ঈদে কক্সবাজারে বেড়াতে গেলে প্যারাসেইলিংয়ের স্বাদ নিতে পারেন। আপনার যদি উচ্চতাভীতি না থাকে, তাহলে নিতে পারেন পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর স্বাদ। মাঝ  সমুদ্রের জলের জাপটার রোমাঞ্চকর অনুভূতিও পেতে পারেন


সেবার পরিবারসহ কক্সবাজার গিয়েছি। কক্সবাজারে এর আগেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি। তবে সেবারের ভ্রমণটা বিশেষ হয়ে থাকবে। কারণ সেবার আমরা প্রথমবারের মতো আকাশে ওড়ার অনুভূতি পাই। এই প্রক্রিয়াটার নাম প্যারাসেইলিং। একটি প্যারাসুটের মাধ্যমে আপনি উড়বেন আর আপনাকে একটি স্পিডবোটের মাধ্যমে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে সাগরের বুকে। ওপরে আকাশ, নিচে সমুদ্র, আর বাতাস এসে ঝাঁপটা দিয়ে জানিয়ে যাচ্ছে তার আতিথ্য। এটা এক অসাধারণ অনুভূতি!
প্যারাসেইলিং করি আমরা আমাদের ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে। চমৎকার একটা রৌদ্রোজ্জ্বল দিন ছিল সেটি। একটা জিপ গাড়িতে করে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম মেরিন ড্রাইভ ধরে। ঘুরে আসব হিমছড়ি, দরিয়ানগর এবং ইনানি বিচ। জিপে বসে আমরা গান গাইতে শুরু করলাম। তিন বছর আগের স্মৃতি, এখনও কত প্রাণবন্ত! অনুভব করতে পারছি লিখতে গিয়ে। জিপে করে ঘোরা, বিভিন্ন পয়েন্টে থামা ছাড়া বিশেষ কোনো প্ল্যান ছিল না আমাদের। দরিয়ানগরে আসার পর দেখি ওখানে কিছু মানুষ আকাশে ওড়ানোর কন্ট্রাক্ট নিয়ে বসে আছে। আমাদের কৌতূহল হলো। গিয়ে কথা বললাম। জানলাম, এটারই পোশাকি নাম প্যারাসেইলিং। মনে তখন নানা দ্বিধা। ভয় ভয় লাগছে। উঠব নাকি উঠব না? আমি,  স্ত্রী তিথি, আমার ছোট ভাই হাসিব এবং তার স্ত্রী সেতু মিলে তাৎক্ষণিক সভা করে  সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।
হ্যাঁ, আমরা উড়ব আকাশে! সেতু অবশ্য রাজি হয়নি। আমরা তিনজনই সই।
চলতে লাগল প্যারাসেইলিংয়ের প্রস্তুতি। সেখানকার কর্মীরা পরখ করতে লাগলেন বাতাসের বেগ। দুটি জিনিস তাঁরা খেয়াল করেন। বাতাসের বেগ কেমন, কোন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে এবং যে উঠতে চান তাঁর ওজন কেমন। আমার ওজন তখন ছিল অনেক বেশি। ১০০+ কেজি। আমার ব্যাপারে তাঁরা সন্দিগ্ধ প্রকাশ করল। আমাকে ওড়ানো যাবে কি যাবে না– এ ব্যাপারে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। আমি মিশ্র অনুভূতি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম ভবিতব্যের জন্য। আকাশে উড়ব এটার জন্য যেমন আনন্দ, আবার উড়তে গেলে যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়, এই ভয়ও কাজ করছিল। তাই আমি তাঁদের যে কোনো সিদ্ধান্তই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলাম।
এর মধ্যে আমার ভাই আর স্ত্রীকে ওড়ানো হলো। তারা উঠে গেল সাগর থেকে কয়েকশ ফিট ওপরে। ধীরে ধীরে তাদের মনে হতে লাগল একটা পতঙ্গের মতো। পাঁচ থেকে সাত মিনিটের জন্য তাদের পৃথিবীটা বদলে গেল, আর আমার ছেলেমেয়েরা ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদতে লাগল। আমার তখন একটু মন খারাপ হওয়া শুরু হয়েছে। আমার কি এই অভিজ্ঞতার স্বাদ নেওয়া হবে না?
সৌভাগ্যের ব্যাপার, ওদের দু’জনের ওড়া শেষ হলে ওখানকার কর্মীরা বাতাস নিরিখ করে অবশেষে আমাকে ওড়ানোর অনুমোদন দিলেন। আমাকে তাঁরা বেঁধেছেদে, লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে প্রস্তুত করলেন। স্পিডবোট তৈরি আমাকে সাগরের গভীরে নিয়ে যাওয়ার জন্য!
