…।
তাঁর চলে যাওয়া দেখে অপরাধবোধ আরও বাড়তে থাকে এবং এই অপরাধবোধ কোনোদিন আমাকে ছাড়বে কিনা তাও জানি না; কারণ তাকে ভিক্ষা হিসেবে যে টাকাটি দিয়েছি, সেটি ছিল একটি জাল টাকার নোট।
সুহৃদ নোয়াখালী
মন্তব্য করুন