অবশেষে চলে এলো সেই ক্ষণ! সৈকত থেকে দ্রুতগতিতে আমি সরে যেতে লাগলাম, ওপরে উঠতে লাগলাম, উড়লাম! তবে প্রথমদিকে আমার শঙ্কা ছিল এ নিয়ে– এখন যদি আমি পড়ে যাই, তো একদম বেলাভূমির ওপর পড়ব। বেশ ভালো রকম একটা ইনজুরি হবে। তাই আমি অপেক্ষা করছিলাম সাগরের গভীরে যাওয়ার। তখন পতন হলে জল আমাকে বাঁচিয়ে দেবে। লাইফ জ্যাকেট তো আছেই! প্রথম বিশ-ত্রিশ সেকেন্ডের পর আমার সব ভয় আর শঙ্কা কেটে গেল। আমি সত্যিকারভাবে ওড়ার আনন্দটা উপভোগ করতে লাগলাম। ওড়ার আনন্দ না বলে ওঠার আনন্দ বললেই মনে হয় যথাযথ হবে। আমি তো আর পাখি নই, যে ডানা দিয়ে বাতাস কেটে যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারব। আমাকে নানারকম যন্ত্র এবং বস্তু দিয়ে ওপরে উঠিয়ে ওড়ানোর অনুভূতি দেওয়া হচ্ছে। তার পরও এ অনুভূতিই বা আর কোথায় পেতাম আমি! ওই চমৎকার মুহূর্তগুলোর জন্য আমার দরকার ছিল সংগীত এবং সুর। আমি গাইতে শুরু করলাম–
‘এই সুন্দর ধরণী জুড়ে
আসে কত কি নতুন সুরে
আসে অবাক মনের দুয়ারে
কত মধুময় সুন্দর ছন্দ।’
ওই সময় সাগরের পানি ছিল ভূমধ্যসাগরের মতো নীল। আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার। বাতাসে বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আনন্দের বার্তা। আমি ভেসে ছিলাম মোট ছয় মিনিটের মতো। আমি চলে গিয়েছিলাম সাগরের এমন অংশে, সাধারণভাবে যেখানে যাওয়ার কথা ভাবাও যায় না! এর পর সময় হলো ফেরার। দেখি, আমাকে ধীরে ধীরে বেলাভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি নামতে শুরু করেছি। মনটা একটু খারাপ হলো। আরও কিছুক্ষণ তো থাকতে পারতাম। কিন্তু মানুষ তো! মানুষকে শেষ পর্যন্ত মাটির কাছেই ফিরতে হয়। তাঁরা মাইকে করে আমাকে নির্দেশনা দিলেন কিছু, সেটা যথাযথভাবে পালন করলাম। একটু ট্রিকি অংশ ছিল শেষ মুহূর্তে ল্যান্ডিংয়ের সময়টা। তবে সেখানকার কর্মীরা প্রস্তুতই ছিলেন। কয়েকজন মিলে আমাকে ধরে নিয়ে আমার গতি জড়তাকে সামলে নিতে সাহায্য করলেন।
নামার পর অনুভূতি আদান-প্রদানের পালা। শুনলাম তিথি বেশ ভয় পেয়েছিল। সে প্রথমদিকে চিৎকার করে তাকে নামিয়ে দিতে বলছিল। কিন্তু সে আর আমাদের শোনার জো ছিল না! হাসিব ডিল করেছিল যে ওকে সাগরের জল ছুঁইয়ে দিতে হবে। কথা অনুযায়ী যখন ওকে নিচে নামাচ্ছিল, তখন সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল ব্যাপারটা। সে ভেবেছিল যে কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তার পরও ভয় পায়নি; কারণ লাইফ জ্যাকেট তো পরা ছিলই! প্যারাসেইলিং শেষে আমরা চলে গেলাম ইনানি বিচে। মেরিন ড্রাইভে আরও ঘোরাঘুরি শেষে কলাতলী বিচে ফিরলাম। দিনের বাকি সময়টা আমরা কাটালাম সামুদ্রিক খাবার খেয়ে আর সাগরে দাপাদাপি করে। তখনও আমাদের গায়ে লেগে ছিল বাতাসের অনাবিল আদর। v
ছবি: আবু নাঈম


জেনে নিন

হিমছড়ির দরিয়ানগর বিচে গেলেই প্যারাসেইলিং করতে পারবেন। প্রতিজনের  জন্য ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত লাগবে। ২ হাজার টাকা দিয়ে উড়তে পারবেন, ২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে উড়ন্ত অবস্থা থেকে নেমে এসে সমুদ্রের পানির ছোঁয়ার সুযোগ পাবেন।
প্যারাসেইলিংয়ের জন্য আপনার বয়স ১২ বছরের বেশি হতে হবে। ১২০ কেজির কম ওজন হতে হবে। হৃদরোগ এবং উচ্চতাভীতি থাকলে প্যারাসেইলিং
এড়িয়ে চলুন

প্যারাসেইলিং করার আগে উড্ডয়নকারীকে একটি বন্ডে সই করতে হয়। সেখানে লেখা থাকে, প্যারাসেইলিংয়ের সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নেবে না। প্যারাসেইলিংয়ের সময় হাতে মোবাইল ফোন, চোখে চশমা না রাখাই ভালো


বিষয় : আকাশে ওড়ার অনুভূতি

মন্তব্য করুন